নিশীভাতি #৫৪তম_পর্ব

0
353

#নিশীভাতি
#৫৪তম_পর্ব

সারা রাস্তা খালি রাশাদ আর শামসু মিঞাকে গালি দিলো সে। কিন্তু বাস্তবতা মাথাচড়া দিতেই অনুধাবন হলো যাওয়ার জায়গা নেই তার। পেটে ক্ষুধা। টাকাগুলো নিয়েও আশংকা হলো। কেউ যদি তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। ভয় গাঢ় হতেই পা আটকে গেলো কাওছারের। নেতানো ভাস্করের মিয়ে যাওয়া আভায় পরিচিত মুখশ্রী। কাওছার বিমূঢ় স্বরে বললো,
“তুমি?”

পরিচিত মুখখানি নিঃশব্দে হাসলো। অরুণের নিভু নিভু আলোয় সেই হাসি দৃষ্টি এড়ালো না কাওছারের। গায়ে কাটা দিলো খানিকটা। মানুষটি এগিয়ে গেলো। বিদ্রুপাত্মক স্বরে শুধালো,
“যাচ্ছো কোয়ানে কাওছার মিঞা?”
“যেহানে যাই তোমার কি? হুনি?”

সতর্কসহিত উত্তর দিলো কাওছার। টাকার পুটলিটা আঁড়াল করার চেষ্টা করলো খানিকটা। কিন্তু আনাড়ী কাজে বিপরীতের মানুষটি কেবল হাসলো। বরং ভৎসনা করে বললো,
“ঐ সামান্য টেহা আমি নিমু না। বরং তোমার জন্য ভালা এক্কান পস্তাব আছে”
“তোমার পস্তাব আমি হুনতে যামু কেন। আমার খাইয়ে কাম নাই নাকি। শা/উ/য়ো তোমার মতলব আমি সব বুঝি”
“গা/লি দিও না কাওছার মিঞা। আগে হুনো। লাভ আছে ক্ষতি নাই। এই সামান্য টেহা দিয়ে তোমার কি হইবো? আমার কথা হুনলে তুমি আরোও টেহা পাবা”

কাওছার বেশ দোটানায় পড়লো। সংশয়ের তীব্র হাতছানি তাকে গিলে খাচ্ছে। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সামনে থাকা মানুষটিকেও না। কিন্তু লোভের তিলকা আগুন তাকে ধীরে ধীরে ঘুনের মতো খাচ্ছে। লোভাতুর কন্ঠে বললো,
“কত টেহা পামু?”
“পাইবা পাইবা। একটু ধৈর্য্য ধরন লাগবো খালি। সব তো আর একবারে হয় না। কহনো বাঘ শিকার করতে দেকছো?”
“হ্যা?”
“আমরা বাঘ শিকারে নামছি। একটা ভেড়ারে টোপ বানাইতে হইবো। কিন্তু বাঘও তো চালাক। ওয় শিকারীরেই কামড় দেছে। শিকারী নিজে না বাঁচলে কেমনে শিকার করবো? তাই একটু সময় লাগবো”

কাওছার বিরক্ত হলো। সে থুথু ফেলিয়ে বললো,
“টেহা পাবো নি হেইডা কও”
“পাইবা পাইবা, তুমি শুধু আমারে বিশ্বাস কর। তাইলেই হইবো”

পরিচিত মুখখানা বিদায় হাসি দিলো। তারপর কাঁচা পথ ধরে হাটতে লাগলো। একটা সময় সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো তার অবয়ব। কাওছার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার মস্তিষ্ককোষ গুলো চিন্তিত। টাকাটা প্রাণের থেকেও অমূল্য ভেবে আঁকড়ে ধরলো। বলা তো যায় না কেউ যদি কেড়ে নেয়।

******

ফাইজানের মুখখানা বিরক্তিতে ছেয়ে আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে। তার সম্মুখে কাঁচুমাচু মুখ করে দেলোয়ার সাহেব বসা। তার মুখখানা মলিন। ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটিকে আজ নিতান্ত অসহায় লাগছে। কুঞ্চিত চামড়ায় এতোকাল যে সুপ্ত দম্ভ ছিলো তা গুড়োগুড়ো হয়ে গেছে। সে আজ গ্রামের চেয়ারম্যান নয়, সে কেবলই একজন অসহায় পিতা—যার সন্তান কালকুঠুরীতে। তার সম্মুখে রাখা চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তিনি খাচ্ছেন না। কারণ এখানে আয়েশ করে বসে চা খেতে আসেন নি। মার্ডার চার্জ করার জন্য বেইল হচ্ছে না আমানের। ফাইজান এখন প্রতিমন্ত্রী। তার এখনো রমরমা। সে চাইলে সব সম্ভব। তাই ঢাকা অবধি ছুটে আসা। ফাইজান দীর্ঘশ্বাস ফেললো, গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
“মামা, আপনি ফিরে যান”
“ফিরে যাবার জন্য তো আসে নি। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে, তোমাকে সহায়তা করলে আমানের কিচ্ছু হবে না। তাহলে আমার ছেলে আজ জেলে কেনো?”

ফাইজান লক্ষ করলো দম্ভ ভেঙ্গে গেলেও সেই তেজ মিটে নি। ফাইজান গা এলিয়ে দিলো। চশমাখানা চোখ থেকে খুললো। পাঞ্জাবীর নিচ অংশ দিয়ে মুছলো তা। তারপর দায়সারা কন্ঠে বললো,
“আপনার ছেলেকে তো আমি জেলে ঢুকাই নি। সে কাজ ই এমন করেছে যার জন্য আজ তার পরিনতি। শুধু তাই নয়। সে আমার স্ত্রীকে হুমকিও দিয়েছে। আমি চাইলে অবশ্য তাকে তখন ই পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আমি চাই নি আপনার এবং আমার সম্পর্কে ঘাটতি আসুক। কিন্তু এখন তো আমার হাতে কিছুই নেই মামা”

মাথা নামিয়ে নিলেন দেলোয়ার সাহেব। রাগে তিনি কাঁপছেন। কিন্তু সেই রাগ দেখাতে পারছেন না। ফাইজানের বেশ উপভোগ্য লাগছে এই দৃশ্য। তার মুখে ভৎসনার হাসি। হাসিখানা আঁড়াল করে নির্লিপ্ত ভাবে বললো,
“শুনেছি গ্রামের কোন মাস্টার যেনো এবার আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে! দেখুন মামা, আমার মতে আমানকে নিয়ে না ভেবে আপনার উচিত নিজের চেয়ার নিয়ে ভাবা। বলা যায় না। নড়েও যেতে পারে”
“তাহলে তুমি আমাকে সাহায্য করবা না?”
“করবো না তো বলি নি। কিন্তু বেশি আশা করবেন না। কারণ আমি সদ্য পদ পেয়েছি। ক্ষমতার নেশায় ক্ষমতা হারাতে চাই না”

দেলোয়ার সাহেবের মুখখানা কঠিন হলো। চোয়াল শক্ত। ফরিদ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফাইজানের এই জেদ তার অহেতুক লাগছে। শত্রুতা বাড়ানো কি খুব দরকার! দেলোয়ার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ফাইজানের কাছে বসে থাকা অহেতুক। বলে চলে যাবার সময় ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বললেন,
“বাপের মত জেদি হইয়ো না, ফাইজান। পরিণতি খুব সুখময় হবে না”

ফাইজান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। দেলোয়ার সাহেব বেরিয়ে গেলেই ফরিদ বলে উঠলো,
“ফাইজান, তুমি কাজটা ভালো করলে না। আমানকে ছাড়িয়ে দিলে খুব ক্ষতি হত কি?”

ফরিদকে আজ অস্থির লাগছে। সাধারণত ফরিদ ধৈর্য্যচ্যুত হলেও এতোটা অস্থিরতা দেখায় না। ফাইজান তাকে অগ্রাহ্য করলো। কঠিন স্বরে বললো,
“দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষার সখ আমার নেই”

ফরিদ কোনো কথা বললো না। কিন্তু তার মুখশ্রীতে ফুটে উঠলো সুক্ষ্ণ ক্রোধ।

*******

দিনগুলো মন্দ যাচ্ছে না। শীতের তিক্ততা এসে ধীর পায়ে পৃথিবীর চিরধরা বুকে পদার্পন করেছে বসন্ত। আম গাছটায় মুকুল ধরেছে। ছোটছোট সবুজাভ মুকুল। শুকনো পাতা ঝরে গিয়ে সবুজ কিশলয় সদর্পে সূর্যের দিকে মুখ করে আছে। উঠোন ভর্তি রোদেলা সূর্যের নিচে শুকাতে দেওয়া হয়েছে টক বরই। দু তিনটে শালিক পাখি এসে না খুটে খুটে খাচ্ছে। আতিয়া খাতুন পাখা হাতে তাদের সরিয়ে দিচ্ছে। ইলহার জন্য নিজ হাতে টক বরই এর আঁচার বানাবেন তিনি। মেয়েটা আজকাল কিচ্ছুটি খেতে পারে না। খেতে যেনো রাজ্যের অনীহা। সেদিন রাশেদা কুলের আঁচার দিয়েছিলো। মেয়েটা সেটা দিয়েই পুরো ভাত খেয়েছিলো। তাই আতিয়া খাতুন আঁচার বানাবেন। বাড়িতে এখন কেউ নেই। ইলহা হাসপাতালে, হুমায়রা পরীক্ষার হলে আর রাশাদ দোকানে। সামনে রোজার মৌশুম। মাস পার হলেই রোজা। দোকানে চাপ বেড়েছে। ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রের পাশাপাশি মোবাইলও উঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশাদ। তাই দোকানে থাকে অধিক সময়। আতিয়া খাতুন হাটুতে থুতনি ঠেকিয়ে কুলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। টককুল শামসু মিঞার প্রচুর পছন্দ ছিলো। প্রায় বলতেন,
“কাওছারে মা টক কুলের আচার বানাইয়ো”

আতিয়া খাতুনের অন্তস্থল থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। এর মাঝেই চিকন মেয়েলী কন্ঠ কানে এলো,
“আম্মা, আসুম?”

আতিয়া খাতুন মুখ তুলে তাকালেন। রাশাদের ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে যুবাইদা। কত মাস পর এই নারীকে স্বচক্ষে দেখছেন মনে নেই আতিয়া খাতুনের। তবে শরীর নিঙড়ে ঘৃণা প্রতিফলিত হলো চোখে। মুখখানা সাথে সাথেই বিকৃত হলো। ঝাঝালো স্বরে শুধালো,
“হতচ্ছারি, তুই কি করতেছোস এহানে? কি জন্য আসিছিস?”

যুবাইদা্কে খানিকটা ভীত সন্ত্রস্ত দেখালো। লজ্জিত, ভীত স্বরে বললো,
“আম্মা, আমারে ভুল বুঝবেন না”
“তোর মতন মাইয়্যা মানুষরে আমি খুব ভালা কইরে চিনি। আমার ঘর থেইক্যা তো চলেই গেছিলি। এহন কোন মতলবে আইছোস”
“আমি………”

যুবাইদা আমতা আমতা করতে লাগলো। ঠিক তখনই আগমন ঘটলো হুমায়রার। ক্লান্ত শরীরে প্রবেশ করলো বাড়িতে। শরীরখানা তপ্ত সূর্যে ঘেমে নেয়ে একসার। কিন্তু বাড়িতে এসেই যুবাইদাকে দেখে চমকালো সে। যুবাইদার সাথে যেদিনের পর থেকে আর যোগাযোগ করে নি সে। প্রয়োজনও পড়ে নি। কারণ দাদী কাওছারকে ঘরে ঢুকতেও দেন নি। কাওছার এখন কোথায় আছে সেই খবরও অজানা। তার খোঁজ নেওয়া হয় নি প্রায় পনেরো দিবস। সুতরাং যুবাইদাকে এখানে দেখে কিঞ্চিত অপ্রস্তুত হলো সে। যুবাইদা তাকে দেখে কিঞ্চিত নিশ্চিন্ত হলো যেনো। সে আতিয়া খাতুনের কাছে এসে কাঁধে থাকে চটের ব্যাগ থেকে স্বর্ণ এবং অর্থ বের করে তার হাতে দিলো। অপরাধী স্বরে বললো,
“আমাকে ক্ষমা কইরা দিয়েন আম্মা। আব্বার কাছে তো ক্ষমা চাইতে পারি নাই। আপনে ক্ষমা কইর‍্যা দিয়েন”

আতিয়া খাতুন বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। এই গহনা হুমায়রার জন্য বানানো হয়েছিলো। যা নিয়ে পালিয়ে ছিলো যুবাইদা। এদিকে হুমায়রাও অবাক হলো যুবাইদার কাজে। আতিয়া খাতুন তাকে কিছু বলার পূর্বে সে বললো,
“আমি পাপী মানুষ আম্মা, কিন্তু এতোও খারাপ না। আপনে জানতেন আপনার ছেলে কেমন। তারপর কি আমারে দোষী করা মানায়। যাক গা, এহন ওইডি কয়ে কি হইবো। আপনাদের আমানত ফিরায় দিয়া গেলাম। আর কোনোদিন দেহা হইবো না। আমারে দোয়া না দেন, বদদোয়া দিয়েন না”

আতিয়া খাতুন কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। যুবাইদা আর দাঁড়ালো না। সে বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে। হুমায়রার ছোট হৃদয়ে হাজারো প্রশ্নের উপদ্রব হলো। সে তার ব্যাগখানা মাটিতে ফেলেই ছুটলো তার পিছে। মাঝপথেই তার বাহু চেপে ধরলো,
“কেন করছেন আপনি এরকম? কি চান?”

যুবাইদা হাসলো নিঃশব্দে। অনুশোচনা মিশ্রিত স্বরে বললো,
“ক্ষমা চাইছি, এতেও স্বার্থ? আমারে খুব খারাপ লাগে তাই না তোর?”

হুমায়রা উত্তর দিলো না। যুবাইদা তার হাসি অক্ষত রেখেই বললো,
“আমার লগে দেহা করবি কইছিলি। করলি নাতো?”
“প্রয়োজন পড়ে নি। যেটার আশংকা করেছি। কাওছার তেমন কিছুই করে নি”
“যাক। ভালো থাইকো। আমি যাইতাছি গা। তয়, সাবধান করতেছি, কাওছারের মতলব ভালা না। হুনছি সে বাজারের কোনায় দোকান দিছে। এতো টেহা ওয় কই পাইলো? আবারো কইতেছি। কাওছার পারে না এমন কিছু নাই”

বলেই হাত ছাড়িয়ে নিলো যুবাইদা। হুমায়রা অবাক নয়নে তাকে দেখছে। সে কাঁচা পথ ধরে হাটতে লাগলো। একটা সময় মিলিয়ে গেলো দৃষ্টির অগোচরে।

*********

গভীর রাত। আঁধার গিলে ফেলেছে রুপালী চাঁদকে। দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। সেই ভয়ানক ডাক রাতের রহস্যপু্রীতে ভয় মিশিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ নেই। হারিকেনের ধিকধিক আলোয় পড়ছে হুমায়রা। আগামী পরশু পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা। এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো। ফরিদের নাম ভেসে উঠেছে। ফোনটা ধরতেই ফরিদের অস্থির কন্ঠ কানে এলো,
“ফাইজানের এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে হুমায়রা”…..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

৫৩তম পর্ব (বর্ধিতাংশ)
https://www.facebook.com/share/p/XXLTM2dFh53HwYN1/?mibextid=oFDknk

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here