শিশির_ভেজা_শিউলি #পর্ব_২২(শেষাংশ) #ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

0
648

#শিশির_ভেজা_শিউলি
#পর্ব_২২(শেষাংশ)
#ইবনাত_ইমরোজ_নোহা

(🚫দয়া করে কেউ কপি করবেন না।কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ🚫)

জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ রজনী। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে নিস্তব্ধতা নিমিষেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে যেন। কাছে পিঠে বেওয়ারিশ কুকুরের কান্নার আওয়াজে কেঁপে উঠছে মন। চিন্তা, হারানোর ভয় যেনো জেঁকে ধরেছে মিসবাহকে। প্রায় আধাঘন্টা ধরে সূরাকে খুঁজছে তারা। অজানা আশংকায় কন্ঠনালী শুকিয়ে গেছে সবার। সবাই বিচলিত হলেও মিসবাহ শান্ত হয়ে খুঁজে চলেছে সূরাকে। তাকে দেখে মনে হবে যেন কিছুই হয়নি। সে একদম ঠিক আছে। কিন্তু সত্যি কি ঠিক আছে সে‌? শীতলতা বিরাজমান ‌তবুও মিসবাহর শুভ্র ললাটে বিন্দু বিন্দু স্বেদজল মুক্তোর মতো জ্বল জ্বল করছে। বুকের বা পাশের জায়গাটায় যেন কালবৈশাখী তান্ডব চলছে। লহমায় থমকে গেল সে। একটু দূরে দিঘীর পাড়ে থেকে মেয়েলী কন্ঠে হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার জোগাড়। দ্রুত দৌড়ে গেল মিসবাহ সেদিকে। তার পিছু পিছু ছুটলো সবাই। জ্যোৎস্নার আলোয় দিঘীর জলের দিকে তাকিয়ে কাঙ্খিত ব্যক্তিটিকে দেখা মাত্র শান্ত হলো বুঝি মিসবাহর মন। সূরা বসে আছে শেষ সিঁড়িতে। নুহাশ সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে গেল সূরার কাছে। বোনকে আগলে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল

“পুতুল তুই ঠিক আছিস সোনা?কাপড় ভেজা কেন তোর? আর এভাবে বসে আছিস কেন?”

মীরা সূরার পাশে বসে গালে হাত রেখে বলে “সুরপাখি কি হয়েছে? জানিস আমরা অনেকক্ষণ ধরে তোকে খুঁজছি। তুই এই দিকে আসলি কিভাবে আর দীঘিতে নেমেছিস কেন?”

জিহাদ বলল “নিশ্চিত কিছু আবিষ্কার করতে এই রাতে নেমেছিস দীঘিতে। কালও তো আবিষ্কার করতে পারতি বোন। তোর চিন্তায় আমার এক কেজি ওজন কমে গেছে‌।”

দিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে “আঙ্কেলের বাচ্চা জিহাদ্দ্যা রে, দয়া করে চুপ যা। তোর গোবর পঁচা বুদ্ধির প্রদর্শন এখন অন্তত করিস না।”

জিহাদ কটমট করে তাকালো দিয়ার দিকে। সিহাবকে উদ্দেশ্য করে বলল “সিহাব রে তোর শুঁটকি মাছকে সামলা।নয়তো আমি এই দিঘীতে ওকে চুবিয়ে শুঁটকি মাছ চাষ করবো।”

দিয়া শক্ত কন্ঠে কিছু বলবে তার আগে রাফি বলল “তোরা চুপ করবি। সূরাকে বলতে দে আগে।”

রাফির কথায় সম্মতি জানিয়ে রায়হান শান্ত স্বরে বলে “রাফি ঠিক বলেছে। আমাদের আগে সূরার কথা শোনা উচিত। মিষ্টি পরী তোমার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”

সূরা ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল “আমি তো সবার সাথেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু রাস্তার খেতের পাশে এই বিড়াল ছানাকে দেখতে পায়।”

সূরার কথায় সবাই এবার সূরার হাতের দিকে তাকায়। একটা ছোট বিড়াল ছানা গুটিসুটি মেরে লেপ্টে আছে তার সাথে। সূরার হাতে দুটো পদ্ম ফুলও আছে। সবাই আবার সূরার দিকে প্রশ্নাত্মক চাহনি নিক্ষেপ করলে সূরা গদগদ হয়ে বলে

“বিড়াল ছানাটা কি কিউট তাইনা? ওকে দেখে আমার খুব মায়া হচ্ছিল। ওর শরীরে কাদা লেগে ছিল দেখে ওকে
নিয়ে এই দিকে আসি ওকে পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য। তখন আসার সময় দেখেছিলাম দিঘীটা ‌। আমি ভেবেছিলাম ওকে পরিষ্কার করে তোমাদের সাথে বাড়ি যাবো। কিন্তু,,,,

“কিন্তু তুমি দিঘীতে পদ্ম ফুল দেখে নেমে পড়লে পদ্ম তুলতে। আর পা পিছলে পড়ে বসে আছো এখানে তাইতো?”

মিসবাহর গম্ভীর পুরুষালী ভরাট কন্ঠে হকচকিয়ে যায় সূরা। মিসবাহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সত্যিই তো দিঘীতে পদ্ম তুলতে গিয়েই এই অবস্থা ওর। সূরা ক্ষীন স্বরে বলল

“হু, বুঝতে পারিনি সিঁড়ি পিচ্ছিল হয়ে আছে। ভেবেছিলাম পায়ের ব্যাথা একটু কমলে বাড়ি ফিরবো।”

মিসবাহ কন্ঠে তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল “আমি এখন হান্ডেড পার্শেন্ট সিওর সৃষ্টিকর্তা যখন মাথায় বুদ্ধি দিচ্ছিল তখন তুমি ঘাস কাটতেই গিয়েছিলে।”

সূরা কন্ঠে তেজ নিয়ে বলল “দেখুন একদম আমাকে অপমান করবেন না। আমি কি জানতাম এমন হবে?”

মেহের বলে “সূরা আপু তুমি জানো আমরা সবাই কতো টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম? তুমি আমাদের বলতে পারতে এখানে আসবে।”

নুহাশ বলল “তুই এটা ঠিক করিসনি পুতুল। আমাকে বলতি। আমি পদ্ম তুলে দিতাম। পায়ে কি বেশি ব্যাথা করছে?”

সূরা নুহাশের বাহুতে মাথা রেখে আল্লাদি সুরে বলল “সরি ভাইজান। আর এমন করবো না। প্লীজ রাগ করো না । আমি না তোমার পুতুল।”

নুহাশ হাসে বোনের আল্লাদিপোনা দেখে। মিসবাহ ভ্রু কুঁচকায়। এই মেয়ে ভারি ধান্দাবাজ। ঠিক আল্লাদির ভোল ধরলো। মীরা সূরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

“খুব বেশি লেগেছে সুর? হাঁটতে পারবি? দেখ রাত হয়ে গেছে। বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে।”

সূরা ঠোঁট উল্টায়। পায়ে সত্যি বেশ ব্যাথা পেয়েছে সে। মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে এই টুকু তো বুঝেছে হয়তো মচকে গেছে পা টা। দিয়া বসে সূরার পায়ে হাত দিতেই সূরা চেঁচিয়ে উঠে

“নাহ্ প্লীজ! হাত দিস না। ব্যাথা করছে।”

দিয়া আস্বস্ত করে বলে “কিছু হবেনা জান। আমাকে দেখতে দে একটু। কতোটা লেগেছে দেখি।”

মিসবাহ গম্ভীর স্বরে বলে “দিয়া তুমি ওঠো। আমি দেখেছি।”

সূরা বিস্ময়কর কন্ঠে বলে “আপনি দেখবেন মানে! আপনি আমার পায়ে হাত দেবেন নাকি? কোনো প্রয়োজন নেই।”

“প্রয়োজন আছে কি নেই সেটা আমি বুঝবো। তুমি কি ভুলে গেছো আমি একজন ডাক্তার।”

“অর্থোপেডিক তো না।”

মিসবাহ কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে “ডাক্তার দের যে বেসিক নলেজ সব বিষয়েই থাকে সেটা কি ভুলে গেছো সুর? ইডিয়েট একটা।”

সূরা মাথা নিচু করে নিল। মিসবাহ সূরার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে স্বযত্নে সূরার পায়ে হাত দিতেই কেঁপে উঠলো সূরা। মিসবাহ বুঝি কয়েক সেকেন্ড থমকে গেল। একে অপরের দিকে তাকালো দুজনে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়লো। দুজনের ভেতরের উচাটন মন বুঝি বুঝলো তারা। সূরা মিসবাহর চোখের গভীর চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনা। চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকায় সে। মিসবাহ বাঁকা হাসে। সূরার পা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করে। বলে

“একটু মচকে গেছে। ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এক পায়ে বারবার এমন আঘাত পেলে দুই দিনও লাগবেনা পঙ্গু হতে। কেয়ারলেশ মেয়ে একটা‌।”

সূরা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। প্রথম বার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। দ্বিতীয় বারও এক্সিডেন্ট। এতে তার কি দোষ? বজ্জাত লোক। ভেংচি কাটে সূরা। মিসবাহর চোখ এড়ায় না সূরার কান্ড। মনে মনে হাসে সূরার বাচ্চামো দেখে। নুহাশ বলে

“ভাইয়া পুতুল তো হাঁটতে পারছে না। ওকে তাহলে,,,,

নুহাশকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই মিসবাহ গম্ভীর স্বরে বলে “তোরা রওনা দে। আমি ওকে নিয়ে আসছি।”

সবাই পূর্ণ দৃষ্টি দিল মিসবাহর দিকে। হয়তো বুঝলো মিসবাহর মনোভাব। কেউ কিছু না বলে উপরে উঠে গেল। সূরা নুহাশকে ডাকলে সে কর্নপাত না করেই মীরার হাত ধরে চলে যায়। এখানে যে সূরা বলে কেউ আছে হয়তো তারা ভুলেই গেছে। সূরা ইচ্ছা মতো সবাইকে গালি দিল। তবুও যেন মন ভরলো না তার। সূরা কিছু বলবে তার আগেই মিসবাহ সূরাকে কোলে তুলে নিয়েছে। হকচকিয়ে গেল সূরা। পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মিসবাহর দিকে। মিসবাহর কোনো ভাবাবেগ নেই। সে দিব্যি সামনের দিকে তাকিয়ে এগোতে লাগলো। সূরা নড়েচড়ে ওঠে। লহমায় পুরুষালী ভরাট কন্ঠে থমকে গেল সে। মিসবাহ বলে

“এতো নড়ছো কেন? ধান্দাবাজ মেয়ে! নিজে তো পা ভেঙ্গেছো এখন কি আমার কোমড় ভাঙ্গার পায়তারা করছো? মোচড়ামুচড়ি না করে শক্ত করে ধরো আমাকে।”

সূরা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মিসবাহর দিকে। এই লোক বড্ড বাজে বকে। দেখছে তো তার হাতে পদ্ম আর বিড়াল ছানা আছে। সূরা ভেংচি কেটে বলে

“দেখছেন না আমার হাতে পদ্ম ফুল আর বিড়াল ছানা। আপনাকে ধরলে তো ওরা পড়ে যাবে।”

মিসবাহ সামনে হাঁটতে হাঁটতে শান্ত স্বরে বলে

“আমাকে না ধরলে তুমি পড়ে যাবে। তুমি কি চাও আমি তোমাকে ফেলে দিই? তাহলে এক কাজ করি তোমাকে আর তোমার বিড়াল ছানা, পদ্ম ফুলকে এই দিঘীর জলে ছুড়ে মারি। না তোমার আজ বাড়ি যাওয়া হবে না তোমার বিড়াল ছানার। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি”

মিসবাহর শান্ত হুমকিতে ঈষৎ ভয় পেল সূরা। একহাতে বিড়াল ছানা আর পদ্ম ফুল ধরে অন্যহাত মিসবাহর গলা গলিয়ে কাঁধ আঁকড়ে ধরল। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল বুঝি মিসবাহর। আড়চোখে একবার সূরার দিকে তাকালো সে। জ্যোৎস্নার আলোয় তার শ্যামকন্যা কে মায়াবিনী লাগছে। চোখে মুখে অঢেল মায়া যেন উপচে পড়ছে। মিসবাহ মুচকি হেসে শান্ত স্বরে বলে

“একটা বোবাপ্রানীর জন্য তোমার এতো মায়া, ভালোবাসা। কিন্তু আফসোস!এই তুচ্ছ মানবের প্রতি তোমার না আছে মায়া আর না আছে ভালোবাসা। মানবজীবন বুঝি স্বার্থক হলোনা আমার। পরের জন্ম বলে কিছু থাকলে এই বোবাপ্রানী হয়ে জন্ম নিতে চাই আমি। অন্তত তোমার সান্নিধ্য তো পাবো।”

সূরা আহত দৃষ্টিতে তাকায় মিসবাহর দিকে। এই মানবের হৃদয় নিংড়ানো আবেগময় অনুভূতি মিশ্রিত বলা প্রত্যেকটা বাক্যে সূরার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় এই কঠিন মানব কি বোঝে? অনুভূতির কাছে হেরে গেল সূরা। মিসবাহর বুকে মাথা এলিয়ে দিল সে। লহমায় থমকে গেল মিসবাহ। পা দুটো আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলো না। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক নেই। অনেক কষ্টে আওরালো একটি বাক্য

“সুরজান”

সূরার কপোল সিক্ত হলো অবাধ্য অশ্রু কনায়। হেরে গেল এই নিষ্ঠুর রমনী। মন আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ে জিতে গেল মনের সুপ্ত অনুভূতি। মিসবাহ আগলে নিল তার সুরজান কে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকে। সূরা মিসবাহর বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দেয়। এই জায়গাটা তার কাছে শান্তির জায়গা। মিসবাহর মুখোস্রি জুড়ে উপচে পড়া খুশি। প্রশান্তির শিহরণ হৃদয় জুড়ে। পাঁচ বছরের অপেক্ষার প্রহর কি শেষ হলো তবে। নাকি নতুন কোনো ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে তার আর সুরের প্রেমকথা। মিসবাহ মনে প্রাণে চাই আজ এই মুহূর্ত, এই সময় থমকে যাক। সবকিছু স্তব্ধতায় ঘেরা থাক। সে আর তার সুরজান এই মুহূর্তে একে অপরের অনুভূতির জোয়ারে ভেসে যাক। মিসবাহ বিরবিরালো

“শুনছো! শুনছো গো প্রকৃতি!
দেখে যাও!
আজ আমার ব্যক্তিগত চন্দ্রের জ্যোৎস্নায় আলোকিত আমার নিজস্ব ভুবন।
কে বলেছে পাথরে ফুল ফোটে না।
দেখে যাও!
আজ ফুলের গায়ে ফুল ফুটেছে!”

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here