#তোমার_খোঁজে_এই_শহরে
#পর্বঃ৮
#নবনী_নীলা
“ডক্টর আরফিন আপনি একটা গান ধরুন তো। শুনেছি আপনি অনেক ভালো গান করেন।”, সিনিয়র একজনের কথা ইয়াদ ফেলতে পারলো না। এইরকম এক পরিস্থিতিতে সে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।ছোট বড় সবাই একসাথে মোমবাতি আর চাঁদের আলোয় বসে আড্ডা দিচ্ছে।
টয়াও সেখানে একপাশে বসে আছে। সে মনোযোগ দিয়ে একটা জোনাকি পোকা দেখছে। হ্যা এই সেই টয়া যাকে সবাই অর্নীহা বলে ডাকে। স্কুলের সার্টিফিকেট থেকে টয়া নামটা বাদ পড়ে যাওয়ায় টয়া নামে শুধূ কাছের মানুষরাই তাকে চেনে। বাকি সবাই তাকে অর্নীহা বলে ডাকে।
ইয়াদকে টয়ার চেনার কথা না কারণ সাত বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। তেমনি টয়া নিজেও বদলেছে। হটাৎ দেখায় একেওপরকে চিনতে পারা মুশকিল।
ইয়াদ একটা গান ধরলো।এই গান গাওয়ার পিছনে ইয়াদের একটা কারন ছিলো। টয়ার অনেক প্রিয় গান ছিলো এইটা। প্রায় টয়া কাগজে গানের কিছু লাইন লিখে ইয়াদের বারান্দায় ছুঁড়ে মারতো। অনেকবার টয়াকে গুন গুন করে গাইতেও শুনেছে সে।
গান গাওয়ার সময়,ইয়াদের দৃষ্টি ছিল অর্নিহা নামের সেই মেয়ের দিকে। সে যদি সত্যি টয়া হয় তাহলে তার আচরণেই সবটা বলে দিবে।
সেটাই হলো টয়া একটু অবাক হয়ে তাকালো। অনেকদিন পর আবার এই গানটা তার কানে বাজছে। এই ডাক্তারটাকে দেখে তার মোটেও রোমান্টিক মনে হয় নি যে এমন একটা গান এমনি এমনি গাইবে। লোকটাকে দেখে তো গম্ভীর মেজাজের মানুষ মনে হয়।
টয়া আজ আবার পুরোনো কথাগুলো মনে পড়লো। একসময় এই গানটা সে গুনগুন করে একজনের জন্য গাইতো।
সবাই মনোযোগ দিয়ে ইয়াদের গান শুনলো। গান শেষে সবাই ইয়াদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এর মাঝে ইয়াদ খেয়াল করলো অর্নীহা মানে টয়া উঠে এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ইয়াদের অনুমান কিছুটা সঠিক বলে তার নিজের ধারণা।
কিন্তু কয়েক বছরে এত পরিবর্তন টয়ার মাঝে যে মেয়ে নিজের চুল নিজে বাঁধতে পারে না সে চুল লম্বা করেছে আবার চোখে চশমা।
টয়ার চেহারার মায়াবতী ভাবটা চলে গেছে রূপবতী একটা ভাব এসেছে। ইয়াদ যেনো আবার এই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছে।
নিচে সবাই হই হুল্লোড় করলেও টয়ার আর ভালো লাগছে না।টয়া মোমবাতি হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকেই যাচ্ছিলো।
এতো বড়ো জমিদার হয়ে লাভ হয়েছে কি যদি ঘরে বিদ্যুতের ব্যাবস্থা না থাকে। টয়া বির বির করতে করতে হাটছে। শুধু নামের জমিদার হয়েছে কাজের কাজ কিছুই করে নি। টয়ার ঘর দোতলার গলির শেষ মাথায়। বাড়ির রুম গুলো সারি আকারে একের পর এক। টয়া গলি দিয়ে মোমবাতি নিয়ে হেঁটে যেতেই মনে হচ্ছে কোনো ভুতের মুভির সিন। মোমবাতি হাতে এবার তার রাক্ষসদের সাথে লড়াই করতে হবে।
হটাৎ ভীষণ বাতাস শুরু হলো, জমিদার বাড়ির প্রতিটা জানালা বাতাসের সাথে বাড়ি খাচ্ছে একে অপরের সাথে।বাতাসে মোমবাতির আলোর নিভো নিভো অবস্থা হয়েছে হাত দিয়ে সেটা সামলানো যাচ্ছে না। হুট করে বাতাস বইতে শুরু করেছে কেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাসে মোমবাতি নিভে গেলো। টয়া ঘাবড়ে গেল। সে নিজের রুমে ফোন নিতে যাচ্ছিলো কিন্তু মোমবাতি নিভে যাওয়ায় সে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তার মারাত্মক ভয় হচ্ছে।
নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেও উপায় হলো না চাঁদের আলোর কারণে আরো ভয় লাগছে। এই পুরনো জায়গায় কোথায় কি বাসা বেধে আছে কে জানে। যেদিকে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেও এসে তাকে গিলে খাবে। নিজের জায়গা থেকে এক পা বাড়াতে পারছে না টয়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। এমন সময় কারোর হাঁটার শব্দে বুকের ভিতরটা তার ধুক করে উঠলো। তার আত্মাটা মনে হচ্ছে এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে।
টয়া আর কিছু না বলে একটা চিৎকার দিয়ে পিছনের দিকে দৌড় দিতেই অন্ধকারে ইয়াদের বুকে এসে ধাক্কা খেল। ধাক্কা খেয়ে আরো জোরে চিৎকার করতেই ইয়াদ নিজের ফোনের টর্চটা অন করলো। ইয়াদ বুঝতে পারছে না টয়ার চিৎকারের কারন কি? ইয়াদ কে ভুত ভেবে থাকলে ভূতকে জড়িয়ে ধরে কেনো চিৎকার করবে। টর্চের আলোয় টয়া চোখ খুললো। তারপর ইয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে সরে আসলো। কিন্তু তার ভয় কমেনি তাই ইয়াদের শার্টের হাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টয়া ভয়ে এমন দৌড় দিয়েছে যে চশমাটা হারিয়ে ফেলেছে। ইয়াদের বুঝতে বাকি নেই এই মেয়েই টয়া কারণ চশমা পরে থাকায় টয়ার চোঁখ স্পষ্ট দেখা যায়নি, মেয়েটার চোখ আর ভ্রুয়ের কাছে দুইটা ছোটো তিল বলে দিচ্ছে এই মেয়েই টয়া।
ইয়াদ আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভয়ার্ত টয়াকে প্রশ্ন করলো,” তোমার পুরো নাম কি?”
এমনিতে ভয়ে টয়ার হাত পা কাপছে। কিন্তু এই লোক কি হয়েছে?ভয় পেয়েছো কেনো? না জিজ্ঞেস করে পুরো নাম জানতে চাইছে। লোকটার কোনো বিবেক বোধ নেই নাকি?
কাপা কাপা গলায় অর্নীহা তাবাসসুম বলে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে টয়া। নাম শুনে ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
টয়ার সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।টয়া খালি এদিকে ওদিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইয়াদ একটু বুদ্ধি খাটিয়ে প্রশ্ন করলো,” এতো বড়ো নামে ডাকা যায় নাকি? ডাকনাম বলো।”
টয়া এই লোকটার হাব ভাব বুঝতে পারছে না। কিসব প্রশ্ন করছে লোকটা। ভয়ের চোটে বাড়তি কথা বলার সাহস নেই তার মধ্যে তাও ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে বললো টয়া।
ইয়াদের চোখে মুখে যেনো অন্য রকম খুশি। ইয়াদ একটু হেসে বলল,” চিৎকার করছিলে কেনো?”
টয়া যেনো এই প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিল সে গর গর করে বলতে লাগলো। ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে টয়ার কথা শুনছে সব পাল্টালেও টয়ার কথা বলার ভঙ্গি এক রকম আছে।ইয়াদ টয়াকে আসস্ত করে বললো, সে যেটা শুনেছে সেটা ইয়াদের পায়ের আওয়াজ ছিলো নীচে অনেক গন্ডগোল তাই সে উপরে নিজের রুমে যাচ্ছিলো।গন্ডগোলের কারণেই টয়ার চিৎকারের শব্দ কারোর কানে পৌঁছায় নি।
ইয়াদ আবার প্রশ্ন করলো,” তুমি যাচ্ছিলে কোথায়?” প্রশ্নে টয়া ফোন আনতে যাওয়ার কথা বললো। ইয়াদ টর্চের আলো বাড়িয়ে দিয়ে বললো,” যাও তাহলে নিজের ফোন নিয়ে আসো।এবার তো জানতে পেরেছো যে ওটা আমি ছিলাম।”
টয়া কাদো কাদো চেহারা করে বললো,” আপনি একটু আমার রুম পর্যন্ত যাবেন? একা একা যেতে ভয় লাগছে।”
টয়ার বাচ্চাদের মতন আবদার শুনে ইয়াদ একটু হেসে বলল,” আচ্ছা চলো।”
ইয়াদ টয়াকে রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিলো টয়া এমন ভাবে হাঁটছে যেনো পিছন থেকে এক্ষুণি কেউ এসে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। রুমে পৌছে টয়া বললো,” আপনি একটু লাইটা ধরে দাড়ান। আমি এক্ষুনি ফোনটা নিয়েই বেরিয়ে আসবো।”
ইয়াদ হা সূচক মাথা নাড়ল। টয়া যেনো ট্রেনের বেগে গিয়ে ফোনটা নিয়ে বাইরে এলো। তারপর ইয়াদকে প্রশ্ন করলো,” আপনি এখন কি নিচে যাবেন?” ইয়াদ এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,” ঠিক বুঝতে পারছি না।”
টয়া হাসো হাসো করে বললো,” বুঝতেই যখন পারছেন না।তাহলে চলুন নিচে যাই। আমিও নিচে যাবো, পরে আবার আপনার ভয় লাগবে একা একা।” বলেই একটা ঢোক গিললো টয়া।
ইয়াদ একটা ভ্রু তুলে টয়ার দিকে তাকালো নিজের ভয়টা সে ইয়াদের ঘাড়ে দিয়ে দিচ্ছে। নিজের যে একা একা নিচে যেতে ভয় লাগছে সেটা বলতে পারছে না। ইয়াদ ব্যাঙ্গ করে বললো,” আসলেই একা একা যেতে গেলে যদি কারোর পায়ের আওয়াজ পাই তখন ভয় লাগবে, চলো একসাথেই যাই।”
টয়া হালকা করে মুখ বাকিয়ে তাকালো। কিন্তু তার বলার বা করার আপাদত কিছুই নেই। তাই চুপ থাকাই ভালো। টয়া অন্ধকারে পা বাড়াতেই কোনো কিছুর ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেলো। পা সরিয়ে দেখে চশমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে সে। চশমাটা হাতে নিয়ে একবার আড় চোখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,” অন্ধকার তো তাই দেখতে পাই নি।” ইয়াদ ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে মাথা নাড়ল। টয়া মুখ কালো করে হাঁটা শুরু করলো।ইয়াদ টয়ার কাণ্ডে বেশ মজা পাচ্ছে। নিচে চারিদিকে মোম আর হারিকেন জ্বালানো টয়ার মনে হচ্ছে সে আফগানিস্তানের কেনো জঙ্গলে আছে। রাতের বেলা জমিদার বাড়ির বাহিরে চোখ গেলেই শুধু চাঁদের আলো। আশে পাশে মানুষ কম বলবো কি নেই বললেই চলে।
ভয় পেয়ে তিনটা মোমবাতি আর দুইটা হারিকেন সাথে নিয়ে বসে আছে সে। টয়ার ফ্রেন্ডরা বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি করছে তবে এতে টয়ার মাথা ব্যাথা নেই, হাসুক ওরা। যত হাসি ততো কান্না।ইয়াদ টয়ার থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না।আচ্ছা টয়ার কি ইয়াদকে মনে আছে ? নাকি সত্যি ইয়াদকে ভুলে গেছে।
[ চলবে ]
#তোমার_খোঁজে_এই_শহরে
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122115225080106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc