রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২০| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
607

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২০|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অদূরে কারো কারো উচ্চরব ভেসে আসছে৷ দিনের আলোয় বাতাবরণ যেমন কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়‚ রাতে ঠিক ততটাই নীরবতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে। অর্পণ আর আরশকে কিছু না বলেই কুপি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মহুয়া। উনার এমন ব্যবহার অবাক আর হতভম্ব করল অর্পণ আর আরশকে। একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে বেরোলেন মহুয়া। মন বলছে উনার মেয়ে কাছে পাশেই রয়েছে। আওয়াজ ভেসে আছে পুষ্করিণী পাড় থেকে৷ ধ্বনি অনুসরণ করে তিনি সেদিকটাতেই গেলেন। লোকসমাগম ছয় সাতেক হবে। সকলেই ব্যাটারি লাইট ধরে রেখেছে প্রলয় আর অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে৷ দূর থেকে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও মহুয়া ধীর পায়ে সেদিকটাতেই এগিয়ে গেলেন। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। উনাকে দেখা মাত্রই একজন বলে উঠল‚

“বড়োলোক এমপি পাইয়া মাইয়ারে লেলাইয়া দিছ। এখন বুঝ কেমন লাগে!”

ক্রন্দনরত অবস্থায় মহুয়া বললেন‚ “এসব কী বলছেন আপনারা? আমার ভূমি এমন মেয়ে নয়। দেখছেন তো আমার মেয়েটা দুর্বল। তারপরও কেন খারাপ খারাপ কথা বলছেন?”

“চোরের মায়ের বড়ো গলা। শহরে গিয়া তো নিজেই পেট বাঁন্দাইয়া আসছিলা। ভুইলা গ্যাছ বুঝি?”

এতগুলো মানুষের সামনে আবারও পুরোনো কথা উঠে আসছে। গ্রামের মানুষগুলোর কথাবার্তা শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে মহুয়ার৷ মেয়েকে নিয়ে খারাপ কথা তিনি কখনো সহ্য করবেন না! কক্ষনো না! মহুয়া বললেন‚

“অনেক বলেছেন আর না! আমার আল্লাহ জানেন আমি কখনো পাপ করিনি৷ আর না আমার মেয়ে কোনো পাপ করতে পারে।”

এবার প্রলয় মুখ খুলল‚ “অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের অনেক কথা শুনছি। আপনারা আপনাদের নোংরা মুখটা এবার বন্ধ করুন। দেখছেন তো একটা মেয়ে কতটা দুর্বল। আপনাদের এখানেই থেকে কোনো কাজ নেই তাই এখন এখান থেকে যেতে পারেন।”

“আমগোর এইসব দেইখা কোনো কাম নাই। তবে কথা তো আমগোরই কইতে হইব। কে কইতে পারে— এই মাইয়ার এমন অবস্থা তোমার লিগা হয় নাই?”

দাঁত কিড়মিড় করে রমিজা বললেন‚ “উনিশ বছর আগে এই মহুয়ারে গ্যারামে জায়গা দেওয়াই আমগো সবচেয়ে ভুল। একই ভুল আমরা দ্বিতীয় বার করতাম না। এই মাইয়ারে আইজ গ্যারাম থাইকা বাইর করতে হইব।”

“ঠিক! রমিজা ভাবি একখান উচিত কথা কইছে।”

নিজের পক্ষে কাউকে পেয়ে রমিজা যেন আকাশে উড়ছেন। অত্যাধিক ভাব নিয়ে বললেন‚

“আমি উচিত কথা কই দেইখাই‚ আমারে কেউ ভালা পায় না।”

স্ত্রীর কথা তেতে উঠলেন জামাল মিয়া। কোনো কালেই স্ত্রীর মুখের উপর কথা বলতে পারেন না তিনি। গালমন্দ করে চুপ করিয়ে দেন রমিজা। আজ মুখ খুললেন। জামাল মিয়া বললেন‚

“এখন কইলাম বেশি করতাছ৷ ওগো সমস্যা ওরাই মিটাইয়া লইব। তুমি চুপ থাক।”

জামাল মিয়ার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন রমিজা। স্বামী বলা কথা কস্মিনকালেও পছন্দ হয় না উনার। ভীড় ঠেলে অর্পণ আর আরশ এসে দাঁড়াল পুষ্করিণী পাড়ে। মহুয়া মেয়ের মাথার কাছে বসে রয়েছেন। অর্পণ হাঁটু গেড়ে বসে ভূমির পালস পরিক্ষা করল। মেয়েটার শরীর অত্যন্ত দুর্বল। আরশের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইশারা করল অর্পণ। ইশারা বুঝতে পেরেই আরশ বলল‚

“আপনারা এখন ভীড় কমান। ইমিডিয়েটলি ভূমির ট্রিটমেন্ট শুরু করা প্রয়োজন। কপাল আর পায়ের ক্ষ’তটাও বেশ গভীর। ড্রেসিং করাতে হবে।”

শাহাদাৎ মোড়লকে খুব সম্মান করে গ্রামবাসী। সেই সাথে আরশকেও সম্মানের চোখে দেখে সবাই। তার এক কথাতেই কাজে দিল। আপসে মেনে নিয়ে একজন বলে উঠল‚

“আমরা এখন চইলা যাইতাছি কিন্তু কাল এর একটা বিহিত মোড়ল সাব-রে করতেই হইব।”

ভীড় কমতে শুরু করেছে৷ প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে অর্পণ বলল‚ “ভাই উনাকে বেশিক্ষণ এভাবে রাখলে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেই ভালো হবে। কপাল আর পায়ে বেন্ডেজ করাতে হবে৷”

বিনা বাক্যব্যয়ে ভূমিকে কোলে তুলে নিল প্রলয়৷ অর্পণ দ্রুত পায়ে গাড়ি থেকে ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে ভূমিদের বাড়িতে ঢুকল৷ মহুয়া তাড়াহুড়ো করে মেঝেতে মাদুর আর কাঁথা বিছালেন। একটা বালিশও এগিয়ে দিলেন তিনি। ভূমিকে নিয়ে গিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিল প্রলয়। আরশ তার ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে রেখেছে৷ অর্পণ ছুটে এলো। প্রলয় সেখান থেকে সরে দাঁড়াল। ধুলোবালি‚ র’ক্ত জমাট পা দুটো ড্রেসিং করিয়ে বেন্ডেজ করে দিল অর্পণ। ক্ষ’ত হয়েছে বেশ অনেকটাই। ডান পায়ে খুব বেশি আঘা’ত পেয়েছে। কাঁচ অনেকটা ফুটে গিয়েছিল। কপালের রক্তও পরিষ্কার করিয়ে দিল। অল্পের জন্য ক্ষ’তটা গভীর হয়নি। যার জন্য সেলাইও লাগেনি। টিটেনাস আর ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করে দিল। আজ আর জ্ঞান ফিরবে না৷

“আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না। আশা রাখা যাচ্ছে দুর্বলতা ভাবটা কালকের মধ্যেই কে’টে যাবে। তবে ক্ষ’ত শুকতে সময় লাগবে।”

“তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ বাবা। আমার মেয়েটাকে কোথায় পেয়েছিলে প্রলয়?”

“উনাকে আমি এই অবস্থাতেই রাস্তা পেয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরছিল না বিধায় ঘাটে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখনই গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে যা তা বলতে শুরু করল।”

প্রলয় আসল কথাটা জানাল না। কিছুটা এড়িয়েই গেল। প্রলয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মহুয়া বললেন‚

“তুমি না থাকলে যে আমার মেয়েটার কী হত! তোমার ঋণ প্রত্যর্পণ করার ক্ষমতা আমার নেই বাবা৷”

“আপনি প্লিজ এভাবে বলবেন না। মানুষই তো মানুষের হিতসাধনে আসবে। রাত হচ্ছে‚ আমরা এখন আসি?”

“আচ্ছা বাবা।”

অর্পণ আর আরশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রলয়। নিজের ফোন থেকে অর্পণের ফোনে একটা টেক্সট করল সে। নোটিফিকেশন বেজে উঠতেই একবার ফোন স্ক্রিনে চোখ বুলাল অর্পণ। এরপর আরশকে বলল‚

“আরশ তুই গাড়ি নিয়ে বাড়িতে চলে যা। আমি আর ভাই একটু থানা থেকে আসছি।”

অর্পণের হাত থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে আরশ বলল‚ “তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি। আসছি।”

সে রাতে ঘুম হলো না মহুয়ার। মেয়ের মাথায় কাছেই ঠায় বসে রইলেন নির্ঘুম রাত। ভোরের আলো ফুটে উঠতেই মহুয়া গোসল ঘরে গেলেন। কিছু সময় পর ওযু করে এসে নামায আদায় করলেন। অনেকটা সময় নিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। মেয়েকে ফিরে পেয়ে অশান্ত মন খানিকটা শান্ত হলো তবে মন থেকে চিন্তা কিছুতেই দূর হলো না। না জানি আজ নালিশে কী অপেক্ষা করছে! সজাগ হচ্ছে ভূমি। কপালে আর পায়ে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। অসহনীয় ব্যথায় কপাল কুঁচকে এলো মেয়েটার। একটু করে উঠার চেষ্টা করল। তবে ব্যর্থ হলো সে৷ উঠতে পারল না৷ মহুয়া খেয়াল করলেন। জায়নামায গুছিয়ে রেখে মেয়ের মাথার কাছটায় গিয়ে বসলেন। মেয়ের শরীরের ভরটা নিজের উপর নিয়ে উঠে বসালেন তিনি। মেয়েকে শুধালেন‚

“এখন ঠিক লাগছে? বাহিরে যাবি?”

ভূমি মাথা উপর নিচ ঝাকাল। যার অর্থ ‘হ্যাঁ!’ সে বাহিরে যাবে।

ঘর্মাক্ত হয়ে রয়েছে প্রত্যেকের শরীর। মোড়ল বাড়ির বাগানে গ্রামবাসী ভীড় জমিয়েছে। সকলেই ভূমি আর প্রলয়ের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে এসেছে। শাহাদাৎ মোড়ল পড়েছেন বিড়ম্বনায়৷ কীইবা বিচার করবেন তিনি? কীইবা বিচার করার আছে উনার। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তো এখানে কেউই নয়। সকলে একসঙ্গে বলাবলি করছে‚

“আমগো গেরামে মাইয়ারে অপবিত্র করছে ইনি। আমরা এর বিহিত চাই মোড়ল সাব।”

“এই ন’ষ্টা মাইয়া রে আমগো গেরামে আর রাখমু না।”

ভূমির ব্যাপারে খারাপ কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল প্রলয়৷ চেঁচিয়ে বলে উঠল‚ “মুখ সামলে কথা বলুন৷ সত্যি মিথ্যে কিছু না জেনে কারো সম্বন্ধে খারাপ কথা বলতে পারেন না।”

“আপনে মিয়া চুপ থাকেন। অসহায় মাইয়া পাইয়া ইজ্জত লুটছেন আর বড়ো বড়ো কথা কন?”

“হয় এই মাইয়া রে এমপি সাব বিয়া করব আর নাইলে এরা মা মাইয়া এইখান থাইকা সারাজীবনের লাহান চইলা যাইব। তাও আবার মুখে চুন কালি মাইখা।”

অর্পণ এগিয়ে এসে বলল‚ “কীসের মধ্যে কী বলছেন আপনারা? অসহায় একটা মেয়েকে আমার ভাই সাহায্য করেছে আর আপনারা তার উপরই আঙুল তুলছেন? ছিহ্!”

“মোড়ল সাব আমরা আপনের কাছে বিচার চাই।”

সকলের এত এত কথার জালে আটকে পড়েছে ভূমি। মেয়েটা কান্না করতেও যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছে৷ এত মানুষের কটু কথায় ভয় হচ্ছে ভীষণ। মায়ের আঁচল খামচে ধরে রেখেছে৷ নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে ভূমির৷ অষ্টাদশী কন্যার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে অজানা আশঙ্কায়। এই বিবাদের শেষ কোথায়— জানা নেই তার!

“অর্পণ কাজির ব্যবস্থা কর— এক্ষুনি এখানে বিয়ে হবে। পুরো গ্রাম সাক্ষী থাকবে।”

প্রলয়ের কথায় ভড়কে গেল অর্পণ। এখানে কাজি ডেকে আনা মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তার ভাই যে কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেনি। তাহলে আজ কেন? অর্পণ নিজে থেকে কিছু বলতে নেবে তার আগেই হুঙ্কার দিয়ে উঠল প্রলয়৷ তার এমন হুঙ্কারে কেঁপে উঠল উপস্থিত সকলের হৃদয়৷ প্রলয়ের এক অন্যরকম রূপ দেখছে শাহাদাৎ মোড়ল। এই তিনদিন তো অত্যন্ত বিনয়ী এবং শান্ত মনে হয়েছিল৷ কিন্তু ছেলেটার যে এত রাগ তা ঘুনাক্ষরেও টের পাননি তিনি৷ পাবেনই বা কী করে? মানুষ যতটা প্রকাশ করে ততটাই জানা যায় আর বাকিটা তো অজানাই থেকে যায়। মায়ের আঁচলের পেছন থেকে উঁকি দিল ভূমি৷ এতক্ষণে সব কথাই শুনছিল। সমস্ত কটু কথা নীরবে হজম করেই নিচ্ছিল। তাহলে লোকটা কেন এদের দাবি মেনে নিচ্ছে?

কিছু সময় চুপ থেকে প্রলয় আবারও বলল‚ “যেটা বললাম— চুপচাপ সেটাই কর৷ নাকি দাওয়াত করে পাঠাতে হবে?”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here