প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি #সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী #পর্ব_১৫

0
331

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_১৫
,
মাস্টার বাড়ির উঠানে আবার ও বিচার সভা বসেছে, আশেপাশের অনেক মানুষই সেখানে উপস্থিত। মূলত তারা মজা নিতে এসেছে কালকের চায়ের দোকানের গল্পের মূল মাথা এটা করার জন্য।একটা চেয়ারে জামশেদ মাস্টার ও বসে আছে বাড়ির মেয়ে বউয়েরা ঘরের সামনে মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা কাশি দিয়ে চেয়ারম্যান বলতে শুরু করলো, আমি আর কি বলবো আপনারা তো নিজের চোখেই সব দেখছেন। এই মাস্টার আমাদের সবাইকে ঠিক কীভাবে বোকাটাই না বানালো। ছিঃছিঃ গ্রামের এই প্রথম কোনো মাইয়া শহরে গিয়ে এমন আকাম কুকাম করলো। এখন আপনারাই বলেন এর কি বিচার করা যায়।

চেয়ারম্যান এর কথার সাথে সম্মতি দিলো আশেপাশের মানুষ কানাঘুষা করছে ছিঃ ছিঃ করছে। কেউ কেউ বলছে নিজে মাস্টার হয়ে বাড়ির মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিতে পারেনি। এসব কথা জামশেদ মাস্টার চোখ বন্ধ করে হজম করছে তিনি কোনো কথাই বলছে নাহ। তখন শাহিন ভিড়ের মধ্যে থেকে একটু সামনে এগিয়ে এসে বলল, আমি একটা কথা বলতে চাই। আমি এর আগেও বলেছি আমি শশীকে বিয়ে করতে চাই কিন্তু আগের বার তো ওনারা আমাদের বোকা বানিয়ে মেয়েকে শহরে পাঠায় দিলো। কিন্তু আমার তবুও কোনো আপত্তি নাই আমি বিনা দ্বিধায় শশীরে বিয়ে করতে রাজি এখন বাকিটা আপনারা যা ভালো বোঝেন।

ছেলের কথাশুনে চেয়ারম্যান বুক ফুলিয়ে একটা হাসি দিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলল, বাহ এই হলো চেয়ারম্যান এর পোলা। আমার পরে এই পদে একমাত্র তুই বসার যোগ্য। দেখো মাস্টার দেখো এতোকিছুর পরেও আমার ছেলে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি। এমন জামাই এই হিজলতলী খুঁজলেও একটা পাবা না তো আমার শেষ কথা হলো হয় মেয়েকে বিয়ে দেও নয়ত তোমাদের একঘরে করা হবে। কি কন আপনারা?

চেয়ারম্যান এর কথায় ওখানে থাকা সবাই সায় দিয়ে বলল, হ হ চেয়ারম্যান সাহেব একেবারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন যদি শশীকে বিয়ে দেওয়া না হয় তাহলে ওর দেখাদেখি গ্রামের আরো সবাই সাহস পাবে এই কাজ করতে। শাহিন বাঁকা হেসে নিজের বাপের দিকে তাকালো চেয়ারম্যান ও হাসি দিয়ে বেশ আয়েশ করে চেয়ারে বসে বলল, তাহলে এই কথাই থাকলো আজকে রাতের মধ্যে বিয়া তাহলে চলেন আমরা সবাই এখন উঠি। মাস্টার তোমার তো কপাল খুলে গেলো তুমি আমার বিয়াই হতে যাচ্ছো।

এই বিয়ে হবে নাহ আপনারা যা করার করেন।

চিকন মেয়েলি গলায় এই কথাশুনে সবাই সেদিকে তাকালো, চেয়ারম্যান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো শশী উঠানের মাঝে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেছে। কথাটা বলে শশী পিছনে থাকা তার আব্বার দিকে তাকালো মেয়ের তাকানো দেখে জামশেদ মাস্টার চোখের পাতা ফেলে মাথা নাড়িয়ে মেয়েকে ভরসা দিলো যেনো চোখের ভাষায় বলে দিচ্ছে মা তুই আজকে বল সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দে। বুঝিয়ে দে সবাইকে জামশেদ মাস্টার তার মেয়েদের সঠিক শিক্ষায় দিয়েছে। বাবার থেকে চোখ ফিরিয়ে মাথার উড়নাটা ঠিক ভাবে টেনে নিলো। চেয়ারম্যান রেগে বলে উঠল, এটা কেমন ব্যাবহার, মাস্টার তোমার মেয়েকে বলো এখান থেকে যেতে তুমি বলোনি তোমার মেয়েকে বিচার সভায় মহিলাদের এভাবে আসা সঠিক নয়।

আমার আব্বা আমাকে সঠিক শিক্ষায় দিয়েছে আমি শুধু এখানে কয়েকটা কথা বলার জন্য এসেছি বলা হয়ে গেলে চলে যাবো।

মেয়েদের এতো বেশি কথা বলা ঠিক নয়। ওখানে থাকা একজন এই কথাটা বলতেই শশী তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, হ্যাঁ ঠিকি বলেছেন মেয়েদের বেশি কথা বলা উচিত নাহ। কারণ তারা যদি মাথা তুলে উচিত কথা বলা শুরু করে তখন আপনারা তাদের উপর আধিপত্য দেখাতে পারবেন নাহ। আর চেয়ারম্যান কাকা আপনি কি বললেন আমি শহরে গিয়ে আকাম কুকাম করে বেড়াচ্ছি আচ্ছা আপনি কি আমাকে ওইসব আকাম কুকাম করার সময় দেখেছেন? নাকি হাতেনাতে ধরেছেন কোনটা? না দেখে না জেনে নিজের মতো করে বানিয়ে দিলেন একটা কথা বাহ। মানে একজনের বাড়িতে কোনো ছেলে থাকলে সেই বাড়িতে যাওয়া মানে আকাম কুকাম করা? তাহলে আপনার বাড়িতেও তো আপনার ছেলে আছে তাহলে কি আপনার বোনের মেয়ে আপনার বাড়িতে আসে নাহ? এখানে সবার বাড়িতেই তো ছেলে আছে তো আপনাদের বাড়িতে কোনো মেয়ে আসে নাহ? আর আপনি কি বললেন আমার চরিত্রের ঠিক নাই কারণ ওইদিন ক্লাবঘরে আমাকে সমুদ্রের সাথে দেখেছেন তাই। তো এখানে আমার একটা প্রশ্ন আপনারা কেউ কি আমাকে আর ওনাকে খারাপ অবস্থায় পেয়েছিলেন? শাহিন গিয়ে আপনাদের বলল আর আপনারা সেই কথা অনুযায়ী কোনো কিছু না দেখেশুনে চলে আসলেন বিচার করতে। আচ্ছা মানলাম আমি সমুদ্রের সাথে খারাপ কিছু করার উদ্দেশ্য ওই ঘরে গিয়েছিলাম আর শাহিন তা দেখেছে তাহলে শাহিন তখনি আপনাদের ডেকে আনলো না কেনো? ওতো জানতো আমার পরিবারের লোকজন আমায় খুঁজতেছে তাহলে সে তখন গিয়ে বললো না কেনো? এখানে থাকা প্রতিটা মানুষই এসেছেন মজা নিতে কেউ সঠিক বিচার করতে আসেননি।

এইটুকু বলে শশী ওর চোখের পানি মুছে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিলো এইটুকু বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। বিচার করতে আসা সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ী করছে চারপাশে শুধুই ফিসফাস কথার আওয়াজ। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে শশী আবার বলতে শুরু করলো, আমি এখন এই রাতেই শহরে যাবো এবং ওই বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করবো আপনাদের যা করার আছে আপনারা করেন। কি করবেন আমাদের একঘরে করে দিবেন তো ঠিক আছে করে দিন একঘরে, দরকার নাই এমন প্রতিবেশী যারা চোখ থাকতেও অন্ধ ঙ্গান থাকতেও নির্বোধ।

নিজের মন মতো সবটা বলা শেষে শশী দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেলো। শাহানারা কানে ফোন রেখেই মুচকি হেসে ওপাশে থাকা সমুদ্র কে বলল, আমি আজকে সত্যিই অনেক খুশি তুই এই চাকরিতে যাওয়ার পর থেকেই সব সময় ভয়ে থাকতাম তোর উপর ভীষণ অভিমান হতো। তোকে হারানোর ভয় হতো, তোর বাবাকে হারিয়েছি অভিককে হারিয়েছি আমি অনেক ক্লান্ত তোর কিছু হলে সেটা সয্য করতে পারতাম নাহ। তবে তুই আজকে যেটা করলি এখন আর কোনো অভিমান নেই তোর উপর এটা দরকার ছিলো কিছু মানুষের ভুল তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার দরকার ছিলো যেটা শশী করেছে।

আমি চাই না আমার কারণে কোনো পরিবার এভাবে হেনস্তা হোক। এখানে আমার ও ভুল ছিলো মা তাই আমার যেটা ভালো মনে হয়েছে সেটাই করেছি। এখন তাহলে রাখছি অনেক ক্লান্ত লাগছে একটু ঘুম প্রয়োজন রাতে সময় পেলে কথা বলবো।

কথাশেষ করে সমুদ্র কান থেকে ফোন নামিয়ে পাশে রেখে দুইহাত মাথার নিচে দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো ভাবতে লাগলো। একটু আগে যখন সমুদ্র ফোন হাতে নেয় দেখে ওর মায়ের নাম্বার থেকে অনেকগুলো ফোন এসেছে। সমুদ্র কল ব্যাক করতেই জয় ফোন ধরলো, এতোক্ষণ জয়ই কল দিচ্ছিলো। সমুদ্র জিগাস করতেই জয় হরবর করে সবটা বলল সব শুনে সমুদ্র মোটেও বিচলিত না হয়ে জয়কে বলল ফোনটা নিয়ে মাকে দিতে। জয় সেই মতো ফোনটা শাহানারার কাছে দিতেই সমুদ্র কিছু না বলে শুধু বলল ফোন নিয়ে সোজা শশীর কাছে যেতে। ছেলের কথামত শাহানারাও ফোন নিয়ে শশীর কাছে গেলো। শশী তখন নিজের ঘরে বসে কান্না করতে ব্যাস্ত আব্বার এতো অপমান হচ্ছে এই সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করছে। আর যখনি মনে হচ্ছে এই সব কিছুই জন্য ও দায়ী তখনি নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। শাহানারা শশীর পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল।

সমুদ্র তোর সাথে কথা বলবে।

শশী অবাক হয়ে শাহানারার দিকে তাকালো তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিজের কানে ধরতেই ওপাশ থেকে সমুদ্র বেশ গম্ভীর স্বরে বলল, তোমাকে শুধু কয়েকটা কথা বলবো তারপর তুমি সিদ্ধান্ত নেবে যে তুমি কি করবে। এই যে তুমি এখন ঘরে বসে কোনো দোষ না করেও মুখ লুকিয়ে কান্না করছো এটা তোমার দুর্বলতা। আর কিছু মানুষ তোমার এই দুর্বলতা কেই কাজে লাগাচ্ছে। কারণ তারা জানে কাওকে ভেঙ্গে দিতে চাইলে তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে হয়। আজকে তোমার জন্যই তোমার বাবাকে এতোটা অপমানিত হতে হচ্ছে।

এই কথাটা শোনার সাথে সাথে শশী কান্না করে ফেলল সমুদ্র ধমক দিয়ে বলল, এই মেয়ে কথায় কথায় এমন কান্না করো কেনো? তোমার জন্যই তো এসব হচ্ছে। তুমি চুপ করে আছো বলেই এসব হচ্ছে। তুমি চুপ করে আছো বলেই তারা তোমার বাবাকে অপমান করতে পারছে। এখন তোমার বাবার হয়ত আফসোস হতে পারে যে তার কোনো ছেলে নেই কেনো ছেলে থাকলে আজকে এই দিনে সে তার পাশে দাঁড়াতো। তুমি কিন্তু চাইলেই তোমার বাবাকে এই অপমান থেকে মুক্তি দিতে পারো, এর জন্য কি দরকার জানোত একটু সাহস কিন্তু সেটা তোমার নেই। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তুনি জেনে বুঝে তোমার বাবাকে অপমানিত হতে দেখছো। মানুষ কি বলবে সেই ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছো। পরিশেষে একটা কথায় বলবো নিজের দুর্বলতাকে হাতিয়ার বানাও যেনো কেউ তোমার দুর্বল জায়গায় আঘাত না করতে পারে মাকে ফোনটা দাও।

শশী ফোনটা শাহানারার কাছে দিয়ে দিলো। মা তুমি রুম থেকে চলে যাও এবার যা করার ও নিজেই করবে।

তুই এসব কি বলছিস ওইটুকু একটা মেয়ে একা কি করবে?

জীবনে সামনে এগোতে হলে একাই এগোতে হয় মা সেটা তুমি ভালো করেই জানো। ও যদি এখন প্রতিবাদ না করে তাহলে সারাজীবন এটা ভেবে আফসোস করবে যে সেদিন কেনো প্রতিবাদ করলাম নাহ আর আমি চাইনা ও এই আফসোস টা করুক।

বর্তমান,

দেখলেন তো আপনারা ওইটুকু একটা পুচকি মেয়ে কত বড় বড় কথা বলে গেলো শহরে গিয়ে পাখা গজিয়েছে ওর এই পাখা যদি আমি না কাটতে পারি তো আমিও এই গ্রামের চেয়ারম্যান নাহ। ওদের এখনি একঘরে করা হোক একেতো কুকাম করবে তার উপর আবার বড় বড় কথা।

চেয়ারম্যান এর কথা শুনে এখানে থাকা সবাই দাঁড়িয়ে গেলো তারা বলল, কেনো শশী তো ঠিক কথায় বলেছে আমরা কোনো কিছু না দেখে শুধু শুধু এসব কথা বলতে পারি নাহ। আর শাহিন ওইদিন রাতে শশীকে ক্লাবঘরে দেখলে আমাদের সবাইকে তখনি না ডেকে সকালে ডাকলো কেনো? আর মাস্টার কে তো আমরা চিনি তিনি কেমন মানুষ শশীও এই গ্রামের মেয়ে ছোট বেলা থেকে চোখের সামনে ওকে বড় হতে দেখেছি। না না চেয়ারম্যান সাহেব কোনো প্রমাণ ছাড়াই আপনি এমন বলতে পারেন নাহ আমরা মানতে পারছি নাহ।

ওখানে থাকা সবাই একসাথে কথাটার সমর্থন করলো। চেয়ারম্যান আর শাহিন পড়ে গেলো বিপাকে পরিস্থিতি খারাপ দেখে ছেলেকে নিয়ে ওখান থেকে আলগোছে কেটে পড়ল। সাথে ওখানে বিচার করতে আসা সবাই জামশেদ মাস্টার এর কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে গেলো। জামশেদ মাস্টার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সবাই শুনলে তো এই জামশেদ মাস্টার তার মেয়েকে সঠিক শিক্ষায় দিয়েছে।

#চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here