ছায়া মানব ২
২৮.
রাত অনেকটা হয়েছে। অহনা বালিশে মুখ গুঁজে এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। মোহনা কয়েকবার ডাকল রাতের খাবার খেতে যাওয়ার জন্য। অহনা বারবার বলছে, খিদে নেই, খাবে না। মোহনা কোনোমতেই বোঝাতে পারল না। আনিফাকে বলতেই সে এলো অহনাকে নিয়ে যেতে। অন্যদিকে মাহতিমও খিদে নেই বলে শুয়ে আছে। হাঁসফাঁস করছে ভীষণ। বিছানার এপাশ হতে ওপাশ করছে সর্বক্ষণ।
আনিফার কথা ফেলতে পারল না অহনা। নিজেকে সামলে নিয়ে খাবার টেবিলে উপস্থিত হলো। অন্যদিকে আনিফা মাহতিমের কাছেও গেল। বারবার বলছে খাবে না। তাও আনিফা জোর করতে থাকে। এক পর্যায়ে টেনে তুলল তাকে বিছানা থেকে।
‘আম্মা, প্লিজ ছেড়ে দাও। আমি খাব না বললাম তো!’
‘কেন খাবি না? কারণ কী?’
‘এমনিতেই।’
‘সাপের পাঁচ পা দেখে নিয়েছিস তাই না? দিন দিন শরীরের কতটা অবনতি হচ্ছে তা টের পাচ্ছিস? খাওয়া-দাওয়া সব তুঙ্গে ওঠেছে। সবাই অপেক্ষা করছে। খেতেই হবে।’
আনিফা জোর করে মাহতিমকে নিয়ে গেল। অহনার পাশের চেয়ারেই বসতে বলল, তার পাশে আনিফা বসল। খাবার বেড়ে দিতেই সবাই খাওয়া আরম্ভ করল কিন্তু মাহতিম কিংবা অহনা, কেউই খাচ্ছে না। হাত দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে অহনা। অন্যদিকে মাহতিম ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
‘কী হলো? খাচ্ছিস না কেন?’
আনিফার কথায় মাহতিম নিজের প্লেটের দিকে তাকায়। খাবার তার গলাধঃকরণ হচ্ছে না। যেন গলায় কিছু বিঁধে আছে। কিছুতেই পারল না। এদিকে অহনাও খাবারের দিকে তাকিয়ে। খেতে ইচ্ছে করছে। আনিফার বলতেই ছোট একটা লোকমা মুখে পুরল। যেন খাবার নয় বিষ মুখে দিয়েছে এমন ভাব তার। কিছুতেই গিলতে পারছে না। হঠাৎ করেই কাঁশি উঠে যায়। মাহতিম এক মুহূর্তও দেরী না করে পানি এগিয়ে দিল। অহনা ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুতেই পানিটা নিচ্ছে না। আনিফা বলল,’কী হলো, পানিটা খাও। সে কখন থেকেই দেখছি খাওয়ায় মনোযোগ নেই।’
আনিফার কথা শুনতেই অহনা না চাইতেও মাহতিমের হাত থেকে গ্লাসটা নেয়। পানি পান করেই গোগ্রাসে আরো কয়েক লোকমা মুখে নিয়ে নিল। যেন খেয়ে উঠে যেতে পারলেই বাঁচে। খেয়াল করল সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সবাই অনেকটাই অবাক অহনার কান্ড দেখে। ব্রুক্ষেপ করল না অহনা। পরপরই পানি খেয়ে উঠে গেল। মাহতিমের পাশে যেন সে অস্বস্তিবোধ করছিল। অহনা চলে যেতেই মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আনিফার কড়া কথা শুনে সেও গোগ্রাসে কয়েক লোকমা গিলে পানি খেল। সাথে সাথেই উঠে চলে গেল। উপস্থিত সবাই অহনা এবং মাহতিমের কান্ড দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে। কেউ কিছুই বুঝতে পারল না।
অহনা ঘরে গিয়েই এসাইনমেন্টের দিকে তাকাল। নিজেকে বুঝিয়ে নিল, জীবনে সমস্যা থাকবেই, তাই বলে নিজের লক্ষ্য থেকে সরে গেলে হবে না। দ্রুতই সে এসাইনমেন্ট তৈরিতে মনোযোগ দিল। পেছনেই আসলো মাহতিম। দরজাটা লাগিয়ে দিয়েই অহনাকে টেনে তুলল চেয়ার থেকে। অগ্নিশর্মা হয়ে তাকিয়ে আছে অহনা।
‘তুমি কেন এসেছ? আমার আর সহ্য হচ্ছে না তোমাকে। কালই এই বাড়ি ছেড়ে যাব আমি। কোনো বাধা দিতে পারবে না বলে দিলাম।’
মাহতিম অহনার কপোলদ্বয়ে হাত রাখে,‘কেন বুঝতে চাইছ না আমাকে? সুযোগ দিয়েছ একবারও কথা বলার?’
‘কিছু শুনতে চাই না আমি। আমি চিৎকার করব। এখনই বেরিয়ে যাও। তোমার বাড়িতেই আর থাকব না। না হয় যেকোনো সময় তোমার রোষানলে পড়তে হবে। তুমি বড়লোকের ছেলে। তুড়ি বাজালেই হাজারটা মেয়ে লাইন ধরবে। আমায় নিয়ে আর এক মুহূর্তও ভেবো না।’
‘ঠিক আছে! আমি আর তোমাকে নিয়ে ভাববো না। তবে এই বাড়ি থেকে যাবে না।’
অহনা কিছু বলার আগেই মাহতিম পুনরায় বলল,‘না বলতে পারবে না।’
‘ঠিক আছে।’
মাহতিম আর কথা বাড়ালো না। অহনার কাছ থেকে চলে গেল। অহনা কিছুটা দ্বিধান্বিত চোখে দেখল তার যাওয়ার পানে।
সবার খাওয়া শেষ হতেই আনিফা বলল,‘সবাইকে কিছু বলার ছিল। আশা করি আমাদের সিদ্ধান্তে সবাই খুশি হবে।’
সবাই উৎসুক চোখে তাকাল আনিফার দিকে। মামুনও চায়ের কাপ হাতে বসে আছে সোফায়। অর্থাৎ সেও একজন শ্রোতা এখন। আনিফা তাকে তাড়া দিয়ে বলল,‘কিগো! কিছু বলো?’
মামুন কাপটা হাত থেকে রেখেই সবার দিকে তাকাল।
‘আমার কি কিছু বলা উচিত?’
’এসব কী? তুমি না বললে কে বলবে?’
‘তুমি বলো। আমি শুনছি।’
আনিফা আর কথা বাড়ালো না। বলতে যেতেই নিহার কল আসে। সে কিছুটা বিরতি নিতে চাইলেই আনিফা বাধা দিল,‘এখানে তোমার থাকা জরুরী। পরে কথা বলে নিও।’
নিহা বেশ খানিকটা অবাক হলো। সে নিজের মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আনিফা এসেই মাহিনূরের চোখাচোখি বলল,‘বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে তাই না? আমি বুঝিয়ে বলছি। এবং আমি মনে করি এতে সবাই খুশিই হবে।’
‘খোলাসা করে বলুন ভাবী। আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?’
‘অনেক বড়ো সমস্যা। সমাধান করতেই আসা। শুনলাম আমার ছেলে আপনার মেয়েকে খুব পছন্দ করে। আপনার ভাইও দ্বিমত করেনি এটা নিয়ে। আমার জানামতে নিহাও হয়ত বর্ষণকে পছন্দ করে। তাই যদি চান তাহলে ওদের কথা ভাবতে পারি।’
নিহার চক্ষু চড়কগাছ। কানে কী ঠিক শুনল নাকি ভুল, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। এক পলক তাকাল বর্ষণের দিকে। বর্ষণ মৃদু হাসল। নিহা সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিয়ে মাহিনূরের দিকে তাকাল। মাহিনূর বলল,‘আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে যাব। এই মুহুর্তে এসব ভাবতে পারছি না।’
পরপরই নিহার দিকে তাকিয়ে দেখল তার কথায় অসন্তুষ্ট হয়েছে। মুখ শুকনো করে মাথা নিচু করে ফেলল। সাথে সাথেই আনিফা বলল,‘মেয়েকে সুখী দেখতে চান না? মেয়ে যদি বর্ষণকেই পছন্দ করে এতে আমরা কীভাবে দ্বিমত করি? আমি চেয়েছি বরাবরই ছেলেমেয়েরা সুখে থাকুক। তাদের সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি।’
মামুনও বলল,‘তুই দ্বিমত করতে পারিস, এটা তোর অধিকার। কিন্তু আবেগের বশে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না। আশা করি ভেবে বলবি যা বলার।’
মাহিনূর বলল,‘আপনারা চাইছেন, আমি আর দ্বিমত করব না। তবে মেয়ের এবং মেয়ের বাবার মতামত থাকলেই বিষয়টা এগোবে। তার আগে আমি কিছু বলতে পারছি না।’
আনিফা নিহাকে জিজ্ঞেস করল,‘তুমি কি রাজি?’
নিহা চুপ করে রইল। বর্ষণের বুকের ভেতর স্রোত বয়ে যাচ্ছে। নিহার উচ্চারিত কথার জন্য সে অপেক্ষা করছে। যদিও তার প্রতি অনুভূতিগুলো এখনো জোড়ালো হয়নি। তাও চাইছে নিহা রাজি হোক। মাহিনূরও সুর মিলিয়ে জিজ্ঞেস করল,‘তুমি কি সত্যিই রাজি? আমি তোমার মতামতের বিরুদ্ধে যাব না। তুমি না চাইলে কিছুই হবে না।’
নিহা কিছুটা ভাব নিয়েছিল। সাথে সাথে হ্যাঁ বলে দিলে সবার সম্মুখে খারাপ দেখা যেতে পারে তাই চুপ করে ছিল। হঠাৎ করেই মুখ খুলল,‘আমি রাজি!’
বলেই আর এক মুহূর্তও দেরী করল না। অনেকটা দৌড়েই চলে গেল নিজের ঘরে। সবাই আনন্দের হাসি দিল। অবশেষে সমাধান এবং সমাপ্তি হলো সমস্যার।
নিহা প্রাণভরে শ্বাস নিল। ল’জ্জায় আড়ষ্ট সে। পেছন পেছন এলো বর্ষণ। বর্ষণকে দেখতেই হঠাৎ কেমন ল’জ্জা পাচ্ছে। ভিন্ন কিছু অনুভব করছে। আজকের অনুভূতি অন্যদিনের তুলনায় আলাদা। বর্ষণ হেসে বলল,‘লুকিয়ে কান্না করেছ, অথচ আজ সিদ্ধান্ত জানাতে অনেক দেরী করলে! কারণ কী, জানতে পারি?’
নিহা বর্ষণের দিকে না তাকিয়েই বলল,‘জানা নেই।’
‘আমি তোমার স্বামী হব দুইদিন পর। এতো ল’জ্জা পাচ্ছ কেন? মনে হচ্ছে আগেই ভালো ছিলে। না চাইতেও কেমন কাছে চলে আসতে। এখন মনে হচ্ছে তোমার কাছে যেতে চাইলেই হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবে তুমি।’
‘একদম নয়!’
‘তাহলে প্রমাণ করো! আমি জানি, তুমি পারবে না। তোমার সব সাহস উবে গেছে। এখন তুমি ভীতু।’
নিহা সাথে সাথেই বর্ষণের মুখোমুখি দাঁড়াল। তার দীর্ঘ গড়নের দিকে তাকিয়ে একবার ঢোক গিলল। পরপরই বলল,‘আমি অনেক সাহসী। তবে এখন….’
‘অর্থাৎ এখন পারবে না বলছ তাইতো? আমি আগেই বুঝেছি। তুমি ভীতুর ডিম।’
‘আমাকে রাগিয়ে দিও না। না হয়….’
কী বলবে খুঁজে পেল না নিহা। বর্ষণের দিকে চোখ নিবদ্ধ করল। কিন্তু সাথে সাথেই বলল,‘নিজেকে দুর্বল লাগছে। আগে এমনটা হয়নি আমার সাথে।’
‘কারণ, আগে কখনো এভাবে অনুভব করোনি। আমিও হয়ত তোমার পরিবর্তনের জন্যই ভালোবেসেছি।’
নিহার মন খারাপ হয়ে গেল। বলল,
‘একটু পরেই হয়ত আমাকে অহনা ভাববে। নিঃসন্দেহে মেয়েটা সুন্দরী, আমি তার থেকে সুন্দরী নই। কিন্তু ওর থেকে বেশি ভালোবাসতে পারব হয়ত। তুমি কেন বারবার ওর কথা বলো?’
বর্ষণ অহনার ঠোঁট স্পর্শ করে। চোখ বন্ধ করে নেয় নিহা। তার নিশ্বাস গাঢ় হয়ে এলো। ঠোঁট মৃদু নড়ে ওঠল। বর্ষণ বলল,‘ওসব অতীত! আমাদের মাঝে আর কেউ না আসুক। আমি দুঃখিত! হয়ত ভুলতে পারছিনা অহনাকে। কিন্তু কথা দিলাম, বিয়ের আগেই ওর কোনো অস্তিত্ব নিজের মাঝে রাখব না। আমার নিঃশ্বাসেও তোমাকেই রাখব। তাহলে হবেতো?’
নিহা কিছু বলল না। বর্ষণ ধরে নিল, মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। আর এক মুহূর্তও দেরী করল না নিহার কোমল ঠোঁটজোড়া স্পর্শ করে দিল। মিশিয়ে নিল নিজের পুরুষালী ঠোঁটের সাথে। সূচনা করল নতুন এক অনুভূতির। নিহা বর্ষণের ডাকে সাড়া দিয়ে চুম্বন দীর্ঘ করল। শিহরিত হয়ে উঠল দুটি কোমল মন।
সকাল হতেই ব্যাগপত্র নিয়ে বের হলো মাহতিম। আনিফা তড়িঘড়ি এগিয়ে আসে। অহনা না চাইতেও মাহতিমের বিষয়ে দৃষ্টি দিল। কেন যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। জানার আগ্রহটাও বাড়লো। মাহতিম বাঁকা চোখে অহনাকে দেখল, পরপরই বলল,‘চারদিনের ট্যুরে যেতে হচ্ছে সিলেট। ট্রেইনিং আছে এবং কিছু বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রধান বলেছিল, তা এখনো জানানো হয়নি। গেলেই জানতে পারব। আপাতত যেতে হবে।’
অহনার চোখে-মুখে বিষণ্ণতা ফুটে ওঠল। তা প্রকাশ করল না সে। মাহতিম চাইছিল যাওয়ার সময় অন্তত অহনা তার সাথে কথা বলুক। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে অহনা নিজের ঘরে চলে গেল।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
পাঠকমহলের জন্য সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership