রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৪| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
260

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

মোড়ল বাড়িতে বৈঠকখানায় মেহরাব শিকদার ছাড়াও আর তিনজন ডাক্তার বসে রয়েছেন। শাহাদাৎ মোড়লও এখানেই বসে রয়েছেন৷ খুব রাতে মোড়ল বাড়িতে পৌঁছেছেন মেহরাব শিকদার সহ বাকিরা৷ গাড়ি করে এসেছেন বিধায় জেমে আটকে পড়েছিলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে মোর্শেদ শিকদারের নাম্বার থেকে কল আসছে৷ ‘এক্সকিউজ মি!’ বলেই সকলের মাঝখান থেকে উঠে গেলেন মেহরাব শিকদার। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করলেন। অপাশ থেকে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚

“তোকে একটা কারণে কল করলাম!”

“কী হয়েছে ভাই?”

“ঢাকা কবে ফিরবি?”

“এক সপ্তাহ খানেক পর৷ কিছু কী হয়েছে ভাই?”

“প্রলয়ের বিয়ে উপলক্ষে একটা রিসেপশনের আয়োজন করতে চাইছি। তোকে তো জানিয়েছিলাম। তুইও বাড়িতে নেই— একাহাতে কী করে করব?”

“আমি তো এক সপ্তাহের মাঝেই চলে আসছি৷ ভাবি আর ফিরোজাকে বল যা যা কেনাকাটা করার আছে করে নিতে।”

“একটু নিশ্চিন্ত হলাম আমি।

ফোন কে’টে দিয়ে পুনরায় বৈঠকখানায় যেতে নিলে মুখোমুখি হলেন মহুয়ার সঙ্গে। এক দেখাতেই চিনে ফেললেন দুজন দুজনকে৷ মেহরাব শিকদার সৌজন্যতার খাতিরে হাসলেন খানিকটা। কারণ মহুয়ার সঙ্গে নাজমাও দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ চিনেও না চেনার ভান করে রইলেন মহুয়া। নাজমাকে জিজ্ঞেস করলেন‚ “উনি কে ভাবি?”

“ইনি প্রলয়ের চাচা মেহরাব শিকদার। অর্পণের বাবা।”

নিটোল পা দুটো টলে উঠল৷ পৃথিবীটা সত্যিই গোল৷ পরিবারের দোহাই দিয়ে মেহরাব যেই সন্তানকে অস্বীকার করেছিল সেই সন্তানই শিকদার বংশের বউ। ভাগ্য কী রঙ্গলীলায় না মেতেছে! ঠোঁট চেপে কান্না নিবারণ করলেন মহুয়া৷ উনিশ বছর আগেই অতীত এখন উনার চোখের সামনে৷ মহুয়ার সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেন মেহরাব শিকদার। নাজমা চলে যেতেই অস্বস্তি কা’টিয়ে বললেন‚

“ভূলেই গিয়েছ বোধহয়?”

তাচ্ছিল্য করে হাসলেন মহুয়া। অন্যদিকে ফিরে বললেন‚

“তোমাকে ভুলি কী করে? যেখানে সেই একই চোখ আল্লাহ আমার ঘরেই পাঠিয়েছেন৷ যে চোখের প্রেমে অন্ধ হয়ে আমি নিজের জীবনটাকেই শেষ করে দিয়েছি। বহুবছরের লালন করা স্বপ্নকে মাটিচাপা দিয়েছি। যতবার তোমাকে ভুলতে চেয়েছি ততবারই মেয়েটার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তোমাকে ঘৃণা করতে পারি তাই বলে আমার অংশকে কী করে দূরে ঠেলে দিই? তোমাকে মনে রেখেছি শুধুমাত্র ঘৃণা করার জন্য।”

আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেন মা মেহরাব শিকদারের দিকে৷ রান্নাঘরে ছুটে গেলেন তিনি। অতীত তাহলে আজও পিছু ছাড়েনি। আজও মনে পড়ে উনিশ বছর আগেই অভিশপ্ত জীবনের কথা।

“পড়াশোনা করার উদ্দেশে ঢাকা শহরের বুকে পা রেখেছিলেন মহুয়া৷ বাবা ছিল দিনমজুর। যখন যা কাজ পেতেন সেটাই করতেন৷ বহু কষ্টে মেয়ের পড়াশোনার খরচ পাঠাতেন গাফফার মিয়া৷ গ্রামে উনাকে সবাই গফুর নামেই চিনত৷ পড়াশোনার বদলে মহুয়ার নাচের প্রতি ঝোঁক ছিল ভীষণ। বাবার পাঠানো টাকা দিয়ে হল ভাড়া আর পড়াশোনার খরচ মোটেও হত না। মাঝে মাঝে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে হত আবার মাঝে মাঝে সারাদিন না খেয়েই কাটিয়ে দিতে হত৷ প্রিয় বান্ধবীর কথায় দুটো টিউশনিও নিয়েছিল। হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় মেহরাব শিকদারের সঙ্গে। কলেজ রোডের সামনেই একটা ছোটো ছেলের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল৷ আর সেখানেই তাদের প্রথম দেখা হয়। প্রথম দেখায় লোকটাকে ভীষণই ভালো মানুষ মনে হয়৷ একজন অচেনা মানুষের জন্য যে এতটা করে সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই ভালো মানুষই হবে৷ মেহরাব শিকদারও সেদিন একদৃষ্টে দেখছিলেন মহুয়াকে৷ সময় বসে থাকে না। ঠিকই নিজ গতিতে এগিয়ে যায়৷ এরপরের থেকে প্রত্যেকটা দিনই মেহরাব শিকদারকে কলেজ রোডের সামনে দেখা যেত৷ মাঝে মাঝে বাইক নিয়ে মহুয়া পিছুও নিতেন। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগত মহুয়ার। আবেগের বয়সে এসব ভালো লাগারই কথা৷ মনে মনে তিনিও যে মেহরাবকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন৷ নিজের অজান্তেই মন দিয়ে বসেছিলেন মেহরাব শিকদারকে। রীতিমতো প্রেমতরঙ্গে ভাসছিলেন মহুয়া৷ কিন্তু তিনি এটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন যে‚ আবেগ দিয়ে জীবন চলে না৷ সকলকে লুকিয়ে দুজনে বিয়েটাও করে নিয়েছিলেন। যে বিয়েতে না ছিল সাক্ষী আর না ছিল কাবিননামা। সময় খুব ভালোই যাচ্ছিল৷ যেই স্বপ্ন নিয়ে মহুয়া শহরে এসেছিলেন সেই স্বপ্ন অর্থাৎ পড়াশোনা‚ নাচের সঙ্গে বাড়ল দূরত্ব। হঠাৎ জানতে পারলেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। ছোটো একটা প্রাণ নিজের মাঝে ধারণ করছেন। খুশিতে পাগলপ্রায় অবস্থা৷ খুশির সংবাদটা মেহরাব শিকদারকে জানাতেই‚ তিনি বললেন বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলতে৷ তার নাকি পরিবার আছে স্ত্রী বাচ্চা আছে৷ জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত যখন এলো তখনই প্রিয় মানুষটার কুৎসিত সত্তার সঙ্গে পরিচিত হলেন তিনি। সেদিন খুব কান্না করেছিলেন তিনি৷ ঠকে যাওয়া জন্য নয়— নিজের করা ভূলের জন্য। মানুষ চিনতে তিনি মস্ত বড়ো ভুল করে বসেছিলেন তিনি৷ তবে থেমে থাকেননি। একাই নিজের আর অনাগত সন্তানের দায়িত্ব নেবেন বলে অনিন্দ্যনগর ফিরে এলেন। গ্রামের মানুষের থেকে কম কটু কথা শুনতে হয়নি উনাকে। তবুও নীরবে সহ সহ্য করে গেছেন। ভূল থেকে শিক্ষা নিয়ে মেয়েকে একা হাতে মানুষ করে গেছেন। একা হাতে সবটা সামলানো খুব একটা সহজ ছিল না উনার জন্য”

বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে অর্পণ। বালিশের পাশে থাকা ফোনটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে। সাধের ঘুমটা ভেঙে যাওয়া বিরক্ত সে৷ চোখ বন্ধ রেখে ফোন রিসিভ করে জিজ্ঞেস করল‚

“হ্যালো কে বলছেন?”

“ফোন স্ক্রিনে একটিবার তাকান মহাশয়।”

ঘুম ঘুম আধবোজা চোখে একবার দেখে নিল অর্পণ। ইরাবতী নামটা জ্বলজ্বল করছে৷ কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝে নেওয়া উচিত ছিল৷ ঘুমের ঘোরে এতটা খেয়াল হয়নি। ফোন কানে ধরে অর্পণ পুনরায় জিজ্ঞেস করল‚

“সাত সকালে এভাবে কল করে বিরক্ত করার মানে কী?”

“সাত সকাল তাইনা? ঘড়ি দেখেছেন আপনি? সাড়ে আটটা বাজছে।”

“তো?”

“তো মানে? উঠুন। ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হন।”

“কোথায় যাব? আজ হসপিটালে যাওয়ার তাড়া নেই।”

“আপনাকে হসপিটালে যাওয়ার জন্য আমি কল দিইনি।”

“তাহলে?”

“আপনি এক্ষুনি আমার সঙ্গে মিট করছেন।”

“বললেই হলো?”

“অবশ্যই। আমি আপনার জন্য গুনে গুনে ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করব। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ভার্সিটির সামনে আসবেন।

এইটুকু বলেই থামল ইরা৷ নিশ্বাস নিয়ে আবারও বলল‚ “আর হ্যাঁ!”

বিরক্তি নিয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “আবার কী হলো?”

“নাস্তা করে তবেই বের হবেন। আমার কাছে বাড়তি টাকা নেই যে‚ আপনাকে নাস্তা করাব৷”

“খেয়ে আসব না৷ রেস্টুরেন্টে বসে খাব। বিল তুমি দেবে।”

“আমার বয়েই গেছে।”

“এক কাজ কর— তুমি আমাদের বাড়িতেই চলে এসো। আমার এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।”

“কেউ একজন বলেছিল— বুদ্ধি থাকলে বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া যায়।”

“এখানে শ্বশুর বাড়ির কথা আসছে কেন?”

“বাহ্ রে! বিয়ের পর আমি তো আপনাদের বাড়িতেই উঠছি। এইযে আপনি কত বুদ্ধিমান। বিয়ের আগেই নিজের শ্বশুর বাড়ি থেকে ঘুরে গেলেন। এখন আবার আমাকে আপনাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ডাকছেন।”

“ফালতু লজিক নিজের কাছেই রাখ। এলে আসবে না এলে নেই৷ এত কথা শুনতে বাধ্য নই আমি।”

“আপনি আসবেন না তো?”

“না!”

“সত্যি তো?”

“কানে কী কম শোন? বললাম তো আসব না৷”

“তাহলে আমি পাড়ায় পাড়ায় রটিয়ে দেব‚ আপনার বদনাম।”

ইরা কল কে’টে দিয়েছে৷ অর্পণ গাল এলিয়ে হেসে উঠল মেয়েটার বাচ্চামোতে৷ অল্পতেই রেগে যায় ইরা। এইজন্যই মেয়েটাকে কারণে অ-কারণেই রাগায়৷ অর্পণ ঝটপট তৈরি হয়ে নিল। হসপিটালে আজ তার ডিউটি নেই। আরশের নাম্বারে কল লাগাল অর্পণ। কল রিসিভ হতেই বলল‚

“বাবা পৌঁছেছে? বাবার নাম্বার বন্ধ কেন?”

অপরপ্রান্তে থাকা আরশের কথা কিছুই শোনা গেল না৷ অর্পণ আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কে’টে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘর ফিরোজা নাস্তা বানাচ্ছেন। অর্পণ তাড়া দিতেই প্লেটে একটা ডিমের অমলেট আর দুটো তেল কম দিয়ে পরোটা বানিয়ে পাঠালেন সাবিনাকে দিয়ে।

নিরুপদ্রব বাহুডোরে আবদ্ধ ভূমি নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে৷ লোকটা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে নিজের সঙ্গে। বেলা হচ্ছে লোকটা কেন বুঝতে চাইছেন না? একপর্যায়ে প্রলয়ের বুকের মধ্যিখানে চুপটি করে রইল ভূমি। সুযোগ পেয়ে প্রলয় তাকে আরও শক্ত করে জাপ্টে ধরল৷ ভূমির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল‚

“এত সকালে উঠতে হবে না৷ তুমি ঘুমোও৷ পেটে ব্যথা করছে এখনো?”

দু পাশে মাথা ঝাকিয়ে বলল‚ “উঁহু!”

কপালে উষ্ণ ছোঁয়া অনুভূত হতেই চোখ মেলে তাকাল ভূমি। প্রলয়কে এতটা সমীপে দেখে লজ্জাপীড়িত ভূমি। তার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে বিছানা ছাড়ল প্রলয়৷ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বারান্দার দিকে গেল৷ গোলাপ গাছটায় হলুদ রঙা ফুল ফুটেছে। কাল সকালেও এটা শুধুমাত্র একটা ছোটো কলি ছিল৷

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here