#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৬
সময়টা প্রায় বিকাল চারটা পাঁচের কাছাকাছি। আদ্রিতা লজ্জায় মাথা নুইয়ে বসে আছে। আচমকা ফারিশকে জড়িয়ে ধরায় সে বেশ লজ্জিত। এই উদগাট কাজ এর আগে কখনো করে নি আদ্রিতা। ইস! ফারিশ কি ভাবলো। আদ্রিতা আড়চোখে ফারিশকে দেখলো। ছেলেটাকে বেশ স্বাভাবিক আর শান্ত দেখাচ্ছে। কি সুন্দর নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে। যেন কিছু হয় নি এমন। আদ্রিতার মুখ দিয়ে আর কথা বের হতে চাইলো না। ফারিশ অনেকক্ষণ পর বললো,
“এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরলে আমি কিন্তু মারা পড়বো ডাক্তার ম্যাডাম।”
আদ্রিতার লজ্জিত মুখ আরো লজ্জিত হলো। তার ইচ্ছে করছে চলন্ত গাড়ি থেকে ছুট্টে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তা আর হলো না। নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্থ করে লজ্জিত স্বরে বললো,
“আমি তো ডাক্তার মানুষ পুরোপুরি মারা পরার আগে ঠিক বাঁচিয়ে নিবো।”
ফারিশ হাসলো। বললো,
“আপনি কিন্তু দারুণ কথা জানেন।”
“আপনার চেয়ে কম।”
“আমার তো মনে হয় না।”
“কিন্তু আমার মনে হয়।”
“এর আগে কোনো পুরুষকে জড়িয়ে ধরেছেন ডাক্তার ম্যাডাম?”
আদ্রিতা আবার লজ্জায় পড়লো। এই ছেলে জড়িয়ে ধরা ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা কি বলতে পারছে না। আদ্রিতা নীরব রইলো। ফারিশ বললো,
“উত্তর কিন্তু পেলাম না।”
“যদি না দেই।”
“আমি কি জোর করতে পারি!”
“আপনি কি চান আমি আর কখনো আপনায় জড়িয়ে না ধরি?”
ফারিশ জবাব দেয় না। আদ্রিতাও আর কিছু বলে না। গাড়ি চলে আপন মনে। গাড়ি তখন প্রায় হসপিটালের কাছাকাছি চলে এসেছে। হঠাৎ ফারিশ প্রশ্ন করে,
“আপনি কি কাঁচের চুড়ি পছন্দ করেন?”
আদ্রিতা বেশ অবাক হয় প্রশ্নে। বলে,“কেন?”
ফারিশ বিরক্তবোধ করে উত্তরে। চোখ মুখ কুঁচকে বলে,“কেনোর উত্তর দিবো না। পছন্দ করেন কি না বলুন?”
আদ্রিতা শান্ত স্বরে শুধায়,“করি।”
ফারিশ কতদূর গিয়েই হঠাৎ গাড়ি থামায়। হসপিটাল দেখা যায় দূর থেকে। আদ্রিতা বিচলিত কণ্ঠে বললো,“আর একটু সামনে যেতে হতো তো।”
ফারিশ সামনে যায় না। উল্টো পিছনে যায়। আদ্রিতার চোখে মুখে বিস্ময়। ফারিশ তখন আসার পথে একটা ছেলেকে দেখে মাথায় হাজি চেপে কাঁচের চুরি নিয়ে যাচ্ছে। ফারিশ সোজা ছেলেটার সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো। জানালার কাঁচ নামিয়ে ডাকলো,“এই পিচ্চি।”
ছেলেটি দাঁড়ালো। পিছন ফিরেই বললো,“আমারে ডাহেন।”
ফারিশ তার পানে তাকিয়ে বলে,“হুম তোমারেই ডাকি। এদিকে আসো।”
ছেলেটি খুশি হলো মাথার হাজিটা শক্ত করে চেপে ধরে এগিয়ে গেল ফারিশের দিকে। ফারিশ গাড়ির দরজা খুললো। বললো,“চুড়ি কত করে?”
ছেলেটি মাথার হাজি মাটিতে রাখলো। ক্লান্ত শরীরে বললো,
“কয়ডজন নিবেন এক এক ডজন চল্লিশ টাহা কইরা।”
“সব কি কাঁচের চুড়ি?”
“হ।”
“সব মিলিয়ে কত ডজন হবে?”
“পনচাস ডজন।”
“ভালো হবে তো।”
“হা। এককালে খাসা মাল আইজগোই বাজার তোন কিন্না আনছি। সাহেব হয়ালে করেন বাড়ি যাওন লাগবে নইলে আম্মায় রাগ হইবো। আম্মার আবার জ্বর আইছে। ঔষধও কেনা লাগবো।”
ফারিশের বুক ভাড়ি হয়ে উঠলো। ফারিশ আর সময় না দিয়ে মানিব্যাগ থেকে দুটো এক হাজার টাকার নোট বের করে ছেলেটার কাছে দিলো। বললো,“সব চুড়ি দিয়ে দেও।”
ছেলেটির চোখ ছানাবড়া। সে বললো,
“এতগুলান চুড়ি আমনে একলা নিবেন?”
“হুম।”
ছেলেটি খুশি হলো। এক হাজি চুড়ি এগিয়ে দিলো ফারিশের দিকে। ফারিশ নিলো। আদ্রিতার কাছে দিয়ে বললো,“এগুলো আপনার জন্য।”
আদ্রিতার চোখ আরো দিগুণ বড় বড় হয়ে গেল। হতভম্ব স্বরে বললো,
“এতগুলো চুড়ি।”
“হুম।”
ফারিশ ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,“ভালো থেকো। আর তোমার আম্মার যত্ন নিবা কেমন।”
ছেলেটির মুখে জড়ানো হাসিটা আরো বাড়লো। হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো,“আমনেও ভালো থাকবেন। আমি যাই।”
ছেলেটি দৌড়ে টাকা দুটো দেখতে দেখতে চলে গেল। ফারিশ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ছেলেটির যাওয়ার পানে। অতঃপর জোরে নিশ্বাস ফেলে গাড়ির দরজা আঁটকে বললো,“তাহলে যাওয়া যাক।”
আদ্রিতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
“এতগুলো চুুড়ি নিয়ে আমি কিভাবে হসপিটাল যাবো?”
“এটা আপনার সমস্যা আমার না।”
“আপনি তো ভাড়ি অদ্ভুত মানুষ।”
“এটা কি আজ নতুন নাকি।”
আদ্রিতার অসহায় মুখ। এখন কি করবে ভাবছে। তার বন্ধুমহল এগুলো দেখলে নির্ঘাত সন্দেহের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে যাবে। ফারিশ এসে হসপিটালের সামনে গাড়িটা থামালো। নীরবে বললো,“নামুন।”
আদ্রিতা নামলো না। ঠায় বসে রইলো। ফারিশ আবার বললো,“কি হলো?”
আদ্রিতার অসহায় মুখ। ছলছল চোখে
বললো,
“এগুলো পরে নিলে হতো না।”
ফারিশ শ্বাস ফেলে বললো,
“কত পরে?”
“ওই রাতে ফেরার পথে।”
ফারিশ বেশি ভাবলো না। আদ্রিতার হাত থেকে চুড়ির হাজিটা নিয়ে বললো,“ঠিক আছে।”
আদ্রিতা নেমে পড়লো। বললো,“আমি কিন্তু ওগুলো নিবো।”
ফারিশ মৃদু হেসে বললো,“আচ্ছা।”
আদ্রিতা চলে গেল। ফারিশও আর না দাঁড়িয়ে গাড়ি স্ট্যার্ট দিলো।’
—-
আদ্রিতা হসপিটালে ঢুকতেই তার আদিবকে নজরে পড়লো। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে বাহিরে বের হয়েছে। আদ্রিতা কৌতুহলী এগিয়ে গেল আদিবের দিকে। বললো,“ভাইয়া আপনি এখানে?”
আদিব খানিকটা চমকে উঠলো। মৃদু হেসে জবাব দিলো,
“তুমি এসে পড়েছো?”
“জি। তা আপনি এখানে কি করছেন?”
“তেমন কিছু না।”
“আপনার কি গালে ব্যাথা?”
সঙ্গে সঙ্গে গাল থেকে হাত সরালো আদিব। বললো,“না। এক বন্ধু এই হসপিটালে ভর্তি তাকেই দেখতে এসেছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা।”
আদিব হন হন করে চলে গেল। ঘাবড়ে ছিল একটু। আদ্রিতাও বেশি না ভেবে ছুটে গেল ভিতরে।”
—-
রাত প্রায় বারোটা ছাড়িয়ে। আদ্রিতা তার কাজ সেরে হসপিটাল থেকে বের হলো। সোহেলকে বললো,“গাড়ি নিয়ে আসতে।”
সোহেল সঙ্গে সঙ্গেই এলো। তবে মাথা নিচু করে। আদ্রিতা বিস্মিত নজরে তাকালো সোহেলের দিকে। তার হাবভাব দেখে বললো,“কি হয়েছে?”
সোহেলের কাঁদো কাঁদো মুখ। বিস্ময়কর চেহারা নিয়ে বললো,“ম্যাডাম কে যেন গাড়ির হাওয়া বের করে দিছে।”
আদ্রিতা হতভম্ব স্বরে বললো,“কি বলো এসব?”
সোহেল মাথা নিচু করেই বললো,“মিথ্যা বলছি না ম্যাডাম আপনি গিয়া দেখেন।”
আদ্রিতা গেল। সত্যি সত্যি তার গাড়িটার সামনের এক চাকার পাম নেই। আদ্রিতা বিরক্ত হলো খুব। ক্লান্ত লাগছে প্রচুর। আদ্রিতা নিরাশ সরে বললো,
“গাড়িটা ঠিক করে নিও।”
“আচ্ছা ম্যাডাম। আমি কি একটা গাড়ি নিয়ে আসবো আপনার জন্য?”
“দরকার নেই আমি পারবো।”
আদ্রিতা বেরিয়ে গেল। আদ্রিতা হসপিটাল থেকে বের হতেই দূর থেকে একটা গাড়িও বের হলো। পিছু নিলো আদ্রিতার কতদূর এগিয়েই সোজা আদ্রিতার সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো। বললো,“আপনার চুড়িগুলো কি নিবেন না ডাক্তার ম্যাডাম?”
আদ্রিতা তড়িৎ চমকে উঠলো। এতরাতে ফারিশকে আশা করে নি। ফারিশ গাড়ির দরজা খুললো। বললো,“ভিতরে আসা হোক।”
আদ্রিতা নিরদ্বিধায় গাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো। দরজা আঁটকে সিটব্লেট লাগালো। বললো,“আপনি কখন এলেন?”
ফারিশের দ্রুত জবাব,“গেছিলাম কখন।”
আদ্রিতা অবাক হলো। বিস্মিত নজরে তাকালো। বললো,“আপনি তখন যান নি?”
ফারিশের দ্বিধাহীন উত্তর,“আপনার চুড়িগুলো যেতে দিল কই।”
ফারিশ গাড়ির পিছন থেকে হাজি সমেত চুড়ি আদ্রিতার হাতে দিলো। বললো,“নিন যত্নে রাখবেন। মাঝে মধ্যে পড়বেন। রিনিকঝিনিক শব্দ করে আমাকে মাতাল বানাবেন। ঠিক আছে।”
ফারিশের শেষ কথায় হাসলো আদ্রিতা। বললো,
“আপনি একটা বিশাল আজব মানুষ।”
“সত্যি কি আজব মানুষ আমার কিন্তু মনে হয় না।”
“আপনার সাথে কথায় জেতা মুশকিল।”
“হারতেও তো নারাজ।”
আদ্রিতা এবার চুপ হয়ে গেল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। ফারিশ প্রশ্ন করলো,
“খেয়েছেন?”
“না বাসায় গিয়ে খাবো।”
“আমার সাথে খাবেন।”
“মা অপেক্ষা করছে।”
“আচ্ছা তাহলে অন্য আরেকদিন।”
“ঠিক আছে।”
“আপনায় একটা কথা বলবো?”
“জি বলুন,
ফারিশ সময় নিলো এক সেকেন্ড, দু’সেকেন্ড, এক মিনিট চলে তাও কিছু বললো না। আদ্রিতা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,“কি হলো বলুন?”
এবার তড়িৎ উত্তর ফারিশের
“আজ থাক। অন্য আরেকদিন।”
আদ্রিতাও আর জোর করলো না। ফারিশ গাড়ি নিয়ে এসে সোজা থামালো আদ্রিতাদের বাড়ির সামনে। আদ্রিতা একঝলক বাড়িটার দিকে তাকিয়ে। ফারিশের দিকে এগোলো। ফারিশ চমকে উঠলো। প্রশ্ন করলো,“কি করছেন?”
আদ্রিতার হাঁসি পেল। ছেলেটা কি ভয় পাচ্ছে। আদ্রিতা ফারিশের কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বললো,“বিকেলের উত্তরটা এখন দিলে আপনি কি খুব রাগ করবেন মিস্টার বখাটে?”
ফারিশ কিছু বলে না। আদ্রিতা শীতল স্বরে আওড়ায়,
“আমি আপনিহীনা কোনো পুরুষকে গভীর ভাবে কখনোই ছুঁই নি।”
আদ্রিতা কথাটা বলেই জড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল। ফারিশ ঠায় বসে। তার কথাটা বুঝতে তিন সেকেন্ডের মতো সময় লাগলো। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে মুচকি হাঁসলো। নিদারুণ সুখময় কণ্ঠ নিয়ে বললো,“এ বুকের হাজারো যন্ত্রণার ভিড়ে আপনি এক শ্রেষ্ঠ অনুভূতি ডাক্তার ম্যাডাম।”
#চলবে…..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️