রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৩| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
270

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৩৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

নবোদিত প্রত্যুষে ঘুম ভাঙল ভূমির। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রলয় অন্যপাশ হয়ে শুয়েছে৷ আলগোছে উঠে বসল ভূমি। বালিশের পড়ে থাকা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিল। ঘড়িতে তখন সাড়ে ছয়টা বাজে৷ এই সময় মনে হয় না কেউ উঠেছে বলে৷ পেটে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে ভূমির। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে বাতায়ন খুলে দিল। সাঁই বেগে প্রাতঃকালের শীতল হাওয়া আছড়ে পড়ল পুরো ঘরময়৷ রোদ ওঠেনি এখনো। ওয়ারড্রব থেকে থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ভূমি। একেবারে গোসল করেই বের হবে।

ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। রুটি বেলতে ব্যস্ত ভূমি৷ আজকের সকালের নাস্তাটা সেই-ই বানাচ্ছে৷ সাবিনা চা বানাচ্ছে৷ আজ খুবই সাধারণ নাস্তা তৈরি হচ্ছে৷ ফিরোজা এসেছিলেন রান্নাঘরে কিন্তু ভূমি উনাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে৷

“আপু তুমি একটু এদিকটা সামলাও আমি একটু ঘরে যাচ্ছি।”

“আইচ্ছা ভাবি।”

ঘরে ফিরে এসে কোথাও প্রলয়কে পেল না ভুমি৷ বিছানাও গুছিয়ে রাখা৷ ভূমি অবাক হলো৷ তার চেয়েও বেশি লজ্জা বোধ করল বিছানায় অন্য চাদর বিছানো দেখে৷ নিশ্চয়ই এমপি মশাই গুছিয়েছেন? অবাকের থেকেও চরম অবাক হলো ভূমি। প্রলয়কে ঘরে আসতে দেখে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚

“আজ এত তাড়াতাড়ি উঠে আপনি কী কোথাও গিয়েছিলেন?”

“আমাকে মিস করছিলে বুঝি?”

“না মানে এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।”

“একটু বাহিরে গিয়েছিলাম৷ আমার জন্য এক মগ কফি নিয়ে এসো।”

“আচ্ছা!”

কফির জন্য দুধ বসিয়ে দিয়ে এসেছিল ভুমি এতক্ষণে হয়তো বলক উঠেও গিয়েছে। সাবিনাকে দায়িত্বে রেখে এসেছিল সে৷ কফি বানাতে খুব বেশি সময় লাগেনি৷ কফি মগ নিয়ে ভূমি আবারও ঘরে ফিরে এলো। কিছুটা ক্লান্ত লাগছে তার। প্রলয় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ভূমি সেখানেই গেল। কফি মগ এগিয়ে দিল প্রলয়ের হাতে। কফি নিয়ে ক্ষীণ হেসে প্রলয় বলল‚

“তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসটা ওয়ারড্রবের উপরের ড্রয়ারে রাখা আছে৷ তুমি বিশ্রাম নাও৷ নিচে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি তোমার খাবার ঘরে নিয়ে আসছি।”

বড়ো বড়ো পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রলয়। ড্যাবড্যাব করে তার যাওয়ার পানে চেয়ে রইল ভূমি। লজ্জায় এতক্ষণ চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না সে৷ লোকটা বুজে ফেলল৷ ইসস! অনাকাঙ্ক্ষিত লজ্জা জেঁকে বসেছে। মেয়েলি সমস্যার কথা কী করেই বা এমপি মশাইকে জানাবে সে? এগুলো ঢোল পিটিয়ে বলার মতো জিনিস নাকি? এরপর আর ঘর থেকে বের হয়নি ভূমি। প্রলয় তাকে বের হতে দেয়নি। বরঞ্চ ভূমির নাস্তাটা পর্যন্ত ঘরে এনে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছে৷

সকাল থেকে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়েছে পুষ্পিতা। পূর্ণতা তৈরি হয়ে বসে রয়েছে৷ আজ তাদের স্কুলে ফেয়ার ওয়েল৷ সকাল এগারোটায় স্কুলে থাকতে হবে অথচ পুষ্পিতা এখনো তার চুল বাঁধেনি৷ মেয়েটা সব কাজেই অলস৷ বিরক্তি নিয়ে পূর্ণতা জিজ্ঞেস করল‚

“অ্যাই পুষ্প তোর কী হলো? নাকি আমি তোকে ফেলেই চলে যাব?”

“আমার বারবি ব্যানটা দে তো পূর্ণ৷”

তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বিছানার উপর থেকে হেয়ার ব্যান নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে পুষ্পিতা৷ দুটোকে তাড়া দিতে মাধুরী ছুটে এলেন। প্রলয় সেই কখন থেকে বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছে পূর্ণতা পুষ্পিতার জন্য। এই দুবোনের জন্য তারও আজ দেরি হচ্ছে। মাধুরী এসে দেখলেন পুষ্পিতা এখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে। তিনি বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন‚

“এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি আর পারি না৷ অ্যাই পুষ্প তুই তাড়াতাড়ি চুল বাঁধবি? তোদের বড়ো ভাইয়া কিন্তু অপেক্ষা করছে৷ দেরি হলে তোদের দুটোকে ফেলেই চলে যাবে।”

পূর্ণতা বলল‚ “আমি অনেক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছি মা। তোমার ছোটো মেয়েই লেট লতিফা।”

কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল‚ “আমি রেডি। চল পূর্ণ।”

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তিনজনেই। পূর্ণতার বিনুনি ঠিক করে দিলেন মাধুরী। পুষ্পিতার খানিকটা এলোমেলো। মেয়েকে থামিয়ে হাত দিয়ে ঠিক করলেন তিনি। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল পূর্ণতা পুষ্পিতা। পেছনে মাধুরী আসছেন। বৈঠকখানার কাছে এসে দুবোন একসঙ্গে বলে উঠল‚

“বড়ো ভাইয়া আমরা রেডি। যাওয়া যাক?”

“তোমাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমার কাজে যেতে হবে।”

প্রলয় যখন রেগে থাকে তখনই পূর্ণতা পুষ্পিতাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে৷ দুবোন বুঝতে পারল তাদের ভাই রেগে আছে শুধুমাত্র তাদেরই জন্য। চুপচাপ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল দুটোতে। প্রলয়ও তার মায়ের কাছে বলে বেরিয়ে পড়ল। দেরি হচ্ছে তার।

বিকেলে…

মোবাইল সার্ভিসিং এর দোকানের সামনে অর্পণ তার বাইক থামিয়েছে। হসপিটালে পৌঁছাতেই হাত থেকে পড়ে উপরের স্ক্রিনে ভেঙে গিয়েছিল৷ সকাল থেকেই ফোনটা বন্ধ৷ মেকানিক অপেক্ষা করতে বলেছে একঘণ্টা সময় লাগতে পারে। ভেতরেই অপেক্ষা করছিল অর্পণ। এতক্ষণে হয়তো ঠিকও হয়ে গেছে৷ বারবার হাত ঘড়ি দেখছে সে৷

মেকানিক ছেলেটা এসে অর্পণের ফোনটা দিয়ে দিল৷ বিল প্যে করে অর্পণ সার্ভিসিং দোকান থেকে বের হয়ে গেল। ভেতরে এসি চলছিল বিধায় গরম অনুভূত হচ্ছিল না৷ এখন কেমন ভ্যাপসা গরম লাগছে! বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে হেলমেট পড়তে নিল অর্পণ। পেছন থেকে চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো যেন।

“ফোন কোথায় আপনার? সেই কখন থেকে আমি আপনাকে কল করছি।”

এই সময় ইরাকে দেখে সহসাই অবাক হলো অর্পণ। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি কোত্থেকে টপকালে?”

“দেখতে পাচ্ছেন তো ভারী লাগেজটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি৷ সাহায্য করুন আমাকে।”

“সাহায্য করতে আমার বয়েই গেল।”

“তাহলে সামনে থেকে সরুন৷ অ্যাই রিকশা। দাঁড়ান মামা।”

লাগেজ তুলতে নিলেই অর্পণ তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “তোমাকে আমি যেতে বলেছি?”

“যখন বললাম লাগেজটা ধরতে তখন তো ধরলেন না৷ এখন দয়া দেখাতে হবে না।”

“কোথায় উঠেছ?”

“আমি আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি তাই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতেও আমি বাধ্য নই।”

অর্পণ আর কিছুই বলল না। ইরার কাছ থেকে লাগেজটা নিয়ে রিকশায় উঠিয়ে দিল৷ ইশারায় ইরাকেও উঠতে বলল। মুখ ঝামটা দিয়ে ইরাও রিকশায় উঠে বসল৷ অর্পণ রিকশা ওয়ালাকে বলল‚

“উনি যেখানে যেতে চাইছেন সেখানেই নিয়ে যান।”

রিকশা চলতে শুরু করেছে৷ অর্পণ বাইকে চড়ে বসল। ধীর গতিতে বাইক চলছে রিকশার পিছু পিছু৷ একপ্রকার ফলো করছে ইরাকে। জানতে চাইছে ইরা কোথায় উঠেছে৷

সায়াহ্নে…

কালো রঙা গাড়িটা মালঞ্চ নীড়ে প্রবেশ করেছে। ড্রাইভারের কাছে চাবি দিয়েই কলিং বেল চাপল প্রলয়। ড্রাইভার গাড়ি গ্যারাজে পার্ক করছে। সাবিনা এসে সদর দরজা খুলে দিয়েছে৷ বৈঠকখানায় এখন কেউ নেই। প্রলয় সোজা রান্নাঘরে ঢুকল। তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে সাবিনা ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল‚

“আপনের কী কিছু লাগব ভাইজান? আমারে কন আমি কইরা দিতাছি।”

“পানি গরম করতে হবে। হট ওয়াটার ব্যাগে ভরে রাখবি।”

“আইচ্ছা ভাইজান৷

বৈঠকখানায় অপেক্ষা করল প্রলয়। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ভরে নিয়ে এসেছে সাবিনা। তাকে ‘ধন্যবাদ’ বলে প্রলয় তার ঘরে চলে গেল। চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানার মাঝখানে মুচড়ে শুয়ে রয়েছে। সকালের চিনচিনে ব্যথা এখন প্রবল আকার ধারণ করেছে। পেটে হাত চেপে শুয়ে আছে মেয়েটা। চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে রয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা নিবারণ করার চেষ্টা করছে ভূমি। প্রলয় গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল‚

“আর ইউ ওকে?”

ক্লান্ত আঁখিপল্লব ঝাপ্টাল ভূমি। অর্থাৎ সে ঠিক আছে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে ঠিক আছে বলে৷ রজঃস্বলা অবস্থায় পেটে ভীষণ ব্যথা হয়। সহ্য করা যায় না। প্রতিবার আম্মা তার জন্য গরম পানি করে বোতলে ভরে দেন। সেই বোতল কাপড়ে মুড়িয়ে পেটের উপর রাখতেই কিছুটা আরাম হয়৷ আজ আম্মাও কাছে নেই। মনে মনে আল্লাহর কাছে সহ্য করার শক্তি চাইছে ভূমি৷ বিছানার অপরপাশে বসে নিজের বক্ষঃস্থলে নিস্তেজ ভূমির মাথা আলগোছে রাখল৷ হাতে থাকা হট ওয়াটার ব্যাগ ভূমির পেটে চেপে ধরল৷ মুখ তুলে একটিবার ক্লান্ত নেত্রে প্রলয়কে দেখল৷ পরপরই আবার চোখ বন্ধ করল ভূমি। এভাবেই শুয়ে রইল প্রলয়ের বুকে মাথা রেখে। ভূমির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই জিজ্ঞেস করল‚

“একটু আরাম লাগছে? তোমার সমস্যা হচ্ছে— আমাকে তো কল করে জানাবে৷ পিরিয়ড ব্যাপারটা একদমই নরমাল। বিষয়টি নিয়ে এত হেজিটেড কেন করছ?”

“আমার জন্য আপনাকে…”

ভূমির ঠোঁটে তর্জনী ছোঁয়াল প্রলয়৷ মুখে বলল‚ “হুস! আমি শুধু তোমার শয্যাসঙ্গী নই— আমি তোমার জীবনসঙ্গী!”

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here