অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয় #লাবিবা_আল_তাসফি ৫.

0
444

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৫.

আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। যখনতখন ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে যাবে। বর্ষা কালের এই এক সমস্যা। সময় অসময় বৃষ্টি নামবে। এই দেখা যাবে আকাশের বুক উজ্জল করে সূর্য উঠেছে আবার মুহূর্তেই নিজের রূপ বদলে ছেয়ে পড়বে আঁধারে। কুঁচকানো কপাল আরো কিছুটা কুঁচকে এলো আয়াজের। প্রকৃতির উপর ভিষণ রকম বিরক্ত সে। বড় দেয়াল ঘড়িতে নজর দিতেই বুঝলো প্রিয়তার বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে। এতক্ষণে তার মুখে মুচকি হাসির সরল রেখা দেখা গেল। নিজের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে যেতেই তার সহকর্মী মেয়েরা তাকে চোখ দিয়ে গিলে খেতে লাগলো যেন। কেউ কেউবা ফিসফিস করে কিছু বলছে। কিন্তু সে এতে পাত্তা দিল না। এ ধরনের ছেঁচড়া টাইপের মেয়ে তার একদম পছন্দ না। বিরবির করে বলল,’ শ্যামলেস!’

আজ ভিষণ মন খারাপ প্রিয়তার। মন খারাপের দিনগুলোতে তার মায়ের কথা ভিষণ মনে পড়ে। আজ ও মনে পড়ছে। মায়ের চেহারাটাও তার স্পষ্ট মনে পড়ে না। কেমন ঘোলাটে স্মৃতি। প্রিয়তার চোখ ভিজে ভিজে উঠছে। আজ বাস আসতে লেইট করছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। দোকানপাটের অধিকাংশ শাটার টেনে দেওয়া হয়েছে। প্রিয়তা ঠিক করেছে সে আর লাল সাদা রঙের শাড়ি পড়বে না। এই শাড়ি পড়লে সেদিন ভিষণ রকম বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি আর তার শাড়ির অদ্ভুত কোন এক কানেকশন আছে। ঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছে। এখন বিকেল হলেও দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে প্রিয়তা যাত্রী ছাউনীর নিচে পদাড়ালো। এই লাইনের বাসটার কোনো ঠিক নেই। আজ না আসলেও পারে। বিরক্ত চোখে আসপাশে তাকালো প্রিয়তা। ফাঁকা কোনো ট্যাক্সি পেলেও চলে। ভাড়াটা যদিও একটু বেশি চাইবে। বাট ইটস্ ওকে।

‘বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। এখন কোনো ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না।’

বৃষ্টির জলে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। চুল থেকে টুপটাপ করে পানি পড়ছে। সাদা রঙের শার্টটা ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে। প্রিয়তা আয়াজের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল। শান্ত গলায় শুধাল,

‘এখানে কি করছ তুমি? আর এতটা ভিজলে কিভাবে?’

জবাবে গা দুলিয়ে হাসলো আয়াজ। ভেজা চুলগুলো ঝাঁকিয়ে পানি ছিটালো প্রিয়তার দিকে। ছিটা ছিটা পানি এসে পড়লো প্রিয়তার মুখমন্ডলে। গরম চোখে আয়াজের দিকে তাকাতে সে আবারো হাসলো। প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

‘আপনার কি আমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে প্রিয়?’

‘একদম না। তুমি মরে গেলেও তোমাকে নিয়ে চিন্তখ করার মতো তুচ্ছ কাজ আমি করবো না।’

প্রিয়তা ভেবেছিলো তার এমধ কঠিন বাক্য আয়াজকে আহত করবে। আত্মসম্মানে আঘাত করবে কথাটা। আয়াজ তখন প্রতিউত্তরে বলবে,

‘আপনি ভিষণ জাদরেল টাইপ মেয়ে। এমন মেয়েকে আমি কখনোই আমার মূল্যবান প্রেম সমার্পন করবো না। যতটা করেছি তা সহিসালামতে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। আল্লাহ হাফেজ।’

প্রিয়তা তখন ভিষণ দুঃখ পাওয়ার অভিনয় করে বলবে,

‘কেবল এতটুকুতেই তোমখর প্রেম ফুরিয়ে এলো?’

কিন্তু আয়াজ কোনো উত্তর দিবে না। তার গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলবে,

‘আমায় ট্রিক করার চেষ্টা করবেন না। আপনার ভোলাভালা মুখ দেখে আমি আর ফাঁসছি না।’

প্রিয়তার এতসব জল্পনা কল্পনাকে জলে ফেলে দিয়ে আয়াজ সুন্দর হেসে বলল,

‘আমি জানি। আর এজন্যই আমি মরতে চাই না। আমার তো এখনো আপনাকে ভালোবাসা বাকি। সংসার করা বাকি। বচ্চার মুখে বাবা ডাক শোনা বাকি। এত অপূর্ণতা নিয়ে মারতে পারি বলেন?’

প্রিয়তা জবাব দিলো না। তার এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে সে অনেক প্রেমের প্রোপোজাল পেয়েছে। কিন্তু তার কেউই এক সপ্তাহের বেশি প্রিয়তার পেছনে ছুটতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ প্রিয়তার কঠিণতা। কিন্তু এই ছেলে তেমন নয়। তার কঠিণতা আয়াজকে তার স্থান থেকে এক চুল পরিমান নড়াতে পারেনি। প্রিয়তা হতাশ চোখে বাইরে তাকায়। বৃষ্টি এখনো তেজ নিয়ে ঝড়ছে। এর শেষ কখন বলা যাচ্ছে‌ না।

‘এদিকে সরে দাঁড়ান প্রিয়তা। ভিঁজে যাচ্ছেন।’

ছিটা ছিটা পানিতে প্রিয়তার শাড়ি অনেকটা ভিঁজে গিয়েছে যা লক্ষ করেনি প্রিয়তা। আয়াজের গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করা তার নাম শুনে সে কেঁপে উঠলো কিছুটা। দিরুক্তি না করে বাধ্য মেয়ের মতো কিছুটা আয়াজের দিকে সরে দাঁড়ালো। এটাই হয়তো প্রথম আয়াজ তার পূর্ণ নাম ধরে ডেকেছে।
___________

‘রাত হয়েছে প্রিয়। চলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।’

প্রিয়তা কোনো কথা বলল না। জেদ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়। আয়াজ প্রিয়তার এই অবাধ্যতা দেখে চোয়াল শক্ত করে নিলো। কঠিন গলখয় বলল,

‘আপনার এ ধরণের অবাধ্যতা আমি সহ্য করবো ভাবলে ভুল ভাবছেন।’

প্রিয়তা কোনো রিয়্যাকশন ছাড়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট দশেক একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে একটা ট্যাক্সি পেতে চড়া ভাড়ায় তাতেই চেপে বসলো প্রিয়তা। আয়াজ শুকনো গম্ভীর মুখ করে কেবল তাকিয়ে রইল। মেয়েটার অবাধ্যতা সীমা লঙ্ঘন করছে। অতি শীঘ্রই এর একটা ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

দরজায় কড়া নাড়তে সুজলা এসে দরজা খুলল। মামিকে দরজা খুলতে দেখেই প্রিয়তা বুঝতে পেরেছে আজ বড় কিছু ঘটতে চলছে। কিন্তু তার ভয় লাগলো না। এসবে সে ঐখন অভ্যস্ত।

‘এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি?’

‘বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলাম।’

প্রিয়তার সহজ জবাব সুজলার পছন্দ হলো না। প্রিয়তার কোনো কিছুই তার পছন্দ হয় না। তার মতে তার সংসারের অশান্তির মূল কারণ প্রিয়তা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন একদিন এই মেয়ের কারণেই তাদের পথে বসতে হবে। লোকে দুটাকা দিলে দুমুঠো খেতে পাবে নয়তো নেই। সুজলা চোখ বাঁকা করে তাকালো প্রিয়তার দিকে। মুখ ঝামটা মেরে বলল,

‘আমার বাড়িতে থাকতে গেলে এসব নষ্টামি চলবে না। আমি কিছু বুঝিনা তাই ভাবছো? বাপের রক্ত বইছে শরীরে। বাপের মতো নষ্ট হতে সযয় লাগবে না।’

‘সব কথার মাঝে আমার বাপকে না টানলেই কি নয় মামি?’

‘আহা! খুব গায়ে লাগছে দেখছি!’

প্রিয়তা আর জবাব দিলো না। সে জানে মামি এখন তাকে রাগাতে চখিছে এসব বলে। সে কোনো উত্তর দিলেই মামর কাছে বিচার বসাবে। এরপর এই সূত্র ধরে বিশাল ঝামেলা। কিন্তু সে কোনো ঝামেলা চায় না। রুমে ঢুকে ভেজা কাপড় বদলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সারাদিন পর নরম বিছানায় পিঠ লাগাতেই ঘুম এসে ধরা দিলো চোখে। সকল হতাশা চিন্তা ভুলে ঘুমের দেশে গা ভাসিয়ে দিলো সে। একটা লম্বা ঘুম দরকার।

মাঝরাতের দিকে প্রচন্ড ক্ষুদায় ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রিয়তার। এপাশ ওপাশ করেও কোনো লাভ হয় না। রান্নাঘরে ঢুকে কোথাও কোনো খাবার খুঁজে পেল না। অবশিষ্ট কোনো খাবার রাখা নেই। শেষে এক কাপ চা আর দুটো বেকারি বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পরতে হলো। আপাতত এটুকুতেই রাতটুকু চলবে।

__________

পরপর দুদিন আয়াজের কোনোরকম খোঁজ পাওয়া গেল না। প্রিয়তা বেশ অবাক হলো। সাথে কিছুটা চিন্তিত ও। আয়াজকে সে যতটুকু চেনে‌ এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পাত্র সে না। তাহলে? একটা সূক্ষ্ম চিন্তায় কপালের মাঝে ভাঁজ পড়লো। পরক্ষণেই চিন্তাগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। আয়াজ আসছে না এতে তো তার স্বস্থি পাওয়ার কথা চিন্তা নয়?

রিকশা‌ এসে বাস স্ট্যান্ড এ থামতেই প্রিয়তা ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো। বাস এখনো আসেনি। প্রিয়তা ব্যস্ত নজরে আশপাশে তাকালো। কপালে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো কানের ভাঁজে গুজে দিয়ে সময় দেখলো। মাথা থেকে আয়াজ নামটা সরছে না। ছেলেটা আশপাশে থেকেও তাকে বিরক্ত করে না থেকেও সেম। প্রিয়তা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার থেকে এত ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে ভাবনা তাকে মানায় না। আয়াজ বাচ্চা ছেলে! পাগলামি করছে কিন্তু সে তো বুঝে! প্রিয়তার মন খারাপ হয়ে এলো। ছোট ছোট করে বলল,

‘তুমি কেন আমার আগে জন্ম নিলেনা? আমি একটা আপন মানুষ পেতাম। ভরসার একটা হাত পেতাম। কিন্তু আমি যে বড্ড অভাগী!’

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here