দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ৭ (শেষ অংশ) #আদওয়া_ইবশার

0
232

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৭ (শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

আচমকা এমন একটা সংবাদে স্তম্ভিত দৃষ্টি। অনুভূতিহীন কেটে যায় কিছু সময়। পরপরই মনে হয় বুকের ভিতর একটু একটু করে সৃষ্টি হচ্ছে বেসামাল যন্ত্রণা। সকালের ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘামছে সে। অন্তর্দাহে পুড়ছে মন জমিন। কিভাবে কি হলো কিছুই জানেনা। শুধু জানে সে যন্ত্রণা নামক এক অথৈ সাগরে ডুবে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে গভীর অতলে। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে,

“আমি যাব।”

ফোনের অপর প্রান্তে থাকা তুসী এমন একটা জবাবে কপাল কুঁচকায়। জানতে চায়,

“কোথায় যাবি?”

দৃষ্টির হৃদয়ে সৃষ্ট যন্ত্রণাটুকু কান্না হয়ে ফুলে ফেঁপে দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরতে চাইছে। চোখ দুটো কেমন জ্বালাপুড়া শুরু করেছে এখনই। কিছু বলতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে তার কন্ঠ দিয়েও কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। শরীর জুড়ে কাঁপুনি অনুভূত হচ্ছে। কোনোমতে নিজেকে সামলায় সে। ধরা গলায় অস্ফুটে বলে,

“সাভার যাব আমি। রক্তিম শিকদারের কাছে।”

মেজাজ খিঁচিয়ে আসে তুসীর। পাগল মেয়ে বলে কি ?কোথাকার কোন গুন্ডা মাস্তানের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সে না কি ময়মনসিংহ ছেড়ে ঢাকায় আসবে! অত্যন্ত রূঢ় স্বরে জবাব দেয়,

“মাথার স্ক্র কি সব গুলো ঢিলা হয়ে গেছে তোর? আমি তোকে ফোন করে খবরটা দিয়েছি যাতে তুই অন্তত একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারিস রক্তিম শিকদার সাধারণ কোনো মানুষ না। এই লোকের মতো গুন্ডা, মাস্তানের মৃত্যু সর্বক্ষণ কাধে চড়ে নাচে। শুধু এদের না এদের সাথে যারা নিজেকে একবার জড়িয়ে নেয় তাদের জীবনও অনিশ্চিত। বাচ্চা না তুই দৃষ্টি। সব বুঝিস। এক পলকের দেখায় কখনো প্রেম হয়না। তাছাড়া তুই নিজেও হয়তো জানিস না রক্তিম শিকদার কি হয় তোর? আর রক্তিম শিকদার! সে তো তোকে চিনেই না। তবে কেন এতো অস্থিরতা তোর?”

সত্যিই তো! এক পলক চোখের দেখায় আসলেই কি কাওকে ভালোবাসা যায়? কি হয় রক্তিম শিকদার তার? এই নামহীন একটা সম্পর্কের জন্য কিসের এতো ছটফটানি তার? দৃষ্টি না হয় দিয়ে দিল তার অনুভূতি গুলোর নাম ভালোবাসা। কিন্তু রক্তিম শিকদার! সে কি কখনো দৃষ্টির হৃদয়ের কথা জানতে পারবে? দৃষ্টির মতো তার মনেও কি কখনো এমন বেসামাল অনুভূতির সৃষ্টি হবে দৃষ্টির জন্য! আর কিছুই ভাবতে পারেনা দৃষ্টি। ভাবতেও চায়না কিছু। দু-চোখ উপচে গড়িয়ে পরে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় কোনো এক বিষ পোকা কামড়ে ধরেছে বুকের বা পাশে। ছটফট করে দৃষ্টি এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু পারেনা। বরং আরও গাঢ় হয়ে ওঠে যন্ত্রণা। নিম্নোষ্ঠ কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালায় দৃষ্টি। নাক টেনে করুন সুরে বলে,

“তুই বুঝবিনা আমার হৃদয়ে এই মুহুর্তে কি চলছে। রক্তিম শিকদার কে বা কেমন লোক কিছুই জানিনা আমি। আর জানতে চাই ও না। আমি শুধু জানি আমার বুকের ভিতর ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। রক্তিম শিকদার!এই নামটাতেই বড্ড দূর্বল হয়ে গেছি আমি। নিজের অনুভূতিদের নিজেই সামলে রাখতে পারছিনা। কত শাসিয়েছি মনকে কিন্তু মন আমার কথা শুনেনা। তুই বিশ্বাস কর তুসী,যখনই মনে পরে তার কথা ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে ছুটে চলে যায় তার কাছে। সেই মানুষটার এমন একটা সংবাদ শুনে আমার ভিতরে কি চলছে একবার বোঝার চেষ্টা কর। ভাব আমি কি পরিস্থিতিতে আছি। ভালোবাসা কখনো ধর্ম, কর্ম মেনে হয়না তুসী। নির্দিষ্ট একজনের প্রতি ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা এমনিতেই চলে আসে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। আমি জানি আমার মন জানে রক্তিম শিকদার কি আমার কাছে। তুই আর কখনো আমার অনুভূতি গুলো নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে কষ্ট দিস না প্লিজ।”

থমকে যায় তুসী। মন থেকে উপলব্ধি করে দৃষ্টির প্রতিটা কথা। বুঝতে পারে মেয়েটার মনে সৃষ্টি হওয়া অনুভূতির প্রগাঢ়তা। সহসা চোখ দুটো বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস টানে। বলে,

“যে পথে পা বাড়িয়েছিস সেই পথ পুরোটা কাঁটায় ভরা বুঝতে পারছিস তুই? মানলাম তোর অনুভূতি মিথ্যে নই। রক্তিম শিকদার ও মেনে নিল তোকে। কিন্তু খালামনি আর খালুজান? তুই তাদের একমাত্র মেয়ে। তারা কখনো চাইবে একটা গুন্ডার সাথে নিজেদের আদরের মেয়ের বিয়ে দিতে? ওরা যদি মেনে না নেয় তখন সইতে পারবি তো বিচ্ছেদের যন্ত্রণা?”

ক্লেষ্ঠ হাসে দৃষ্টি। শুকনো খড়খড়ে ঠোঁট দুটো জ্বিভের ডগায় ভিজিয়ে বলে,

“আম্মু-আব্বুর কাছে যদি সব কিছুর উর্দ্ধে তাদের মেয়ের সুখ থাকে তবে মেনে নিবে। আর না হলে তো নাই। সব কিছু জেনে নিজ থেকেই যখন আগুনে ঝাপ দিয়েছি তখন না হয় সহ্য করলাম পুড়ে ছাই হবার যন্ত্রণা।”

****

সাভার স্পেশালাইজড হাসপাতালের তৃতীয় তলার ১০৩ নাম্বার কেবিনের সামনে রক্তিম শিকদারের কিছু কাছের মানুষের ভীড় জমেছে। কিছুক্ষণ আগেই তাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। আগের থেকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে কিছুনা। গত রবিবার আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে রক্তিমের উপর হামলা হয়। জরুরি একটা কাজ সেড়ে দলের ছেলেদের বিদায় দিয়ে একাই বাইক চালিয়ে নিজের ঠিকানায় ফিরছিল রক্তিম। ঠিক সেই মুহুর্তে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোথা থেকে যেন বুলেটের আঘাত এসে ঝাঝড়া করে দেয় রক্তিমের বুক। তৎক্ষণাৎ বাইক থেকে ছিটকে পরে রক্তিম। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মুখোশধারি কয়েকজন ঝাপিয়ে পরে তার উপর। নির্মম ভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বেহুশ রক্তিমকে ফেলে যায় রাস্তার পাশে। রাতের শেষ প্রহরে এক দল তরুণ যুবক এই রাস্তা ধরেই নিজেদের বাড়ি ফিরছিল। তখনই দেখতে পায় রক্তাক্ত অবস্থায় এক লোক পরে আছে। ছেলে গুলো প্রথমে ভয়ে কাছে না আসলেও কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক ভেবে মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যায়। উল্টো হয়ে পরে থাকা দেহটা ঠেলে সোজা করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রক্তিম শিকদারের রক্তাক্ত মুখ। বুকের পাশ থেকে তখনও অবিরাম ধারায় তাজা রক্ত গড়িয়ে পরছিল। বেদনায় ক্লিষ্ট রক্তিমের চোখের পাতা একটু একটু করে কেঁপে উঠছিলো।যুবক দল নিজ উদ্যোগে রক্তিমের পকেট হাতরে ফোন বের করে জানিয়ে দেয় দলের ছেলেদের কাছে এই খবর। খবরটা একজনের কানে পৌঁছনোর কয়েক মিনিটের মাথায় ঝড়ের গতিতে ছুটে আসে প্রত্যেকে। নিয়ে যাওয়া হয় রক্তিমকে হাসপাতালে। আজীজ শিকদার ছেলের এমন করুন অবস্থার কথা জানতে পেরে কাওকে কিছু না জানিয়ে রাতের অন্ধকারেই ছুটে আসে হাসপাতালে। কিন্তু ছেলেকে দেখতে পারেনা এক নজর। ওনার আসার আগেই রক্তিমকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। অস্ত্রপচার করে বুক থেকে বুলেট বের করতে পারলেও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনা ডাক্তার। টানা চব্বিশ ঘন্টা আইসিইউ এ অচেতন থাকার পর আজ জ্ঞান ফিরে তার। তবে বুকের আঘাতের কারণে এখনো ঠিকমতো কথা বলতে পারছেনা।

ফিনাইলের তীব্র গন্ধে কপাল কুঁচকে চোখ বন্ধ করে পরে আছে রক্তিম। তার কাছে মনে হয় পৃথিবীর সবথেকে বাজে গন্ধ যদি কোথাও থেকে থাকে তবে সেটা এই হাসপাতাল নামক জায়গায় মেডিসিন আর ফিনাইল এর তীব্র গন্ধ। অসহ্যকর এই গন্ধ কয়েক মিনিটের ভিতর মাথা ব্যাথা ধরিয়ে দেয় রক্তিমের। সুস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থাতেই সে কখনো হাসপাতালে পাঁচ মিনিটের বেশি টিকতে পারেনা। সেখানে এমন অসুস্থ অবস্থায় কিভাবে থাকবে? একেতো শরীরের কাটাছেড়ার যন্ত্রণা। তার উপর এসব উটকো গন্ধে মাথা ব্যাথার সাথে পেট গুলিয়ে মুখ ভরে বমি আসতে চাইছে। দাঁতে দাঁত খিঁচে সহ্য করে চুপচাপ পরে আছে রক্তিম। নিরব কেবিনে হঠাৎ কারো পদচারনায় ভাবে হয়তো কোনো নার্স বা ডাক্তার এসেছে। চোখ বন্ধ অবস্থায় ভারি স্বরে জানতে চায়,

“আমাকে এখানে আর কতদিন স থাকতে হবে?”

“যতদিন পযর্ন্ত পুরোপুরি শরীর সুস্থ্য না হচ্ছে ততদিন। এর থেকে বেশিদিন থাকার ইচ্ছে থাকলে আবার কারো গুলির সামনে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে যান। বুক ঝাঝড়া করে আবার না হয় আসবেন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে আরাম করার জন্য।”

কোনো নার্স বা ডাক্তারের গলার আওয়াজের পরিবর্তনে চিরচেনা বাবার গম্ভীর স্বরের জবাব পেয়ে একটু চমকায় রক্তিম। ভারি হয়ে আসা চোখের পল্লব ঝাপটে খুলে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকায় আজীজ শিকদারের দিকে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও চোখ বুজে নেয়। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শত চেষ্টায় টেনেটুনেও বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছেনা রক্তিম। মনে হয় চার পাশের সমস্ত কিছু ঘুরছে। রাজ্যের ঘুম জমে আছে চোখের পাতায়।

“কেমন লাগছে এখন?”

আজীজ শিকদারের কন্ঠ এবার যথেষ্ট নরম শোনায়। শারীরিক বেদনা ভুলে বুকের ভিতর এক টুকরো প্রশান্তি উপলব্ধি করে রক্তিম। বাঃহিক দিক থেকে সবার কাছে পরিচিত পাষাণ হৃদয়ের রক্তিম শিকদারের মনটা যে প্রতিনিয়ত জন্মসূত্রে পাওয়া আপন মানুষ গুলোর একটু ভালোবাসার জন্য সর্বক্ষণ কাঙ্গাল হয়ে থাকে এই খবর একমাত্র রক্তিম শিকদার ছাড়া কেউ জানেনা। মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে সে ঠিক জানে এখনো সে এতোটা পাষাণ হয়ে উঠতে পারেনি যতটা পাষাণ হলে বাবা-মায়ের জন্য মন ছটফট করেনা।

“ভালো।” অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় রক্তিম। ছেলের দিকে তাকিয়ে হতাশাভরে নিঃশ্বাস ছাড়ে আজীজ শিকদার। মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে রক্তিমের মাথার কাছে একটা টুল টেনে বসে। নিচের দিকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কন্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে বলতে থাকে,

“আমি নিজে রাজনীতিতে পা বাড়ালেও কখনো চাইনি আমার ছেলেরা রাজনীতিতে আসুক। অথচ আমার কানের কাছে রাজনীতি নামটা উচ্চারিত হলেই শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে এখনো। চোখে ভাসে শহস্র স্বপ্ন। যে আমার হাতে শত শত তরুণ রাজনীতিবিদের জন্ম সেই আমি শুধুমাত্র উপজেলাল মেয়র হয়ে থামিয়ে দিয়েছি পথচলা। পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে আর সামনে আগানোর সাহস পায়নি। এটুকুও ছেড়ে দিতাম যদি রক্তের সাথে রাজনীতি নামটা মিশে না যেতো। তোমাকে সামরিক বাহিনীতে দিয়ে এলাকা থেকে বের করলাম। ইচ্ছে ছিল সংগ্রামকে পিএইচডির জন্য বিদেশ পাঠিয়ে দিব। মেয়ে দুটোকে যত দ্রুত সম্ভব পাত্রস্থ করব। কারণ এক আমি রাজধানীর সাথে জড়িয়ে মনে হতো পুরো পরিবারের ধ্বংস ডেকে নিয়ে এসেছি। সর্বক্ষণ ভয় হতো তোমাদের নিয়ে। যদি কখনো কেউ কোনো ক্ষতি করে দেয়! আমার সুন্দর পরিবারটায় যদি ধ্বস নেমে আসে! ভাগ্যের পরিহাসে সেই ধ্বংস নেমে আসলোই আমার সুখের পরিবারে। এর জন্য আমি কখনো তোমাকে দায়ী করিনি আর করবও না। তবে তুমি ঐ ধ্বংস লিলার পরও থামোনি। সেই আমার ভয় সত্যি করে পা বাড়িয়েছো বি-পথে। এলাকার মানুষের ভালো করতে গিয়ে মারামারি কাটাকাটি করে সবার কাছে গুন্ডা নামে পরিচিত হয়েছ। তোমাকে দমাতে না পেরে রাগে দুঃখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম। তুমিও আমার মুখের কথা শুনে তাই করলে। একটাবার আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে আমার ভিতরের কষ্ট গুলো দেখলেনা। লিয়াকত বিল্লা কতটা ভয়ংকর সেটা আমি জানতাম। যখন শুনলাম লিয়াকত বিল্লার ছেলের গায়ে হাত তোলার অপরাধে তুমি জেলা তখন আর বাবা হয়ে স্থির থাকতে পারিনি। ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে মাথা নত করেও যদি কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এই দন্দ মিটাতে পারি! একবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলাম। পরদিন আবার যেতাম আমি। সন্তানের জীবনের থেকে বাবা-মায়ের কাছে সম্মান কখনো বড় হতে পারেনা। তবে তার আগেই তোমার প্রিয় জনগণ আন্দোলন করে ছুটিয়ে আনল তোমাকে। ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে উস্কানি দিয়ে লেলিয়ে দিল তোমার উপর। আমি শতভাগ নিশ্চিত তোমার উপর এই আক্রমণ লিয়াকত বিল্লা করিয়েছে।”

“সেটা আমিও জানি।”

বাবার এতো গুলো কথার পর জবাব দেয় রক্তিম। কথার মাঝে বাধা পরায় ছেলের প্রতি রুষ্ট হয় আজীজ শিকদার। নিচু স্বর কিছুটা উচু করে বলে,

“কথা শেষ করতে দাও আমাকে। এরপর তোমার যা ইচ্ছা বলো।”

চুপ থেকে সম্মতি দেয় রক্তিম। আজীজ শিকদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলতে থাকে,

“আজ ভাগ্যের জুড়ে বেঁচে গেলেও লিয়াকত বিল্লা কখনো সুস্থ্য ভাবে বাঁচতে দিবেনা। এক সন্তান হারিয়ে আমার ঘরটাতে যে শূণ্যতা এখনো বিরাজ করছে সেই একই শূন্যতা আমি আর চাইনা। গত দুটো বছর তো কত আবদার করলাম তোমার কাছে। কোনোটাই রাখলেনা। আজকে শেষ একটা আবদার করব। বলতে পারো বাবা হয়ে সন্তানের কাছে অনুরোধ রাখব। আমার অনুরোধটা রাখবে?”

“কি?” একই ভাবে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে জানতে চায় রক্তিম। আজীজ শিকদারের দৃষ্টি চঞ্চল হয়। কথাটা বলতে একটু দ্বিধা কাজ করে। তবুও সেই দ্বিধাটুকু কাটিয়ে বলে ওঠে,

“লিয়াকত বিল্লার কাছে মাফ চেয়ে ঝামেলা চুকিয়ে নাও। এটা তোমার কাছে এক অসহায় বাবার অনুরোধ। আমার কথা না ভাবলেও নিজের বোনটার কথা একটু ভাবো। সে তোমার ক্ষতি করতে না পেরে যদি তোমার বোনের কোনো ক্ষতি করে দেয়?”

কথাটা কানে পৌঁছাতেই তড়িৎ দু-চোখের পাপড়ি আলগা হয়ে যায় রক্তিমের। দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকায় বাবার দিকে। শুভ্র রাঙা পাঞ্জাবী পরিহিত ভদ্রলোককে আজীবন জেনে এসেছে দিলখোলা মানুষ হিসেবে। রাজনীতিতে জড়ালেও কখনো অন্য কোনো দলের সাথে কোনো প্রকার ঝামেলা করেনি নিজে থেকে। সর্বক্ষণ নিজেকে জনগণের সেবায় উৎসর্গ করেছে। সেই লোক কিভাবে নিজের সন্তানকে অন্যায়ের প্রতি মাথা নত করতে বলে? ভেবে পায়না রক্তিম। কিছু পল চুপচাপ বাবাকে দেখে নিয়ে গলা উচু করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দলের ছেলেদের ডাকে। সাথে সাথেই ব্যাথায় কুঁকিয়ে ওঠে। একটু বিচলিত হয় আজীজ শিকদার। সেদিকে পাত্তা দেয়না রক্তিম। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে ব্যাথা হজম করে দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা রাকিবের উদ্দেশ্যে বলে,

“মেহেদীকে ডাক।”

তৎক্ষণাৎ দরজা থেকেই বেরিয়ে যায় রাকিব। এর কিছুক্ষণ পরই হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে মেহেদী। তাকে দেখেই রক্তিম আদেশ ছুড়ে,

“ঐদিনের ভিডিও স্ক্রিপ্টটা তোর কাছে আছে না?”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় মেহেদী। আবারও আদেশ ছুড়ে রক্তিম,

“মেয়র সাহেবকে দেখা ওটা।”

একবার রক্তিমের মুখের দিকে আর একবার আজীজ শিকদারের মুখের দিকে তাকায় মেহেদী। পরপর দ্রুত ফোন হাতে এগিয়ে যায় আজীজ শিকদারের দিকে। চোখে-মুখে অসন্তুষ্টির লেশ আজীজ শিকদারের। মনে মনে হতাশ হয় অনেক। এতোক্ষন নিজের উনুভূতি ব্যক্ত করার পরও ছেলের মুখে বাবা ডাকের বদল মেয়ের সাহেব শুনে মনটা বিষিয়ে ওঠে। হতাশ মুখেই তাকায় মেহেদীর ধরে রাখা ফোনের স্ক্রিনে। ফোনে চলা ভিডিওটা দেখে থমকে যায় তৎক্ষণাৎ। বাবার থমথমে মুখ বিবর দেখে তাচ্ছিল্য হাসে রক্তিম। শ্লেষাত্বক স্বরে বলে,

“এখনো বলবেন ঐ জানোয়ারের কাছে মাফ চেয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে?”

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়না আজীজ শিকদার। উল্টো জানতে চায়,

“এসব পুলিশের কাছে দিচ্ছো না কেন?”

“কোন পুলিশের কাছে? যে পুলিশ লিয়াকত বিল্লা নিজের পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়?”

সহাস্যে জানতে চায় রক্তিম। মেহেদী এতোক্ষনে বাবা-ছেলের মাঝ থেকে মিহি স্বরে বলে,

“পুলিশ সব জানে কাকু। পুলিশের সহযোগীতা নিয়েই লিয়াকত বিল্লা এতো বড় কাজ গুলো অনায়াসে করতে পারছে।”

“এখন কি করবে তুমি?”

আজীজ শিকদারের চোখে এবার একটু তেজ দেখতে পায় রক্তিম মেহেদী দুজনেই। বুঝতে পারে রক্তিম আদর্শবান মেয়র আজীজ শিকদার এতো বড় একটা অপকাজের প্রমাণ নিজ চোখে দেখে ফুসে ওঠছে লিয়াকত বিল্লার প্রতি। আঘাতে জর্জরিত ফোলা ঠোঁট দুটো অল্প ছড়িয়ে হাসে রক্তিম। জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে শিয়ালের মতো ধূর্ত চোখ দুটো। ভাবলেশহীন স্বরে জবাব দেয়,

“বিষধর সাপের বিষদাঁত একেবারে গুড়ি থেকে উপরে ফেলতে হবে। এর জন্য আগামী সংসদ নির্বাচনে আপনাকে এমপি পদে লিয়াকত বিল্লার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আশা করি এতে আপনার কোনো আপত্তি থাকবেনা।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here