মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১০,১১

0
415

#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১০,১১
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-১০

বিনিকে শান্ত করতে বেশ বেগ পেতে হলো ইফরানকে। দুহাতে তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষণ। বিনি নড়তে চড়তে পারলো না। কিন্তু অনবরত চিৎকার করে গেলো।

একটা মেয়ে ইফরানের গালে চুমু খেয়ে গেছে অথচ সে নাকি টেরই পায় নি এমন মিথ্যে কোন পাগলেও বিশ্বাস করবে না। ইফরান ভেবেছে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বিনিকে চুপ করিয়ে দেবে। কিন্তু বিনি এত বোকা নয়! হাতেনাতে প্রমান পেয়েছে সে। ইফরানকে এত সহজে ছেড়ে দেবে না। দরকার পড়লে থানায় জালিয়াতির মামলা করবে।

ইফরান ক্লান্ত হয়ে বিনিকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো। সে ছেড়ে দিতেই বিনি হঠাৎ নাক টেনে টেনে কাঁদতে শুরু করলো। এতক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করার ফলে ভাঙ্গা গলায় ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ বেরোচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—‘আমি মাকে গিয়ে কি জবাব দেবো? তাঁর ছেলে হোটেলে বসে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে?’
—‘চুপ। একদম চুপ। এতকথা কেন বলো তুমি? পুরোটা কথা না শুনেই নাচানাচি শুরু করে দিয়েছো।’
—‘আর কি শুনবো? হোটেল রুমে বসে চুমোচুমি করছো! আর কি শোনার বাকি আছে?’
—‘আবার কথা বলে! আর একটা কথাও বলবে না তুমি।’

ইফরান নিজেকে শান্ত করতে বড়বড় দম দিলো। এতক্ষণ বিনির সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে বেশ হাঁপিয়ে গেছে। ঘামে ভেজা মাথার চুলগুলো এলোমেলোভাবে টেনে ধরলো। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললো,
—‘যদিও তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই। তবুও তোমার এই ভ্যাঁ ভ্যাঁ থামানোর জন্য এই মুহূর্তে আমার কাছে আর কোন উপায় নেই। সো, ফর ইউর কাইন্ড ইনরফরমেশন আমি আবারো বলছি তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে। আই থিংক সি কিসড মি হোয়েন আই ওয়াজ স্লিপিং। ইট’স জাস্ট অ্যা ওয়ান সাইডেড ইনফ্যাচুয়েশন।’

বিনির কান্না থামলো। আড়চোখে ইফরানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা। ইফরান তাঁর দিকেই চেয়ে আছে। চোখমুখে উদ্বেগ। সে সত্যি বলছে বুঝতে পেরে বিনি ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
—‘নেহায়েত তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে। নইলে তোমার মত ছেলেকে আমি পাত্তা দেই?’

বিনি শান্ত হয়েছে বুঝতে পেরে ইফরান উঠে দাঁড়ালো। বিনির কথাটা যেন শুনতেই পায় নি এমন ভাব করে বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। বিনিকে টেবিলের পাশ থেকে সরাতে গিয়ে তাঁর হাত কেঁটে গেছে। বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করলো। সামান্য এন্টিসেপটিক লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেধে নিলো। বিনি আড়চোখে সেটা দেখেও না দেখার ভান করে রইলো।

ইফরান ওয়াশরুম থেকে বেরোলে ফের ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
—‘কপাল দোষে তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। নইলে তোমার মত ছেলে আমি ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতাম ?’
—‘কবে ঘেঁষেছি তোমার ধারেকাছে? তুমি নিজেই তো হুটহাট হামলে পড়ো আমার গায়ের ওপর?’
—‘হামলে পড়ি মানে? তুমি আমাকে কি মনে করো?’
—‘কিছুই মনে করি না। ইনফেক্ট তোমাকে নিয়ে মনে করার কিংবা মাথা ঘামানোর মত ধৈর্য বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই!’
—‘মাথা আছে তোমার? তবেই হলো। আমি অবশ্য জানতাম না!’

বিনি কৃত্রিম অবাক হওয়ার ভান করে আচমকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে ইফরানের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। ইফরান ভয়ানক অপমানিত বোধ করলো। চট করে মাথাটা গরম হয়ে গেলো। বিনিকে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
—‘নিজেকে তুমি কি ভাবো? সরোজিনী নাইডু? কমলা হ্যারিস? না প্রতিভা পাটেল? কোনটা? ভাব দেখে তো মনে হয় পুরো পৃথিবীসুদ্ধ জ্ঞান তুমি একাই অর্জন করে বসে আছো।’

বিনি নির্বিকার। ইফরানের রাগত কন্ঠের বিপরীতে মুখের হাসি বজায় রেখে ধীরস্থির কন্ঠে বললো,
—‘ইভা ব্রাউন। নিজেকে আমি ইভা ব্রাউন মনে করি। চেনো তাঁকে?’
—‘না। কে সে?’
—‘হিটলারের বউ’!’

বিনির মুখে মিটিমিটি হাসি। ইফরান স্তম্ভিত। মুখে জবাব নেই! বিনি এটা কি বললো? নিজেকে সে হিটলারের বউ মনে করে? তারমানে ইফরান হিটলার? ও গড! এই মেয়ে কি ন্যুনতম সম্মানও দেবে না ইফরানকে?

তর্কযুদ্ধে হেরে গিয়ে আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। বিনিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
—‘মা বলেছিলো লক্ষ্মীমন্ত বউ এনেছি ইফরান। সাত চড়ে রা কাটে না। এই বুঝি তাঁর নমুনা?’
বিনি ঈষৎ হেসে বললো,
—‘মা তো আমাকেও বলেছিলো, শোন বিনি আমার এই ছেলে হচ্ছে একটা অগাকান্ত। সহবত জানে না। হাতপায়ের চাইতে মুখ চলে বেশি। কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা! সংসারের হাল কিন্তু তোকেই ধরতে হবে মা। এই আমার আদেশ।’

কথা শেষ করে সকৌতুকে ইফরানের দিকে চাইলো সে। ইফরান বিতৃষ্ণা বোধ করলো। এই নারীর আশেপাশে থাকা বিপজ্জনক! মহাবিপজ্জনক!
ভয়ানক ঠোঁটকাটা এই মেয়ে! মুখে কিচ্ছু বাধে না।


এদিকে রাহেলা মির্জা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। বিনি সেই বিকেলে বেরিয়েছে হালিম মিয়াকে নিয়ে। এখনো ফিরছে না। ইফরান তাঁর সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করে বসে নি তো? এই দুশ্চিন্তায় তাঁর মাথাব্যথা উঠে গেছে।

সন্ধ্যের দিকে আর টিকতে না পেরে একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিনির নাম্বারে ফোন করলেন। বিনি তখন ইফরানের জামাকাপড় গোছগাছ করছিলো।

শ্বাশুড়ি মায়ের ফোন পেয়ে রিসিভ করে হাসিমুখে বললো,
—‘আমরা ফিরছি মা। আর বেশিক্ষণ লাগবে না। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।’
অপরপাশ থেকে তখনো রাহেলা মির্জার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর শোনা গেলো। গলায় একরাশ উৎকণ্ঠা ঢেলে দিয়ে বললো,
—‘ইফরান? ইফরান ফিরবে?’

বিনি একঝলক চাইলো ইফরানের দিকে। এতক্ষণে ফোনে কথা বলছিলো। সম্ভবত বন্ধুদের ম্যানেজ করছিলো। বিনি তো সাফ জানিয়ে দিয়েছে ইফরান যদি বাড়ি না ফেরে তবে বিনিও ফিরবে না। ইফরানের সঙ্গে হোটেলেই থাকবে। দরকার পড়লে রাহেলা মির্জাকেও ফোন করে হোটেলে নিয়ে আসবে। তবুও ইফরানকে ছাড়া ফিরবে না।
ইফরান এইমুহূর্তে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে বিনির দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন চাইছে বিনিকে তুলে আছাড় মারে। শুধুমাত্র বিনির জন্য বন্ধুদের সঙ্গে একগাদা মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে ইফরানকে। এত সাধের সেন্টমার্টিন প্ল্যানটা ক্যান্সেল করতে হয়েছে।

বিনি তাঁর রাগের পাত্তা দিলো না। উলটে ইফরানকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো,
—‘ফিরছে মা। আপনার ছেলেকে সঙ্গেই নিয়ে ফিরছি আমরা।’

রাহেলা মির্জা ভীষণ খুশি হলেন। বিনি তাহলে ইফরানকে ম্যানেজ করতে পেরেছে। তারপর আচমকা গলা খাদে নামিয়ে আনলেন। যেন তিনি জোরে কথা বললেই ইফরান শুনতে পাবে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন,
—‘ও তোর সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করে নি তো?’

বিনি এবারেও ইফরানকে শুনিয়ে শুনিয়ে জবাব দিলো,
—‘করেছে। খুব খারাপ ব্যবহার করেছে মা। কষ্টে,দুঃখে আমার তো নিশ্বাসই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।’

বিনির কন্ঠে চাপা হাসি। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ইফরানের সঙ্গে ঝগড়া করতে চাইছে সে। ইফরান সেটা বুঝতে না পেরে টেনে ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো। অমাবস্যার ন্যায় অন্ধকার মুখ করে বললো,
—‘প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে তো মাথায় উঠাচ্ছো। এখন আমার মাথায় উঠে নাচছে কদিন বাদে তোমার মাথায় উঠে নাচবে। তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল!’

রাহেলা মির্জা শঙ্কিত হতে গিয়েও হলেন না। ছেলের কন্ঠস্বর তিনি চেনেন! এমন পরিস্থিতিতে অন্যসকলের সঙ্গে ইফয়ানের রূঢ় আচরণ, রাগ ঠিক কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন।

কিন্তু আজকের এই কন্ঠস্বরে বাহ্যত রাগ থাকলেও ভেতরে ভেতরে খানিকটা প্রশ্রয়ের আভাস পেলেন। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। বোকা ছেলে ঠিক মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেছে। মিষ্টি হেসে বললেন,
—‘এমন মিষ্টি বউ এনেছি কি মুখ গোমড়া করে বসিয়ে রাখার জন্য? দরকার পড়লে বাড়িসুদ্ধ লোকের মাথায় উঠে নাচবে। দশটা নয় পাঁচটা নয় আমার একটা মাত্র ছেলের বউ আমার। তাঁকে আমি মাথায় করে রাখবো।’

মা কে বুঝিয়ে লাভ নেই! তিনি ঘুরেফিরে পুত্রবধূকেই সমর্থন করবেন! আশাহত ইফরান পুনরায় বিনির হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে গটগট করে বাইরে বেরিয়ে গেলো। বিনি সেদিকে তাকিয়ে আপন মনে হেসে ফেললো। মাথামোটা বদরাগী হলেও তাঁর বরটা কিন্তু মানুষ খারাপ নয়।

#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-১১

‘ইউ আর ফ্রম আ হোল অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড,
………………………
কিস মি, কি-কিস মি,
ইনফেক্ট মি উইথ ইউর লাভিং
ফিল মি উইথ ইউর পয়জন
……………………….
ওয়া’না বি ইউর ভিক্টিম
রেডি ফর অ্যাবডাকশন
বয় ইউ আর অ্যান এলিয়েন
ইউর টাচ সো ফরেইন~

মিউজিক প্লেয়ারে বিখ্যাত আমেরিকান গায়িকা কেটি প্যারির ‘এক্সট্রাটেরিস্ট্রিয়াল’ গানটি বাজছে। ইফরান ড্রাইভিং সিটে স্টিয়ারিং ধরে মৃদু শিষ দিচ্ছে গানের তালে তালে। বাইরে অন্ধকার ঘন অন্ধকার। তাঁরা হোটেল থেকে বেরিয়েছিলো সাতটার সময়। এখন বাজে সাড়ে আটটা। তারওপর রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। আগামী একঘণ্টাও পৌঁছাতে পারবে কি না সন্দেহ আছে।

তুমুল বর্ষণও হচ্ছে ঢাকা শহরে। রাস্তায় পানি উঠে গেছে। গাড়ির চাকা সহজে এগোচ্ছে না। বৃষ্টির ফোঁটায় সামনের কাঁচ বারবার ঝাপ্সা হয়ে আসছে। উইপার দিয়ে ক্রমাগত পরিষ্কার করছে ইফরান।

গাড়ির জানালা বন্ধ। বিনি একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। বৃষ্টি সময়ে কর্মব্যস্ত নগরীর ছোটাছুটি, দেখতে ভালো লাগছে। ইফরান গান শুনতে ব্যস্ত। তাঁর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কিঞ্চিৎ অনুরোধের সুরে বললো,
—‘বাইরে কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে। একটা রবীন্দ্র সংগীত প্লে করো না।’
—‘আমার ফোনে রবীন্দ্র সংগীত নেই।’
ইফরানের এমন জবাবে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো বিনি। বিড়বিড় করে বললো,
—‘থাকলেই বরং আশ্চর্য হতাম।’

যাইহোক, নিজের ফোন বের করে সুন্দর একটা রবীন্দ্র সংগীত প্লে করে দিলো সে। বাইরে বৃষ্টি! ভেতরে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে! অসম্ভব মোহনীয় এক অনুভূতি, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ! আহা! প্রাণ জুড়িয়ে যায় যেন।
ইফরান দু-চরণ মন দিয়ে শুনে ঠোঁট চেপে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
—‘ঘুমের ঘোরে অ্যাক্সিডেন্ট করলে তোমার দোষ। তুমি এই বোরিং গান প্লে করেছো।’

বিনি জবাব দিলো না। উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকালো। গানের সুর আর বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ হৃদয়ে দোলা লাগিয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে নিস্তব্ধতায় ডুব দিয়ে মন চাইছে। হারিয়ে যেতে মন চাইছে অজানা কোন সুখের রাজ্যে! গুনগুন করে গাইলো সে,
‘আমি হৃদয়ের কথা কহিতে ব্যাকুল
শুধাইলো না কেহ
সে তো এলো, না যারে সঁপিলাম
এই মন প্রাণ দেহ~

ইফরান বিনির দিকে তাকিয়ে ছিলো। চোখ সরিয়ে সম্মুখপানে চেয়ে কিঞ্চিৎ ঠাট্টাসুরে বললো,
—‘ছ্যাঁকা খেয়েছো নাকি?’

বিনি বুঝতে পারে নি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইফরানের দিকে চেয়ে রইলো। বিনিময়ে ইফরান মুচকি হেসে বললো,
—‘ছ্যাঁকা! আই মিন বিয়ের আগের কোন আশিক-টাশিক ছিলো? যাকে ভালোবেসে মন প্রাণ সঁপে ছিলে?’

বিনি পাংশুটে মুখে বাইরে তাকালো। তাঁর দৃষ্টি ছলছল! নাম না জানা এক বিষাদ হঠাৎ করেই হৃদয়গহীনে জেঁকে বসেছে। কেন এমন খাপছাড়া অনুভূতি হচ্ছে সে নিজেও জানে না। প্রকৃতির সঙ্গে একই সুরে সুর মিলিয়ে হুহু করে কাঁদতে মন চাইছে।

ইফরান আদৌ তাঁকে কোনদিন তাঁকে বুঝবে কি না সে জানে না। মেয়েমানুষের মন বোঝার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা এই পাজি বদমাশটিকে দেন নি। সে কেবল একটাই জিনিস জানে। সেটা হলো ক্ষণে ক্ষণে বিনির হাড় জ্বালাতন! এছাড়া আর কিচ্ছু পারে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্তিমিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—‘আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?’

ইফরান বিনির মলিন মুখখানা দেখতে পেয়েছে কিনা ঠিক বোঝা গেলো না। হাতঘড়ি চেক করে খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,
—‘আধঘন্টা। রাস্তায় পানি জমে গেছে, চাকা সামনে এগোতে পারছে না। তাই দেরী হচ্ছে।’


রাত বারোটায় রান্নাঘরের কাজ গুছিয়ে ঘরে এলো বিনি। আজকে বেশ দেরী হয়ে গেছে। বাড়ির ভৃত্যরা ইতোমধ্যে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আসার পর রাহেলা মির্জার সঙ্গে গল্পগুজব করতে গিয়েই দেরী হয়ে গিয়েছে বিনির। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আর কোন কিছু বাদ রাখে নি সে। এক এক করে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে।

সব শুনে রাহেলা মির্জা দারুণ হেসেছেন। তাঁর স্বেচ্ছাচারী, স্থুলবুদ্ধি, নিরেট প্রকৃতির ছেলেটি পুত্রবধূর কাছে বেশ জব্দ হয়েছে ভেবে মনে মনে তিনি ভিষণ উৎফুল্ল বোধ করলেন। বিনির কোমর বেধে নেমেছে ইফরানকে সোজা করার জন্য। এবার যদি সৃষ্টিকর্তা একটু মুখ তুলে চান। বিনির বদৌলতে যদি ইফরান এবার ঘরমুখী হয়, তবে আর কিচ্ছু চাওয়ার থাকবে না রাহেলা মির্জার। বাকি জীবনটা তিনিই এমনিই পার করে দিতে পারবেন।

সন্ধ্যা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি অব্যাহত। থামাথামির নাম নেই। ইফরান বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। আবছা আলোতো বৃষ্টি দেখার অনুভূতি অন্যরকম। বৃষ্টির ছাঁট চোখেমুখে এসে লাগছে। বাতাসের তোপে গাছের ডালপালা এসে বারান্দায় পড়ছে। ইফরানের মনোযোগ অবশ্য বৃষ্টি দেখাতে নেই। সে কিছু একটা নিয়ে ভাবছে।

আজকে ফেরার পথে বিনির চোখে পানি দেখেছে ইফরান। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিলো বিনি! সেই থেকেই মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছে।
কাঁদছিলো কেন বিনি? কিসের দুঃখ তাঁর? সে কি সত্যিই কাউকে ভালোবাসতো? এখনো কি বাসে?

তাই যদি হয় তবে ইফরান নিজে বিনিকে তাঁর ভালোবাসার হাতে তুলে দেবে। প্রেম ভালোবাসার ঝামেলায় কাউকে বেশিদিন জড়িয়ে রাখা ঠিক না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিটমাট করে ফেলা ভালো।

তাছাড়া ইফরানের দৃঢ় ধারণা বিনিকে এখনো সে আগের মতই অপছন্দ করে। তাই বিনির চলে যাওয়া না যাওয়াতে তাঁর কিচ্ছু আসে যায় না। আবার এই বিনির চোখে পানি দেখেই সন্ধ্যা থেকে তাঁর মনের ভেতর অজস্র টানাপোড়ন চলছে। নিজের অজান্তেই বারবার চিন্তিত হচ্ছে বিনিকে নিয়ে।
কি অদ্ভুত ইফরানের অনুভূতি! কি অদ্ভুত তাঁর ভাবনা চিন্তা। অবশ্য এই প্রসঙ্গে তাকে ঠিক দোষ দেওয়া যায় না! যে নিজেকেই ঠিকমত চিনতে পারে নি সে নারীর মন কি করে বুঝবে?

বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের বেগ বাড়ছে। ঘরের দরজা জানালা হাওয়ায় ঠাসঠুস বাড়ি খাচ্ছে। বিনি ঘর থেকে আওয়াজ দিলো,
—‘দরজা বন্ধ করে দাও। বারান্দা ময়লা হয়ে যাচ্ছে।’

ইফরান তখনো দাঁড়িয়ে বিনির কথা ভাবছিলো। বিনিকে সে কি করে তাঁর ভালোবাসার মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। কি করে রাহেলা মির্জাকে ম্যানেজ করবে, ইত্যাদি নানারকম কথাবার্তা। বিনির আওয়াজ পেয়ে হাতের সিগারেট নিভিয়ে গম্ভীরমুখে ভেতরে এসে ঢুকলো। এত ভেবে কাজ নেই। যা হবার তাই হবে।


বিনি ফ্রেশ হয়ে মাত্র বিছানায় এসে বসেছে। ইফরান খাটের পাশে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আড়চোখে বিনির প্রসাধনী ব্যবহার করা দেখছে। খুব মনোযোগের সহিত ঘষাঁমাজা করছে মেয়েটা।

বিনি পায়ে লোশন মাখার জন্য পা সোজা করতেই হঠাৎ তাঁর পায়ের ওপর একটা ব্যাঙ তিড়িংতিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো। বৃষ্টির কারণে নিচতলার বারান্দায় খানিকটা পানি জমেছে। সেখান থেকে উঠে এসেছে হয়ত।

আচমকা কিছু বুঝতে না পেরে আতংকে লাফিয়ে উঠলো বিনি। ইফরান প্রথমে অবাক হলেও বিনির রিয়েকশন দেখে পুরো ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। ঠিকই সেইমুহূর্তে সজোরে বজ্রপাতের শব্দ হলো বাইরে। বিনি ফের কেঁপে উঠলো ভয়ে। ব্যাঙটা লাফ দিয়ে একেবারে বিছানার মাঝখানে!

অপহসিত ইফরান হাসি থামানোর বৃথা চেষ্টা করে বললো,’বাহ! একই সাথে জোড়া ব্যাঙের লম্পঝম্প! বেশ দারুণ।’

বিনি থেমে গেলো। বিছানায় শান্তভাবে বসে আছে ব্যাঙটা। ইফরানের হাস্যরত মুখখানার দিকে একবার চেয়ে খপ করে ধরে ফেললো সেটাকে। ছুঁড়ে মারলো ইফরানের গায়ের ওপর।

ইফরান হতবম্ভ! ঘটনার আকস্মিকতায় থ’ বনে গেছে সে। এ যেন তাঁর ভাবনার বাইরে। এক্ষুনি তো ব্যাঙ দেখে চিৎকার করছিলো বিনি! এখনই আবার হাত দিয়ে ধরে ফেললো? এ তো সাংঘাতিক মেয়ে! কোনদিন না জানি ইফরানের গলাটা এমনভাবে টিপে ধরে!

বিনি নির্বিকার ভাবে বিছানা পরিপাটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যেন কিছুই হয় নি। ইফরান বিস্ময়ভাব কাটিয়ে সামান্য গলা খাঁকারি দিলো। গম্ভীর মুখ করে বললো,
—‘আমার ওপর রাগ করে ব্যাঙের গলা টিপে ধরেছো! যদি কামড়ে দিতো?’

বিনি ভ্রু কুঁচকে সম্মুখপানে চাইলো। স্মিত হেসে বললো,
—‘ব্যাঙের গলা টিপে ধরতে যাবো কেন? তুমি ব্যাঙ দেখে খুশি হয়েছিলে তাই ভাবলাম তোমার কাছে পাঠিয়ে দেই।’

ইফরান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বিনির মুখের দিকে চেয়ে রইলো কতক্ষণ। তারপর হেসে উঠে বললো,
—‘কিন্তু ব্যাঙের চরিত্রে যে দোষ আছে। সে তো তোমার কোলে গিয়ে আসন পেতেছে।’
—‘তোমার বন্ধু বলে কথা। চরিত্রে একটু আধটু দোষ না থাকলে হয়?’

ইফরান হাসি থামিয়ে বিরক্ত দৃষ্টিতে বিনির দিকে চাইলো। এই মেয়ে রোজ একবার তাঁর চরিত্রের জিরাবাটা না করলে শান্তি পায় না। জিভের আঘাতে ইফরানের মন, মস্তিষ্ক কে বিক্ষিপ্ত,বিচ্ছিন্ন করে তবেই ক্ষ্যান্ত হয়। আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here