#স্নিগ্ধ_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৮
সকাল থেকে চিন্তিত আরাবী।গতকালকের ঘটনাটা এখনও ওকে ভাবাচ্ছে।গতকাল রাতে ঘুম আসছিলো না আরাবীর।জেগে ছিলো অনেক রাত অব্দি।রাতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছিলো।বারান্দায় বসে বৃষ্টি বিলাশ করেছিলো আরাবী।বৃষ্টি দেখায় এতো ধ্যানমগ্ন ছিলো আরাবী যে কখন মধ্যরাত হয়ে গিয়েছিলো টেরই পায়নি।ধ্যান ভগ্ন হয়েছিল মোবাইল ফোনের আওয়াজে।মেসেজ এসেছে।তাও আননোন নাম্বার থেকে।আরাবী মেসেজটা ওপেন করতেই।ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল শব্দগুলো,
‘ এতো রাত অব্দি জেগে আছেন কেন?ইট ব্যাড ফোর ইয়্যুর হেলথ।গো টু বেড নাও।এন্ড হেভ অ্যা নাইছ বিউটি স্লিপ।’
এমন একটা মেসেজ হঠাৎ ওকে কে দিবে?আর তাও আবার এতো গভীর রাতে?আর মেসেজকারি জানলই বা কিভাবে যে ও জেগে আছে?ভেবেই ভ্রু-কুচকে আসে আরাবীর।পালটা মেসেজ করল,
‘ কে আপনি?’
সাথেই সাথেই জবাব আসল,
‘ আমি কে সেটা সময় এলেই জানতে পারবেন।আপাততো এটা শুনে রাখুন। এখন আমি যা বললাম তা সুন্দরভাবে মেনে চলুন।’
মেসেজটা আসার পর সাথে সাথে আরেকটা মেসেজ আসল,
‘ সকালের ছেলেটা কে ছিল?’
আরাবী বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো।এই লোক কি তাকে ফলো করছে নাকি প্রতি কদমে কদমে?কে এটা?আরাবী লিখল,
‘ আপনি কে বলুন তো?’
‘ আন্সার মাই কুয়েশ্চেন ফার্স্ট।’
মেসেজটা ধমকির মতো মনে হলো।আরাবীর একবার মনে হলো প্রশ্নের জবাবটা দিবে না।আর নাম্বারটা ব্লক কর দিবে।পর পর কি মনে করে যেন লিখেই ফেলল,
‘ সে আমার ভাই হয়।’
‘ কেমন ভাই? ‘
আশ্চর্য সব প্রশ্ন।
‘ আমার আপন ভাই।আমার একমাত্র ভাই। আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। এইবার আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন।’
আরাবীর প্রশ্নের জবাবে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে উত্তর এলো,
‘ ঘুমিয়ে পরুন।’
এরপর আরাবী চার পাঁচটা মেসেজ পাঠিয়েছে।কে সে জানার জন্যে।মেসেজগুলো আর দেখেনি মানুষটা।দুশ্চিন্তায় পরে যায় আরাবী।সারারাত এসব ভেবে ভেবে ফজরের আজান দিয়ে দেয়।পরে নামাজ পরে একবারে ঘুমায়।এরপরেই একটু ঘুম আসে।
আবার সকাল সারে সাতটাতেই এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।কারন তাকে অফিসে যেতে হবে।আবার আজকেই প্রথম দিন।কিছুতেই লেইট করা যাবে না।সকালে ঘুম থেকে সব কাজ করছে ঠিকই।কিন্তু চিন্তাভাবনা কমছে না একটুও।আবার রাতে ঘুম না আসায়।মাথা ব্যথা করছে।আজকে চশমাটা পরে বের হতে হবে।নাস্তা শেষ করে জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগমকে বলে ফাহিম আর আরাবী নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে।আরাবীকে ওর অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে ফাহিম চলে যায় কোচিং সেন্টারে।এইতো আর দুদিন পর থেকে সকালে কোচিং-এ পড়াতে পারবে না ফাহিম।কারন দুদিন পরেই কলেজে টিচার হিসেবে জয়েন করবে ফাহিম।বড্ড খুশি ও।
আজ কারেক্ট টাইমে এসেছে ফাহিম। তাই এসেই ক্লাসরুমে চলে গেলো।এদিকে ফাহিমকে আঁড়চোখে একবার দেখে নিলো নূর।ওর মনটা ভীষণ খারাপ।দুদিন বাদ থেকে নাকি ফাহিম আর সকালে পড়াতে পারবে না। কলেজে টিচারের চাকরি পেয়েছে। এখন নূর কি করবে তাহলে?লোকটাকে একপলক না দেখলে যে ভালো লাগে না।তাহলে এরপর থেকে কিভাবে থাকবে নূর। পর পর কি যেন ভেবে তাচ্ছিল্য হাসল নূর। আজ বাদে কাল তো কোনো একদিন তো আসবে যেদিন নূর অন্যকারো হয়ে যাবে।তখন তো বছরের পর বছর চলে যাবে ফাহিমকে আর দেখতে পাবে না নূর।তাহলে সেটা এখন থেকে অভ্যাস করে নেওয়া ভালো না?নিজের মনকে যতো তাড়াতাড়ি শক্ত করতে পারবে।ততোই ওর নিজের জন্যে ভালো।কিন্তু মনটা যে বেহায়া কিছুতেই মানে না।যতোবার ভাবে সে এই জনমে আর ফাহিমকে পাবে না।ততোবার মনে হয় মনটা বিষাক্ত ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।নিশ্বাস আটকে আসে।মনে হয় এই বুঝি ও ম’রে গেলো।কিভাবে থাকবে নূর?কিভাবে সহ্য করবে ফাহিমকে না পাবার যন্ত্রনা?ঠিক কিভাবে?
_____
প্রথমদিন অফিসে এসে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না আরাবী।ফাহিম বলেছে ওর বন্ধু নয়নের কাজিন এই অফিসে কাজ করে।সে নাকি আসবে ওর কাছে।কিন্তু কোথায় সে?আধাঘন্টা যাবত একজন স্টাফের দেখিয়ে দেওয়া ডেস্কে এসে বসে রয়েছে আরাবী।আরও কতোক্ষণ যে বসে থাকতে হবে কে জানে?তবে বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হলো না। আরাবীর ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো আলিফা।এসেই মিষ্টি করে হেসে বলল,
‘ তুমিই কি আরাবী?’
আরাবী দাঁড়িয়ে গেলো।বলল,
‘ হ্যা আমিই আরাবী।কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?’
‘ আমি নয়ন ভাইয়ার কাজিন আলিফা।ভাইয়া আমাকে তোমার কথা বলেছিলো।তোমার পিকও পাঠিয়েছিলো।তাই তোমাকে এক দেখাতেই চিনে ফেললাম।’
আরাবী সস্থির নিঃশ্বাস ফেলল।যাক তবে একটা কাছের মানুষ পেলো তবে।হোক আজকেই প্রথম দেখা।তবুও তো একটু আধটু চিনে তাদের।আরবী বলল,
‘ আপু আমাকে ঠিক কি কাজ করতে হবে একটু বুঝিয়ে দিবে?আসলে আমার কোনো এক্সপেরিয়েন্স নেই এসব বিষয়ে।’
আলিফা হেসে বলে,
‘ তুমি চিন্তা করো না।আমি তো এইজন্যেই তোমার কাছে এসেছি।’
একটু থেমে আলিফা ফের বলে,
‘ তুমি এখানে জায়ান স্যারের পি.এ হিসেবে নিয়োগ হয়েছ।
তোমার কাজ হলো,স্যারের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে সাহায্য করা, যেমনঃ ফাইলিং সিস্টেম গুছিয়ে রাখানি।স্যারের হয়ে ফোন কল রিসিভ করা ও প্রয়োজনে অ্যাপয়েনমেন্টের ব্যবস্থা করা।স্যারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও অ্যাপয়েনমেন্টের কথা মনে করিয়ে দেয়া।স্যারের হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মানুষের সাথে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখা।মিটিংয়ের সময় নোট নেয়া। এবং তাকে তা মনে করিয়ে দেওয়া।যার কারনে তোমার সাথে সাথেই থাকতে হবে বেশির ভাগ।’
আরাবী চওড়া হাসি দিলো,
‘ ওয়াও আপু।তুমি তো খুব ভালোভাবে এই চাকরি সম্পর্কে জানো।খুব ধন্যবাদ তোমাকে আপু।’
‘ আমি জানবো না এই ব্যাপারে?আমিও তো এখানের একজনের পি.এ। এই অফিসের মালিকের ভাইপো ইমতিয়াজ ইফতি সাখাওয়াত।যার কারনে আমার অফিস লাইফটা যন্ত্রণাময় হয়ে গিয়েছে।’
শেষের কথাটা বিরবির করে বলল আলিফা।এর মাঝেই ডাক আসল আরাবীর জন্যে।জায়ান তাকে ডাকছে।
এর মাঝে আরাবীর হাতে গোটা একটা ফাইল ধরিয়ে দেওয়া হলো।এই ফাইলের মাঝে জায়ানের আজকের সেড্যুয়াল আছে।আরাবী ঢোক গিলল।তার বুকটা ধ্বুকপুক করছে।প্রথমদিন কোনো কিছু যদি ভুল হয়ে যায়?
আলিফা আরাবীর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে।তাই আরাবীর কাধে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘ চিন্তা করো না। সবঠিক থাকবে।জায়ান স্যার একটু গম্ভীর আর রাগি।তবে তুমি একটু সাবধানে কাজ করলেই হবে।’
আলিফার কথায় ভয় কমবে কি?ভয় আরও বেড়ে গেলো।যতো দোয়া দরুদ পরে নিলো মেয়েটা।তারপর জায়ানের অফিসরুমের সামনে এসে নক করে নিলো।তারপর ধীরে বলল,
‘ মে আই কাম ইন স্যার।’
‘ ইয়াহ!ইয়্যু কাম ইন।’
আরাবী আস্তেধীরে ভেতরে প্রবেশ করল।লোকটা ল্যাপটপের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।হাতের আঙুলগুলো বেশ দক্ষতার সাথে কিবোর্ডে চালাচ্ছে সে।রয়েল ব্লু রঙের স্যুট কোটে বেশ আকর্ষনীয় লাগছে তাকে।সিল্কি চুলগুলো জেল দিয়ে স্যেট করে রেখেছে।ফর্সা মুখশ্রীতে চাপদাড়িগুলো যেন তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।আরাবী চোখ সরিয়ে নিলো।কি করছিলো ও?এভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিলো।যদি লোকটা দেখতো তবে কি ভাবত?
‘ মিস আরাবী আজকের সেড্যুয়ালটা বলুন।’
পুরুষালি ঠান্ডা স্বরের আওয়াজে কেঁপে উঠল আরাবী।পরপর হালকা আওয়াজে বলতে লাগল আজকের সেড্যুয়াল।সব শুনে শেষে জায়ান বলল,
‘ ক্যান ইয়্যু মেক কফি?’
‘ এ্যাঁহ?’
‘ আমি বললাম আপনি কফি বানাতে পারেন?’
‘ হু! পারি।’
‘ দ্যেন মেক টু কাপস ওফ কফি।’
‘ দু কাপ কেন স্যার?’
আরাবীর প্রশ্নে জায়ানের ল্যাপটপে চালানো আঙুলগুলো থেমে গেলো।তারপর অদ্ভুতভাবে তাকালো আরাবীর দিকে।বলল,
‘ আমি এখানে একা নই।আপনিও আছেন।এখন আমার কফি খাওয়া দেখে যদি আপনার লোভ লাগে?আপনি যদি নজর লাগিয়ে দিন।তখন তো আমার পেট ব্যথা করবে।আর আমি সেরকম কোনো রিস্ক নিতে চাই না।’
জায়ানের এমন একটা কথা শুনে আরাবী ঠিক কি রিয়েকশন দিবে ভুলে গেলো।মানে এমন দামড়া একটা ছেলে যে এমন বাচ্চাদের মতো অদ্ভুত সব চিন্তাভাবনা মাথায় রাখে এটা ভেবেই অবাক আরাবী।এদিকে আরাবীকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।জায়ান শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আরাবীর দিকে। তৎক্ষনাত ঘাবড়ে গেলো।আজকেই প্রথম দিন।আর সে চায় না প্রথম দিনেই বসকে নারাজ করতে।তাই আরাবী কফি বানানোর জন্যে চলে গেলো।আশেপাশে ভালোভাবে তাকালো।হ্যা ওইতো দেখা যাচ্ছে কফি বানানোর সব সরঞ্জাম।আরাবী দ্রুত সেখানে গিয়ে কফি বানাতে লাগল।কফি বানানো শেষে আরাবী জায়ানকে একবার দেখে নিলো।নাহ,লোকটা কাজ করছে।এই সুযোগে আরাবী নিজের জন্যে বানানো কফিটা এক চুমুক খেয়ে চ্যাক করে নিলো।নাহ,ঠিক আছে সব কিছু।আরাবী এইবার মগদুটো নিয়ে জায়ানের কাছে আসল।হালকা আওয়াজে বলে,
‘ স্যার আপনার কফি। ‘
জায়ান না তাকিয়েই বলে,
‘ টেবিলে রাখুন।’
আরাবী কফিটা রাখতেই জায়ান এইবার দূরে একটা ফাইল রাখার একটা আলমারি আছে।সেখানে ইশারা করে বলে,
‘ ওই জায়গাটায় লাল রঙের একটা ফাইল আছে নিয়ে আসুন।’
আরাবী মাথা দুলালো।তারপর হাতের কফিটা জায়ানের জন্যে বানানো কফির পাশে রেখে চলল ফাইলটা আনতে।জায়ান এই সুযোগে নিজের কাজটা সেরে নিলো।আরাবীর কাপের জায়গায় ওর কাপটা রেখে দিলো।তারপর আরাবীর কাপের কফিটা নিয়ে নিলো।বিনাবাক্যে এক চুমুক কফিটা খেয়ে নিলো।ঠিক সেখানটায় যেখানে আরাবী চুমুক দিয়েছিলো।ওখানে আরাবীর ঠোঁটর লিপগ্লসের ছাপ বুঝা যাচ্ছিলো।কফিটা খেয়ে তৃপ্তির হাসি দিলো জায়ান।আরবীর দিকে নেশাময় চোখে তাকিয়ে বিরবির করল,
‘ ঠিক কবে যে এই কাপে লাগানো।তোমার ঠোঁটের ছোঁয়া না নিয়ে।ডিরেক্ট তোমার ওই কোমল অধরজোড়ার ছোঁয়া নিতে পারব আরাবী?আমাকে যে চুম্বকের মতো টানে ওই ঠোঁটজোড়া।ইচ্ছে করে তোমাকে চেপে ধরে চুমু খেয়ে ফেলি।বাট আ`ম হেল্পলেস।আই হেভ টু কন্ট্রোল মাইসেল্ফ ফোর ইউ মাই লাভ।’
#চলবে_________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন। ছোটো হয়েছে তার জন্যে দুঃখিত।