ছায়া মানব ২
৪৮.
যে তিনজন অপরাধীকে আটক করা হয়েছে তারা আর বেঁচে নেই। সকাল সকাল এমন মেসেজ আসতেই মাহতিম বেশ চমকে ওঠে। দ্রুত অনুজকে কল করে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে অনুজ বলল,‘বিষয়টা ভৌতিক অনেকটা। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুই। তিনজন অপরাধীই মারা গেছে। তাও আবার কাঁচের প্রভাবে। কাঁচ খেয়েই মৃ’ত্যু হয়েছে মেডিকেল রিপোর্ট বলল। এটা বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু এটাই সঠিক। জেলখানায় তো আর কেউ তাদের উত্তেজিত করেনি কাঁচ খাওয়ার জন্য! করলেও তিনজনের বিষয়টা মাথায় আসলেই কিছু ভাবার থাকে না।’
‘আর কোনো সমস্যা ছিল তাদের?’
‘না, কাঁচই মৃ’ত্যুর কারণ।’
‘তবে কি কোনো প্রমাণ পাব না? কে সে, যে আমার পেছনে লেগেছে?’
‘বলতে পারছি না।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মাহতিম। দ্রুত তৈরি হয়ে নিল। সকালের নাস্তা না করেই রওনা দিল থানায়। লাশ তিনটাকে দেখেই তার আত্মা কেঁপে ওঠে। এতটা নিষ্ঠুর মৃ’ত্যু হয়ত তারা আশা করেনি। ডাক্তারের সাথে দেখা করল মাহতিম। সে আরও একটি তথ্য দিল,
‘মৃত্যুটা হয়েছে এখন থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা আগে। অর্থাৎ রাত তিনটার পর পরই। তিনজনের রক্তেই ড্রাগস পাওয়া গেছে। এবং মদ্যপান করার কারণেই তাদের মৃত্যু হলো। মদের সাথেই কাঁচের গুঁড়ো মিশ্রিত করা ছিল।’
মাহতিম প্রশ্ন করেই বসল,‘জেলের ভেতর কে তাদের জন্য মদের ব্যবস্থা করবে? আদৌ কি সম্ভব?’
‘দায়িত্বে যারা ছিল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত। তারাই জানবে। হয়ত কেউ ইচ্ছে করেই এমন করেছে।’
ক
মাহতিম কিছু একটা ভাবে। পর পরই অফিসে চলে যায়। উপস্থিত সবার পাশাপাশি আশিশ, অনুজ, নাজসহ অনেকেই ছিল। অর্থাৎ উচ্চপদস্থ সবাই উপস্থিত সেখানে। মাহতিম আসতেই আলোচনা শুরু হয়। প্রধানের দায়িত্বে মাহতিম থাকায় সহ্য হলোনা অনেকের। আলোচনা বহির্ভূত কথা বলতেই উদ্যত হয় মাহতিম। কিন্তু কোনো একটা বাধায় থেমে যায়। সবশেষেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,‘আমার কোনো শত্রু আছে বলে জানা নেই আমার। সবাই বন্ধু। যারা আমাকে বন্ধু ভাবেনা, তাদেরকেও ভালোবাসি। গতদিন রাতে আমার ফিয়ন্সের ওপর অ্যাটাক করা হয়েছিল। তাকে অপহরণ করে বন্দি করা হয়েছিল এবং আমার দিকে শর্ত আরোপ করা হয়েছিল, তাকে উদ্ধার করতে হলে নিজের পদ ছাড়তে হবে। বিষয়টা জেনেই বুঝেছি, আমার সহচরদের মাঝেই কেউ এমনটা করেছে। হয়ত সে আমার প্রতি খুশি নয়। এখনো আমার কোনো অভিযোগ নেই। যে এ অপরাধ করেছে তাকে ক্ষমা করলাম। শান্তি চাই প্রতিবার। তাই যে আমার ক্ষতি করতে চাইছ গোপনে, থেমে যাও। আমরা দেশ বাঁচাতে শপথ নিয়েছি, দেশ রক্ষার্থে অস্ত্র ধরেছি, একে অপরের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করতে নয়। আমাদের লক্ষ্য একই থাকতে হবে, আমাদের ধ্যান-ধারণা একই থাকতে হবে। এভাবে নিজেদের মাঝে লড়াই করলে নিজেরাই ধ্বংস হব। দিনশেষে অসুখী হয় সবাই। তাই বলছি থেমে যাও। এ রেষারেষি জমিয়ে রেখো না। আমি ভালোবাসা চাই, বিপরীতে ঘৃণা চাই না।’
নিস্তব্ধতার মাঝেও সবাই সায় দিল। প্রকৃত অপরাধী হয়ত দমে যাওয়ার পাত্র নয়। আশিশ মাহতিমের কাঁদে হাত রেখে বলল,‘সর্বাবস্থায় সাথে আছি বন্ধু।’
মাহতিম ভরসার হাত পেয়ে হালকা হাসল। এতকিছুর পরেও বন্ধুত্বের হাত পেয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত সে,
‘পাশে চাই সবসময়।’
নাজ এসেই বলল,’সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। জানতাম না তোমার ফিয়ন্সে আছে। কতদূর তবে? বিয়ে করছ কবে?’
‘ভাইয়ের পরেই আমার পার্ট। আশা করি পরের মাসেই করব।’
‘এক্সাইটেড মনে হচ্ছে। তো আমাদের হবু ভাবীকে কি দেখতে পারি?’
‘সিউর, কেন নয়?’
‘আজ ডিনারে আসতে বলো তাহলে। দেখা হয়ে যাবে।’
পাশাপাশি অনুজ আর আশিশও সায় দিল। মাহতিম আর না করল না। বন্ধুদের সাথে সেও পরিচয় করাতে চায় অহনাকে। এরই মাঝে এলিনা আসে। তাদের আলোচনা করতে দেখে জিজ্ঞেস করল,‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে?’
আশিশ অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বলল,‘ডিনারের আয়োজন চলছে।’
‘ওয়াও! দারুণ ব্যাপার। আমিও জয়েন করতে পারি?’
মাহতিম বলল,‘হুম! পরিচিত একজনের সাথেই দেখা হবে আজ। তুমি থাকলে আরও ভালো লাগবে।’
আশিশ ঠিক সহ্য করতে পারেনা এলিনাকে। একটু সুযোগ পেলেই কথা শোনাতে ছাড়ে না। বলল,‘দিন দিন শরীরের কী হাল হচ্ছে! এখন থেকেই শরীর কমাও, না হয় বিয়ে হবে না।’
‘আগে নিজের দিকে তাকাও। চেহারাটা ছাড়া আর কিছুই সুন্দর দেখতে পাই না। পেটটাও মাঝ নদীতে ভাসমান। নিজে ঠিক হয়ে আমাকে বলো।’
‘আমাকে দেখে এখনো মেয়েদের হৃদস্পন্দন থেমে যায়।’
‘এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে যেকারো স্পন্দন থেমে যাওয়ার কথা। ভাগ্যিস সবসময় চশমা পরেছি। না হয় আমারও একই অবস্থা হতো।’
‘কানা বলেই এই অবস্থা।’
মাহতিম মাঝখান থেকে দুজনকে থামিয়ে দেয়,‘বুঝলাম না। তোমরা কি বাচ্চা নাকি? এভাবে পায়ে পা মিলিয়ে ঝগড়া করো কেন? থেমে যাও, না হয় ডিনার ক্যান্সেল।’
‘আমি না। ও করছে, ওকে থামাও।’
এলিনার কথায় আরও রেগে যায় আশিশ,
‘আমি না, তুমি ঝগড়া করছ। যে ছেলে তোমাকে বিয়ে করবে তার জীবন ধ্বংস। আমি বাপু আগে থেকেই মাইকিং করে দেব, কোনো ছেলেই যেন তোমাকে বিয়ে না করে।’
‘ত্রিশ পেরিয়ে বুড়ো হয়ে যাচ্ছ, এখনো একটা মেয়েও পটাতে পারলে না। আবার আমাকে অভিশাপ দাও।’
‘তোমার যেন আছে?’
‘সবাই চুপ।’
মাহতিম চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,‘আশা করি রাতে দেখা হবে। এখনের জন্য বিদায়।’
সে চলে গেল। এলিনাও মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। নাজ আর আশিশ একসাথেই বের হলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পর পরই অনুজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও রওনা দিল।
সন্ধ্যা হতেই মাহতিম বাড়ি গেল। অহনা ঘুমাচ্ছিল! মাহতিম গিয়েই অহনার ঘরে ঢুকে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করল। এ অবেলায় ঘুমাচ্ছে দেখে রাগও হলো খুব। খুব বেশি ঘুমায় এ মেয়ে। মাহতিম কাছে গিয়েই কানে সুড়সুড়ি দিল। অহনা কিছুটা নড়ে উঠতেই আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। মাহতিমও একপাশে ঝুঁকে অহনার কপোলে চুমু দেয়। মুহুর্তেই ঘুম উড়ে যায় অহনার। আচমকা জেগে উঠেই বিচলিত হয়ে পড়ে। মাহতিমকে পাশে দেখেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে,
‘তুমি এখন?’
‘কয়টা বাজে খবর আছে? এই অবেলায় কেউ শুয়ে থাকে?’
‘ঘুম পেলে কী করব?’
‘আমার সাথে চলো। এক জায়গায় যাব।’
অহনা কিছুটা অবাকের সুরেই প্রশ্ন করে,‘কোথায়?’
‘বন্ধুরা বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে। না করতে পারিনি। যদি যাও ভালো লাগবে।’
‘তুমি না বললেও যাব। ইচ্ছে করছে বাইরে যেতে।’
‘তাহলে তৈরি হয়ে নাও।’
অহনা উঠে যেতেই মাহতিম এক ঝটকায় অহনাকে নিজের কাছে টেনে নেয়,
‘যত দেখি ততই ভালো লাগে। ছাড়তে ইচ্ছে করে না।’
অহনা লজ্জায় মিইয়ে যায়। আড়ষ্টতা ঘিরে ধরে চারিদিক থেকে। আধো আধো কন্ঠে বলল,‘বৃদ্ধ হয়ে গেলে এত ভালোবাসা থাকবে তো?’
‘কখনোই শেষ হবে না। মৃত্যুর পরেও পিছু নেব। শুধু তুমি আমাকে ভুলে যেও না। আমাকে খুঁজে নিও, চিনে নিও আপন করে। ’
অহনা নিজে থেকেই মাহতিমকে আলিঙ্গন করে। কেঁপে উঠে প্রতিটি লোমকূপ। শিহরণে তলিয়ে গিয়ে মাহতিম অহনাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিল,
‘নিজে থেকেই আগলে নিলে। সামলাই কী করে বেহায়া মনকে?’
অহনা কিছু বলল না। লজ্জায় মুখমণ্ডল আরক্ত। থেকে থেকে শরীরে কাঁপুনি হচ্ছে। পর পরই সরে গিয়ে বলল,‘এবার তৈরি হয়ে আসি?’
দেরি করল না। তৎক্ষণাৎ ওয়াশরুমে চলে গেল। মাহতিমও নিজের ঘরে যায়। ছেলেদের তৈরি হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। মাত্র দশ মিনিটের মাথায় এসে হাজির হলো সে। কিন্তু অহনা এখনো ওয়াশরুম থেকেই বের হলো না। মাহতিম অপেক্ষা করছে। অনেকটা সময় চলে যেতেই বের হয়ে এলো। মাহতিমের কপাল কুঁচকে এলো। অহনা ছোট ড্রেস গায়ে দিয়ে বের হল। রক্ত চড়ে বসে মাথায় মাহতিমের,
‘এটা পরে যাবে তুমি?’
‘কেন, ভালো লাগছে না?’
‘বাসরঘরে এটা হলেও চলবে, তাও এখন অন্তত শালীন পোশাক গায়ে দাও।’
অহনা ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে। মাহতিম ওয়্যার ড্রপে থাকা সমস্ত ড্রেস খুঁজে একটা গাউন বের করল,
‘নাও, এটা পরো।’
অহনা কথা বাড়ালো না। গাউন পরেই বের হলো।
‘এবার চলো।’
‘সাজগোজ করব না?’
‘তুমি এমনিতেও সুন্দর। সাজতে হবে না।’
‘ উঁহু!’
বলেই অহনা আয়নার সামনে বসে যায়। মেঝেতে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মাহতিমের নজর সেদিকেই আটকে যায়। অহনা সামান্য পরিমাণ কাজল লাগিয়ে ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক দিল। পর পরই সামনে থাকা নীল লিপস্টিকের দিকে চোখ যায়। এমন রঙের লিপস্টিক মেয়েরা নেয় না কখনো। অথচ অহনা নিল। ভালো লাগা থেকেই এমন রঙের লিপস্টিক পরার সখ হলো। ঠোঁটে লাগাতে গেলেই মাহতিমের চোখ যায় সেদিকে। হাত ধরে ফেলে,
‘নিজেকে পেত্নি সাজানোর খুব সখ বুঝি?’
‘এটার কালার সুন্দর। আমাকে অনেক ভালো লাগবে।’
মাহতিম অহনার হাত চেপে ধরে,
‘আর লাগবে না। এবার চলো।’
‘চুল ঠিক করিনি।’
মাহতিম হাত দিয়ে অহনার চুলগুলো আরও কিছুটা অগোছালো করে নিয়ে বলল,‘এবার ঠিক আছে। পরীর মতো লাগছে তোমায়।’
নিচে নামতেই আনিফা সামনে পড়ে। এভাবে দুজনকে বের হতে দেখে বেশ চমকে যায়। কিছু বলার আগেই মাহতিম বলল,‘বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ওকেও সাথে নিয়ে যাই?’
আনিফা কিছুটা আন্দাজ করে বলল,‘সাবধানে যাবি।’
মাহতিম ভেবেছিল আনিফা বাধা দেবে কিন্তু দেয়নি। তাই দেরি করেনি আর। টেনে নিয়ে গেল অহনাকে গাড়ির সামনে। অহনার মনমরা! একটু ভালোমতো চুলও ঠিক করতে পারেনি। মূলত মাহতিমের সহ্য হয়নি অহনার সাজগোজ করা। সে চায়নি তার বন্ধুদের সামনে আরও কিছুটা সুন্দর লাগুক অহনাকে। এক প্রকার হিংসে থেকেই এমনটা করল।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম