#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭।
মৌমি ইতস্তত সুরে বলল,
‘আমি কী কথা বলব?’
‘শুধু একটু খোঁজ খবর নিলেই হবে। আমি কেবল ভাইয়ার ভয়েসটা শুনতে চাই। আমার যে কোনোভাবেই ভাইয়ার সাথে কথা বলার সাহস হচ্ছে না।’
প্রিয়তার মনস্তাপ দেখে রাজী হলো মৌমি। তার ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা, কল দাও।’
প্রিয়তা এক বুক সাহস সমেত কল লাগাল। রিসিভ হলো না প্রথম দুবার। তৃতীয়বার রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে শোনা গেল ভরাট এক পুরুষালী স্বর। মৌমি নিজেও ভীত। সে ম্লান সুরে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ভালো আছেন?’
ওপাশের ব্যক্তি সালামের জবাব দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল,
‘কে বলছেন?’
মৌমি ড্যাবড্যাব করে প্রিয়তার দিকে চাইল। প্রিয়তা ইশারায় বলল, একটা ভুল ভাল নাম বলে দিতে। মৌমিও তাই করল। বলল,
‘আমি মিমি বলছি।’
‘কে মিমি?’
মৌমি সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কি নীহাল ভাইয়া বলছেন?’
‘জি, আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।’
ফোনটা লাউডস্পিকারে দেওয়া বলে প্রিয়তা সবই শুনতে পাচ্ছে। সে তার ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে মৌমির কানে কানে উত্তর সাজিয়ে দিল। মৌমিও সেই মোতাবেক বলল,
‘আমি প্রিয়তার বান্ধবী। ওর কি কোনো খোঁজ পেয়েছেন, ভাইয়া?’
ওপাশ নীরব রইল কয়েক পল। অতঃপর মিইয়ে যাওয়া সুরে জবাব এল,
‘না, পাইনি। পুলিশ কমপ্লেইন করা হয়েছে। কিন্তু প্রিয়তা তো নিজ থেকেই দেশ ছেড়েছে, তাই ওকে খুঁজে পেতে এতটা বেগ পোহাতে হচ্ছে আমাদের। আচ্ছা, তুমি কি প্রিয়তার সেই পাকিস্তানী প্রেমিক সম্পর্কে কিছু জানো? না মানে, তার নাম পরিচয়, কিছু একটা।’
প্রিয়তা মাথা ঝাঁকিয়ে “না” বলতে বলল তাকে। মৌমিও তাই করল। বলল,
‘না তো, ভাইয়া। আমি তো এই ব্যাপারে কিছু জানি না।’
নীহালের মনঃক্ষুন্ন হলো। অনেক তদন্ত করেও ঐ ছেলের কোনো খোঁজ খবর পুলিশও বের করতে পারেনি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নিজেই পাকিস্তানে চলে আসবে। বোনকে খুঁজে বের করতে হবে যে। সে বলল,
‘আচ্ছা, রাখছি তাহলে। আর চিন্তা করো না, আমি কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তানে যাব প্রিয়তাকে খুঁজতে। দেখো, ওকে ঠিক আমি খুঁজে নিয়ে আসব। আমরা কেউ ওকে ছাড়া ভালো নেই যে।’
প্রিয়তার চোখ ভিজে উঠল। মন সিক্ত হলো। মৌমিরও মন খারাপ হলো ভীষণ। মৌমি বলল,
‘আচ্ছা ভাইয়া, রাখি তবে। ভালো থাকবেন।’
ফোন কাটল মৌমি। বলল,
‘দেখেছ, আমি বলেছিলাম না, কেউ তোমাকে অপছন্দ করবে না। সবাই তোমাকে সবসময়ের মতোই ভালোবেসে যাবেন, দেখছিলে না তোমার ভাই কী বলছিলেন।’
প্রিয়তা মলিন হেসে বলল,
‘ভাইয়া তো এমনিতেই আমার অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারে না। এক দিনের বেশি দুদিনের জন্য আমাকে কোথাও থাকতে দেননি। আর এখন এতগুলো দিন আমি উধাও, কষ্ট তো হবেই।’
প্রিয়তার কান্না পাচ্ছে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব। কার জন্য করল এসব, কার জন্য নিজের পরিবারকে এত কষ্ট দিল? একজন প্রতারকের জন্য, একজন ঠকবাজের জন্য, একজন নারী পাচারের জন্য? ছি! নিজেকে ভীষণ ধিক্কার জানাল সে।
মৌমি প্রিয়তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
‘তোমার ভাইয়া আসলে, ভাইয়াকে এখানে নিয়ে আসবে। আমরা সবাই মিলে তোমার ভাইয়াকে বোঝাব। তুমি কোনো চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
প্রিয়তা অসহায় সুরে বলল,
‘এতকিছুর পরেও আমি ভাইয়ার সামনে মুখ দেখাব কী করে?’
মৌমি তার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘এত ভেবো না তো। দেখবে তোমার ভাই তোমাকে দেখেই সব ভুলে গিয়েছেন।’
শুধুমাত্র তার জন্য তার ভাইকে এত কষ্ট করে এত দূর আসতে হবে। শুধুমাত্র তার জন্য তার পরিবার প্রতিনিয়ত এত কষ্ট পাচ্ছেন। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে প্রচন্ড। একটা ভুল মানুষের প্ররোচনায় পড়ে আজ তার জীবনের এই দশা। আবার যে কবে একটু সুখ পাবে কে জানে!
রাতে খেতে বসে মৌমি দিলরুবা বেগমকে প্রিয়তার ভাই আসার কথাটা জানাল। দিলরুবা বেগম অবাক হলেও ক্ষিপ্ত হলো ফারজাদ। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘তোকে আগ বাড়িয়ে উনার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে কে বলেছে? আমরা ছিলাম না? আম্মি ছিল না, আমাদের মধ্যে কেউ কি কথা বলতে পারত না? তোর মিথ্যে পরিচয়ে উনার সাথে কথা বলার কী প্রয়োজন ছিল?’
ফারজাদের আকস্মিক রাগে মৌমি আর প্রিয়তা দুজনেই ঘাবড়ে যায়। প্রিয়তা ঢোক গিলে মৃদু সুরে বলে,
‘আমিই মৌমিকে কথা বলতে বলেছিলাম, এখানে ওর কোনো দোষ নেই।’
ফারজাদ কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘কেন বললেন? বাড়িতে কি কথা বলার মানুষের অভাব পড়েছে? আম্মিকে বলতে পারলেন না? মৌমিকে কেন আপনার জন্য মিথ্যে বলতে হবে?’
প্রিয়তা মাথা নুইয়ে চোখের জলকে সংযত করল। দিলরুবা বেগম অস্থির স্বরে বললেন,
‘এভাবে কেন বলছো, ফারজাদ? ও কথা বলতে পারছিল না বলেই মৌমি কথা বলেছে। তাতে এত রেগে যাওয়ার কী আছে?’
‘আম্মি, সবসময়ই উনার হয়ে কথা বলবেন না। উনার জন্য আমরা অযথাই ঝামেলায় পড়েছি। আর কোনো ঝামেলা আমি চাই না। আপনি কাল উনার ভাইকে কল দিয়ে সব বলবেন। বলবেন, উনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে এসে যেন নিয়ে যান।’
‘কিন্তু, মেয়েটার পাসপোর্ট ভিসা তো ওর ব্যাগেই রয়ে গিয়েছে।’
ফারজাদ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘জি, আর ঐ ব্যাগ পুলিশ উদ্ধার করতে পারেননি। আমাকে কল দিয়ে জানিয়েছিলেন, ঐ ছেলের বাড়িতে উনারা কোনো কিছুই পাননি খুঁজে।’
‘এগুলো ছাড়া দেশে ফিরবে কী করে?’
‘সেটা উনি বুঝবেন। ভাই এলে ভাইকে নিয়ে ব্যবস্থা করবেন, তবে এই বাড়িতে থেকে আরো কোনো ঝামেলা করুক আমি তা চাই না।’
ফারজাদ উঠে গেল। খাবারটাও খেল না পুরোটা। তার হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ দিলরুবা বেগম উদঘাটন করতে পারেন না। ফারজাদ প্রস্থান করতেই প্রিয়তার গাল বেয়ে অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়ে। মৌমি অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকায়। ভাইটা তার অযথাই রাগ দেখায়। দিলরুবা বেগম উঠে এসে প্রিয়তার পাশের চেয়ারে বসলেন। বললেন,
‘কষ্ট পেও না, মা। ছেলেটা সবসময় সব ঝামেলা এড়িয়ে চলেছে। সে এসব পছন্দ করে না। এখন তোমার জন্য একটু থানা পুলিশ করতে হচ্ছে বলে হয়তো এই নিয়ে বিরক্ত। তবে একটু পরেই দেখবে সবকিছু ঠিক। রাগ পড়ে গিয়েছে। ওর কথায় কষ্ট পেও না। তোমার ভাই আসলে তোমার ভাইকে আমরা বুঝিয়ে বলব সব।’
প্রিয়তা নিজেকে আর সংযত করতে না পেরে শব্দ করে কেঁদে উঠল। কান্নারত অবস্থায় বলল,
‘উনার কোনো দোষ নেই, আন্টি। সব দোষ আমার। আমার জন্যই তো সব হচ্ছে। আমার জন্য বাংলাদেশে আমার পরিবার কষ্ট পাচ্ছেন, আর এইদিকে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমার জন্যই যত ঝামেলা। আজ আমি পালিয়ে না আসলে এসব কিছুই হতো না। সব দোষ আমার, আমার ভুলের জন্যই দুই পরিবারের মধ্যে এত অশান্তি। আমাকে ক্ষমা করে দিন, আন্টি। ক্ষমা করে দিন।’
প্রিয়তা হাত জড়ো করল। দিলরুবা বেগম তার হাত ধরে বললেন,
‘কী করছো, মেয়ে? কান্না থামাও। কাঁদলে কিছুই হবে না। ভুল করেছ, এখন ভুল থেকে শিক্ষা নাও; তাহলেই ভুলের সব প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে।’
প্রিয়তা চোখ মুখ মুছল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘জি আন্টি, প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন। আমি রুমে যাই, আন্টি। আমার এখন ঘুমের প্রয়োজন। আমাকে ডাকবেন না, প্লিজ।’
প্রিয়তা নিশ্চল ভঙিতে হেঁটে ঘরের দিকে গেল। গিয়েই দরজা আটকে দিল শব্দ করে। মৌমি বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করল,
‘আম্মি, আপু আবার কিছু করে বসবে না তো?’
দিলরুবা বেগম চিন্তিত সুরে বললেন,
‘বুঝতে পারছি না তো। মেয়েটার যা মানসিক অবস্থা যদি কিছু করে বসে। চল তো।’
মৌমিকে নিয়ে গেস্ট রুমের কাছে গেলেন দিলরুবা বেগম। দরজায় ঠকঠক শব্দ করে ডাকলেন,
‘প্রিয়তা।’
সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল,
‘আন্টি, আমি ঘুমাচ্ছি। আমার ঘুমের প্রয়োজন। আমাকে দয়া করে ডিস্টার্ব করবেন না।’
প্রিয়তার জবাব মেয়ে শান্তি পেলেন দিলরুবা বেগম। পরক্ষণেই কিছু একটা পড়ার শব্দে চকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী পড়ল, প্রিয়তা?’
‘আন্টি, আপনার কাচের ফুলের টবটা আমার হাত লেগে পড়ে গিয়েছে; আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’
দিলরুবা বেগমের কেমন যেন সন্দেহ হলো। তিনি দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন,
‘তোমার পরিষ্কার করতে হবে না। তুমি দরজা খুলো।’
‘না, আন্টি। আমি পরিষ্কার করে ঘুমিয়ে পড়ব, আপনি যান।’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/