ছায়া মানব ২
৫০.
চোখ খুলতেই অহনা নিজেকে আবিষ্কার করে একটি সুন্দর দোলনায়। সাদায় কারুকাজ, ভীষণ মোহনীয়। চারপাশে তাকাতেই যেন আরও মুগ্ধ হয়ে গেল সবকিছু সাদায় সাদায় পরিপূর্ণ। অহনা পাশেই মাহতিমকে দেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দ্রুত এগিয়ে গেল,
‘তুমি জানতে, আমি শুভ্রতার প্রেমে পড়ি তাই না?’
মাহতিম বিচলিত হাসল। উপরে চোখ নিবদ্ধ করে বলল,‘আমি জানি। শান্তির প্রিয় প্রতীক সাদাতেই তোমার মুগ্ধতা। তাই তো এ আয়োজন।’
‘তবে বিয়েতে কিন্তু নীলেই রঙিন হব। তুমি আর আমি, দুজনেই নীল শাড়ি, নীল পাঞ্জাবি।’
পর পরই বলল,‘ভবিষ্যত নিয়ে খুব বেশি ভাবি, যদি পূরণ না হয়?’
মাহতিম অহনার কপোলদ্বয় স্পর্শ করে বলল,‘অযথা ভয় পাও। আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।’
হঠাৎ করেই অহনা বলে ওঠল,‘অনুজ কি তোমার খুব প্রিয় বন্ধু?’
‘হুম! হঠাৎ তার কথা কেন জিজ্ঞেস করলে? কিছু বলেছে?’
‘ছেলেটার নজর ঠিক লাগেনি আমার কাছে। আমি ভুল হতেও পারি, এমনিতেই বললাম।’
‘আমি জানি। তোমার দিকেও নজর দেবে ভাবতে পারিনি। আরে যে মেয়েকেই দেখে, তাকেই তার ভালো লাগে। আমাদের সহপাঠী ইশতিয়াকে পছন্দ করে, সেও পছন্দ করে। এদিকে আবার নাজকেও পছন্দ করে। আরেকজন আছে রিভা। তাকেও সময় দেয়। অথচ সবার কাছে নিজেকে সিঙ্গেল দাবি করে।’
অহনা বোকা বনে গেল। দেখতে ইনোসেন্ট ছেলেটার এমন অবস্থা?’
মাহতিম কিছুটা সরে গিয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে এলো। সাদায় হাজার রকমের ফুল। অহনার মুখে তৎক্ষণাৎ হাসি ফুটে ওঠে। খুশিতে বিচলিত হয়ে মাহতিমকে আলিঙ্গন করে। সাথে সাথেই আনিফার কল আসে। অনেক রাত হয়েছে তাই বাড়ি ফিরতে বলে। অহনাও ক্লান্ত তাই ফিরে যেতেই উদ্ধত হলো। কিন্তু মাহতিম বলল,‘আর কিছুক্ষণ!’
অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,‘তুমি থাকো। আমি গেলাম।’
অগত্যা মাহতিমকেও ফিরে যেতে হলো।
_
মোহনা আর ইমন পাশাপাশি বসে আছে। কাজ করে অনেক ক্লান্ত তারা। অপেক্ষা করছে সঠিক সময়ের। ঘেমে একাকার হয়ে মোহনা। ইমন কাছে এসেই রুমাল এগিয়ে দেয়,‘ঘাম মুছে নিন।’
মোহনা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,‘আপনি থেকে এবার তুমিতে আসুন। হ্যাংলার মতো আপনি আপনি করবেন না।’
ইমন হাসি চাপা দিয়ে বলল,‘আপনি যেন তুমিতে কনভার্ট হতে পেরেছেন?’
মোহনা বিচলিত ভঙ্গিতে বলল,‘আমি যা ইচ্ছা বলতে পারি, আপনি নন। সো, তুমি বলেই সম্বোধন করবেন।’
‘আচ্ছা, তোমার যা ইচ্ছা। এবার মুখ মুছে নাও।’
মোহনা চুপ করে রইল। ইমন কিছুটা এগিয়ে আসে। মুখোমুখি সংঘর্ষে বসে বলল,‘তোমার কী হয়েছে?’
‘কিছু না। মনটা বিষণ্ণ লাগছে। ঠিক করছি কি? এভাবে কি কারো মনে আঘাত দেওয়া ঠিক হবে?’
ইমন আলতো করে মোহনার কপালে জমা হয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিয়ে বলল,‘বিষণ্ণতার কারণ নিশ্চয় বিহান। আমি কি কিছুতেই তোমাকে খুশি করতে পারি না?’
আচমকা এমন কথা শুনে মোহনা কিছুটা নড়ে বসে। ছেলেটার থেকে সে এমন কথা আশা করেনি। এ দুই দিনে ইমন অনেক করেছে মোহনার জন্য। মন খারাপের চরম পর্যায়ে এসেও হাসানোর চেষ্টা করেছে। মোহনা চট করেই বলল,‘আপনি আমাকে পছন্দ করেন তাই না?’
কাশি উঠে যায় ইমনের। কী বলবে বুঝতে পারেনা। মোহনা সাথে সাথেই কপট রাগ নিয়ে বলল,‘ভীতু ছেলেদের আমি পছন্দ করিনা। আশা করি আপনিও তাদের দলেই আছেন। এবং বিপরীতে আশা করছি তাদের দলে থাকবেন না।’
ইমন অপলকে তাকিয়ে আছে। মোহনার কথার কোনো মানেই সে বুঝতে পারেনি। মোহনা পুনরায় বলল,‘সাহস না থাকলে আমার আশেপাশে ঘুরবেন না। কাউকে ভালো লাগলে ভয় না করে বলে দেবেন। পরবর্তীতে সে গ্রহণ করবে কি না সেটা তার ব্যাপার। নিজের ভালোলাগা চেপে রেখে আর কয়দিন থাকবেন। আপনাকে দেখে এজন্যই আমার খুব বিরক্ত লাগে।’
‘বুঝতে পারলাম না।’
‘আমি সোজা কথা বলা পছন্দ করি। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই হয়ত টের পেয়েছেন। তাই বলছি যদি আমাকে পছন্দ করে থাকেন তাহলে বলে দিন। গ্রহণ করব কি না ভেবে দেখব।’
ইমনের চক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটা কী বলছে এসব? আসলেই কি সে মনের কথা বুঝে গেল? মনের কথা জানালে অপমান করার ধান্দায় নেইতো সে? মোহনা চশমা ঠিক করে পুনরায় বলল,‘এখন থেকে তিন মিনিটের মাঝে নিজের মনের কথা বলবেন। না হয় আমার আশেপাশেও আসবেন না, ভুল করেও না। আমি ভীতুদের পছন্দ করিনা।’
ইমন ভীষণ ঘামছে। আচমকা মোহনার এমন কথা বলার মানে কী? ভাবতে গিয়েও দ্বিধায় পড়ে যায়। কী বলবে এখন? মোহনা কি সত্যি তার মুখ থেকেই কথাটা শুনতে চায়? মোহনা তাড়া দিয়ে বলল,‘আর দেড় মিনিট বাকি।’
ইমন ঢোক গিলে নেয়। নিজেকে শান্ত করে সিদ্ধান্ত নেয়, যা হবার হবে। আপাতত বলে দেওয়াই উত্তম হবে। মোহনা সাথে সাথেই বলল,‘আর ত্রিশ সেকেন্ড।’
ইমন শান্ত হয়ে শ্বাস নিল। পর পরই চোখ-মুখ খিঁচে বলে ওঠল,‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মোহনা।’
মোহনা ঠোঁট টিপে হাসল,
‘বলতে এত দেরি করলেন। যদি জোর না করতাম, তবে না বলেই আজীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। অভ্যাস আছে আপনার। কিন্তু আমি শুনিনি, আবার বলুন।’
ইমন চোখ খুলল। মোহনার অস্বাভাবিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে কিছুটা হকচকিয়ে ওঠে। পর পরই বলল,‘রেগে গেলে না?’
‘শুনতে পাইনি। আবার বলুন, একটু আগে কী বলেছিলেন?’
ইমন পুনরায় বলল,‘তোমাকে ভালোবাসি বললাম।’
‘ঠিক আছে।’
এটা বলেই মোহনা উঠে গেল। নিচে চলে গেল সোজা। ইমন তাজ্জব বনে গেল। যে কথাটা শোনার জন্য উদগ্রীব ছিল মোহনা সে কথাটা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কিছু বললও না। বোকার মতো বসে রইল ইমন। কিছুক্ষণ পর সে নিজেও নিচে যায়। বারান্দায় দিকে চোখ যেতেই দেখল কেউ দাঁড়িয়ে। এগিয়ে যেতেই বুঝল এটা মোহনা। একা একাই হাসছে। ইমনকে দেখতে পেয়েই গম্ভীর হয়ে দাঁড়াল। মোহনা ল’জ্জায় আড়ষ্ট। দ্রুত চলে গেল।
–
মাহতিম লোকাল বাসের মতো গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে বাড়ি এলো। অহনাও বিরক্ত হয়ে পড়ে তার এমন কান্ডে। কিছু বলার আগেই মাহতিম বলল,‘বাড়ি চলে এসেছি। তোমার স্বর্গ এটা। একটু বেশি সময় বাইরে থাকতে পারলাম না।’
অহনা কোনো কথা না বলেই নেমে পড়ল। মাহতিমও ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাড়ির দিকে এগোলো। কেমন অন্ধকার সব। একটা লাইটও জ্বালানো নেয়। অহনা এগোলো না। মাহতিমকে বলল,‘লোড শেডিং হলো নাকি? কোনো লাইট জ্বালানো নেই কেন?’
মাহতিমও পূর্ণ নজর দিয়ে অহনার হাত ধরল,‘গিয়েই দেখা যাবে।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু ভয় হচ্ছে। ভূত আছে কি ঘরে?’
কলিং চাপতেই আপনাআপনি দরজা খুলে যায়। মাহতিম বেশ অবাক হলো। সাথে অহনাও। ভেতরে ঢুকেই মাহতিম ‘আম্মা, আম্মা ‘ বলে কয়েকবার ডাকল। কোনো উত্তর এলো না। বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। অহনা মাহতিমের শার্ট খামচে ধরে। ভয়ে হজম হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সাথে সাথেই তিনটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো মাহতিমের দিকে। কিছু আন্দাজ করার আগেই কিছু একটা স্প্রে করল। বেঁধে ফেলল অহনা আর মাহতিমকে। দুজনই ছোটার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে কিছুই করার রইল না। পরবর্তীতে আরও দুটো ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো। তাদের মুখ বাঁধা কাপড় দিয়ে। শরীরেও কালো পোশাক। অহনা চিৎকার করে ওঠল। মাহতিম বিষয়টা বুঝতে পারেনি এখনো। অহনাকে ডাকল,‘আ-আহি, তুমি ঠিক আছ?’
অহনা উত্তর দিল,‘এসব কী হচ্ছে? আমাদের বন্দি করল কে?’
সাথে সাথেই মুখোশধারী একজন বলল,‘মাহতিম, এবার তোকে মরতেই হবে। আর কতবার বেঁচে যাবি আমার হাত থেকে? আজকে, এখানেই তোর সময় শেষ।’
অহনা আঁতকে ওঠল,
‘না, আপনারা কারা? ওকে মারতে চান কেন? ও আপনাদের কী ক্ষতি করেছে?’
‘তার জন্যই সব হচ্ছে। তাকে মরতেই হবে। দুজনকে মারব না। একজনকে মারলে অন্যজন শোকেই মরে যাবে।’
অহনা চট করেই বলল,‘আমি ওকে মরতে দিতে পারি না। আমাকেই মেরে ফেলুন।’
মাহতিম সাথে সাথে সাথেই বলল,‘শত্রুতা আমার সাথে। যা করার আমাকেই করো। ওর ক্ষতি করো না।’
একজন বলে ওঠল,‘বাহ! কী প্রেম। তবে দুজনকেই মেরে দিই! কী বলো?’
উচ্চস্বরে হেসে উঠল সবাই। মাহতিম বোঝার চেষ্টা করছে মানুষগুলো কারা। চিনতেই পারল না।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম