নিশীভাতি #১৩তম_পর্ব

0
396

#নিশীভাতি
#১৩তম_পর্ব

সকাল সকাল অদ্ভুত কান্ড হলো। ঘুম ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই দেখা গেলো কাওছার এসেছে। অদ্ভুত ব্যাপার, তার টাকা সময় মত রাশাদ পাঠাচ্ছে তবুও সে এসেছে। শুধু তাই নয়, এসেই মায়াকান্না জুড়েছে। সকালবেলা যখন আতিয়া খাতুন নামায পড়ে উনুন জ্বালাতে হেসেলমুখী হলেন তখন ই কোথা থেকে কাওছার এসে তার পা ঝাপটে ধরো। মেকি কান্না জুড়ে বললো,
“আম্মা, আমারে ক্ষমা করি দাও। আমি বইখে গেছিলাম। অর্থ আমার চিন্তায় বালি মারছিলো। লোভে পাপ করছি। আমারে ক্ষমা করে দাও”

কাওছারের এমন আচারণ দেখে হতভম্ব হলেন আতিয়া খাতুন। বিস্ফারিত হলো নয়ন। সেদিনের ঘটনার পর কুলাঙ্গারটা ফিরবে বিশ্বাস ই হচ্ছে না। নিজেকে ধাতস্থ করেই পা সরিয়ে নিলেন তিনি। ক্রোধিত স্বরে বললো,
“হা’রা’ম’জা’দা, ছাড় আমারে। আর বাইর হো আমার ঘর থেইক্যা। এক্ষন বাইর হো”
“এমনে কইও না মা, তোমগোর ছাইড়ে থাকতি পারতেছি না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমারে ক্ষমা করে দাও”

আতিয়া খাতুন গললেন না। এমন কুলাঙ্গার পুত্রের জন্ম দেওয়াও মাঝে মাঝে নিজের কাছে পাপ মনে হয়। নিজের পেটকেও গা’লমন্দ করতে ইচ্ছে হয়। সন্তানের জন্য মমতাগুলো তার ঘৃণ্য কাজের প্রেক্ষিতে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শ্বাসরোধ করে গ’লা চেপে হ’ত্যা করতে ইচ্ছে হয় আতিয়া খাতুনের। মাতৃত্ব নামক স্বাদও যে অভিশাপ লাগতে পারে তাকে না দেখলে জানা যেত না। আতিয়া খাতুনের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো বাকিদের। রাশাদ শার্ট গলিয়ে বেরিয়ে এলো। ইলহা নামায পড়েই জানালায় উঁকি দিলো। হুমায়রা তখন সালাম ফিরালো। বাবার কণ্ঠ কানে আসতেই চুপসে গেলো যেন। ভালোই তো ছিলো এই দেড় মাস। ভাইজান আশ্বস্ত করেছিলো মানুষটি আর ফিরবে না। তাহলে! কাওছারকে দেখে রাশাদের চোয়াল শক্ত হলো। শামসু মিঞা বের হলেন। বৃদ্ধের সমস্ত গা রাগে রি রি করছে। প্রবীন হাটুতে বল নেই। তবুও অসভ্য সন্তানকে মারতে ছুটলেন। কাওছার চুপ করে মার খেলো। তবুও তার কান্না, মিনতি থামলো না। পা ধরে বসলো শামসু মিঞার,
“আব্বা, আমারে ক্ষমা করি দেন। আমি পাপি, বাজে লোক, জানি। কিন্তু আমারে নিজেদের থেইক্যা আলাদা কইরেন না”

শামসু মিঞার বুড়ো হাত ইচ্ছে মত তাকে মেরে ক্ষান্ত হলো। কিন্তু কাওছার তার পা ছাড়লো না। রাশাদের চোখে মুখে ভীষণ বিরক্তি জন্মালো। ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আর কি চান আপনি? আমাদের জীবন নরক না বানালে শান্তি হচ্ছে না নাকি?”
“রাশাদ্দ্যা এমনে কইস না বাপ। আমি তো বাপ”
“হ্যা, বাপ। যে বাপ কিছু পয়সার জন্য তার মেয়ের ঘরে অন্য পুরুষ ঢোকায়। যে বাপ বিয়ের বিয়ে ছেড়ে জুয়া খেলতে যায় ঘরের অর্থ নিয়ে। ছেলে আর বাবার ঘাড়ে ঋণের বোঝা দেয় সেই বাপকে আমি বাপ মানি না”

রাশাদের কঠিন কথা চিরলো সকালের নিস্তব্ধতা। কাওছার কান্নারত স্বরে বললো,
“বাপ আমারে ক্ষমা করি দে। আমি আর এমন করুম না। আব্বার কসম, আমি আর মদ খামু না। জুয়া খেলুম না। এই যে দেখ, তুই আমারে যা টেকা পাঠাইছোস, সব লইয়্যা আইছি। আমি কথা দিতাছি, মোর জন্য আর তোদের ছোট হতে হবে না”

কাওছারের হট্টোগোলে ধীরে ধীরে আশেপাশের বাড়ির মানুষ জড়ো হতে লাগলো। সকাল সকাল নিজ কাজ ছেড়ে অন্যের বাড়ি উঁকিঝুকি দেওয়া মানুষগুলোর বড়ই কৌতুহল হচ্ছে টা কি! মানুষের আগমন দেখে রাশাদ স্বর নামালো, কিন্তু কাওছার তার কান্নার জোর বাড়ালো। ঠোঁট ভেঙ্গে বলল,
“এতো নিষ্ঠুর হইস না বাপ, আমি তো বাপ। জানোস কাল রাইতে আমার দম বন্ধ হইয়ে আইছিলো। তখন মনে হইছিলো আমি এই পৃত্থিবীতে একলা। আমার কেউ নাই। কি যে কষ্ট, তখন আমার মাথায় বুদ্ধি আইলো, কি পাপ ই না করিছি। আব্বা, আমি যদি মরি যাইতাম তালি তো আমার পায়াসচিত্ত হতো না। আব্বা আমারে এককান হুযোগ দেন। আমি ভালা হয়ে যামু। এক কোনায় পড়ি থাকুম। কিন্তু আমারে একলা কইরেন না”

তার কান্নারত মুখ দেখে পাশের বাড়ির কালাম বললো,
“বুইড়া মানুষ, ক্ষমা করে দাও চাচা। তোমগোর বাদে যাবেও বা কই”

শামসু মিঞার চোখে অশ্রু জমলো। কি নির্মমতা। নিজের ছেলের মৃত্যুর কথা শুনে বুক কাঁপছে, কিন্তু কাছে টানতে পারছে না। রাশাদ এর মধ্যেও অনড়। নিজ সিদ্ধান্তে সে দৃঢ়। দয়া হলো না বাবার জন্য একবিন্দুও। কারণ এই মানুষটি একজন অমানুষ। তার কাছে ছেলে, মেয়ে, বাবা-মা মূল্যহীন। নিজ স্বার্থসিদ্ধি ই আসল। নিশ্চয়ই কোনো মতলবে এসেছে। যা এখানের কেউ বুঝতে পারছে না। মতলবটা রাশাদ ও আন্দাজ করতে পারছে না। এই দেড় মাসে কম টাকা তাকে পাঠায় নি সে। তাহলে হুট করে আসার কি মানে! কাওছার এবার এমন কাজ করলো যে সবাই তব্দা খেয়ে গেলো। হুমায়রা এবং ইলহা নিজ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। কাওছার ছুটে গিয়ে মেয়ের পা ধরে বসলো। হুমায়রা কেঁপে উঠলো। হতভম্ব স্বরে বলল,
“আব্বা কি করেন?”
“ক্ষমা করে দে মা, আমি পাপি। আমারে তুই শাস্তি দে।“

বলেই তার হাত দিয়ে নিজেকে মারতে লাগলো। নাকে খড় দিল। কানে ধরল। হুমায়রা বিভ্রান্ত হলো। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চাইলো রাশাদের দিকে। অপ্রস্তুত হলো উঠানে জড়ো মানুষের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। যতই হোক মেয়ে বাবাকে মারছে, তার সামনে বাবা নাকে খড় দিচ্ছে ব্যাপারটা মর্মান্তিক। হুমায়রা কাঁপা স্বরে বলল,
“আব্বা, ছাড়েন। এমন কইরেন না। উঠেন আপনি, কান ছাড়েন”

কিন্তু কে শোনে কার কথা। কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“তুই ক্ষমা কর আগে, তালি আমার পায়াসচিত্ত হইবো”
“আপনি উঠেন”
“আগে ক, ক্ষমা করিছিস। নয়তো এহানেই আমি নাক খুঁড়ে মরুম”

রাশাদের মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে এলো। ক্ষুদ্ধ স্বরে বললো,
“করছেন টা কি? পাগল আপনি?”
“পাগল তো ছিলুম, বুদ্ধি তো এহন হইলো। বিলকিস মা, আমারে ক্ষমা কর”

আশেপাশের মানুষের মাঝে কানাগোসা শুরু হলো। তীব্র নিন্দা তাদের চাহনীতে ফুটলো। কিশোরী বেশ দ্বিধায় পড়লো। মানুষের তীব্র দৃষ্টিতে বাধ্য হলো সে কাওছারকে ক্ষমা করতে। অপ্রস্তুত স্বরে বলল,
“উঠুন, ক্ষমা করেছি আমি”

শামসুও কঠিন থাকতে পারলো না। বাহিরের মানুষের কথায় নরম হতেই হলো। অবশেষে কাওছার আবার ঘরে আশ্রয় পেলো। এদিকে রাশাদ এই সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারলো না। প্রচন্ড রাগ হলো দাদার উপর। তাই হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। রাশাদের ক্রোধিত মুখখানা ইলহার নজর এড়ালো না। এত অমিলের মাঝেও কোথাও যেন রাশাদের সাথে নিজের মিল খুঁজে পেলো।

******

সূর্য তখন মধ্য আকাশে তীব্র তেজে নিজেকে প্রকাশ করেছে। তেজের অগ্নিতে ঝলছে যাচ্ছে ধরণী। বাতাস তখন থমকে আছে। বিদ্যুৎ নেই। কপালে জমেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের কথা। হিসেবের অংকে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে রাশাদ। ঠিক তখন ই মিঠুকে দেখলো তড়িঘড়ি করে চেয়ারের বন্দোবস্ত করতে। কিছু শুধানোর পূর্বেই ফাইজানের ছায়া পড়লো মাথার উপর। ফাইজানকে দেখেই চোখ ছোট ছোট করে তাকালো রাশাদ। বসতে বললো না, বরং গম্ভীর স্বরে শুধালো,
“কি চাই?”
“বসতে পারি?”

ফাইজানের প্রশ্নে কিছুসময় চুপ থেকে হাতের ইশারা করলো। ফাইজান আয়েশ করে বসলো। মিঠু আপ্যায়নে ছুটলো। কড়া করে বেশী দুধের চা নিয়ে এলো। ফাইজান করলো নম্র স্বরে বললো,
“অহেতুক কষ্ট করলে, আমি চা খাই না। আর এখানে কালো কফি পাওয়া যায় না। তাই এসবের প্রয়োজন নেই”
“কি প্রয়োজনে এসেছেন, ঝেড়ে কাশুন”

কঠিন স্বর রাশাদের। ফাইজান অবাক হলো না। তার ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন হলো না। বরং কণ্ঠ বিনয়ী হলো,
“আমার এবং হুমায়রার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে এসেছি”
“”আপনাকে আমার প্রথম থেকে ভীষণ ভাবে অপছন্দ”

রাশাদের মৃদু কিন্তু গম্ভীর কন্ঠ আলোড়িত করলো নিস্তব্ধতা। সে বরাবরই বুদ্ধিমান। কখনো চিৎকার চেচামেচি করে না। খুব শান্ত ভাবেই নিজের অমত প্রকাশ করে। আজ ও তাই হলো। সে বুঝিয়ে দিলো, তার এই বিয়েতে মত নেই। এবং কখনো রাজি ও হবে না। তবুও ফাইজান দৃঢ়, অনঢ় ভঙ্গিতে বসে রইলো। দায়সারা গলায় উত্তর দিলো,
“কিন্তু আমি তো আপনার সাথে সংসার করবো না। না আপনি আমাকে বিয়ে করবেন; তাই আপনার আমাকে পছন্দ হওয়া বা না হওয়াটা খুব জরুরি কিছু নয়। অন্তত আমার জন্য”
“তাহলে এখানে কেন এসেছেন”
“আপনি আমার হবু অর্ধাঙ্গিনীর ভাই তাই। তার খুশিটা আমার জন্য জরুরি। আপনি রাজী না হলে সেও খুশি থাকবে না। হয়তো বিয়ে হবে, একটা খুঁত থেকে যাবে।“
“আপনি আসতে পারেন”

রাশাদ হিসেবে মনোযোগ দিলো। ফাইজানের কণ্ঠ এবার গাঢ় হলো। স্পষ্ট স্বরে বলল,
“না ভেবে কিছুই করা উচিত নয়। আপনি এতোটা নির্বোধ আমার জানা ছিলো না”
“কি বলতে চাইছেন?”
“নিজের বোনের সুখ পায়ে ঠেলছেন, নির্বোধ ছাড়া আর কি?”
“আপনার সাথে আমার বোন সুখী হবে? হাসালেন”
“সত্য কথায় সবাই হাসে। যখন গ্যালিলিও বলেছিলো পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে মানুষ হেসেছিলো।“
“তা এতো নিশ্চিত কি করে আপনি? এতো বিশ্বাস নিজের উপর?”

ফাইজানের দৃষ্টি শান্ত। রাশাদের তাচ্ছিল্যেও সে শান্ত। মৃদু কিন্তু কাঠিন্য স্বরে এনে বলল,
“আমার মা খুব ভালো মানুষ, সে বেঁচে থাকতে হুমায়রা এক চিলতে কষ্ট পাবে না। আমি হুমায়রার পড়াশোনার ক্ষতি হতে দিবো না। ওকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমার। এই নোংরা জগৎ থেকে একটা সুন্দর পরিবেশ দিবো তাকে”
“নোংরা?”
“কেনো! শুনেছি আপনার বাবা ফিরে এসেছে। সে তো একবার হুমায়রার ঘরে পুরুষ পাঠিয়েছিলো বিশ হাজার টাকার লোভে। ভুল বলেছি?”

ফাইজানের কথায় স্তব্ধ হলো রাশাদ, সে কি করে জানে তার বাবা ফিরে এসেছে। বাবা ফিরেছে সে কথা বাড়ি এবং বাড়ির আশেপাশ বাদে কেউ জানে না…………….

চলবে

[অয়নের স্ত্রীর নাম প্রাপ্তি। বিগত দেড় বছর যাবৎ মেয়েটি নিখোঁজ। কোথায় আছে! কি করছে! আদৌ বেঁছে আছে কি না কেউ জানে না। দিনটি ছিলো তাদের বিবাহ বার্ষিকী, প্রাপ্তি তার স্বামীকে চমকে দেবার জন্য সারপ্রাইজ পরিকল্পনা করেছিলো। অয়ন তার সারপ্রাইজটা পেলো ঠিক ই কিন্তু যেখানে তাদের দেখা করার কথা ছিলো সেখানে প্রাপ্তিকে পেলো না। নিজ ক্ষমতা, টাকা পয়সা সবকিছু দিয়ে অয়ন তার স্ত্রীকে খোঁজার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থতাকেই বরণ করতে হলো। পুলিশ ও হাত তুলে ফেলেছে। প্রাপ্তি যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। আজ অবধি সে নিখোঁজ অথচ একটা অচেনা মেয়ে দাবি করছে সে প্রাপ্তি। এটা কিভাবে সম্ভব! মেয়েটির গড়ণ প্রাপ্তির মতো হলেও তার চেহারা একেবারেই ভিন্ন। চোখ, ঠোঁট, চাহনী, নাক সব ভিন্ন। অয়নের মাথা ধরে এসেছে। ক্রোধ, বিষাদ, শুন্যতা তাকে ঘিরে ধরলো। বুকের ভেতর ছাই চাপা আগুনটা দাও দাও করে জ্বলে উঠলো। তীব্র কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি আপনাকে চিনি না, আল্লাহর ওয়াস্তে আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিবেন না!”
“অয়ন, তুমি সত্যি আমাকে চিনতে পারছো না? তুমি ই তো বলতে আমাকে নাকি অন্ধকারেও ঠিক চিনে পারবে! সব কি মিথ্যে ছিলো তবে! তুমি বলতে আমার অস্তিত্ব তোমার রক্তে মিশে আছে! সব মিথ্যে?”

অয়ন তার দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। মেয়েটার ভেজা কন্ঠ গায়ে কাঁটার মতো বিধছে। এই কথাগুলো সে শুধু প্রাপ্তিকে বলেছিলো। মেয়েটি কিভাবে জানলো! কে এই মেয়ে

তন্দ্রাবিলাসী (অংশ বিশেষ)

পুরো গল্পটা এখন পেয়ে যাবেন বইটই এপে। দাম মাত্র ৮৫ টাকা!

তন্দ্রাবিলাসী: মূল্য – ৮৫টাকা।
https://link.boitoi.com.bd/RmQN]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here