প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি #সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী #পর্ব_১৪

0
441

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_১৪
,
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে আরো দুটো মাস, সেদিন ইমেইল পাওয়ার পরেরদিনই সমুদ্র চলে গেছে তার কাজের জায়গায়। বাড়িতে শুধু শশী শাহানারা এবং জয়। শশীর পরিক্ষা চলছে এই জন্য শশীও গ্রামে চলে গেছে। আজকে শশীর শেষ পরিক্ষা আর দুইদিন থেকেই আবার শহরে ফিরে যাওয়া লাগবে। ফাইল হাতে গাড়ি থেকে নেমে মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। চাইলে মেইন রাস্তা থেকে ভ্যানে একেবারে বাড়ির সামনে নামা যায় তবে শশী সেটা করেনি। অনেকদিন নিজের বাড়ি থেকে গ্রাম থেকে দূরে থাকায় যেনো মায়াটা আরো বেশি পড়ে গেছে। দুইদিন পরতো আবার চলে যাওয়া লাগবে এইজন্য পরিবেশটা উপভোগ করার জন্য এইটা করলো। শশী হাঁটতে হাঁটতে সেই পেয়ারা গাছের নিচে এসে থেমে গেলো আজ থেকে কয়েকমাস আগে ঠিক এই জায়গাটায় সমুদ্রের সাথে ওর প্রথম দেখা হয়েছিলো। একটা উঁচু পাহাড়ের মতো লোক গম্ভীর স্বরে শশীকে জিগাস করেছিলো, এই মেয়ে জামশেদ মাস্টার এর বাড়ি কোনটা চিনো? শশী সমুদ্রের মতো বলার চেষ্টা করে নিজে নিজেই হেসে ফেললো। তখন ওই লোকটাকে একদম পছন্দ হয়নি কিন্তু এই কয়েকটা মাসে ওই লোকটার সম্মন্ধে যতটা জেনেছি যেনো ততই ওই লোকটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। আসলেই লোকটার নামের মতো সেও অনেক গহীন ওনার গভীরে যেতে গেলে ডুবে যেতে হবে। সমুদ্র যাওয়ার পর শশীই ওই ঘরটাকে পরিষ্কার রাখতো কেনো জানি বেশ টানতো ঘরটা। প্রথমে অবুঝ মন কিছু বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে ঠিক বুঝে গেছে আসলে টানটা কিসের জন্য ছিলো। হাতের ছোট্ট ঘড়ির দিকে তাকাতেই শশীর টনক নড়ল ভাবতে ভাবতে এখানেই বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছে। তড়িঘড়ি করে সামনে এগোতেই দেখলো শাহিন তার দুজন সাঙ্গদের নিয়ে ওর দিকেই আসছে। শশী দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটাতে গেলে শাহিন সামনে দাঁড়িয়ে বলল।

কিরে শহরে গিয়াতো দেহি আরো বেশি সুন্দর হইয়া গেছোস। তা ওই সমুদ্র বুঝি বেশ আদর করে? আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন তোদের কি আদেও বিয়েটা হইছে? নাকি এমনে এমনেই ওরে মজা দিতাছোস।

দেখ শাহিন তোর সাথে এসব ফালতু কথা বলার সময় আমার নাই রাস্তা ছাড় দেরি হচ্ছে আমার।

হ রাস্তাতো ছাড়বোই তবে আমি কিন্তু একটা গোপন কথা জানি যেইটা গ্রামের কেউ জানে নাহ। ওই সমুদ্রের লগে তোর বিয়া হইনাই তুই আর তোর বাপ গ্রামের সবাইরে বোকা বানাতে পারলেও আমারে পারবি নাহ। তা বিয়া ছাড়াইতো তুই ওরে সব দিচ্ছিস বলি আমারেও একটু ছিটেফোঁটা দে আমরাও খুশি থাকি কি বলিস তোরা। কথাগুলো বলেই শাহিনসহ সবাই হাসাহাসি শুরু করল। ওদের কথায় শশীর রাগে লজ্জায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গাল বেঁয়ে পড়ল। কথাটা তো সত্যিই বিয়ে ছাড়া এভাবে আরেকজন এর বাড়িতে থাকলে মানুষ তো আজেবাজে কথা বলবেই। শশী কিছু না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলো শাহিন শশীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে কমর থেকে ফোনটা বের করে কারো কাছে ফোন দিলো।

হ আম্মা আপনার কাজ শ্যাষ এখন দেখি ওই শশী কেমনে আমারে ছাইড়া সমুদ্রের কাছে যায়। আপনার কথা মতোই সব হচ্ছে তবে দিন শেষে কিন্তু শশীকে আমার চাই।

ওপাশ থেকে কি বলল সেটা বোঝা গেলো নাহ তবে শাহিনের মুখে হাসি ফুঁটে উঠল। হয়ত ওপাশের থাকা ব্যাক্তি শাহিনের মন মতোই উত্তর দিয়েছে।
,,,,,,,,,,
মাস্টার বাড়ির সামনেই সাদা রঙের গাড়িটা এসে থামল জয় গাড়ি থেকে নিচে নেমে একবার বাড়িটার দিকে তাকালো। তারপর আবার ভিতরে গিয়ে মায়ের হাত ধরে সাবধানে মাকে নিচে নামিয়ে আনলো। তার বরাবরই ইচ্ছে ও ওর বড় ভাইয়ার মতো হবে। সেই জন্যই তো ওর বড় ভাইয়া যাওয়ার সময় ওকে দুটো দায়িত্ব দিয়ে গেছে সেই দায়িত্বই ও এখন পালন করছে। গাড়ির দরজা বন্ধ করে মাকে নিয়ে গেট দিয়ে ভিতরে গেলো, এক হাতে মাকে ধরে রাখলেও তার দু চোখ অন্য কাউকে খুঁজতে ব্যাস্ত। কারণ সব খবর যদি ঠিকঠাক ভাবে তার বড় ভাইয়াকে না দিতে পারে তাহলে সে কীভাবে একজন বড় অফিসার হবে। বাড়ির মধ্যে থেকে একে একে সবাই বেরিয়ে আসলো, শশী এসে শাহানারা কে জড়িয়ে ধরতেই শাহানারা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

কি হয়েছে তোর এতো করে ফোন করে বললাম জামশেদ ভাই এর সাথে চলে আয় কিন্তু মেয়ের সেই এক কথা যাবো নাহ। তাইতো বাধ্য হয়ে আমাকেই আসতে হলো এখন বল কি হয়েছে যাবি না কেনো?

শশী কিছু বললো নাহ চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, আমি আর ওবাড়ি যাবো নাহ।

ওদিকে জয় শশীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে সব নোট করছে। বাড়ি আসার এক মাসের মধ্যে আগের থেকে একটু চিকন হয়েছে, আগের মতো আর দুষ্টুমি করে নাহ। বেশ খানিকটা ফর্সা হয়েছে আর আরো বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে। এই কথাগুলো মনের খাতায় নোট করে রাখল। পারভীন এগিয়ে এসে শাহানারার পাশে দাঁড়িয়ে বলল।

আরে আপা এসব কথা পরে হবে আপনি আগে ভিতরে চলেন তো। এতো দূর থেকে এসেছেন আপনি তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

সবাই ভিতরে চলে গেলো জয় পিছন পিছন যেতে গিয়েও থেমে গেলো সামনে তাকিয়ে দেখে জোনাকি দুহাত পিছনে দিয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে ঢুলছে আর মিটমিট করে হাসছে। জয় সমুদ্রের মতো ভাব নিয়ে ওর মতো হাঁটা চেষ্টা করে হেলেদুলে জোনাকির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এভাবে আমাকে দেখে হাসতেছো কেনো?

জোনাকি কিছু বলল না হাসতে হাসতে দৌড়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেলো। জয় কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিজেই নিজেকে বলল, এই মেয়ের থেকে সাবধানে থাকতে হবে মেয়েটা খুবি বিপদজনক।
,,,,,,,,,
ধান কাটা হয়েছে উঠান জুড়ে যেনো ধানের মেলা বইছে। বাড়ির মহিলারা একসাথে কাজে মগ্ন শশী উঠানের এক পাশে পেতে রাখা চড়াটের উপর বসে বসে পা দুলাচ্চে। তখনি দেখলো গেট দিয়ে শাহিনসহ গ্রামের আরো কিছু বয়স্ক লোক ওদের বাড়ির দিকেই আসছে। শশী উড়নাটা মাথায় দিয়ে দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে গেলো, এই ভর দুপুরে এভাবে বাড়ির উপর ওনাদের আসতে দেখে জামশেদ মাস্টার বড়ই চিন্তিত মুখে সেদিকে এগিয়ে গেলো। চেয়ারম্যান বেশ ব্যাঙ্গ করেই বলল, কি মাস্টার তুমি গ্রামের মধ্যে এসব কি শুরু করেছো। নিজে মাস্টার হয়ে বাড়ির মেয়েদের দিয়ে এসব আকাম কুকাম করালে স্কুলের ছেলেমেয়ে তোমার কাছ থেকে কি শিখব?

সারাজীবন সবার সামনে মাথা উঁচু করে সম্মানের সহিত চলা জামশেদ মাস্টার হঠাৎ এই কথাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি মনে মনে এতোদিন ধরে যেই ভয়টা পাচ্ছিলেন তাহলে কি শেষ পযন্ত সেটাই হলো? এবার ওনি কি করবেন একটা মিথ্যা ঢাকতে গিয়ে এতোগুলো মিথ্যা বলেও কোনো কাজ হলো নাহ। এই জন্যই হয়ত বলে সত্য কখনো চাপা থাকে নাহ, তবুও ভিতরে ভিতরে নিজেকে যথা সম্ভব ঠিক রেখে বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন।

মুখে লাগাম দিন চেয়ারম্যান সাহেব কোথায় দাঁড়িয়ে কি কথা বলছেন সেটা একবার ভেবে দেখুন। আপনি কিসের ভিত্তিতে আমার বাড়ির উপর এসে এভাবে আমার মেয়েকে আজেবাজে কথা বলছেন।

চোরের মায়ের বড় গলা শোনো মাস্টার আমরা সব জানি তুমি যে কত বড় চালবাজ সেটা আমরা ঠিক বুঝে গেছি। খুবতো আমাদের বোকা বানিয়ে নিজের অবিবাহিত মেয়েকে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলে তাও আবার সেই বাড়িতে যেখানে কিনা দুটো জোয়ান জোয়ান ছেলে থাকে। ছিঃ ছিঃ মাস্টার আমরা অন্তত তোমার থেকে এমনটা আশা করেনি।

জীবনে এই শেষ বয়সটায় এসে এভাবে সবার সামনে অপমানিত হতে হবে কখনো কল্পনাও করেননি জামশেদ মাস্টার। হঠাৎই বুকের মধ্যে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। ক্রমে ক্রমে ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে, স্বামীর আসন্ন পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ধূলো মাথা হাতেই পারভিন তাকে ধরল। ততক্ষণে মাস্টার নিচে মাটিতে বসে পড়েছে নিশ্বাস নিতে খুবি কষ্ট হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে এই বার শ্বাস ছাড়লে বুঝি আর পরের শ্বাসটা নিতে পারবে নাহ। হাতের মুটোই থাকা ফোনের স্কিনে জামশেদ মাস্টার এর এহেন অবস্থা দেখে ইজি চেয়ারে দুলতে দুলতে মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ শব্দ করে বাঁকা হেসে বেশ আফসোসের স্বরেই মালবিকা বলল।

আজ শুধু মাত্র তোমার জন্য একটা পরিবারের উপর এতোটা বিপদ নেমে আসলো সমুদ্র। এবার তুমি কি করবে? চাইলেও তুমি ওখানে যেতে পারবে নাহ আর বাঁচানো তো দূরে থাক। ঠিক এভাবেই তোমার কাছের মানুষগুলো কে আস্তে আস্তে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দেবো। আমি তোমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি সমুদ্র তোমারও শেষ পরিনতি ওমনি হবে যেমনটা অভিক এর হয়েছিলো।
,,,,,,,,,
মাথায় তেল পানি বসায়ে বুকেও খানিক তেল ডলে দিলো পারভিন। খুব কমল স্বরে স্বামীকে জিগাস করলো, এখনো কি আপনার বুকের মধ্যে বেথ্যা করছে?

প্রতিউত্তরে কোনো জবাব দিলেন নাহ জামশেদ মাস্টার, শাহানারা পাশে বসে অপরাধী স্বরে বললেন, আজকে এসব আমার জন্যই হচ্ছে আমি যদি সেদিন শশীকে না নিয়ে যেতাম তাহলে এমনটা হতো নাহ।

আপা আপনি কেনো নিজেকে এভাবে বলছেন আসলে কি বলুন তো কিছু মানুষের কাজই এমন যারা শুধু একটু সুযোগ খুঁজে কীভাবে অন্যকে হেনস্তা করা যায়। জন্মেছি তো এই গ্রামে তাই প্রতিটা মানুষ কে খুব ভালো করে চিনি কে কি রকম। আপনি চিন্তা করবেন নাহ আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো দেখি ওনারা কি করতে পারে।
,,,,,,,,,
ছোট্ট টেবিলের উপর অযন্তে ফেলে রাখা ফোনটা এই নিয়ে বিশবার বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। ফোনের মালিক ফোনের কাছে না থাকায় ফোনটা এভাবে অবহেলায় পড়ে আছে। কিন্তু ওপাশ থেকে যে কল দিচ্ছে সে হয়ত বড়ই ধৈর্যশীল নয়ত বিশ বারের মাথায় কল না ধরলে পুনরায় পুরো দমে আবার সে একুশ বারের মতো কল দিতো নাহ। ক্লান্ত শরীলে তাবুর মধ্যে প্রবেশ করলো সমুদ্র ওরা একটা মিশনে আছে যার জন্য আপাতত গহীন জঙ্গলেই দিনরাত্রী যাপন করা লাগছে। পায়ের জুতোটা খুলে মোজাটা খুলতেই পায়ে ঠান্ডা বাতাস লাগতেই বেশ আরাম অনুভব করলো। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ঘা হয়ে গেছে টানা ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে পা ভিজিয়ে রাখা কাঁদার মধ্যে দৌড়ানো নিজের অযন্তের ফলেই এই অবস্থা। গাঁ থেকে ইউনিফর্ম টা খুলে পাশের দড়িতে ঝুলিয়ে রাখলো। পড়নে আর্মি প্যান্ট আর সাদা সেন্টু গেঞ্জি, দুহাতের কব্জিতে লম্বা লম্বা কাঁটাদাগ এগুলো জঙ্গলের মধ্যে দৌঁড়ানোর সময় লেগেছে। মাটিতে পেতে রাখা নাম মাত্র বিছানায় নিজের শরীলটা এলিয়ে দিলো। তখনি শুনতে পেলো তার সাইলেন্ট করে রাখা ছোট্ট ফোনটা বেজে চলেছে। হাত টানা করে ফোনটা সামনৈ ধরতেই কলটা কেটে গেলো, পুনরায় কল আসার আগেই সমুদ্র নিজেই কল দিলো।

#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here