ছায়া মানব ২ ১৩.

0
333

ছায়া মানব ২

১৩.
মাহতিম ফুলটাকে আদর করতে করতে বলল,’আমার বাগানে কী করছ তুমি?’

অহনা কোনরকমে ওঠল। হাতে থাকা কাদা মাটি মাহতিমের পুরো মুখে লেপ্টে দিল। নিজের রাগটা কিছুটা হালকা হলো এতক্ষণে। তবে মাহতিমের রাগটা আরো গাঢ় হয়ে গেছে। কপট রাগ নিয়ে নিজের গাল স্পর্শ করল,’এটা কি করলে তুমি?’

‘যা করেছি বেশ করেছি। আপনার জন্য‌ই আমার এই অবস্থা, একটু শাস্তিতো পেতেই হতো।’

‘ তাই বলে কাদা মেখে দেবে? ভুলটা তোমার। আমার বাগান থেকে ফুল ছিঁড়লে কেন?’

মোহনা আসতেই দুজনে চুপ হয়ে গেল। মাহতিম আগ বাড়িয়ে বলল,’তোর বান্ধবী আমার গাছ থেকে ফুল ছিঁড়েছে। অথচ এখনো আমার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলছে। তার মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই।’

অহনা মুখ বাঁকিয়ে বলল,’অনুতাপ থাকতো যদি আপনি সুন্দর করে বিষয়টা আমাকে বুঝিয়ে বলতেন। তা না করে আমার জামা নোংরা করেছেন।’

মোহনা ঝগড়া থামানোর জন্য বলল,’আচ্ছা, তোমরা থামো। ভুল হতেই পারে। তাই বলে তোমরা সিনক্রিয়েট করছ কেন? আর ভাইয়া তুমি শুনো, জানি তোমার বাগান থেকে ফুল ছেঁড়ার সাহস কারো নেই। অহনাতো সেটা জানত না। জানলে ভুলটা করত না। তাই বলছি মাফ করে দাও।’

মাহতিম বলল,’তাহলে তোর বান্ধবীকে বল আমার কাছে মাফ চাইতে।’

অহনা দাঁত কটমট করে বলে,’মগের মুল্লুক নাকি? আমি বিনা দোষে মাফ চাইব না। মাফ যদি চাইতেই হয় তাহলে আপনি চাইবেন। আপনার জন্য‌ই আমার পোশাক খারাপ হয়েছে।’

‘দোষ তোমার তাই তুমি আমাকে সরি বলবে।’

‘ কক্ষনো না। আপনি বলবেন।’

‘না, তুমি।’

‘ আপনি।’

মোহনা দুজনের ঝগড়ার কোনো সুরাহা করতে পারল না। শোরগোল শুনে বর্ষণ‌ও এগিয়ে এলো। পুরো বিষয়টা শুনতেই মাহতিমকে বলল,’আমি তোকে আরো ফুলের চারা এনে দেব। এখন থামা উচিত তোর।’

মাহতিম মোহনাকে সামনে রেখেই বলে ওঠল,’মেয়েটাকে পছন্দ করিস বলে এখন আমার বিরোধিতা করছিস? এতো কিছুর পরেও তোর ভালোবাসা কমেনি?’

‘ভালোবাসা কোনো খাবার নয় যে পেট ভরে গেলেই আর ইচ্ছে করবে না। এটা সুস্বাস্থের মতোই, হারিয়ে গেলে শরীর অবশ হয়ে যায়।’

অহনা আর মোহনা দুজনের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে আছে। অহনা বুঝতে পারল। বর্ষণ যে তাকে পছন্দ করে সেটা আগে থেকেই মাহতিম জানতো। অনেকটা রাগ হয় অহনার। এদিকে মোহনাও কিছুটা আন্দাজ করল। মনে মনে বলল,’তার মানে ওরা তিনজন একে অপরকে আগে থেকেই চিনত। কিন্তু তা কী করে হয়?’ তার ভাবনার মাঝখানেই গতদিনের কথা স্মরণ হয়। মাহতিমের অহনার প্রতি যত্ন দেখে সে কিছুটা হলেও আন্দাজ করে। কিন্তু তবুও মাথা গড়মিল হচ্ছে। মূলত মাহতিম এবং বর্ষণের মধ্যে কে অহনাকে পছন্দ করে সেটা নিয়ে। ওর ভাবনার মধ্যে‌ই অহনা বলল,’সার্কাস হচ্ছে মনে হয় এখানে। আমি গেলাম।’

মোহনাও সুযোগ বুঝে কেটে পড়ল। বর্ষণ মাহতিমের উদ্ভট আচরণের ক্রুদ্ধ হয়। বলেই বসল,’ওর সাথে এমন করছিলি কেন? কাল দেখলাম খুব যত্ন নিলি, আজ আবার বকলি।’

‘ আমার মাথা ঠিক ছিল না। জানিসতো বাগানটা আমার কতোটা প্রিয়।’

‘একটা ফুলের জন্য তোর ভবিষ্যত ভাবীর সাথে এমনটা করা উচিত হয়নি।’

মাহতিম কিছু বলল না। এমনিতেও রাগ চটে আছে। তার ওপর এমন গা জ্বালানো কথা তার সহ্য হলো না। পেছন ফিরে পা বাড়াতেই মাহতিমকে পেছন থেকে ডাকল বর্ষণ,
‘তুই চাস কী?’

মাহতিম কিছু না বলেই পা বাড়ালো। পুনরায় থামিয়ে দেয় বর্ষণ,’বলে যা।’

মাহতিম কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’অহনাকে কি ভুলে যেতে পারো না?’

এমন প্রশ্নে কিছুটা হকচকিয়ে ওঠে বর্ষণ। হঠাৎ এমন কথা সে আশা করেনি। মনে হচ্ছে তার আড়ালে বিরোধিতা করছে। মাহতিম আর কথা বাড়ালো না‌। দ্রুত ঘরের দিকে গেল। সে আজকাল কিছুটা উদাসীন। শব্দের সঠিক ব্যবহার বুঝতে পারছে না। কখন কী বলতে হবে বোধগম্য হচ্ছে না।
ঘরে এসে চোখেমুখে পানি দিল। কেমন একটা সংকোচ কাজ করছে নিজের মধ্যে। কিছুতেই তার কারণ বুঝতে পারছে না।

অহনা ম্যাচে এসেই পোশাক পরিবর্তন করল। মোহনা ওকে ব‌ইপত্র গোছাতে সাহায্য করল। ম্যাচের পরিবেশ পছন্দ হলো না মোহনার। সে কিছু চিন্তা করল। তারপর অহনার সাথে বেরিয়ে গেল। কলেজের সামনে এসে গাড়ি থামতেই অহনার চোখ গেল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মাহতিমের দিকে। মোহনাকে বলল,’তুমি যাও, আমি একটু পরেই আসছি।’

মোহনা চলে যেতেই অহনা বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়াল। কোথা থেকে বর্ষণ এসে তার সামনে দাঁড়াল। মাহতিম অহনার কাছে আসতে গিয়েও থেমে যায়। বর্ষণ অহনাকে তার সাথে যেতে বলল। সাধারণ কথায় না শুনল না সে। অনেকটাই বিষন্ন হয়ে পড়ল। অহনা তাকে নিরাশ করতে পিছপা হলো না।
‘সমস্যা কী আপনার? কেন আমার পিছু ছাড়ছেন না?’

‘তোমাকে ভালো লাগে। যদি বারবার ফিরে আসা অপরাধ হয় তাহলে কিভাবে সম্ভব তোমাকে জয় করা? কোনো কি উপায় নেই?’

‘ আপাতত অসম্ভব। আপনি দয়া করে আমার পিছু ছাড়েন। আমি আপনার প্রতি বিরক্ত।’

বর্ষণের পুরো মুখে যেন মেঘেরা ভীড় জমালো। গুমোট মুখেও বলল,’কেন বিরক্ত তুমি?’

‘আপনার আর আমার স্ট্যান্ডার্ডে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আপনি বড়লোকের ছেলে বলে যখন যে কাউকে পছন্দ করতেই পারেন‌। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমি অন্তত এসবে নেই। আমি জড়াতে চাই না‌। সবচেয়ে বড়ো কথা যদি বলা হয় তাহলে জীবনসঙ্গী নির্বাচনে আমি এখনো পাকাপোক্ত ন‌ই। আমি এখনো কাঁচা! এই অসময়ে অন্তত কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুগতে পারিনা। আপনি মানুষটাই আমার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত। দয়া করে আর আমাকে বিরক্ত করবেন না।’

বর্ষণের চোখ ছলছল করে ওঠল। রাগে তার মাথা ফেটে যাবে মনে হলো। নিজেকে শান্ত করতে পারল না‌। ভেজা কন্ঠে বলল,’ঠিক আছে। আমি আর কখনোই তোমার সামনে আসব না। তবে মনে রেখো, অন্যকাউকেও সহ্য করব না‌। আমি ভুলিনি, শুধু কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিচ্ছি তোমাকে বোঝার।’

বর্ষণের কথা আপাতত বুঝল না অহনা। তবুও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। বর্ষণ উল্টো হাঁটা ধরল। অহনা কলেজ গেট পার হ‌ওয়ার আগেই সামনে এসে দাঁড়ায় মাহতিম। অহনা বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে পা চালালো। তাদের দুই ভাইকেই এখন বিরক্ত লাগছে। সুযোগ দেবে না এবার আর।
অহনা কোনো কথা না বলে পা বাড়াতেই মাহতিম তার হাত চেপে ধরল। বুকটা ধ্বক করে ওঠল অহনার। হাতটা সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পেছন ফিরতেই মাহতিম তার হাত ছেঁড়ে দেয়।
‘ভাই কী বলেছে তোমাকে?’

অহনা ঠোঁট টিপে কিছু চিন্তা করল। পরক্ষণেই বলল,’তেমন কিছু না।’

‘ মনে হলো ঝগড়া করেছ।’

‘এটা নতুন কী? আপনাদের সাথে দেখা হ‌‌ওয়ার পর থেকেই আমার সাথে সব খারাপ হচ্ছে।’

‘যাই হোক! তোমার এখন কি ক্লাস আছে?’

‘না, পার্টি করতে এসেছি।’

‘ সুন্দর করে উত্তর দিতে পারতে। আমি কিন্তু তোমাকে পটাতে আসিনি। এমনিতেও আমি চাকরিজীবী মানুষ, এসব আমার সাথে যায় না। তবে ব্যবসায়িকদের মতো লাভ-লোকসান দিয়েই সব কাজ শুরু করি। যদি কখনো কারো প্রেমে পড়ি তবে শর্ত থাকতে হবে।’

অহনা কিছু অবাক হয়। ছেলেটা এসব কী বলছে? সত্যিই কি তার মনে কোনো অনুভূতি নেই? শর্তে বিশ্বাসী? ভাবনার ছেদ ঘটিয়েই বলল,’কিরকম শর্ত?’

মাহতিম চুল ঠিক করে বলল,’তুমি কি আমার প্রেমে পড়ে গেলে নাকি? এসব বাদ দাও, আমি তোমার প্রতি ইন্টারেস্টেড না।’

অপমানে অহনার কান জ্বলে উঠল। কেউ তাকে পাত্তা দিলনা সেটা তার কাছে অনেকটা কটু বলে মনে হলো। ভীষণ জেদ‌ও চেপে বসল। কিন্তু উত্তরে বলল,’সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আপনি ডিল করবেন নাকি সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। আমি অন্তত আপনার প্রেমে পড়িনি।’

‘ কী করলে পড়বে?’ গলা নত করে বলল মাহতিম।

‘ কিছু বললেন?’

‘ নাতো। তোমাকে আর কী বলব? বোঝানোর সাহস মনে হয় আমার প্রপিতামহের দাদার পঞ্চাশ পুরুষের প্রপিতামহের‌‌ও নেই।’

অহনা না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কী বলল মাহতিম সে বুঝতে পারল না। এদিকে মাহতিমের ব্যাকুল চিত্ত আরো কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠল। ভেবেছিল পাত্তা না দিলে মেয়েটা নিজের জেদ ধরে রাখতেই তাকে শর্ত দেবে বা তাকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। কিন্তু সেতো তেমনটা কিছু করেনি। অহনার ক্রোধ বাড়ানোর চেষ্টা করল,’ছেলেরা তোমাকে পাত্তা দেয়?’

অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর দিল,’আমি চাই না।’

‘ কেন চাও না?’

‘ দরকার কী?’

এমন সোজা প্রশ্নের উদ্ভট উত্তর কল্পনা করেনি মাহতিম। কিছুতেই মেয়েটাকে সে কাবু করতে পারছে না। মাথা চুলকে বলল,’কাউকে সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো।’

‘ কেন? আপনি কি সুযোগ পেতে চান নাকি?’

মাহতিম খুশিতে গদোগদো হয়ে বলল,’অবশ্য‌ই!’

অহনা ব্রু কুঁচকালো। মাহতিম ঢোক গিলে বলল,’তেমন কিছু না। এমনিতেই বললাম। আমিতো তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য‌ই বলেছি। আমি জানি তুমি ভীতু। ভয় পাচ্ছ, আমি যদি জিতে যাই তবে তুমি হেরে যাবে।’

‘ আমি ভয় পাই না আপনাকে। নিজেকে খুব স্মার্ট মনে করছেন তাই না? তবে দেখান স্মার্টনেস‌।’

‘শর্তে কী থাকছে তাহলে?’

‘আপনার ইচ্ছেনুযায়ী, যদি আপনি জিতে যান তবে আমি আপনার সাথেই রিলেশন করব।’

‘ কথাটা শেষ পর্যন্ত মনে থাকবে তো?’

‘ আমি সহজে কিছু ভুলিনা।’

‘ ঠিক আছে, বলো কী করতে হবে আমায়?’

অহনা ভাবতে শুরু করল। তেমন কিছুই মাথায় আসছে না। দেখল রাস্তা দিয়ে বড়ো একটা ট্রাক তার নিজস্ব গতি ঠিক থেকেই বাতাসের বেগ নিয়ন্ত্রণ চলছে। চোখের পলকেই সেটা অনেকদূর এগিয়ে গেল। সাধারণ মানুষ কখনোই তার নাগাল আর পাবে বলে মনে হয় না। অহনা হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে সাথে সাথেই বলল,’ঐযে দূরে ট্রাকটা দেখছেন। এটা যতক্ষণ চলবে, আপনাকেও ততক্ষণ এটার পেছনে দৌড়াতে হবে। হাল ছেড়ে দিলেই আপনি ঠকে যাবেন।’

মাহতিম দেখতে দেখতেই সেটা অনেকটা দূরে চলে গেল,
‘এটা কেমন কথা? তুমি কি জানো ট্রাকটার গন্তব্য কোথায়? এটা চাঁদপুর ছাড়িয়ে যাবে। এতক্ষণ দৌড়ালে আমার অস্থিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

‘ আমার কথা শেষ। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। অযথাই সময় নষ্ট করছেন, বেশি সময় বাকি নেই। গাড়িটাকে একটু পর আর দেখতে পাবেন না।’

মাহতিম ভাবশূণ্য। কী করবে এখন সে? দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অহনা পুনরায় বলল,’আপনার কাছেতো জিপিএস আছে।’
সাথে সাথেই মাহতিমের গাড়ি থেকে জিপিএস এনে দিল।
‘এবার যান। আমি এখানেই আছি।’

ততক্ষণে ট্রাকটা অদৃশ্য হ‌ওয়ার জোগাড়। মাহতিম দেরী করল না। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে ট্রাকটাকে দেখল। যেন চোখে স্ক্যান করে নিল দ্রুত। পরপর‌ই অহনার দিকে একবার তাকিয়ে পথের দিকে অগ্রসর হলো।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

গল্পটা পড়ুন এবং মতামত প্রকাশ করুন সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership এই গ্রুপের মাধ্যমে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here