চন্দ্রমহল -০২
৪.
“আম্মাজান,এই মেয়েটার নাম বনলতা কে দিছিলো?নামের সাথে স্বভাব চরিত্র ও মিলে গেছে।দেখছেন আম্মা এই মেয়ের স্বভাব চরিত্র ও বন্য প্রাণীদের মতো। কথা বলতে গেলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। ”
প্রভাতের কথা শুনে প্রমিলা ধীর গলায় বললো,”ও বন্য প্রাণীদের মতোই থাকবে,যেভাবে ওর সুবিধা সেভাবেই থাকবে।আশা করছি এসব নিয়ে তোমার অসুবিধা হবার কথা না।মেয়েটা নিশ্চয় তোমার কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে নি।”
প্রভাত মায়ের কথায় বিরক্ত হলো। কথা না বাড়িয়ে প্রমিলার কক্ষ থেকে বের হতে হতে মনে মনে বললো,”আমার অসুবিধা তো ওর চোখ ধাধানো সৌন্দর্য আম্মা,আপনি তার কি বুঝবেন।ওকে নিজের করে না পেলে তো জনম বৃথা যাবে।”
দুই কাখে দুই আচারের বৈয়াম নিয়ে বনলতা ছাদের দিকে যাচ্ছিলো।প্রভাত তা দেখে আশেপাশে তাকালো।নিজের দুই স্ত্রীর কাউকে না দেখে নিজেও পা বাড়ালো ছাদের দিকে।
উপুড় হয়ে বসে বনলতা সবগুলো আচারের বৈয়াম সারিতে সাজিয়ে রেখে,স্টিলের চামচ দিয়ে আচার তুলে তুলে খাচ্ছিলো।প্রভাত গিয়ে পিছনে দাঁড়ালো। পিঠের যেটুকু উন্মুক্ত অংশে চোখ যায় লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে প্রভাত।
নিজের ভিতরের পশুকে আর সংবরণ করতে না পেরে ছাদের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এগুতে লাগলো বনলতার দিকে।
বনলতার মনে হলো কেউ একজন ওর দিকে এগিয়ে আসছে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে। দ্রুত জিহবা দিয়ে লেহন করে স্টিলের চামচ পরিষ্কার করে নিলো।ঝকঝকে চামচে ভেসে উঠলো প্রভাত আসছে তার দিকে এগিয়ে। প্রস্তুত হয়ে রইলো বনলতা। প্রভাত এসে নিচের দিকে ঝুঁকে বনলতার ঘাড়ে হাত দিতেই হিংস্র বাঘিনীর মতো চামচের ডাঁট দিয়ে আঘাত করলো বনলতা প্রভাতের গলার বাম পাশে।অতর্কিত আক্রমণে প্রভাত নিজের গলা চেপে ধরতেই বনলতা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,”আগুনে হাত দিতে নিষেধ করেছি না,জ্বলেপুড়ে যেতে হবে পরেরবার। ”
একমুহূর্ত আর না দাঁড়িয়ে হরিণের মতো দ্রুত পায়ে ছুটে ছাদ থেকে নেমে গেলো। গলার ব্যথায় প্রভাতের অবস্থা খারাপ। মনে মনে বললো,”তোর ওই রূপের আগুনে এই প্রভাত পানি ঢেলেই ছাড়বে,আমাকে আঘাত করেছিস।এবার দেখ আমি কতো নিচে নামতে পারি।”
বনলতা ছুটতে লাগলো করিডর দিয়ে। ছুটতে ছুটতে প্রলয়ের সাথে ধাক্কা খেলো।প্রলয় বিড়বিড় করে বললো,”ননসেন্স”
থমকে দাড়িয়ে বনলতা জিজ্ঞেস করলো,”ননসেন্স বললেন আমাকে?আমাকে কি অশিক্ষিত ভেবেছেন?তবে এই ইংরেজি গালি আমি আপনাকে দিবো না।ইংরেজদের আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি,আর যারা ইংরেজদের চামচামি করে তাদের ও। আপনাকে আমি বলবো আপনি একটা অপদার্থ। ”
এই বলেই বনলতা ছুটতে লাগলো। প্রলয় মুচকি হেসে নিজের কক্ষের দিকে গেলো। তারপর দাসী রূপাকে বললো,”লতাকে বলো আমার জলখাবার দিয়ে যেতে।”
হেঁশেলে দাঁড়িয়ে বনলতা একটা কাঁচা আম নুন লঙ্কা দিয়ে খাচ্ছিলো।রূপা গিয়ে বললো,”ছোট বাবু বলেছেন ওনাকে জলখাবার দিয়ে আসতে তোকে।”
বিরক্তি চেপে বনলতা খাবারের প্লেট নিয়ে দোতলায় প্রলয়ের ঘরের দিকে গেলো।প্রলয় তখন একটা কবিতার বই পড়ছে।বনলতা কক্ষে ঢুকতেই প্রলয় বললো,”পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
বনলতা চমকে তাকাতেই প্রলয় বললো,”আরে এটা একটা কবিতা,তোমাকে বলি নি আমি কিছু।এই প্যাকেটে একটা চুলের খোঁপা রয়েছে,খোলা চুল বেঁধে নিও এটা দিয়ে।ইদানিং খাবারে তোমার চুল পাই আমি।আর এই নুপুর জোড়া পায়ে দিও,তাহলে অন্তত তোমার ষাঁড়ের মতো ছোটার সময় বুঝতে পারবো সামনে ক্ষ্যাপা ষাঁড় আছে।ধাক্কা খাবে না কেউ।”
জলখাবার টেবিলে রাখতেই প্রলয় তাকালো বনলতার হাতের দিকে।তারপর চমকে গেলো হঠাৎ করেই। বনলতা আর না দাঁড়িয়ে খোঁপা,নুপুর নিয়ে চলে গেলো হতভম্ব প্রলয় কে রেখে।
৫.
রাজেন্দ্র নারায়ণ তার পালঙ্কে হেলান দিয়ে শুয়ে ভাবছেন গতরাতের কথা।হঠাৎ করেই তাকে মৃত্যু ভয় চেপে ধরলো।বারবার তার মনে হচ্ছে মৃত্যু তার ভীষণ নিকটে। কেনো এমন লাগছে বুঝতে পারছে না।
বরাবরের সাহসী রাজেন্দ্র নারায়ণ মৃত্যু ভয়ে বিছানায় পড়ে আছে ভাবতেই তার লজ্জা লাগছে।আবার ভয়টাও অমূলক নয় বিধায় ঝেড়ে ফেলতে পারছে না।
ইচ্ছে করছে চার পুত্রকে নিজের চারপাশে বসিয়ে রাখে কিন্তু তা সম্ভব না।
এই প্রথম বারের মতো রাজেন্দ্র নারায়ণের আফসোস হচ্ছে নিজের একটা মেয়ের জন্য।
প্রমিলাকে সে কথা বলতেই প্রমিলা বললো,”আমার তিনটা জীবন্ত মেয়েক মাটিচাপা দিয়ে মেরে ফেলতে সেদিন কি হাত কাঁপে নি।আজ কেনো মেয়ের জন্য আফসোস হচ্ছে! ”
লজ্জা পেলো রাজেন্দ্র নারায়ণ। তারপর বললো,”কন্যাসন্তান কেনো আমার অপছন্দের ছিলো তা তুমি ভালো করে জানো প্রমিলা।চোখের সামনে আমার সেই দৃশ্য ভেসে উঠে আজও।যেনো জীবন্ত সব।”
প্রমিলা কিছু বললো না।রাজেন্দ্র নারায়ণ নিজের ভয় কাটানোর জন চাকরকে হুকুম দিলো মদের বোতল খোলার জন্য।এই একটা তরল পদার্থ আছে শুধু ভয় কাটানোর জন্য।
প্রমিলা রেগে গিয়ে বললো,”আমার কক্ষে আমি এসব ছাইপাঁশ খেতে দিবো না।”
রাজেন্দ্র নারায়ণ বের হয়ে গেলেন বাহিরে তার মদ খাওয়ার কক্ষে।
চাকর এসে মদের বোতল দিয়ে চলে গেলো। দরজা লাগিয়ে দিয়ে জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ মদ খেতে লাগলো।আস্তে আস্তে নিজের শরীর উত্তেজিত হতে লাগলো।সারা কক্ষে পায়চারি করতে লাগলো রাজেন্দ্র নারায়ণ। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকৃতির মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে বললো,”এই নটীর বাচ্চা,হা করে দেখছিস কি হ্যাঁ! ”
মদের ঘোরে থাকা রাজেন্দ্র টের পেলো না মূর্তির পিছন থেকে একটা নারীদেহ বেরিয়ে এসে কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর একটা সুচালো স্টিলের শিক ঢুকিয়ে দিলো জমিদারের চোখের একপাশে সন্তর্পণে যাতে চোখে না লাগে।”
গগনবিদারী চিৎকার তুলে রাজেন্দ্র নারায়ণ মেয়েটির চুল চেপে ধরলো। চুলের খোঁপাটা রেখে মেয়েটা ছুটে পালিয়ে গেলো।
মুহুর্তেই লোক জড়ো হয়ে গেলো।সবাই হতবাক হয়ে ভাবতে লাগলো কে এই মেয়ে,যে দুই বার এভাবে হামলা চালালো জমিদারের উপর।
প্রলয় নিজের বাবার হাতে বনলতার খোঁপাটা দেখে এবার আর চমকালো না।গতরাতেই সে বুঝেছে বাগানবাড়িতে বনলতা ছিলো।সবাই যখন সারা বাগান বাড়ি খুঁজে ও কিছু পেলো না তখন প্রলয়ের নজর গেলো সুড়ঙ্গপথের দিকে।
সুড়ঙ্গের মুখে একটা ঝোপালো কাটাযুক্ত গাছের সাথে প্রলয় এক গোছা চুল পেলো।নাকের কাছে ধরতেই এক চেনা ঘ্রাণ নাকে ধাক্কা দিলো।
ধীর পায়ে বের হয়ে গেলো বনলতার খোঁজ করতে।
৬.
বনলতা জমিদার বাড়ির পিছনে পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে অস্ত্রচালনা অনুশীলন করছিলো। খুঁজতে খুঁজতে প্রলয় সেখানে এসে পৌছায়। বনলতার মুখে ক্রোধের পরিপূর্ণ ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে।গ্রীষ্মের এই তপ্ত দুপুরে ঝিঝিপোকারাও যখন চিৎকার করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সেখানে উন্মাদনায় মেতেছে এক বন্যলতা।
প্রলয় গিয়ে সোজা বনলতার তরবারির সামনে দাঁড়ালো। সাথেসাথে বনলতা থেমে গেলো।
হতবাক হয়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করলো,”কেনো লতা?
আমার আব্বাজানকে কেনো তুমি এভাবে খুন করতে চেয়েছো?”
একমুহূর্ত চুপ থেকে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে বনলতা। তারপর বললো,”ভুল বললেন ছোট বাবু,আমি এখনো আপনার বাবাকে হত্যা করার জন্য মনস্থির করি নি।আমি তো এখনো তাকে ভয় দেখাচ্ছি।এতো সুখের মরণ তাকে আমি দিবো না।তাকে আমি নৃশংসভাবে হত্যা করবো।এগুলো তো শুধুমাত্র তাকে আতংকে রাখার জন্য করা।”
প্রলয় বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছালো।তারপর বললো,”তোমার ভয় লাগছে না আমাকে?
আমি যদি আব্বাজানকে গিয়ে বলে দেই সব?”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে বনলতা বললো,”মৃত্যুর ভয় বনলতার নেই,আপনার বাবা আমার কেশাগ্র ও ছুঁতে পারবে না।আর আপনাকে কেনো বলেছি এসব জানেন?
আপনার মনে আমার জন্য যে অন্যায় অনুভূতি জন্ম দিচ্ছেন সেই অনুভূতিকে যেনো অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে পারেন তার জন্য।”
প্রলয় ভীষণ অবাক হলো।দেখতে চুপচাপ,শান্ত শিষ্ট এই মেয়েটা এতোটা গোছানো তা সে ভাবতে পারে নি কখনো। এ যেনো তার সেই চেনা বনলতা নয়,এই অন্য এক বনলতা।
বনলতার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রলয় বললো,”আমার অনুভূতি যদি বুঝতেই তবে কেনো সাড়া দাও নি লতা?
কেনো আমাকে চাতকের ন্যায় এক বুক প্রেমতেষ্টা বুকে নিয়ে থাকতে হচ্ছে? ”
বনলতা সোজা জবাব দিলো,”কেননা আমি ঘৃণা করি আপনাকে,আপনার পুরো পরিবারকে,জমিদারের রক্তকে,ইংরেজদের চামচাকে।”
প্রলয়কে সেখানে হতভম্ব অবস্থায় রেখে বনলতা আবারও ছুটলো চন্দ্রমহলের দিকে।
অস্ফুট স্বরে প্রলয় বললো,”এতো ঘৃণা কেনো করো আমাকে?
আমার যে সেই শক্তি নেই এই ঘৃণার ভার বহন করার মতো।
চলবে…….
লিখা: জাহান আরা