প্রজাপতির_রং🦋
Part_14
#Writer_NOVA
— সরি, মিসেস এনাজ আহমেদ। আমরা আপনার ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না।
ডাক্তারের কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।আমি ধপ করে নিচে বসে পরলাম।আমার চারপাশ চরকির মতো ঘুরছে।শেষ পর্যন্ত আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটা আমি হারিয়েই ফেললাম।আমার নাভান আমাকে ছেড়ে চলেই গেলো। গগণ বিদারক এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম।তায়াং ভাইয়া আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখছে।কারণ অলরেডি আমি পাগলামি শুরু করে দিছি।ভাইকে জড়িয়ে ধরে আমি কান্না করছি।ভাইয়ার চোখেও পানি।
আমিঃ ও ভাইয়া দেখ না ওরা কি বলছে? আমার নাভান নাকি বেঁচে নেই। ওরা ভুল বলছে।আমার ছেলে আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেই না।আমার ছেলেকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে গেলো।ওরা সবাই মিথ্যে বলছে।নাভান আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না।ছাড় আমাকে,ছাড় বলছি।আমি আমার ছেলের কাছে যাবো।ও একা ভয় পাচ্ছে তো।তোকে ছাড়তে বলছি তায়াং ভাইয়া।
আমি তায়াং ভাইয়াকে ইচ্ছে মতো মারছি।কিন্তু তায়াং ভাইয়া আমাকে নাভানের কাছে যেতে দিচ্ছে না। এরিন,হিমিও মুখ চেপে কান্না করছে।তায়াং ভাইয়ার চোখেও পানি।আমি অনেক কষ্টে তায়াং ভাইয়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দৌড় দিলাম নাভানের কাছে।আমার পিছু পিছু তায়াং ভাইয়া, এরিন, হিমিও আসছে।কেবিনে আসতেই দেখলাম সাদা কাপড়ে আমার ছোট ছেলেকে ঢেকে রাখছে।আমি এক টানে নাভানের মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
আমিঃ এই তো আম্মু চলে এসেছি। তোর কিছু হবে না। তোর আম্মু তোর কিছু হতেই দিবে না।এরা কি মানুষ? আমার জ্যন্ত ছেলেটাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো।ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো না।তায়াং ভাইয়া চল তো এখান থেকে। একটা ডক্টরও ভালো না।ওরা পড়াশোনা না করেই ডাক্তার হয়েছে। আমার জীবিত ছেলেটাকে মৃত ঘোষণা করে দিলো।দেখ, ও আমার দিকে কিরকম হাসি মুখে ঘুমোচ্ছে। আমি জানি একটু পরেই আমার কলিজার টুকরো ঠিক ভালো হয়ে যাবে। তুই ঠিক দেখিস।এরিন দেখ না ওর মুখটা কি সুন্দর দেখাচ্ছে ঠিক যেনো রাজপুত্র। ও এখনো হাসছে।চেহারাটা কত নিষ্পাপ। হিমি তুই বল না রে। আমার নাভান তো বেঁচে আছে। নয়তো কেউ এভাবে হাসে।তোরা সবাই মিথ্যে বলছিস আমি জানি।আমার ছেলেকে তোরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছিস।আমি আমার ছেলেকে নিয়ে ভালো আছি তা তোদের ভালো লাগছে না।
তায়াং ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি নাভানের সারা মুখে অজস্র চুমু খেতে লাগলাম।শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখছি।
আমিঃ এই তায়াং ভাইয়া, নাভানের শরীর এতো ঠান্ডা কেন রে? ওরা কি আমার ছেলেকে শরীর ঠান্ডা করার কোন ঔষধ দিয়েছে? আচ্ছা, ও চোখ খুলছে না কেন? নাভান, এই নাভান, লক্ষ্মী বাবাই চোখ খুলো।আমি তোমাকে অনেকগুলো খেলনা কিনে দিবো।একবার চোখ খুলো।
তায়াংঃ নাভান আর নেই নোভা।ও আর কখনো চোখ খুলবে না। সারাজীবনের জন্য ও ঘুমিয়ে পরেছে। আর কখনো চোখ খুলে আমাদের দেখবে না। তোকে আম্মু বলে, আমাকে মামা বলে ডাকবে না।আমাদের ছেড়ে ও চলে গেছে। (কাঁদতে কাঁদতে)
আমিঃ তুই মিথ্যে বলছিস।আমি এসব বিশ্বাস করি না।সর তো আমার সামনে থেকে।
এরিনঃ তায়াং ভাইয়া ভুল বলছে নারে নোভা।নাভান আর কখনও ফিরবে না।
আমিঃ তোরা সবাই এক জোট হয়ে মিথ্যে বলছিস।একটাও আমার ছেলের কাছে আসবি না।যা তো এখান থেকে। জলদী যা।
হিমিঃ পাগলামি করিস না নোভা।একটু বোঝার চেষ্টা কর তুই।
আমিঃ আমি কিছু বোঝার চেষ্টা করবো না।আমার দুচোখের সামনে থেকে সর তো তোরা।তোদের আমার সহ্য হচ্ছে না।
★★★
——– নাভান!!!!!
একটা চিৎকার দিয়ে উঠে বসলাম।সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। শরীর থরথর করে কাঁপছে। কি অলুক্ষ্মেণে স্বপ্ন দেখলাম।হাত বাড়িয়ে লাইটের সুইচ অন করলাম।পাশে তাকাতেই দেখি নাভান আমার সাথে ঘুমিয়ে আছে। এতক্ষণে আমার কলিজায় পানি এলো।আমি তাহলে এত সময় স্বপ্ন দেখছিলাম।এটা একটা খারাপ স্বপ্ন ছিলো।আমি ঘুমন্ত নাভানকেই কোলে নিয়ে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরলাম।ওর ঘুমন্ত মুখে ইচ্ছে মতো চুমু খেলাম।এতে নাভান কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো।কিন্তু আমি ওকে ছাড়লাম না।সেভাবেই শক্ত করে ধরে রাখলাম।হঠাৎ করে এত খারাপ স্বপ্ন দেখার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না।সামনে কি আমার ছেলের ওপর দিয়ে কোন ঝড় ঘনিয়ে আসছে? আমি ওকে এক মিনিটের জন্যও একা ছাড়বো না। সবসময় নিজের সাথে রাখবো।যদি আমার থেকে ওকে কেউ কেড়ে নিয়ে যায়।তাহলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে??
🦋🦋🦋
সময় এখন ভোর ছয়টা।তাজরান ও আরিয়ান জগিং সুট পরে বাইরে বেরিয়েছে।উদ্দেশ্য প্রায় এক ঘন্টা আজ জগিং করবে। ওদের বাসার থেকে মিনিট ২০ হাঁটলেই একটা পার্ক আছে। অবশ্য ঐটা পার্ক নয়।ছোট একটা ঘন গাছ-গাছালির বাগান।তবে সেখানে কতগুলো বসার জন্য বেঞ্চ আছে বলে প্রায় সময় সেখানে মানুষের আনাগোনা দেখা যায়।যার কারণে সবাই এটাকে ছোট পার্ক বলে। তাজরান ও আরিয়ান আজ জগিং করতে করতে এদিকেই এসেছে। তাজের কানে ইয়ারফোন গোঁজা। যদিও ওর ফেভারিট শো এখনো শুরু হয়নি তবুও সে রেডিও শুনছে।
আরিয়ানঃ ভাই, তুই এসব এফএম রেডিও কি শুনিস বল তো? আজকালকার দিনে কেউ এসব শুনে।সকাল, বিকেল যেখানে থাকিস যেই অবস্থায় থাকিস তোকে এফএম রেডিও শুনতেই হয়।কিন্তু কেন?
তাজ কোন উত্তর দিলো না।তীক্ষ্ম চোখে একবার আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে থামলো।ততক্ষণে পার্কের সামনে চলে এসেছে। কোন কথা না বলে হাত দুটো মেলে ব্যায়াম করতে লাগলো।আরিয়ান একটা নিশ্বাস ছেড়ে একটা বেঞ্চে বসে রইলো।ওর কানে হেডফোন গোঁজা। সেখানে গান চালু করে দিয়ে গানের তালে তালে হাত-পা বসে বসেই নাড়াতে লাগলো।তাজ খুব মনোযোগ সহকারে এক্সারসাইজ করছিলো।হঠাৎ ওর চোখ গেলো ওদের থেকে কিছুটা দূরে আরেকটা বেঞ্চের দিকে।সেখানে চুপ করে বসে আছে বছর দুয়েকের একটা বাচ্চা ছেলে। চেহারাটা অসম্ভব মায়াবী।তাজ গুটিগুটি পায়ে বাচ্চা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলো।
তাজঃ তোমার নাম কি বাবু?
নাভানঃ আমাল নাম বাবু না নাবান।
তাজঃ ওহ্ আচ্ছা 😅।তুমি এখানে একা বসে আছো কেন? তোমার সাথে কেউ নেই?
নাভানঃ আমাল আম্মু আছে।এট্টু ঐদিকে গেছে মানি(পানি) আনতে।
ছোট হাতের আঙুল দিয়ে উল্টো দিকে দেখিয়ে দিলো নাভান।তাজ মুগ্ধ চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে নিজের খুব চেনা।আজানা একটা টান অনুভব করছে।আরেকটা জিনিস খেয়াল করে তাজ ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে গেলো। তা হলো বাচ্চা ছেলেটার আর তার পরনে একই রং,ডিজাইনের জগিং সুট। এখন যদি কেউ ওদের দেখে তাহলে চোখ বুজে বাবা-ছেলে ধরে নিবে।
তাজঃ তুমি কি আমার কোলে আসবে?আমি তোমাকে অনেকগুলো চকলেট দিবো।
নাভানঃ না না।আম্মু বলছে কেউর থেকে কিছু না নিতে।আম্মু বকবে।
তাজ অবাক হয়ে গেলো।বাচ্চাটা যথেষ্ট ম্যাচিউর।এত ছোট বয়সে কেউ এতটা গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কিন্তু বাচ্চাটা চোখ, মুখ কুচকে টাস টাস কথা বলছে।কোন কথার উত্তর কি করে দিবে তা ও আগের থাকে যুগিয়ে রাখছে।পারবে নাই কেন? আট মাস থেকে তো নাভান কথা বলতে পারে। আর দুই বছর বয়সে সব কথাই বলতে পারে। আর নিজের ছোট ব্রেণ খাটিয়ে এমন এমন কথা বলে যা বড়রা শুনলে অবাক হয়ে যায়। মনে হবে কেউ শিখিয়ে দিয়েছে। তাজ অপলক চোখে নাভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু সময় ভেবে আবার নাভানকে বললো।
তাজঃ আচ্ছা যাও তোমাকে চকলেট দিবো না। আমার কোলে একটু উঠো।তাহলেই হবে।উঠবে আমার কোলে?
নাভান কপাল কুঁচকে মুখে এক আঙুল দিয়ে বড়দের মতো করে কিছু একটা ভাবলো।তারপর ঘাড় কাত করে কোলে উঠতে সায় দিলো।তাতে তাজ খুব খুশি হয়ে নাভানকে কোলে তুলে নিলো।নাভানকে কোলে নিতেই তাজের সারা শরীরে একটা অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো। তাজের মনে হচ্ছে ওর নিজের ছেলেকে কোলে তুলে নিয়েছে। মনটা নিমিষেই ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো।নাভানকে কোলে নিয়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলো।নাভান ভদ্র ছেলের মতো সব প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলো।তাজ, নাভানের চোখের দিকে তাকিয়ে বরসর একটা ঝাটকা খেলো।চোখ দুটো তার খুব কাছের মানুষের মতো।তার প্রিয় মানুষটা আর এই বাচ্চা ছেলেটার চোখের এত মিল কি করে হলো? তাহলে কি কোন সম্পর্ক আছে তাদের?
আরিয়ানঃ তাজরান ভাই!!!! যাওয়ার সময় হয়ে গেছে আমাদের। এখন ফিরতে হবে।
আরিয়ানের ডাকে হুশ ফিরে তাজের।আরিয়ান দূর থেকে হাত নাড়িয়ে জোরে চেচিয়ে ওকে ডাকছে।তাজ একবার নাভানের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আরিয়ানের দিকে তাকালো।তাজের এখন এই বাচ্চা ছেলেটাকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।মন চাইছে ওকে নিজের সাথে সারাজীবনের জন্য রাখতে।কেন, তা নিজেও জানে না। ঐ যে নিজের রক্তের একটা ঘ্রাণ বলে কথা আছে তো।সেটার থেকে কি এত সহজে মুক্তি মিলে।না চাইতেও নাভানকে বেঞ্চে বসিয়ে দিলো।তারপর ওর কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বিষন্ন মনে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো।নাভান ওর যাওয়ার পানে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাজ অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আবার পেছন ফিরে তাকালো।নাভান এখনো সেম ভাবে তাকিয়ে আছে। তাজের চোখ দুটো নিজের অজান্তেই ছলছল করে উঠলো।সে আর পিছনে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে আরিয়ানেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তাজ দৃষ্টির সীমানা পেরোতেই নোভা পানির বোতল নিয়ে চলে এলো।আজ নাভানকে নিয়ে সকাল সকাল হাঁটতে বের হয়েছিলো।পথিমধ্যে নাভানের পানির তেষ্টা পেয়েছিলো বলে নাভানকে এখানে বসিয়ে পানি আনতে গিয়েছিল। ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু ঐদিকটার রাস্তা ভালো নেই বলে নেয়নি।
আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে।নোভা যদি নাভানকে নিয়ে যেতো তাহলে তো তাজের সাথে আজ দেখা হতো না। যদিও তারা জানে না সম্পর্কে তারা বাপ-বেটা। তবুও দুজন তাদের রক্তের টানের অনুভূতি টের পেয়েছিলো।সেটাই বা কম কিসের।
#চলবে
কেউ আবার বলেন না আট মাস থেকে বাচ্চারা কথা বলে কি করে? আর মাত্র দুই বছরে এত কথা স্পষ্ট করে ও গুছিয়ে কি করে বলে? এক্ষেত্রে আমি একটা কথা বলতে চাই। নাভানের চরিত্রটা আমি আবিকল আমার ভাতিজা আয়ানের মতো করে সাজিয়েছি।আয়ান আট মাস থেকে কথা বলতে পারে। ওর বয়স এখন মাত্র আড়াই বছর। কিন্তু ও সব কথা স্পষ্ট করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। ওর কথা শুনলে আপনাদের মনে হবে কোন চার বা পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে গুছিয়ে কথা বলছে।মাঝে মাঝে এমন কথাও বলে যা শুনে আমরাও অবাক হয়ে যায়।