#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সকালে মহুয়ার মুখে মেয়ের কথা শুনে খুবই কৌতূহল হলো মেহরাব শিকদারের৷ সত্যিটা জানার আগ্রহ দাবিয়ে রাখতে পারছেন না কিছুতেই। নাস্তার পর্ব চুকিয়ে মহুয়া বাকি কাজগুলো করছেন। সবকিছুতেই আজ তাড়াহুড়ো করছেন তিনি। মেহরাব শিকদারের সামনে পড়তে চান না কিছুতেই। একগাদা কাপড় ভিজিয়েছিলেন সকালে। সেগুলো এখন বাগানে মেলে দিচ্ছেন। রোদ আছড়ে পড়ছে সেখানটায়৷ কাপড়চোপড় শুকতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। বালতি হাতে নিয়ে মহুয়া পেছন ফিরতেই মেহরাব শিকদারকে দেখতে পেলেন। লোকটা উনাকে অনুসরণ করছেন কিন্তু কেন? লোকটাকে দেখেই রাগের মাত্রা তড়তড় করে বাড়তে শুরু করল। একটা সময় যে ব্যক্তি উনার সবথেকে প্রিয়‚ ভালোবাসার মানুষ ছিলেন। আজ তাকে দেখে ঘৃণা হৃদয়‚ মস্তিষ্ক জর্জরিত হচ্ছে৷ মহুয়া বাগান থেকে প্রস্থান নিতে চাইলে মেহরাব শিকদার বলে উঠলেন‚
“তোমার মেয়ে কোথায় মহু?”
“সেটা জেনে তোমার কোনো কাজ নেই।”
মেহরাব শিকদারকে ভয় দেখানোর উদ্দেশে মহুয়া আবারও বলে উঠলেন‚
“তোমার সত্যিটা সকলের কাছে বলতে আমার খুব বেশি সময় লাগবে না। বাঁচতে চাইলে খুব শীগ্রই এখান থেকে চলে যাও৷ তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
মহুয়ার এহেন কথা ভীষণ রাগ হলো মেহরাব শিকদারের। তবে সেই রাগ প্রকাশ করলেন না৷ বরঞ্চ তাচ্ছিল্য করে বললেন‚
“বেশি বাড় বেড় না ঝড়ে পড়ে যাবে।”
“আর পড়ার বাকিটাই কী রেখেছ? অ্যাই তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও তো। পুরোনো ক্ষ’ত আবার তাজা করতে এসেছ? এবার কিন্তু আমি চুপ থাকব না।”
“মুখ থেকে টু শব্দ বের হলে খু’ন করে রেখে দেব।”
“ড. মেহরাব শিকদার বুঝি ভয় পাচ্ছে?”
“ভয় তাও আবার আমি? হুহ্!”
“তোমার সব অন্যায়‚ পাপের শাস্তি তোমাকে ইহকালেই পেয়ে যেতে হবে৷ বউ‚ বাচ্চার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারবে তো?”
“কোনো সত্যির মুখোমুখি আমি ওদের হতে দেব না আমি।”
“যতই চেষ্টা কর— সত্যিটা একদিন সবার সামনে আসবেই৷ সেদিন কোথায় মুখ লুকাবে?”
মেহরাব শিকদার এদিক সেদিক তাকালেন। কাউকে দেখতে না পেয়ে মহুয়ার গাল চেপে ধরলেন রুক্ষ ভাবে৷ ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে এলো মহুয়ার৷ নিজে থেকে মেহরাব শিকদারের হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন৷ চেঁচিয়ে বললেন‚ চোখের সামনে থেকে দূরে চলে যেতে। মেহরাব শিকদার আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালেন না।
ভূমিকে নিয়ে ডাইনিং স্পেসে এসেছে প্রলয়৷ কাল সন্ধ্যের পর আর ঘর থেকে বের হয়নি মেয়েটা৷ মাধুরী রান্নাঘরে রয়েছেন। মোর্শেদ শিকদারের পাশের চেয়ারে প্রলয় বসল। পূর্ণতা পুষ্পিতা সামনাসামনি বসেছে৷ ভূমি রান্নাঘরে গিয়েছে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। তাকে দেখে কিছু বললেন না মাধুরী৷ বরঞ্চ ভূমির হাতে জুসের জগটা ধরিয়ে দিলেন। রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নেওয়ার আগে বললেন‚ ‘দ্রুত নিয়ে এসো।’ মাধুরীর কথানুযায়ী উনার পেছন পেছন ছুটল ভূমি৷ ফিরোজা সকলের প্লেটে অমলেট দিচ্ছেন। ভূমি পরোটা এগিয়ে দিতে লাগল। খাওয়ার একপর্যায়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚
“অর্পণ কোথায়— দেখছি না যে?”
ফিরোজা বললেন‚ “ও একটু বেরিয়েছে।”
খাওয়া রেখে পুষ্পিতা বলল‚ “ওয়েট ওয়েট! বড়ো ভাইয়া তুমি কী ছোটো ভাইয়াকে মিস করছ?”
পূর্ণতা বলল‚ “ছোটো ভাইয়া থাকলে হয়তো আবেগে কেঁদেই দিত।”
নিজেরাই কথা বলছে নিজেরাই হাসছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার কানে টেনে ধরলেন মাধুরী। সারাক্ষণ দুষ্টুমি লেগেই থাকে এদের। আজ মনে হচ্ছে দুটোর মাঝে কোনোটার থেকে কোনোটা কম না। চঞ্চল দুটোই। পূর্ণতা মাঝে মাঝে শান্ত থাকে কিন্তু পুষ্পিতাকে বকে মে’রে শান্ত করানো যায় না। পানি পান করে প্রলয় দুবোনের উদ্দেশে বলল‚
“পাগলদের সঙ্গে কথা বললে আমিই কখন পাগল হয়ে যাব!”
“বড়ো ভাইয়া তুমি আমাদের পাগল বললে?“
“ভূল হয়েছে।” কথাটা শুনে হয়ে গিয়েছিল পূর্ণতা পুষ্পিতা। প্রলয়ের পরবর্তী কথাটা শুনে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল দুটোতে৷ যখন প্রলয় বলল‚ “পাগলি বলা উচিত ছিল।”
মুখ টিপে হাসছে ভূমি আর ফিরোজা। মাধুরী বললেন‚ “তুমি খেতে বসে পড় ভূমি। ফিরোজা তুইও বোস৷”
সফট মিউজিক বাজছে। শীতল পরিবেশ৷ রঙ বেরঙের মরিচবাতি জ্বলছে৷ অর্পণ ইরা মুখোমুখি বসে রয়েছে। আজ ভার্সিটি যায়নি৷ কলেজ রোডের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে৷ খাবার আর কোল্ড কফি অর্ডার দেওয়া হয়েছে৷ চুপ করে বসে রয়েছে ইরা। নীরবতা ভেঙে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“এত তাড়াহুড়ো করে ডেকে আনার মানেটা কী?”
“কেন আমার সঙ্গ বুঝি আপনার ভালো লাগছে না?”
“ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল চলবে না৷ সরাসরি কথা বল।”
“আজ তো রোজ ডে। বান্ধবীরা সবাই কত কত ফুল পেয়েছে! আপনি আমাকে ফুল দেবেন না?”
“তা আমি কেন তোমাকে ফুল দেব?”
“আমি এখন অতশত ব্যাখ্যা দিতে পারব না৷ আপনি ফুল কিনে দিবেন কি-না সেটা বলুন।”
“চল ফুল কিনে দিচ্ছি।”
অল্পতেই খুশি হয়ে গেল ইরা৷ মুখে লেপ্টে রয়েছে তৃপ্তিকর মিষ্টি হাসি। অপলক নেত্রে চেয়ে রইল অর্পণ। ইরা বলল‚ “এভাবে তাকিয়ে থাকলে প্রেমে পড়ে যাবেন তো। তখন আপনাকে কে সামলাবে?”
“প্রেমে পড়া কী এতই সোজা? তোমার প্রেমে পড়তে আমার বয়েই গেছে?”
“নারীর চোখ কী ফাঁকি দেওয়া যায়?”
“যায় না বুঝি?”
“অবশ্যই যায় না। প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা একটা নারী খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারে।”
“তাই?”
“হুম— হুম! এ চোখে তাকালে আপনি প্রেমে পড়তে বাধ্য।”
“আচ্ছা ওসব প্রেমের কথা বাদ। পড়াশোনা কেমন চলছে তোমার?”
“যেমন দেখছেন।”
“তোমার মতো ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে দুটো দেখিনি।”
“দেখেননি তো কী হয়েছে? এখন দেখে নিন।”
“ভারী দুষ্টু তুমি।”
“নতুন কথা বলুন। পুরনো কথা শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত।”
অর্পণ দুহাত জোর করে ইরার সামনে মাথা নোয়াল‚ “আমার ভুল হয়েছে বোন। তোমার পেছনে লাগা উচিত হয়নি।”
ইরা রেগে বলল‚ “আমি আপনার কোন জন্মের বোন হই? আমার একটা সুন্দর নাম আছে। সেই নামেই ডাকবেন।”
“আরে রাগছ কেন? আমি কী রাগ হওয়ার মতো কিছু বললাম নাকি?”
“অবশ্যই। কফি অর্ডার দিন। গলা শুকিয়ে গেল।”
“যেভাবে ঝগড়া করছ গলাতে শুকবেই।”
“আপনি ঝগড়া করতে এসেছেন কেন বদ লোক?”
“তাহলে চলে যাই?”
“তা তো যাবেনই। আমি কী আটকে রেখেছি নাকি? যান— চলে যান।”
“না যাব না। টায়ার্ড লাগছে।”
“আপনি বড্ড তর্ক করেন।”
“হার মেনে নিলাম।”
“গুড গার্ল।”
চকিত দৃষ্টিতে অর্পণ তাকাল ইরার দিকে। জিজ্ঞেস করল‚ “ওটা গার্ল নয় বয় হবে। স্টুপিড।”
“আপনি থাকুন। আমিই চলে যাচ্ছি।”
ইরা উঠে চলে আসতে নিলে অর্পণ তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। সে তো নিছকই মজা করছিল। মেয়েটা অল্পতেই রেগে যায়৷ তাইতো রাগাতেও ভালোই লাগে৷ অর্পণ বলল‚
“আমাকে ডেকে এনে এখন কোথায় যাচ্ছ?”
“বেশি তর্ক করতে চাইছি না তাই চলে যাচ্ছি।”
“ইরাবতী কী হাঁপিয়ে গেল?”
অর্পণের মুখে ইরাবতী ডাকটা শুনে অবাক হলো ইরা। ভীষণ রকমের অভাক। এই প্রথম ইরাবতী ডাকটা শুনে বেশ ভালো লেগেছে তার৷ অর্পণের মুখে ডাকটা অন্যরকম সুন্দর লাগল যেন৷
রাতে…
বৈঠকখানায় মোর্শেদ শিকদার মাধুরী পাশাপাশি বসেছেন। প্রলয় আর অর্পণ দুজন দুই প্রান্তে বসেছে৷ ডাইনিং টেবিলে থাকা এঁটো বাসন গুলো রান্নাঘরে এগিয়ে রাখছে ভূমি। সাবিনা সেগুলো ধুয়ে রাখছে। ফিরোজাও রান্নাঘরেই রয়েছেন৷ বড়োদের আলোচনায় পূর্ণতা পুষ্পিতাকে থাকতে দেননি মাধুরী। পরীক্ষা প্রায় চলে এসেছে৷ মেয়ে দুটোর মন খারাপ‚ বড়ো ভাইয়ার রিসেপশন/জন্মদিনে আনন্দ করতে পারবে না বলে। প্রলয় ভূমির রিসেপশনের জন্য কার্ড ছাপানো হয়েছে৷ কাকে কাকে দিতে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে মূলত। এখনো অনেক কিছু কেনাকাটা করার বাকি রয়েছে৷ সেজন্য মোর্শেদ শিকদার বললেন‚
“রিসেপশনের জন্য যা যা কেনার আছে কিনে নিয়ো প্রলয়। আজ দুপুরে তোমার মা আর ফিরোজা গহনা ঠিক করাতে দিয়ে এসেছিল।”
কথায় বিরতি নিয়ে মোর্শেদ শিকদার আবারও বললেন‚ “ভূমিকে সঙ্গে নিয়ে যেও। ওরও তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে৷”
প্রলয় কিছু বলল না৷ মনে মনে তো সে এটাই চাইছিল‚ ভূমিকে নিয়ে শপিং এ যাবে৷ মোর্শেদ শিকদার না বললেও সে ভূমিকে নিয়ে যেত। ক্ষীণ হাসল প্রলয়। মাধুরী বললেন‚
“তোর বন্ধুদেরও বলবি কিন্তু। কেউ যেন বাদ না পড়ে৷”
ভাত মাখতে মাখতেই প্রলয় বলল‚ “ওদের আরও আগেই বলা হয়ে গিয়েছে৷”
অর্পণ টিপ্পনী কে’টে বলল‚ “ভাই তুমি তো ফাইভ জি স্পিডে ছুটছ।”
চোখ গরম করে তাকাল প্রলয়। মনে মনে একটা কথা বলতে খুবই ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু বড়োদের মাঝে সেই কথাটা বলা শোভা পাবে না। কথাটা এমন ছিল যে‚
“আমার স্পিড সম্পর্কে তোর কোনো ধারণা নেই! চাইলেই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তোকে চাচ্চু বানিয়ে দিতে পারি।”
মনের কথাটা মনেই দাবিয়ে রাখল। বলতে তো তার অনেক কিছুই ইচ্ছে হচ্ছে৷ কিন্তু যতই হোক তারও তো লাজলজ্জার বালাই আছে৷
চলবে?…..