#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২২
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তৃষাম আড় চোখে তাকালো জায়ানের দিকে অতঃপর বলল – তবুও, তবে তোকে রোজ রোজ এই সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া, বাইরে খাওয়ানো সব কিছুই কিন্তু ওর অনুতপ্ত বোধ থেকে। এর মধ্যে ছিটে ফোঁটা কিন্তু অন্য কিছু নেই। তুই আবার অন্য কিছু ভেবে বসিস না।
জায়ানের চোয়াল শক্ত হলো। ধপধপ করে জ্বলে উঠলো তার মাথাটা। তৃষাম ছেলেটা তো দেখা যাচ্ছে রীতিমতো তাকে আঁইক্কাওয়ালা বাঁশ দিচ্ছে। এত কিছু সে করছে কিসের জন্য? সে তো চাইছেই পূর্বাশা তাকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবুক, তার কার্মকান্ড গুলো নিয়ে পূর্বাশার মনে প্রশ্ন জাগুক। নিজের মুখে বলতে পারছে না তাই সে কাজে বুঝাতে চাইছে। অথচ এই ছেলে তাকে বাস দেওয়ার জন্য যেন উঠেপড়ে লেগেছে। তার এত পরিশ্রম কিসের জন্য তাহলে? মেয়েটা যদি তার কাজ নিয়ে অন্য কিছু নাই ভাবে তাহলে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া আবার খেতে নিয়ে যাওয়া কি শখের জন্য নাকি? এটা তার বন্ধু নাকি শত্রু? জায়ানের মুখশ্রী থমথমে হলো, কন্ঠে গাম্ভীর্যতা এটে বলল – চুপ কর তুই। এত কথা কে বলতে বলেছে তোকে?
তৃষাম খুব একটা পাত্তা দিল না জায়ানের কথায়। সহজ কন্ঠে সে বলল – আরে আমি তো তোর উপকার করছি। আমি কখনওই চাই না আমার বোন আর বন্ধুর মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হোক। আজকালকার মেয়ে পূর্বাশা। তোর এত কেয়ারিং দেখে যদি আবার অন্য কিছু ভেবে বসে তখন? তখন কি হবে ভেবে দেখেছিস? তাই তো আগেভাগে ওকে সাবধান করে দিচ্ছি আমি।
কথাটুকু শেষ করেই তৃষাম তাকালো পূর্বাশার পানে, বলল – কি পূর্বা ঠিক বলেছি না আমি?
পূর্বাশা মাথা নুইয়ে ফেললো। বেশ অপ্রস্তুত দেখালো মেয়েটাকে। সে যে বিষয়টা নিয়ে ভাবেনি তেমন নয়। জায়ানের হঠাৎ বদলে যাওয়া, তার সাথে এত ভালো ব্যবহার করা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন জেগেছে তার মনে। তবে সে প্রশ্নকে আবার নিজের হৃদয়েই নিজে দমন করেছে মেয়েটা বারংবার, প্রকাশ্যে আনেনি। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একটু হাসলো পূর্বাশা, বলল – আরে না আমি এ বিষয়ে তেমন কিছুই মনে করিনি।
জায়ান দাঁত কিড়মিড় করে নিজের প্লেট থেকে কাঁটা চামচের মাথায় করে এক টুকরো মাংস মুখের মধ্যে পুরে দিল। প্রবল চাপ প্রয়োগে চিবুতে লাগলো মাংসের টুকরোগুলো। যেন নিজের ভিতরকার সমস্ত ক্রোধ এই মাংসের টুকরোটার উপরেই ঢালছে সে। তবে এখন এই মাংসের টুকরোটাথ স্থানে দাঁতের মধ্যে ফেলে ঐ তৃষামের মাথাটা যদি চিবুতে পরতো তাহলে যদি আর একটু শান্তি পেত সে। তা তো আর সম্ভব নয়। না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। ভালোই ফাঁ’সা ফেঁ’সে গেছে সে।
****
খাওয়া দাওয়া শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে রাস্তায় বের হলো পূর্বাশা, জায়ান আর তৃষাম। হোস্টেলের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো তারা। কিন্তু হাঁটছে পারছে না পূর্বাশা। রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার পর থেকেই কেমন মাথা ঘুরাচ্ছে আর বমি বমি পাচ্ছে তার। এমন কেন হচ্ছে? তেল ঝাল খাওয়ার জন্য কি গ্যাস্টিকে সমস্যা দেখা দিয়েছে? হতে পারে। নিজের স্বভাবগত কারনে নিজের সমস্যাটা আবার বলতেও পারছে না কাউকে। কেমন ইতস্তত লাগছে। তাই চুপচাপ নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটা। আর একটু পথ। তার পরই হোস্টেল। বমি হলেও সেখানে গিয়ে হোক। এই রাস্তার মধ্যভাগে বসে যেন না হয়। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে শুরু করলো পূর্বাশা। কিন্তু শেষ রক্ষাটা আর হলো না বুঝি তার। হরহর করে বমি করে দিল রাস্তার পাশেই। চমকে উঠলো জায়ান আর তৃষাম। একটু আগেও তো মেয়েটা ঠিক ছিল। হঠাৎ কি হলো এর? অস্থির হলো জায়ানের হৃদয়। অস্থির কন্ঠেই সে বলল – কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে আপনার?
পূর্বাশা উত্তর দিতে পারলো না কোনো। এতক্ষন যা যা খেয়েছে সবকিছু যেন ভিতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজের পেট চেপে ধরে সে তার পেটে থাকা খাবারগুলো বাহিরে বের করে দিতে ব্যস্ত। জায়ান নিজের হাত বাড়ালো পূর্বাশার বাহুর দিকে কিন্তু কি ভেবে যেন আবার ফিরিয়ে আনলো হাতটা। একবার ঢোক গিলে মেয়েটার হাতের একটা আঙ্গুল চেপে ধরলো সে। তৃষামের পানে তাকিয়ে বলল – একটা পানির বোতল নিয়ে আয় তো তাড়াতাড়ি।
তৃষাম সময় ব্যয় করলো না। ব্যস্ত পায়ে ছুটলো সে পানির বোতল কিনতে। পূর্বাশা কিছু সময় নিয়ে ব’মি করে পেটের খাবার সব উগড়ে দিয়ে যেন ক্ষান্ত হলো। শরীরটা যদিও দূর্বল লাগছে এখনও। এর মধ্যে তৃষামও পানির বোতল নিয়ে উপস্থিত হলো। সে পানির বোতলটা পূর্বাশার পানে এগিয়ে দেওয়ার আগেই অস্থির ভঙ্গিতে তৃষামের হাত থেকে পানির বোতলটা কেড়ে নিল জায়ান। বোতলের ছিপিটা খুলে বাড়িয়ে দিল পূর্বাশার পানে। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে পানি নিল। কয়েকবার গড়গড়া করে কুলকুচি করে খেয়ে নিল পানি। জায়ান ব্যগ্র কন্ঠে শুধালো – ঠিক আছেন আপনি? চলুন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই আপনাকে।
পূর্বাশা হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল জায়ানকে, বলল – আমি ঠিক আছি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না।
– কিন্তু….
জায়ানকে কথাটা সম্পুর্ন করতে দিল না পূর্বাশা। তাকে থামিয়ে দিয়েই সে প্রশ্ন করলো – রেস্টুরেন্টে যে মাংসটা অর্ডার করেছিলেন ঐটা কিসের মাংস ছিল?
– কেন হাসের মাংস।
– ওহ আমি হাসের মাংস খেতে পারি না। হাসের মাংস খেলেই মাথা ঘুরিয়ে বমি পায় তাই এমন হয়েছে। চিন্তার কোনো কারন নেই আর ডাক্তারের কাছেও যেতে হবে না। এমনিই ঠিক হয়ে যাব আমি।
জায়ান হতাশ হলো। কাল থেকে সে যাই ভালো করতে যাচ্ছে তারই বিপরীত কিছু ঘটছে। এ কেমন কথা? ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক কষ্টে সে জেনেছিল, বাঙালিরা নাকি শীতকালে হাসের মাংস খেতে পছন্দ করে। তাই অনেক খুঁজে কাছেপিঠে হাসের মাংস ভালো রান্না করে এমন রেস্টুরেন্টেই গিয়েছিল। এখন কিনা পরিস্থিতি তার বিপরীতে চলে গেল? এই মেয়েটা হাসের মাংস খেতেই পারে না। সে করতে গেল ভালো আর হলো খারাপ। গতকালকেও এমনই হয়েছে। সে যাই করতে যাক না কেন তাই খারাপ হচ্ছে।
****
সময় গড়ালো একটু। পূর্বাশাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে নিজেদের হোস্টেলে ফিরলো জায়ান আর তৃষাম হোস্টেলে। নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে ঢুকেই শীত পোশাক খুলে ফেললো তারা। হোস্টেলের প্রতিটি কক্ষেই হিটার লাগানো থাকায় রুমের মধ্যে শীত পোশাক পড়তে হয় না তাদের। জায়ান একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো তাদের কক্ষের বারান্দার কাছাকাছি দরজারটার সম্মুখে। অতঃপর তৃষামের পানি তাকিয়ে তাকে ডেকে বলল – শোন তৃষাম।
শীত বস্ত্রটা খুলে পাশে রেখে সে ফিরে তাকালো জায়ানের পানে, বলল – কি?
– এখানে আয় দেখে যা একটা জিনিস।
তৃষাম উৎসুক হলো। জায়ান তাকে কি দেখাতে চাইছে নাচতে নাচতে দেখতে গেল তা। বোকা ছেলেটা বুঝলো না জায়ানের পরিকল্পনা। তৃষাম দরজার কাছটায় পৌঁছে বলল – কই কি দেখাতে চাইছিলি তুই।
জায়ান জবাব দিল না কোনো। হুট করেই বারান্দার দরজাটা খুললো সে। তৃষামের ঘাড় ধরে ধক্কা মেরে তাকে পাঠিয়ে দিল বারান্দায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজাটা বন্ধ করে দিল জায়ান, দাঁতে দাঁত চেপে বলল – এটা তোর অতিরিক্ত বোঝার শাস্তি।
তৃষাম যেন আঁতকে উঠলো। এই সময়ে চীনে যা ঠান্ডা। যেকোনো সময় তুষারপাতের উৎপাতও শুরু হতে পারে। সেখানে কিনা বীনা শীত বস্ত্রে তাকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা হবে? এই ঠান্ডায় ম’রে ভুত হয়ে যেতে তার সময় লাগবে না খুব বেশি। এখনই তো ঠান্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা তার। দরজায় করাঘাত শুরু করলো তৃষাম। গলা উঁচিয়ে বলল – দরজাটা খোল ভাই শীতে জমে যাচ্ছি আমি।
– জমে যা সাথে তোর অতিরিক্ত বোঝার বুদ্ধিগুলোও জমে যাক তারপর না হয় আমি খুলে দেব দরজাটা।
তৃষাম এবার রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো ঠান্ডায়। কম্পিত কন্ঠে সে বলল – আর বেশি বুঝবো না আমি। এই কান ধরছি ভাই। এবার আল্লাহ রাস্তে দরজাটা খোলা ভাই।
তৃষামের কম্পিত কন্ঠে মায়া হলো জায়ানের। খুলে দিল সে দরজাটা। হুমকির স্বরে বলল – এরপর আর বেশি বুঝলে জামা কাপড় খুলে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখবো এই বলে দিলাম।
কথাটা বলেই সে প্যান্টের পকেট থেকে বের করলে আনলো নিজের মোবাইলটা। ভাবলেশহীন ভাবে বসলো নিজের চেয়ারে। লক খুদে পূর্বাশাকে মেসেজ করলো – এখন কেমন আছেন?
এই দুই দিনে তার আর কোনো উপকার হোক বা না হোক অন্তত তাদের দুইজনের মধ্যাকার শত্রুতা একটু কমেছে। এখন আর ঐ তৃষামের পিছনে ঘুরে ঘুরে তাকে দিয়ে কল বা এসএমএস করাতে হবে না। এখন যা করার সে নিজেই করতে পারবে। পূর্বাশাও আর তাকে এড়িয়ে যাবে না। জায়ানের ভাবনার মধ্যেই তার মোবাইলের স্ক্রীনে আলো জ্বলে উঠলো। ছেলেটা তাকালো সেদিকে। পূর্বাশার নাম্বার থেকে উত্তর এসেছে। জায়ান ক্লিক করলো পূর্বাশার এসএমএস টার উপরে। দেখতে পেল সে লিখেছে – জ্বী আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো।
জায়ান হাত চালিয়ে আবার একটা এসএমএস পাঠালো পূর্বাশাকে। সে লিখলো – আমি দুঃখিত। আসলে আমি জানতাম না হাঁসের মাংসে আপনার সমস্যা হয়। যদি জানতাম তাহলে কোনো দিনই হাঁসের মাংসের অর্ডার করতাম না।
– ইটস ওকে। এটা নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই।
– তবুও আমি দুঃখিত। যা হলো আমার জন্যই তো হলো।
আমার অবশ্যই খাবার অর্ডার করার আগে জেনে নেওয়া উচিৎ ছিল যে আপনি কি ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করেন বা করেন না। কোন কোন খাবার আপনি খেতে পারেন, কোন কোন খাবারে আপনার এলার্জি আছে। কিন্তু আমি তার কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।
– এভাবে বলবেন না। এখানে আপনার কোনো দোষ নেই। আমারও নিজের সমস্যার কথা জানানো উচিৎ ছিল।
পূর্বাশার পাঠানো শেষ বার্তাটা থেকে হাসলো জায়ান। তৎক্ষণাৎ নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগালো সে। ব্যস্ত হাতে বলল – তবুও ভুলটা আমারই বেশি। যাক এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে আরেকদিন না হয় আমার তরফ থেকে ট্রিট দেব আপনাকে।
– না না তার দরকার নেই।
– প্লীজ নয়তো আমার ভিতরে একটা অনুতপ্ত বোধ কাজ করবে। এমনিতেও তো কম খারাপ ব্যবহার করিনি আমি আপনার সাথে।
পূর্বাশা চিন্তায় পড়ে গেল। তার কি করা উচিৎ এখন? যাক একটা দিনের ব্যাপার তো। ছেলেটা যেহেতু এত করে বলছে। পূর্বাশা মেনে নিল জায়ানের কথা। হাত চালিয়ে বার্তা লিখলো – ঠিক আছে।
জায়ান বিস্তর হাসলো। সময় ব্যয় না করে লিখলো – কালই চলুন তাহলে। কাল কলেজও বন্ধ রয়েছে।
পূর্বাশা সময় নিল একটু অতঃপর বলল – আচ্ছা।
জায়ান ঠোঁট প্রসারিত করলো। পূর্বাশাকে “শুভ রাত্রি” জানিয়ে সম্মুখে তাকাতেই ভরকে গেল যেন সে। তৃষাম আর চ্যাং শকুনের ন্যায় তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার পানেই। জায়ান ভ্রু কুঁচকালো, থতমত খেয়ে গেল চ্যাং আর তৃষামও। দুই জনই নজর সরিয়ে ফেললো। তৃষাম নিজের শরীরে কম্বোল জড়াতে জড়াতে বলল – আমি একটুও বেশি বুঝিনি।
চ্যাং ও নিজের নজর ঘুরিয়ে নিল। আমতা আমতা বলল – আমি কিছু দেখিনি। তুই যে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রহস্যজনকভাবে মিটিমিটি হাসছিলি। বিশ্বাস কর আমি দেখিনি।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link
[ আহরাব ইশতিয়াদ এবং নিশিতা জুটির উপর লেখা আমার প্রথম উপন্যাস “স্নিগ্ধ প্রেয়শী” পড়ে নিন বইটই অ্যাপে, মাত্র ৪০ টাকা। বইয়ের লিংক এবং কিভাবে কিনবেন পেয়ে যাবেন কমেন্ট বক্সে ]