ছায়া মানব ২
২৭.
মাহতিম গরম স্যুপ বানালো অহনার জন্য। দ্রুত সেটা নিয়েও গেল। অহনা শুয়ে আছে। মাহতিমকে দেখতেই তড়িঘড়ি উঠার চেষ্টা করল। মাহতিম বাধা দিয়ে বলল,’তোমাকে উঠতে হবে না। আমি আসছি।’
‘না উঠলে খাব কি করে? এমনিতেও আমার খুব খিদে পেয়েছে।’
‘কেন? আমি খাইয়ে দিলে বুঝি খুব বেশি সমস্যা হয়ে যাবে?’
অহনা কিছু বলল না। শুধু এক ধ্যানে মাহতিমকে দেখছে। এই কয়দিনেই কেমন ভালো লাগার মানুষে পরিণত হলো। মাহতিম অহনার শিয়রের কাছে বসলো।
‘তোমার কি ঠান্ডা লাগছে?’
অহনা মৃদু হাসল,‘একদমই না।’
‘হা করো।’
আধশোয়া হয়ে বসা অহনা। মাহতিম যত্ন নিয়ে খাইয়ে দিল অনেকটা। তারপর বলল,‘এখন কেমন লাগছে?’
‘তুমি থাকলে মনে হয় এই হালকা ব্যথা কিছুই না।’
‘জানি, অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। যদি পারতাম, তবে তোমার সব কষ্ট নিজের করে নিতাম। সহ্য হচ্ছে না কেন জানি। যতটা কষ্ট তুমি সহ্য করছ তা কি কখনো আমি করতে পারব? কিভাবে পারো বলো?’
‘আল্লাহ কখনোই কাউকে সহ্যের বাইরে কিছু চাপিয়ে দেননি। মেয়েদের এই ব্যথাটা সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েই ব্যথাটা দিয়েছেন। তাই আমি সহ্য করতে পারি। ছেলেদের এটা সহ্য করার ক্ষমতা দেননি, তাই তারা পারবেও না। তুমিও পারবে না কখনোই। যেমন ধরো, অনেক ভারী একটা জিনিস ওপরে তুলতে তোমার হয়ত ততটা কষ্ট হবে না, কারণ আল্লাহ তোমাকে সেটা সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছেন। অন্যদিকে আমি বা একটা মেয়ে সেইম কাজটা করতে পারবে না। আমাদের ততটা শক্তি দেওয়া হয়নি। তাহলে বুঝেছ বিষয়টা?’
‘বুঝলাম। তবে কষ্টতো হচ্ছে তোমার। কী করে সেটা কমাতে পারি?’
‘এখন ঠিক আছি। তুমি চাইলে কাকাকে দেখতে যেতে পারো।’
‘তোমাকে একা রেখে আমি কখনোই যাব না। কখন কী হয় বলা মুশকিল।’
‘আমার জন্য ভয় পাও?’
মাহতিম অহনার চুলের ভাঁজে হাত রেখে বলল,‘অনেকটা! ভালবাসার মানুষের জন্য ভয় থাকেই। যতদিন বেঁচে আছি তুমি আমার ভাবনাকে দখল করে থাকবে। ছায়া হয়ে থাকব তোমার। কখনোই ছেঁড়ে যাব না।’
‘মৃত্যু যদি আমাদের আলাদা করে দেয়? তুমি কি মেনে নিতে পারবে?’
মাহতিম রসিকতা করে বলল,‘মৃত্যুর পর তোমার কাছে উড়ে উড়ে চলে আসব। ছাড়তে পারব না কোনোমতেই। তুমি না চাইলেও আসব। রাখতে পারবে তো?’
অহনা দুহাতে জড়িয়ে ধরল মাহতিমকে,
‘আমি পেত্নি হয়ে তোমার সাথে থাকব।’
বলেই দুজনে খুব হাসল।
নূরের বাবাকে বাড়িতে নেওয়া হলো। কিন্তু নূর কিছুতেই বাড়ি থাকবে না। সে আনিফার সাথে ফিরে আসতে চাইছে মাহতিমের কাছে। কান্নাকাটি করছে ভীষণ। এদিকে তার স্কুল খোলা। কিছুতেই সে যেতে পারে না। এতদিনে অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে। তাই সবাই সিদ্ধান্ত নিল নূর ঘুমিয়ে পড়লেই তারা বের হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সবাই নূরকে বুঝতে দিল না তারা কখন যাবে। মোহনা বলল,‘এখন আমরা যাব না। কাল গেলেই ভালো হয়। নূর তোর ঘরে চল। নিহাও আসো! আমরা খেলব।’
নূর খুশিমনেই মোহনা আর নিহাকে নিজের সাথে নিয়ে গেল। সবাই বেশ চিন্তিত নূরের এমন কার্যকলাপ দেখে। বিষয়টা যে এতটা গড়াবে কেউ বুঝতে পারেনি। সবাই এটাকে সাধারণভাবেই নিয়েছিল।
মাহতিম অহনাকে এক মুহূর্তেও জন্যও চোখের আড়াল করল না। একটু পর পর শুধু গিয়ে দেখে আসছে পরিবারের কেউ এলো কিনা। অহনা অধৈর্য হয়ে বলল,’তুমি কি আমাকে ঘরবন্দি করে রাখবে নাকি?’
‘না, কিন্তু বিশ্রাম নেওয়াই ভালো এখন।’
‘পারব না। আমি এখন বাগানে হাঁটতে যাব। তুমি যাবে?’
মাহতিম মাথা দুলিয়ে সায় দিল। দুজনে মিলে বাগানের দিকে রওনা দিল। মাহতিম একটা হুডি জড়িয়ে দিল অহনার গায়ে। মুহুর্তেই অহনা বিরক্তিতো চোখ রাঙায়,
‘এই গরমে এটা কেন?’
‘বাইরে বাতাস। এখনের ভারী বাতাস তোমার গায়ে লাগলে সর্দি, কাঁশি হতে পারে। তার চেয়ে ভালো হয় তুমি এর মধ্যেই থাকো।’
অহনা আর কথা বাড়ালো। এমনিতে ভালোই লাগছে। বারকয়েক দেখল মাহতিমকে। একটু আগেই সে পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে গোসল করে তৈরি হয়েছিল। অহনা খুব অবাক হয়েছিল বিষয়টা দেখে। মাত্র পাঁচ মিনিটে সে গোসল করে নায়কের মতো ফিটফাট হয়ে চলে আসলো। একই সময়টা যদি অহনাকে দেওয়া হতো। তাহলে কখনোই পারত না। অহনা হাসল মাহতিমকে দেখে। ব্লু জিন্স আর হোয়াইট টিশার্টে তাকে মন্দ লাগছে না। শ্যামবর্ণের এক শ্যামপুরুষকেই যেন সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে বসল। মাহতিম দ্রুত বলল,‘আমাকে দেখে হাসছ কেন?’
‘সুদর্শন লাগছে তাই।’
মাহতিম কিছুক্ষণ ভেবে বলল,‘সত্যি বলছ? তুমি মনে হয়না পুরোপুরি আমার প্রেমে পড়োনি। এখনো কিছুটা গ্যাপ আছে বলেই মনে হচ্ছে আমার। সেটা কি প্রেম নিবেদন না করার কারণে নাকি অন্য কোনো কারণ?’
‘একটা প্রশ্ন করব?’
‘একটা নয়, কয়েক হাজার করো।’
‘আমার কী দেখে তোমার ভালো লাগল?’
মাহতিম কিছুক্ষণ তব্ধা মেরে দাঁড়িয়ে রইল। অহনা পুনরায় ওর চোখের দিকে তাকাতেই বলল,‘তোমার সৌন্দর্য দেখে। যে রুপের আগুনে দগ্ধ করেছ, সে রূপ ভুলতে পারিনি বলে।’
অহনা বেশ খানিকটা অবাক হলো। সাথে কষ্টও পেল। আজ পর্যন্ত যতজন তাকে পছন্দ করেছে, তা তার রুপ দেখে। মাহতিমও তাই হবে, ভাবতে পারেনি। কেমন যেন কষ্ট লাগল ভেতরে। অহনার চোখ ছলছল করে ওঠল। কেন সবাই সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে? মন বলে কি কোনো কিছু নেই? কষ্টে গোলাপ গাছের একটা পাপড়ি ছিঁড়তে গিয়েও থেমে যায়। মাহতিম পুনরায় বলল,‘আমি একবিন্দুও মিথ্যে বলছি না। তোমার রুপেই আমি আঁটকে গেছি। যে রুপের তুলনা হয়না। মনে হয়েছিল তুমি আমার জন্যই সব তুচ্ছ করে পৃথিবীর বুকে এসেছ। শুধুমাত্র আমার জন্য।’
অহনা কোনোরকমে বলল,‘তোমার কি আর কিছু বলার আছে? না থাকলে আমি এখন ঘরে যাব।’
‘মাত্রইতো এলাম। এখনই চলে যাবে?’
‘তোমার কথায় আমি অসন্তুষ্ট হয়েছি। আর কখনোই আমার কাছে ঘেঁষবে না। রুপের পূজারী কোনো ছেলেকে আমি নিজের জীবনসঙ্গী করব না।’
মাহতিম অনেকটা অবাক হয়ে বলল,‘রুপের প্রশংসা কী করতে নেই? রূপ দেখে কি প্রেমে পড়তে নেই?’
‘এসব মোহ। মোহ কেটে গেলে আমিও তোমার জীবন থেকে চলে যাব। রূপের জন্যই ভালোবাসলে, রূপ ক্ষয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তখন কষ্ট পাওয়ার চেয়ে এখন কষ্ট পাওয়া অনেক ভালো। তুমি আর কখনো আমার সাথে কোনো কথা বলার চেষ্টা করবে না।’
অহনার চোখ জলে ভর্তি হয়ে গেল। কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছে না। কখনো ভাবতে পারেনি প্রেম নামক জিনিসটা তার মাঝে আসবে এবং এত দ্রুতই চলে যাবে। মাহতিম বলল,’পুরো কথাটা শুনে যাও। তুমি আমার কাছে খুব স্পেশাল। ভালোবাসি আমি তোমাকে।’
‘এমন ভালোবাসা চাই না। যেটা রূপ দেখে তৈরি হয়। আমি চেয়েছিলাম নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, যেটা হবে মনের টানে। তুমিতো ভালোবাসার সংজ্ঞাই ভুল প্রমাণিত করলে। আমার কথায় যদি কোনো মিথ্যে উত্তর দিতে তাও আমি এতো কষ্ট পেতাম না। সত্যিটা শুনে যতটা কষ্ট পেলাম। সত্যি বলতে কী তুমি আমাকে ভালোই বাসোনি। মাহতিম অহনার কাছে এগিয়ে আসে। কপোলদ্বয়ে হাত রাখতেই অহনা দূরে সরে যায়,
‘অমন নোংরা হাতে আমাকে ছুঁবে না। তোমার ছোঁয়াও রূপের দিকেই হাত বাড়িয়েছে। তুমি কখনোই আমাকে ছোঁয়ার অধিকার রাখোনা। কখনোই ছুঁবে না আমাকে।’
‘আমার কতটা শোনো। আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দাও।’
‘আর কিছু কি বলার আছে? কী বোঝাতে চাইবে তুমি? আমি অন্তত শুনতে চাই না। আর কখনোই আমার সাথে কথা বলবে না। আমার ঘেন্না হচ্ছে, তোমার মতো পুরুষের ছোঁয়ায় নিজেকে সর্বসুখী ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। মুখ ফুটে বলিনি কখনো, কিন্তু ভালোবেসেছি খুব যতনে। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি প্রতি রাতে। নির্ঘুম সময়ে তোমাকেই ভেবেছি। আমার পুরো অস্তিত্বে স্থান দিয়েছিলাম। তুমি তার যোগ্যই না।’
‘আমার কথাটা তো শুনো, প্লিজ।’
‘একদম ছুঁবে না আমাকে।’
অহনা আর একটা কথাও না বাড়িয়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে গায়ে থাকা জ্যাকেটটা খুলে গাছের ডালে রাখল। মাহতিমের কোনো জিনিসেই এখন তার প্রকোপ নেই। এক প্রকার দৌড়েই চলে গেল।
নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে কান্না করছে। মাহতিম অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালো কিন্তু সে দরজা খুলল না। কানে ইয়ারফোন গুঁজে কাঁদছিল। অপর পাশে মাহতিম চিৎকার করে ডাকছে। অহনার কানে পৌঁছাচ্ছে না কিছুই।
বিকেল হয়ে এসেছে। এখন নূর ঘুমাচ্ছে। সাথে মোহনা এবং নিহাও। আনিফা এসে ওদের দুজনকে জাগিয়ে দিয়ে তৈরি হতে বলল। তারা দেরী করল না দ্রুতই রওনা দিল। তবে সবার মনেই চিন্তা, নূর জেগে উঠলে ঠিক কী করবে!
তারা অল্প সময়েই পৌঁছে গেল বাড়িতে। দরজার কলিং চাপলো। কিন্তু খেয়াল করল দরজা খোলাই আছে। তাই সবাই ভেতরে ঢুকল। মোহনা আর নিহা ওপরে আসতেই দেখল মাহতিম অহনার ঘরের সামনে বসে আছে। বারবার বলছে,‘আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দাও প্লিজ। তোমার অবহেলা আমার সহ্য হচ্ছে না।’
মোহনা ব্রু জোড়া বক্র করে শুধালো,‘ভাইয়া, তুমি এভাবে বসে আছ কেন?’
মাহতিম দ্রুত উঠে দাঁড়াল। কান্না করেছিল খানিকটা। চোখ লাল হয়ে আছে। মোহনার কথায় চোখ মুছে বলল,‘ও আমাকে ভুল বুঝেছে। কথা বলছে না। আমি নিতে পারছি না এটা। ওকে বল দরজা খুলতে। আমি না হয় পাগল হয়ে যাব। বল প্লিজ!’
মোহনা তার কথার আগাগোড়া না বুঝেই দরজা ধাক্কালো। মোহনার কন্ঠস্বর শুনেই অহনা দরজা খুলে দিল। মুহুর্তেই মাহতিমকে নজরে পড়তেই মায়া হলো। শ্যামবর্ণের চেহারায় যেন উজ্জ্বলতা ফিরে এলো চোখের জলে। কাকুতি জড়ানো কন্ঠ তোলার আগেই অহনা কঠিন হয়ে চোখের পানিটা মুছে নিল। পরপরই বলল,‘মোহনা, নিহা ঘরে আসো। আর কাউকে আসার পারমিশন দিতে পারিনা। সে চলে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয় আমার জন্য।’
মাহতিম মোহনা ও নিহার সামনেই অহনাকে জাপটে ধরে। কেঁদে দেয় খানিকেই। মোহনা এবং নিহা থাকতে পারল না। তারা দ্রুত বের হয়ে গেল। বুঝল, তাদের মধ্যে অভিমানের দেয়াল জুড়েছে। সেটা ঠিক হতে হলে ভাইয়ের কিছুটা পাগলামো দরকার। অহনা কঠোর গলায় বলল,’ছাড়ো আমাকে।’
মাহতিম আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অহনা কেঁপে ওঠল। বুকের সাথে মিশে থাকা মাহতিমের শরীরের স্পর্শ পেতেই তার কন্ঠনালী শুকিয়ে এলো। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিতে পারলেই যেন বাঁচে। তৎক্ষণাৎ শক্তি প্রয়োগ করে মাহতিমকে দ্রুত নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। সাথে সাথেই দরজা বন্ধ করে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ! তারা নিজেদের সামলাতে ব্যর্থ।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership