#মৃগতৃষ্ণা
#পর্ব:০৪
হেমন্তি হুট করেই পেছনে ফিরলো কিন্তু চোখ খুলছে না ভয়ে। কিছু মূহুর্ত চোখ বন্ধ করে রেখে তারপর আস্তে আস্তে এক চোখ খুলল, এক চোখ খুলেই পরমূহুর্তেই আরেক চুখ খুলে হেমন্তি আবিষ্কার করলো তার স্বপ্নে আকা মানব সুলায়মানকে। বুকে হাত দিয়ে আমতা আমতা করে বলল উফফফ,!! আপনি!!
আপনি এত রাতে এখানে মি.সুলায়মান??
সুলায়মান তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে হেমন্তিকে বললো প্রশ্নটা আমার করার কথা নয় কি? আপনি এত রাতে এখানে ঘুরাঘুরি করছেন কেন বলুনতো? আপনি জানেন না মধ্যরাতে সবাই ঘুমের ঘোরে থাকে, আপনার পায়ের আওয়াজে তো তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, জানেন না নাকি?
সুলায়মানের এত প্রশ্নে হেমন্তি যেন হাপিয়ে গেছে। হেমন্তি সুলায়মানের প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে আবার প্রশ্ন করলো -আচ্ছা আপনাদের রাজবাড়ীতে আসার পর থেকে কোনো বাচ্চাকে দেখলাম না যে, এ বাড়িতে কোনো বাচ্চা নেই নাকি?
সুলায়মান যেন একটু ভড়কে গেলো তবুও সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল- হঠাৎ এই প্রশ্ন যে?
এ যেন প্রশ্নের প্রতিযোগিতা চলছে, দুজন দুজনকে কেবল প্রশ্ন ই করে যাচ্ছে উত্তর দেওয়ার কোনো বালাই নেই বললেই চলে।
হেমন্তি অবশেষে বলে উঠল আমার মনে হলো কোনো বাচ্চা কাঁদছে তাই আমি দেখতে এলাম আর কি। কিন্তু কোথাও আমি কোনো বাচ্চাকে দেখতে পেলাম না!!
সুলায়মান বিরক্তির সুরে বলে উঠল এটা আপনার মনের ভুল, আর শুনুন রাতের অন্ধকারে রাজবাড়ী তে ঘোরাঘুরি করবেন না আর এ বাড়িতে কোনো বাচ্চা-কাচ্চা নেই। আপনি আপনার কক্ষে যান।
হেমন্তি সুলায়মানের কথায় একটু অপমান বোধ করলো কিন্তু অবাক হলো এই এত্ত বড়ো রাজবাড়ীতে কোনো বাচ্চা নেই এমনকি দাস-দাসীদেরও কোনো বাচ্চা নেই এ বাড়িতে। তবে এত রাতে যে ও কোনো বাচ্চার চিৎকার এর শব্দ পেলো সেটা কিসের তবে? মনের এত বড় ভুল হতে পারে সেটা কিছুতেই মানতে পারছেনা হেমন্তি। কোনোরকমে সে এক পা দু পা করে পা ফেলে নিজের কক্ষে এসে পৌছাল। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে সে ভাবনায় পড়ে গেলো। ভাবতে ভাবতে সে কখন যে তন্দ্রাঘোরে চলে গেলো নিজেও জানেনা।
______
সুলায়মান হেমন্তিকে তার কক্ষে পাঠিয়ে দিয়ে জুলেখার খাবার নিয়ে মধ্যরাতের শেষভাগে দরজায় কড়া নাড়লো। জুলেখা বিছানা ছেড়ে তারাহুরো করে দৌড়ে এগিয়ে এলো দরজার সামনে। সুলায়মান তার হাতে থাকা খাবারের প্লেট এগিয়ে দিতে যাবে তার আগেই জুলেখা হুড়মুড় করে সুলায়মানের হাতে থাকা প্লেটটা একপ্রকার কেড়ে নিয়েই বললো
– মধ্যরাত শেষ হয়ে আরেকটু পর ভোরের আলো ফুটে গেলে কি আর এসব বাচ্চাদের ক*লিজা কাজে দেবে বলুনতো?আপনি আমাকে এখন আর আগের মতো করে ভালোবাসেন না বোধহয় এজন্যই আমাকে বাঁচানোর আকুলতা এখন আর আপনার মধ্যে দেখিনা।
সুলায়মান যেন জুলেখার কথায় একটু মনে আঘাত পেলো তবু জুলেখাকে সেটা বুঝতে না দিয়ে বলে উঠলো — ছি!ছি! বেগম এসব ভাবনা মনে আনাও যে পাপ।আমি তোমাকে এই পৃথিবীর শতভাগের ভালোবাসার শতভাগেরই পরিপূর্ণ ভালোবাসি।
আসলে আজ যে মেহমানরা আমাদের বাড়িতে এসেছিল তার মধ্যে একজন মধ্যরাতে কক্ষের বাইরে চলে এসেছিল তাই তাকে সামলে নিয়ে আসতে আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। যেহেতু এখন বাড়িতে মেহমান মানে বহিরাগতদের অবস্থান তাই তোমাকে এই কয়েকদিন মধ্যরাতেই খেতে হবে নতুবা ওনাদের কাছে আমাদের কর্মকাণ্ড ফাঁস হয়ে যেতে পারে। আমি চাইনা কেউ আমাদের চুল পরিমাণ ও সন্দেহ করুক। আমার বেগমের গায়ে আমি ছিটেফোঁটা আচও আসতে দেবোনা, প্রয়োজনে আমি পুড়ে ছাই হয়েও আমার বেগমকে বাঁচাবো।
জুলেখা সুলায়মানের দিকে কিছুমূহুর্ত মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো অত:পর চোখ সরিয়ে খাবারের প্লেটের দিকে নজর দিলো। জুলেখার চোখ চকচক করছে সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না৷ ধুপধাপ পা ফেলে জুলেখা বিছানায় বসে গোগ্রাসে গিলতে লাগলো।
সুলায়মান অপলক চেয়ে আছে জুলেখার দিকে।
বিশ বছর সে যে জুলেখাকে চিনতো তাকে এই এক মাসে অনেক অচেনা মনে হয়। মনেই হয়না এই সুনয়নাকে সে কখনো চিনতো। যার প্রতিটি কাজেই মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতো সুলায়মান এখন তার প্রতিটি কাজেই অবাক হয়।
জুলেখা খাওয়া শেষ করে চোখ উপরে তুলে তাকায় আর বলে আপনি কি দেখছেন ওমন করে জনাব? জুলেখার হাটা,চলা, তাকানো, খাওয়া,ঘুমানো কি আজও সেই প্রথম দিনের মতো মুগ্ধ করে আপনাকে?
সুলায়মান মৃদু হাসি দিয়ে বলল আজও আমার বেগমের প্রতিটা পদক্ষেপ আমায় মুগ্ধ করে তবে এখন সেই সাথে সাথে অবাক ও হই বটে।
জুলেখা এবার বিস্ময়কর চোখে চেয়ে রইলো, অবাক হন কেন এই প্রশ্নটা করবে করবে করেও করতে পারছে না।জুলেখার মুখটা মলিন হয়ে আছে।
সুলায়মান যেন তার বেগমের মনের কথাও শুনতে পায় তাই সে বলে উঠল আমি জানি বেগম তুমি কি জানতে চাইছো, আমি কেন অবাক হই তাইনা?
জুলেখা মাথা নাড়াল।
সুলায়মান একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করল এই এক মাসে তুমি কেবলই রাতের খাবারের জন্য ছটফট করতে থাকো আমি সারাদিন পর রাতে বাড়িতে ফিরে আসার পর তোমার প্রথম প্রশ্নটা হয়, কলিজা পেয়েছেন?? কিন্তু এক মাস আগেও আমি যখনই বাড়িতে পা ফেলতাম তুমি জিজ্ঞেস করতে আপনার বেগমকে কে মনে পড়লো তবে? আমি হেসে উত্তর দিতাম আমার বেগম সবসময় আমার মনেই অবস্থান করে। তাকে ভুললে তো মনে পড়বে। আরও কত খুনসুটি হতো আমাদের কিন্তু এখন সেসব অতীতের খাতায় নাম দিয়েছে।
জুলেখার চাহনি বেশ করুন, সুলায়মান তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল বেগম তুমি নিশ্চিত হও এতে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা -প্রেম বিন্দুমাত্র ও কমেনি বরং দিন দিন আমার ভালোবাসা শুধু বেড়েই চলেছে।
-আমার শেষ ইচ্ছে যদি জানতে চাও তবে আমি বলবো তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার যেন মৃত্যু হয় তবে শেষ বেলায়ও বেগম সুনয়না জুলেখার মুগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে মরতে…….
সুলায়মানের মুখ চেপে ধরে জুলেখা আর বলে, এমন কথা মুখেও আনবেন না বলে দিলাম। আমি যে আপনার জন্যই বাচতে চাই, আপনার ভালোবাসা এতই তীব্র যে আমায় বেঁচে থাকার লোভ দেখায়।
আমার তো ক*লিজা খা*ওয়ার লোভ নেই, লোভ হচ্ছে আপনার ভালোবাসা পাওয়ার। আপনার ভালোবাসাই যে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারন জনাব।
সুলায়মানের ওষ্ঠাধর জুড়ে হাসি ফুটে উঠলো সে খুশি হলো এটা জেনে তার বেগম তাকে আগের মতো করেই ভালোবাসে। ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটাই শুধুমাত্র বদলে গেছে।
সুলায়মান এবার তার বাহুডোরে জুলেখাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
_________
চারদিকে ভোরের আলো ফুটেছে পাখিদের কন্ঠে গান হচ্ছে হু হু করে বাতাস বইছে এমন সুন্দর পরিবেশ বোধহয় রাজবাড়ী কে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে রেখেছে । সিরাজ, দিগন্ত, রফিক ও সোফিয়া ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো কিন্তু এখনো হেমন্তির ঘুম ভাঙেনি। সিরাজ মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে উঠলো ও বোধহয় মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছে এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে দেখ। ও না না মামাবাড়ি না মামাবাড়ি না এটা তো আবার ওনার শশুড় বাড়ি।
সবাই ওর কথা শুনে হাসলেও রফিক বললো তাহলে তো বলতে হয় এটা তোর স্বপ্নের বেগমের স্বামীর বাড়ি। আবারও ওরা হো হো করে হেসে উঠল। তন্মধ্যেই হেমন্তির ঘুম ভাঙলো এত কোলাহলে কি ঘুমানো যায় নাকি। হেমন্তির জানা আছে যে তার উঠতে দেরি হওয়ায় আর কেউ কিছু বলুক আর না বলুক সিরাজ তাকে কথা শোনাবেই।
এরপর ওরা সুলায়মানের অনুমতি নিয়ে নিলো পুরো রাজবাড়ী ঘুরে দেখার শুধুমাত্র জুলেখার কক্ষ ছাড়া। জুলেখা কোনো পুরুষ কে মুখ দেখায় না প্রায় আঠারো বছর হলো। হেমন্তি আর সোফিয়াকে মেয়ে হওয়া সত্বেও অনুমতি দেয়নি সুলায়মান।
হেমন্তি সুলায়মানকে দিন আর রাতের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছে কারন তার সাথে দেখা হওয়া মানব টির রাতের অন্ধকারে কেমন যেন অন্যরকম মনে হলো চেহারায় কোনো মায়া-মমতা ছিলোনা কিন্তু দিনের আলোতে তার চেহারায় সেই মায়া মমতা ফুটে উঠেছে।
হেমন্তি রাতের ঘটনাটা কাউকে বললো না যদি ওরা এটা নিয়েও মজা করে তাই। কিন্তু মনের মধ্যে প্রশ্নটা রয়েই গেলো।
সবাই মিলে পুরো রাজবাড়ী ঘুরছে আর ওদের অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লিখে রাখছে। ওদেরকে এ বাড়ি ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব এ বাড়ির পুরোনো একজন কর্মচারী আবুল মিয়াকে। তাকে ওরা এ বাড়ির নিদর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে আর তিনি উত্তর দিয়ে চলেছেন। এ বাড়ির সৌন্দর্যে ওরা বিস্মিত, কি অপরূপ দেখতে সবকিছু। হঠ্যাৎ রফিক বলে উঠল তোরা বরং রাজবাড়ী ঘুরে দেখ আমি বাইরেটা পর্যবেক্ষণ করে আসি।
রফিক চায় তার এসাইনমেন্ট সবচেয়ে উত্তমরূপে প্রকাশ পাক, তাই সে শুধু ভেতরটাই নয় বরং বাইরের সৌন্দর্য খুটিনাটি তার ডায়েরি তে লিপিবদ্ধ করতে চায়।
রফিক পুরো বাড়ির চারপাশটা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো আর লিখতে লাগলো।রফিক বাড়ির পেছনটায় অবস্থান করছে এখানে কেউ আসেনা বললেই চলে খুব ছিমছাম পরিবেশ। হাটতে লাগলো রফিক আচমকাই পায়ের সাথে কিছু একটা বেজে উষ্ঠা খেয়ে পড়ে গেলো ও। এই দৃশ্য কেউ দেখে ফেলার আগেই উঠে পড়তে হবে নয়তো বা হাসির পাত্র হতে হবে। রফিক দুই হাতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে আর তখনই খেয়াল করে এখানকার মাটি কাচা, হাত ভেতরে ডেবে যাচ্ছিল রফিক তার আরও শক্তি প্রয়োগ করে ওঠার সময় খেয়াল করে কিছু একটা তার হাতের সাথে লাগছে ঠিক মানুষের আঙুলের মতে।রফিক ধরফর করে উঠে মাটি সরালো কিছুটা মাটি সরাতেই দেখলো একটা হাত,খুব ছোট ছোট আঙুল গুলো, হয়তো বা কোনো বাচ্চার হাত।রফিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা এখানে একটা বাচ্চাকে কেউ পু*তেরেখেছে, কিন্তু কেন?
রাজবাড়ীর পেছনের দরজা আরেকটু খেয়াল করলেই দেখা যায় কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে রফিক তড়িঘড়ি করে আরেকটু মাটি সরাতেই যাবে ঠিক তখনই……..
চলবে,,,,
#লেখা: মুন্নি ইসলাম
[ গল্পটি ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করে পাশে থাকবেন।নেক্সট লেখার পাশাপাশি গল্প সম্পর্কে কমেন্ট করুন আর গল্পটি ভালো লাগলে অবশ্যই পেইজ ফলো করে দিবেন]