নিশীভাতি #১২তম_পর্ব

0
858

#নিশীভাতি
#১২তম_পর্ব

“অনেক ভেবে দেখলাম, আপনি ঠিক বলেছেন। মাকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। তাই বিয়েতে আর অমত করবো না আমি”

ফাইজানের ধীর কন্ঠে শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বয়ে গেলো যেন। বিমূঢ়তা, বিস্ময় স্বচ্ছ চোখজোড়া দখল করলো। অসাঢ় হয়ে গেলো যেন হৃদয়। তাহলে কি বিয়েটা হচ্ছেই? কিশোরী হৃদয় সে স্বপ্নগুলো বুনেছিলো এতোটা দিন সেগুলোকে কি গ/লা টিপে হ/ত্যা করতে হবে হুমায়রাকে। এদিকে ফাইজানের কথায় খুশির লহর বইলো শরীফার চোখ, মুখে। বৃদ্ধ শামসু মিঞাও খানিকটা স্বস্তি পেলেন। ফাইজানের আশ্বস্ত কণ্ঠে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো রাশাদকে সে রাজি করিয়ে নিবে। নাতনী বিবাহের দায় থেকে তিনি মুক্ত হবেন। নিশ্চিন্তে শ্বেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারবেন ভেবেই তার শান্তি লাগছে। ফাইজান কিছু সময় হুমায়রার বিভ্রম মুখখানার দিকে চেয়ে রইলো। যেন সে কিছুর জন্য অপেক্ষারত। তারপর মাকে তাড়া দিলো। দ্বিপ্রহর শেষ হতে বেশি দেরি নেই। আতিয়া খাতুন হুমায়রাকেও তাড়া দিলেন,
“বুবু, সাইজাগুইজা যাও। জামাই এর ভালা লাগবো”

কিসের জামাই? কোন জামাই? ভাইজান আসলে এই জামাইকে হালুয়া বানিয়ে দিতেও সময় লাগবে না। হুমায়রা কিছুই বললো না। নিজ স্বভাবের বহিরাগত কাজ সে করে না। তাই দাদীর কথা মেনে শরীফার পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো। ঘর থেকে বের হলেই তার মেদুর মুখখানায় উষার কিরণ ছড়ালো। ভাইজান শহর থেকে ফিরেছে। কিন্তু সাথে সাথে পাশের দূর্বল, ছোট, জীর্ণকায়া নারীকে দেখেও বিস্মিত হলো কিশোরী। রাশাদ এবং ইলহা তখন উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। রাশাদ তার কাপড়ের ব্যাগটা মাটিতে রেখে হাত পা ধুতে গেলো। দাদীকে হাক দিয়ে বলল,
“দাদী, খাবার দাও খিদা লাগছে”

রাশাদের ডাক শুনেই আতিয়া খাতুন বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তাজ্জব হলেন উঠানের অপরিচিত নারীকে দেখে। হাসপাতালে থাকাকালীন আতিয়া খাতুনের সাথে ইলহার দেখা হয় নি। যে কারণে তাকে না চেনাই স্বাভাবিক। আর শহর থেকে অজানা নারীকে বাড়ি নিয়ে আসার মত ছেলে রাশাদ নয়। সে ইহজনমে কোনো নারীর দিকে প্রেমদৃষ্টিতে তাকিয়েছে বলে জানা নেই আতিয়া খাতুনের। তাই তাজ্জব হওয়া জায়েজ। শরীফা এবং ফাইজান অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে গেলো। শরীফা অবশ্য অন্যকারণে অপেক্ষা করছে। একেবারে ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ মনোভাব তার। যেহেতু রাশাদ এসেই গেছে, তাহলে বিয়ের কথা একেবারে এখনি শেষ করবে সে। ছেলের মতিগতির ঠিক নেই, বেঁকে বসতে সময় নেয় না। হাত মুখ ধুয়ে এসে ইলহাকে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো রাশাদ। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“হাতমুখ ধুয়ে আসেন। খাবেন না কি?”

ইলহা সামনের মানুষগুলো বিস্মিত, বিভ্রম, কুন্ঠিত নয়নের ধারে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপরিচিত মানুষগুলোকে দুম করেই তো বলা যায় না, “খেতে দিন”। যদিও সে বিনা দ্বিধায় রাশাদের সাথে তার বাড়ি চলে এসেছে, কিন্তু এখন বেশ সংশয় হচ্ছে। বিব্রতও লাগছে। রাশাদ তার পরিবারের লোকের দিকে তাকালো। হুমায়রা এবং আতিয়া তার মুখপানে চেয়ে আছে, মেয়েটির পরিচয় জানার লক্ষে। রাশাদ বিনা সংকোচে বলল,
“উনি ইলহা, আমাদের সাথে কিছুদিন থাকবেন”
“উনারে তুমি চেনো কেমনে রাশাদ?”

দাদীর প্রশ্নে কিছুটা সময় নেয় রাশাদ। সত্যবাদী রাশাদের মাঝে কিছুটা দ্বিধা স্থান পায়। সত্যটা বললে ঘরের মানুষের ভাবমূর্তি কেমন হবে জানা নেই। তখন-ই পাশ থেকে ইলহা বলে উঠে,
“আমি এখানে নতুন। গ্রামে কিছু কাজে এসেছি। কিন্তু কোথায় থাকবো বুঝতে পারছিলাম না। নাতী… রাশাদ সাহেবের সাথে আমার পরিচয় হাসপাতালে হয়েছিলো। শামসু সাহেবের অসুস্থতার সময় যখন উনাকে চেকাপে এসেছিলাম তখন। এখানে চিনি না আমি। তাই উনার থেকে সাহায্য চাওয়া।“
“আপনে ডাক্তার?”
“জি”
“উনারে চিকিৎসা করিছিলেন নি?”
“জি”

আতিয়া খাতুনের সংশয় মুহূর্তেই কেটে গেল। স্বামীর চিকিৎসা সরল হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। বিনা দ্বিধায় অতিথিকে তিনি আপন করে নিলেন,
“আপনে তালি বুবুর লগে, থাকবেন।“

ইলহা অবাক হলো মানুষটির সারল্যে। শুধু স্বামীর চিকিৎসার কথা শুনেই সে সব ভুলে গেলেন। ইলহার কোনো খারাপ মতলবও থাকতে পারতো। অথচ তিনি বিনা সংশয়ে তাকে বরণ করে নিলেন। শরীফা সেই সময় বলে উঠলো,
“আজ আমরা যাই, পরে একদিন রাশাদের সাথে কথা বলবো। যেহেতু মেহমান এসেছে হুমায়রার আজ যাবার প্রয়োজন নেই”

শরীফার কথায় রাশাদ সেদিকে তাকালো। এতোসময় পর সে লক্ষ করলো এখানে বাহিরের মানুষও উপস্থিত। ফাইজানের দিকে চোখ পড়তেই চোয়াল শক্ত হলো, দৃষ্টিতে অসম্ভব কাঠিন্য প্রকাশ পেলো। কিন্তু ফাইজান বরাবরের মতোই নির্বিকার, নির্লিপ্ত। তার চোখ হাতের সোনালী বেল্টের ঘড়িতে। শীতের বেলা না বের হলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে চোখের পলকে। রাশাদ রুক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“হুমায়রা কোথায় যাবে?”
“উনাদের সাথে মেলায়”

আতিয়া খাতুন সাথে সাথেই উত্তর দিলো। এবং শরীফার উদ্দেশ্যে খুব বিনয়ী স্বরে বললো,
“কি কন, ওর লাইগ্যা কত সময় অপেক্ষা করলেন আর ওয় যাবে না? মেহমান আমি সামলায়ে নিমু। বুবু তুমি যাও হেগোর লগে”
“না হুমায়রা কোথাও যাবে না”

নির্দ্বিধায় বারণ করে দিলো রাশাদ। হুমায়রা চুপ করে রইলো। মনে মনে খানিকটা স্বস্তিও পেলো। শরীফার সাথে সারাদিন থাকতেও তার আপত্তি নেই। কিন্তু ফাইজানের সাথে সময় কাটানোর কথা ভেবে অস্বস্তি লাগছিলো। রাশাদের এমন রুঢ় আচারণে খানিকটা মনোক্ষুন্ন হলো শরীফা। ফলে বলেই বসলো,
“আমাদের সাথে যেতে আপত্তি কোথায়?”
“আপত্তি আর আপত্তি। গতবার কি হয়েছিলো আমি কিন্তু ভুলি নি”
“আমিও ভুলি নি রাশাদ। তবে গতবারের ভুলটা যে এবারো হবে তা তুমি নিশ্চিত হচ্ছো কি করে? “
“হবে না তার নিশ্চয়তাও তো নেই। আমার বোনের দায়িত্ব নিবেন তখন?”
“অবশ্যই। আমি আর ফাইজান যখন তাকে নিয়ে যাচ্ছি। তবে দায়িত্ব বুঝেই নিচ্ছি”

রাশাদ এবার উত্তর দেবার সুযোগ পেলো না। তার আগেই আতিয়া খাতুন ধমকের স্বরে বলে উঠলেন,
“তর্কে যাচ্ছো কেনে রাশাদ, উনারা নিতে চাচ্ছে। তোমার দাদা বলেছেন যেতে। তুমি নাক গলাইয়্যো না”

দাদীর কথার উপর কথা বলার মত অভদ্র নয় রাশাদ। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ দমালো। নিজেকে সংযত করলো। পরমুহূর্তেই কড়া স্বরে ফাইজানের উদ্দেশ্যে বললো,
“সন্ধ্যা হবার আগে ওকে বাড়ি দিয়ে যাবেন। আর দেরি হলে আমাকে ফোন দিবেন”

ফাইজান শান্তভাবে কথাটি শুনলো। হয়তো গুরুত্বও দিলো। তাই ঘড়ির দিকে এক দফা তাকিয়ে খুব নম্র গলায় বললো,
“জি, অবশ্যই। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন”

হুমায়রার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। ক্ষণিকের স্বস্তি উবে গিয়ে মুখখানা পানসে হয়ে গেলো। না চাইতেও ফাইজান নামক ব্যাক্তির সাথে বের হতে হলো। তবে একটা দিক ভালো শরীফা সাথে আছে। নয়তো দূর্বিষহ হয়ে যেত ব্যাপারটি।

******

অপরাহ্নের প্রথম ভাগ। রোদ্দুরের তীব্রতা কমে এসেছে। সূয্যিমামা ঝিমিয়ে পড়েছে পশ্চিমে। রক্তিম আভা ছিটিয়ে পরেছে সফেদ মেঘে। গ্রামের মেঠোপথ। কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলছে পদচলিত ভ্যান। সেই সাথে কৃষ্ণ এলোমেলো চুলে দোলা নিয়ে যাচ্ছে শীতল সমীর। নীলাম্বরে উড়ে যাচ্ছে অগণিত পাখি। যেয়ে আশ্রয় নিচ্ছে নিজের কুঠিরে। হুমায়রা স্বচ্ছ চোখে দেখছে প্রকৃতির মায়া। হাত দুখানা ভর দিয়ে আছে ভ্যানের কাঠে। চার আঙ্গুলের দূরত্বেই বসা ফাইজান। শরীফা ইচ্ছেকৃত তাদের পাশাপাশি বসিয়েছে। হুমায়রা গাইগুই করেছে, লাভ হয় নি। ফাইজান বিনা আপত্তিতে মায়ের জেদ মেনে নিয়েছে। হুমায়রা তাই ঠিক করলো সে শুধু রাস্তা আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। করলোও তাই। কিন্তু পাশের মানুষটির গাঢ় নয়ন তার মাঝেই আবদ্ধ। নির্লজ্জ, বেহায়া, অসংযত দৃষ্টি। অক্লান্ত নয়নে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে আছে ফাইজান। হুমায়রা না তাকিয়েও সেই দৃষ্টির আঁচ বুঝতে পারছে। বা হাত দিয়ে খোলা চুলগুলো কানের পাশে গুজলো সে। বিরক্ততা প্রকাশ করতে চাইলো না। কারণ সামনেই বসে রয়েছে শরীফা। মহিলা এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নন। তাই তাকে চিন্তায় ফেলাতে ইচ্ছে হলো না। শুধু অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ভ্যান থামবে। অবশেষে ভ্যান থামতেই দ্রুত গতিতে নামলো সে। ফাইজান টাকা মিটাতেই দেখলো কিশোরী তার মাকে নিয়ে মেলার ভেতরেই চলে গিয়েছে। তার থেকে ছাড়া পাবার জন্য মরিয়া হয়ে গেছে যেন। ব্যাপারটা না চাইতেও আনন্দ দিলো ফাইজানকে।

মেলায় অনেক বছর পর এলো শরীফা। গ্রামের মেলার ধরণ ই আলাদা। বিভিন্ন দোকান বসেছে, সব ই গ্রামের মানুষের মেধাকে দর্শায়। একপাশে গ্রামের বধুদের সুনিপুন হাতের নকশি কাঁথা, জামা, ওড়না; তো অন্য পাশে রুক্ষ্ণ হাতের মাটির জিনিস। কেউ খাবারের দোকান দিয়েছে, কেউ কাঠের পুতুলের। শরীফার আনন্দ তার মুখে ছলকাচ্ছে। সে এক দোকান থেকে অন্য দোকান যাচ্ছে। অপেক্ষাও করছে না ফাইজান এবং হুমায়রার জন্য। হুমায়রার মনে হলো সে কোনো দশ বছরের বাচ্চাকে দেখছে, যে বহুদিনের বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়েছে। মুক্ত বিহঙ্গীর মতো শরীফাকে দেখে সে ফাইজানকে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনি চাচীকে নিয়ে কখনো ঘুরতে বের হন না?”

ফাইজান নির্বাক চাইলো। হুমায়রার প্রশ্নে জেরার ছাপ ছিলো কি! ফাইজান ইকবালকে জেরা করার সাহসিকতা দেখানোও দুঃসাহসের কাজ। অষ্টাদশী সর্বদাই তাকে অবাক করে, এবার ও করলো। মেয়েটি অপেক্ষা করলো উত্তরের। ফাইজান গাঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“সময় হয় না”
“সব অজুহাত। ব্যাস্ততা মানুষের নিজস্ব সাজানো অজুহাত, সপ্তাহ, মাসে একদিন নিজের মাকে দিলে ব্যস্ততা বাড়ে না”

হুমায়রার শানিত বাক্যে হেসে ফেললো ফাইজান। কন্ঠ কাঁপলো হাসির দোলায়। খানিকটা তাচ্ছিল্য করেই বলল,
“”আপনার ধার কি শুধু আমার জন্য? কারণ ঘরে তো নজরও উঠে না”

ফাইজানের কথায় বিস্মিত হলো হুমায়রা। খানিকটা বিরক্তও লাগলো। সেই বিরক্তির ছাপ মুখেও দৃশ্যতঃ হলো। ফাইজান আবার নিঃশব্দে হাসলো। মেকি হতাশা প্রকাশ করে বললো,
“আমি তো অপেক্ষা করছিলাম আপনার প্রতিবাদের। বলে উঠবেন আমাকে আপনার অপছন্দ। আমার নামে অভিযোগের ঝুলি খুলবেন, যেমনটা মায়ের কাছে করেছেন”
“সেটা আমার অভিযোগ নয়, আপনার প্রতি অভিব্যক্তি। আর আমার ভাইজানের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। সে এই বিয়েতে কখনো সম্মতি দিবে না”

খুব শান্ত গলায় উত্তর দিলো হুমায়রা। ফলে ফাইজানের হাসির বিস্তৃতি বাড়লো। মাথাটা খানিকটা হুমায়রার দিকে ঝুকিয়ে বললো,
“দেখা যাক”

ফাইজানের এমন কাছে কদম পিছিয়ে গেলো হুমায়রার। অপ্রস্তুত হলো ভীষণ ভাবে। এর মাঝেই শরীফার ডাক পরলো। হুমায়রার উদ্দেশ্যে বললো,
“এই হুমায়রা, এদিকে আসো”

হুমায়রা কাছে যেতেই একটা লাল নকশি করে ওড়না তার মাথায় তুললো সে। শুভ্র গায়ে রক্তিম লালখানা যেনো মিশে গেলো। পড়ন্ত লাল আভায় লাল ওড়নায় কি হুমায়রাকে বেশি চোখ ধাঁধানো লাগছে? কে জানে?

********

ইলহার আপ্যায়ন বেশ ভালো করেই হলো। হুমায়রা না আসা অবধি আতিয়া খাতুন তার কাঁধ ছাড়লেন না। মহিলা যে বেশ মিশুক তাতে সন্দেহ নেই। কত দিন এমন মন খুলে কথা বলা হয় না ইলহা হয়তো বলতে পারবে না। আতিয়া খাতুন কথায় কথায় জানতে চাইলেন,
“আপনের বাপে কি করে?”
“উনি ব্যাবসা করেন”
“আর মায়ে?”
“গৃহিনী?”
“ভাই বোন?”
“আমি একাই”
“অহ, তা বিয়াশাদী?”

বিয়ের কথা শুনতেই গত পরশুর বিভৎস স্মৃতি ডানা মেলল। ইলহা বিষন্ন স্বরে বলল,
“না, হয় নি”
“মাইয়্যাদের বিয়া হয়ে যাওয়াই ভালা, এই দেখো না বুবুর সামনে বিয়া”
“রাশাদ সাহেবের বোনের?”
“হ্যা গো, মেলা ভালা পোলা। তাই উনি অমত করে নাই। তুমি বিয়া পর্যন্ত থাইকো। ভালা হইবো”
“এতোদিন থাকা”
“বিয়ার দেরি নাই বেশি, আর দিন ই তো শেষ হয়ে যায় চোখের পলকে”

আতিয়া খাতুন কথাটা বলে পান মুখে পুরলেন। ইলহা হাসলো। এই মানুষগুলোর মাঝে কোনো মারপ্যাচ নেই। সরল তাদের মন। ইলহা মৃদু হেসে বলল,
“এতোদিন থাকলে রাশাদ সাহেব বিপাকে পড়বেন”
“ঐডা আমি দেইখ্যা লমু, তুমি থাইক্যো”
“ঠিক আছে, থাকবো”

****

হুমায়রা ফিরলো ঠিক সন্ধ্যার পর পর। না চাইতেও অনেক কিছু শরীফা কিনে দিলো। এবং জোরপূর্বক সেগুলো হুমায়রাকে নিতে হলো। ফাইজান নিজে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিলো হুমায়রাকে। রাশাদের সাথে দেখাও হলো। সে নামাজ পড়ে ফিরছিলো। রাশাদের উদ্দ্যেশ্যে বেশ দৃঢ় স্বরে বলল,
“আপনার বোনকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম। দায়িত্ব ঠিক মত পালন করলাম কি না দেখে নিয়েন”

রাশাদ ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হুমায়রাকে শুধালো,
“ক্ষিদা লাগছে? বাসায় চল। ভাইবোন একসাথে মুড়িমাখায়ে খাবো”

******

বাড়ি ফিরতেই হন্তদন্তের মতো ফরিদ ঘরে প্রবেশ করলো। ফাইজান তখনও জামা বদলায় নি। পাঞ্জাবীর বোতাম গুলো খুলছিলো তখন ই সে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে শুধালো,
“তুমি ফোন ধরো না কেন? কতবার ফোন দিছি”
“সাইলেন্ট ছিলো”
“কিন্তু একবার চেক তো করতেই পারতা, কত দরকারী ফোন আসছে জানো। আমি কেমনে সামলাইছি আমি ই জানি”

দুপুরবেলা কার্যালয় থেকে ফোন এসেছিলো। কিছু জরুরী বিষয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে হবে। এজন্য প্রায় পয়তাল্লিশবার ফোন করেছে ফরিদ। কিন্তু ফাইজান একবারও ফোন উঠায় নি। ফরিদ হুমায়রার বাড়ির যেতে চেয়েছিলো কিন্তু ফাইজানের ভয়ে যেতে পারে নি। ফাইজান একবার মোবাইলটা দেখলো। এরপর নির্লিপ্ত চিত্তে উত্তর দিলো,
“ওহ”

ফাইজানের দায়সাড়া ভাবে বিরক্ত হলো ফরিদ। বিরক্ত প্রকাশ করেই বললো,
“আচ্ছা, হঠাৎ এত পরিবর্তন কেনো তোমার মাঝে? বিয়ে করতে হঠাৎ মত দিলে কেনো?”
“বিয়ে মত দেবার কি কোনো কারণ থাকে?”
“অবশ্যই থাকে। এখন বলো না তুমি ঐ মেয়ের প্রেমে পড়েছো!”

ফাইজান পাঞ্জাবীটা খুললো। একটা টি-শার্ট গলায় গলিয়ে স্বাভাবিক স্বরে শুধালো,
“সেটা কি খুব অস্বাভাবিক কিছু হবে!”
“অবশ্যই, ফাইজান ইকবাল কারোর প্রেমে পড়বে এটা পৃথিবীর নবম আশ্চর্য। সে মানুষ তার হবু স্ত্রীর মৃ/ত্যুতে নির্বিকার থাকে…”

সাথে সাথেই থেমে গেলো ফরিদ। বহুবছর সে ফাইজানের সাথে কাজ করে। তার এসিসট্যান্ড, বন্ধু, বডিগার্ড প্রায় সব ই সে। তাই তাদের সম্পর্কটা বেশ ভালো। কিন্তু ফাইজানকে সে ভয় ও পায়। কারণ তার মতে ফাইজান খুব ই নিষ্ঠুর, পাথর হৃদয়ী মানুষ। অনুভূতিশুন্য মানুষদের ভয় বেশি লাগে। ফরিদ থেমে যেতেই ফাইজান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। তাচ্ছিল্যভরা স্বরে বলল,
“একটু বেশি কথা বলছো না? আমার প্রতি তোমার এমন ধারণায় কষ্ট পেলাম। যাই হোক, যে কাজটা দিয়েছিলাম, হয়েছে?”
“হ্যা”
“যাও এবার ঘুমাতে যাও। মাথা ঠান্ডা লাগবে। তখন দেখবে মন ও ভালো থাকবে”

ফরিদ দাঁড়ালো না। একটা খাদি খাম টেবিলে রাখলো। বললো,
“প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যেতে হবে ভুলো না। আর একটা কথা, হুমায়রা খুব সাধারণ মেয়ে। তাই গতবারের মত ঘটনা এবার যেন না ঘরে খেয়াল রেখো”

ফরিদ অপেক্ষা করলো না। বেরিয়ে গেলো সাথে সাথে। ফাইজান গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিলো। আগামীকাল রাশাদের সাথে দেখা করতে হবে। বিয়েটা দু-তিনদিনের মধ্যে হলেই ভালো। দেরি করা যাবে না______

******

সকাল সকাল অদ্ভুত কান্ড হলো। ঘুম ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই দেখা গেলো কাওছার এসেছে। শুধু তাই নয়, আসার পর থেকেই ভীষণ মায়াকান্না জুড়েছে……………

চলবে

[মুসলিম পাড়ার দুটি বাড়ি, নাম শান্তিকানন এবং সুখনীড়। কিন্তু সেখানে অশান্তির বাস আর সুখের ছিটেফুটেও নেই। আছে শুধু ঝগড়া কলহ, বিদ্বেষ। বড়রা তো বড়রা, ছোটরাও এই কোন্দলে ঝাঝড়া। সকালবেলায় বল এসে ভেঙ্গে ফেললো আয়াতের শখের চুড়ি। ক্রোধ বর্ষণ হলো এই পাশ থেকে। কিন্তু ওপাশের সৌম্য পুরুষ, সাফওয়ান কেবল ই হাসলো। ফলে আরেকদফা ঝগড়া লাগলোই। আর দর্শক হলো মুসলিম পাড়া। এই বিদ্বেষ, কলহের বাতাসে প্রেমপুষ্প ফোটাবার দুঃসাহস পোষন করেছে এক জোড়া কপোত-কপোতী, প্রভা-ইশতিয়াক। আঠারো বছর ধরে সঞ্চিত প্রণয় পরিণয়ে পৌছাবে তো? নাকি তার পূর্বেই দু-বাড়ির কোন্দল পিষিয়ে দিবে প্রেম? সাফওয়ান-আয়াতের ঝগড়া কি কখনো শেষ হবে? নাকি চাঁদ কখনো বলবে হাতটি ধরতে?

ই-বই : চাঁদ বলে হাতটি ধরো (অংশ বিশেষ)

পুরো গল্পটা পাবেন শুধুমাত্র বইটই এপে। দাম মাত্র ৬০ টাকা!বইটি পড়তে হলে অবশ্যই গুগল প্লে স্টোর থেকে বইটই এপ ডাউনলোড করে নিজের একাউন্ট রেজিস্টার করতে হবে]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here