অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-১৪

0
280

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

পুত্রের কান্ডকীর্তি শুনে সানওয়ার সাহেব বিমূঢ়
হয়ে বসে রইলেন। বিষয়টা খুব জটিল। তিনি কীভাবে
তা খন্ডন করবেন ভেবে পেলেন না৷ তাখলিফ তার ছেলে, ঝুমুরও তার মেয়ে। তিনি চাইলে এক্ষুনি
দুটোকে মিলমিশ করিয়ে দিতে পারেন৷ কিন্তু তার ভাই, ভাইবৌ? অতীতের খারাপ অভিজ্ঞতার জন্য শামসুল হক তাখলিফকে তেমন পছন্দ না করলেও অপছন্দ
করেন না। কিন্তু পাখি বেগম! সে-তো একদমই না।
তাখলিফের ইন্সিডেন্টের পর তিনি দেখেছেন পাখি বেগম মনের মধ্যে কি ভীষণ বিদ্বেষ পুষে রেখেছেন ওর জন্য। সানওয়ার হক কীভাবে চাইবেন তাদের আদরের ছোট মেয়েকে? তার বিবেকে নাড়া দিচ্ছে অথচ ঝুমুর তার
পুত্রের লিগ্যাল ওয়াইফ। অন্য একটা ছেলের সাথে ঝুমুরের বিয়ে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না সেক্ষেত্রে৷ তিনি কিছুদিন সময় নিলেন। ঠিক করলেন আগে কথাগুলো তার ভাইকে জানাবেন। সে যদি মেনে নেয় তাহলে পাখি বেগমকে তিনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলবেন৷ সেইসাথে সানওয়ার হকের এটাও ভয় হলো, এসবের চক্করে এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা সত্যিটা না আবার বেরিয়ে আসে। তাহলে তিনি
কি করবেন? তমালিকাকে কি জবাব দিবেন? সানওয়ার হক ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন৷ তাখলিফ বাবার মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলো। জিজ্ঞেস করতেই সানওয়ার সাহেব মৃদু হাসলেন৷ কিছু হয়নি বললেন৷ এরপর ওঠে চলে গেলেন। অথচ তাখলিফ তার চোখে স্পষ্ট একটা ভয় দেখতে পেলো। তবে কি সেটা তা ধারণা করতে পারলো না। ওর কাছে সব কেমন এলোমেলো লাগলো। ঝুমুরের ম্যাসেজ পেয়ে ওর মনটা ঘুরলো, “আপনি কি খেয়েছেন?”

তাখলিফ ভাবনাচিন্তা করে দেখলো এই মেয়ের সাথে ওর বেশিরভাগ দেখাসাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয় খাবারকে ঘিরেই। কি অদ্ভুত! তাদের দু’জনের মাঝে এছাড়া আর নতুন কোনো টপিক আসছে না। ও আনমনে হাসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একমগ কফি করে ছাদে চলে গেলো। রাতের উজ্জ্বল আকাশে তারাদের পানে তাকিয়ে খুব করে আশা করছিলো একটিবার ঝুমুর আসুক! ও খুব করে অপেক্ষা করতে লাগলো, বারবার ছাদের দরজার দিকে তাকাতে লাগলো কিন্তু মেয়েটা এলো না। তাখলিফের আচমকা মনে হলো ঝুমুরকে সে ভীষণ মিস করছে!

____________

অনেক চেষ্টার পর বাইশ হাজার টাকা বেতনের একটা চাকুরি জোগাড় করতে পারলো ইয়াসিফ। টাকাটা খুব বেশি না হলেও ইয়াসিফের জন্য চলে। নিজের বউয়ের দায়িত্ব তো আর বাবার কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারে না। সে তো আর কাপুরুষ নয়। বাড়িতে এসে খবরটা আগে বাবা-মাকে দিলো সে। পাখি বেগম খুব একটা আনন্দিত হলেন না। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে বাবার ব্যবসায় হাত লাগাক। একটাই ছেলে, তাকে কেন অন্যের গোলাম হয়ে চাকুরী করতে হবে? তিনি বেজার মুখ করে রান্নাঘরে চলে গেলেম। এদিকে খবরটা পেয়ে তুসি ভীষণ খুশি হলো। ইয়াসিফ ওকে জোর করে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ওর কোলে মাথা রাখতেই তুসি বলল, “রান্না বসিয়েছি চুলোয়।”

ইয়াসিফ চোখমুখ কুঁচকে বলল, “একটু সেবা তো করতে পারিস, সারাদিন এত রান্নার পেছনে ছুটতে
হবে না। নিজের বউটাকে একটু কাছেও পাইনা।”

“সর তো, যত বাজে কথা।”

“না। কোথাও যেতে পারবি না।”

ইয়াসিফের দৃঢ় গলার স্বর। তুসি হাল ছেড়ে ওর চুলে হাত ডুবিয়ে বিলি কেটে দিতে লাগলো৷ ইয়াসিফ ইতোমধ্যেই চোখবন্ধ করে ফেলেছে। চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। তুসি একদৃষ্টে ওর মুখয়ানে তাকিয়ে থেকে কপালে চুমু খেলো। ইয়াসিফ ফট করে তাকাতেই লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “তুই ঘুমাসনি?”

ইয়াসিফ ওর নাক টেনে ধরলো,
“গাধী কোথাকার, মাথায় একটুও ঘিলু নেই!”

তুসি ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
“আবার বাজে বকছিস?”

“লুকোচুরি করলে বাজে বকা শুনবিই।”

“পাগল।”

“হ্যাঁ, তোর জামাই।”

তুসি হেসে ফেললো। ইয়াসিফ ওর কোলে মুখ ডুবিয়ে বলল, “তোর বাবা এত ত্যাড়া কেন? বিয়ে করে বাসর সেরে ফেলেছি সে এখনো আমার বউকে নিয়ে যেতে চায়। আমায় ফোন করে হুমকি দেয়।”

তুসি ভয়ার্ত গলায় বলল, “কি হুমকি দিয়েছে?”

“ঐ এক কথা, আমার মেয়েকে ছাড়ো। নয়তো মামলা ঠুকিয়ে জেলের ভাত খাওয়াবো। আর আমার মেয়েকে নিয়ে আসবো তোমার মতো বেকার ছেলের সংসার থেকে।”

তুসি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইয়াসিফ বলল,
“আমিও বলে দিয়েছি, পা ভেঙে ভেঙে আপনার খুকির জন্য আমি চাকুরি খুঁজেছি। এত সহজ নাকি? বাইশ হাজার টাকা স্যালারীর চাকরি পেয়েছি। জেলের ভাত খেতে আপত্তি নেই, আপনার মেয়েও খাবে। শুনে কি রাগ, হুহ…”

তুসি এবার আগ্রহী গলায় জানতে চাইলো, “বাবা তোর চাকুরির খবর শুনে কি বললো?”

ইয়াসিফ নাকমুখ কুঁচকে বলল,
“বললো এটা কোনো চাকরি? জুতার ফ্যাক্টরিতে জুতা সেলাই করলেও নাকি এরথেকে বেশি ইনকাম করা যায়। আমিও বলে দিয়েছি মেয়ে নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যান। তবে আমার অমূল্য সম্পদ নিয়ে যাওয়ার আগে আমি যতটুকু পরিশ্রম করে টাকা রোজগারের ব্যবস্থা করেছি তার মূল্য চুকিয়ে দিতে হবে।”

তুসি মুখ কালো করে ফেললো, “তুই ইনডিরেক্টলি যৌতুক চাইছিস?”

ইয়াসিফ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“তো চাবো না? তোর বাপে আমায় হুমকি দেয়, আমার বউ নিয়ে যেতে চায়, কতবড় সাহস! আমিও বলে দিয়েছি ঐ কালো মেয়েকে আমার থেকে নিয়ে গেলে আমার কিছুই হবে না, বরংচ সে ডিভোর্সি ট্যাগ পাবে। এমনিতেই কালো, তার ওপর ডিভোর্সি। কে ঝোলাবে গলায়? উল্টোদিকে আমার তো কিছুই হবে না। আরেকটা বিয়ে করে তোর বাবার বিশাল বাড়িটার সংসার পাতাবো সুন্দর বউ নিয়ে।”

তুসি ছলছল চোখে তাকালো। অভিমানী গলায় বলল,
“তুই এমনটা ভাবতে পারলি? আমি তাহলে ভুল বিশ্বাস করেছিলাম তোকে?”

ইয়াসিফ বিরক্ত চোখে তাকালো। শুরু হলো ঝর্ণার বয়ে চলা, থামাথামি নেই। ও ওঠে বসে তুসিকে বুকে জড়িয়ে মজা পেয়েছে এমন কন্ঠস্বর করে বলল, “কাঁদবি না একদম। তোর বাবাকে ঢপ দিলাম। বলেছি তোকে ছাড়বো, বিনিময়ে তার সব সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিতে হবে। তোর বাপ এত বোকা নাকি? সে আমায় লোভী, বদমাশ ট্যাগ দিয়ে ফোন কেটে দিলো।”

বলে ইয়াসিফ হাসতে লাগলো। তুসি ওরদিকে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি তো? নাকি… ”

ইয়াসিফ চোখ পাকিয়ে তাকালো। হাত ঝাড়া মেরে তুসিকে দূরে সরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তোর কি মনে হয় মিথ্যে? তাহলে যা তোকে তোর পথে ছেড়ে দিলাম। যা খুশি কর…”

তুসি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো বেশ রেগে গেছে। ওর ভালোবাসা যে খাদহীন তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সেই চোখে। ও ইয়াসিফের গা ঘেঁষে মিনমিন করে বলল, “সরি।”

“লাগবে না।”

“মন থেকে বলছি তো…”

“বলতে হবে না।”

তুসি অধৈর্য হয়ে ওর কোলের ওপর বসে পড়লো। ইয়াসিফ হকচকিয়ে তাকাতেই ওর দু’গালে ফটাফট
চুমু বসিয়ে এরপর ধরা গলায় মৃদু হেসে বলল,
“আমি জানি তুই আমাকে কখনো ঠকাবি না৷ কিন্তু আমি যে তোকে হারিয়ে ফেলার খুব ভয় পাই। তুই চাইলেই পারতি আমার চেয়ে আরো বেটার কাউকে লাইফ পার্টনার করতে। মাঝেমাঝে আমার গিলটি
ফিল হয়, তুই ঠকে গেলি না তো! আমার খুব কষ্ট হয় ভাবলে…”

ইয়াসিফ চোখ পাকিয়ে তাকালো, “আরেকবার এসব টপিক তুললে মারবো এক চড়৷ এসব হাবিজাবি বাদ দিয়ে পতিসেবা কর। যা খাবার আন।”

তুসি হেসে গাল মুছে চলে গেলো খাবার আনতে। ইয়াসিফের সামনে তা রাখতেই ও ফোন স্ক্রল করতে করতে বলল, “খাইয়ে দে।”

তুসি চোখ বড় বড় করে তাকালো, “তোর হাত আছে, তুই খা।”

ইয়াসিফ রেগে গেলো,
“তোরও তো হাত আছে, সেগুলো কিসের জন্য? পতিকে হাতে তুলে খাওয়াবি বলেই তো! না পারলে ভাগ আর এসব নিয়ে যা।”

“সেকি? মহাশয়ের আবার রাগ কেন?”

ইয়াসিফ কঠিন গলায় বলল,
“যা তো সামনে থেকে…”

ধমক খেয়ে তুসি চলে গেলো। মিনিট পেরুতেই ফিরে এলো। হাত মুছে প্লেটে খাবার বেড়ে লোকমা ইয়াসিফের মুখের সামনে ধরলো। ও রেগে তাকাতেই মিষ্টি হেসে বলল, “নে, পতিসেবা করছি।”

ইয়াসিফ ওর হাসি দেখে নিজেও ভেতরে ভেতরে
হেসে ফেললো। তবে তা বুঝতে না দিয়ে ‘হা’ করে লোকমাটুকু মুখে পুরে নিলো। তুসি মুগ্ধ চোখে ওকে দেখতে লাগলো। জীবনে ওর ভালো কাজটা কি
জানে না, তবে কোন পুণ্যের বিনিময়ে এই ছেলেটাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে ভাবতেই শিহরিত হলো দেহ, মন। ইশ, ভালোবাসার অনুভূতিগুলো এত
মধুর কেন?

______________

আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে। গাছপালা
জোরালো হাওয়ায় দুলছে। চারদিকে কেমন মন খারাপের বার্তা। এই অসময়ে প্রকৃতি এমন রুপ ধারণ করে না সচরাচর। তাখলিফ অফিস থেকে ফিরছিলো। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই বৃষ্টি নেমে এলো। ও আধভেজা হয়ে থেকে বাড়ি ফিরলো যথাসময়ের একটু দেরিতে। দোতলার সিঁড়িতে পা রাখতেই টের পেলো ফ্ল্যাটের দরজাটা হালকা চাপিয়ে দেওয়া। সেখান থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে একজোড়া চোখ। কৌতূহলী সেই দৃষ্টিজোড়া চিনতে অসুবিধা হয় না তাখলিফের। দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা চললো।
খপ করে নব টেনে ধরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিস কেন? সামনে আসার
সাহস নেই? তোর না বর হই?”

ঝুমুর ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠলো। চারদিন পর দেখলো সে তাখলিফকে। ওর গলা কাঁপছে। কন্ঠ দিয়ে শব্দ বেরুতে চাইছে না। ও দরজায় পিঠ লাগিয়ে বুকভরে শ্বাস নিয়ে বলল, “দেখছিলাম না।”

তাখলিফ স্মিত হেসে বলল,
“ওহ তাই? তাহলে দরজা চাপিয়ে রেখেছিস কেন? খোল…”

“না না আসবেন না। বাড়িতে দাদী ছাড়া আর কেউ নেই।”

ঝুমুরের কথা শুনে তাখলিফের কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে গেলো। বলল, “কোথায় গেছে?”

“ফুয়াদের জন্মদিনে গেছে মা সবাইকে নিয়ে। বাবা আর ছোট চাচ্চু তো মাল আনতে গেছে, দাদাভাই অফিসে।”

তাখলিফ বিরক্ত ভঙ্গিতে ধমক দিলো,
“তাতে আমার কি? সর, তোকে দেখবো…”

“না, কিছুতেই না। ভেজা কাপড় নিয়ে ঢুকতে
পারবেন না।”

“একশো বার ঢুকবো। সর…”

ঝুমুর কাঁপতে কাঁপতে বলল, “যদি কিছু হয়ে যায়?”

তাখলিফ তখন নিজের ভেজা চুল ঝাড়ছিলো। ঝুমুরের কম্পিত কন্ঠে বলা কথা শুনে পা থেমে গেলো দরজাতেই। কপালে ভাঁজ পড়লো। দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হবে?”

ঝুমুর জিভ কাটলো। ছি ছি! এসব কি কথা বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে? মানুষটাকে আধভেজা গায়ে এতো মোহনীয় লাগছে যে ঝুমুরের হাত-পা কাঁপছে সেই তখন থেকে। এত সুন্দর কেন লোকটা? ঝুমুর দু’হাতে মুখে ঢেকে বলল, “আপনি প্লিজ যান এখান থেকে। প্লিজ…”

“সত্যিই যাবো?”

ঝুমুরের ইচ্ছে করে ওকে আটকে দেয়ালের ফটোফ্রেমে বসিয়ে দিতে। সারাক্ষণ চোখের সামনে রাখতে। কিন্তু না, এখন তো কিছুতেই সম্ভব না৷ মন মানতে চাইছে না। ও অনেক কষ্টে বলল, “যান….”

তাখলিফ পা বাড়ালো তিনতলার সিঁড়ির দিকে। পরক্ষণেই পেছনে থেকে শার্ট টেনে ধরলো কেউ। ও ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকাতেই ঝুমুর গাল ফুলিয়ে বলল,
“বললেই চলে যান কেন? একটু জোরও তো করতে পারেন।”

তাখলিফ কটাক্ষ করে বলল,
“তোর মতো বাচ্চাকে জোর করে কি হবে? শুধু শুধু কেঁদে দিবি।”

“এই আমি কিন্তু আপনার বউ।”

“মাথা কিনে নিসনি তো আর।”

“আপনি সবসময় ঝগড়া করেন। আমার খারাপ লাগে।”

তাখলিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এখন যাই, চেঞ্জ করতে হবে।”

ঝুমুর ওকে আটকে দিয়ে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, “বড়চাচাকে বলেছেন?”

“হুঁ।”

ঝুমুর অবাক হয়ে বলল,
“শুধু হুঁ? ওনি কিছু বলেন নি?”

তাখলিফ একটুক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর ভাবলেশহীন ভাবে বলতে লাগলো, “বলেছে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবে। তাছাড়া বিয়ের সময় তুই একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলি। আর বাচ্চার সাথে কিসের বিয়ে? ওসব বিয়েটিয়ে হয়নি বললো।”

ঝুমুরের চোখ বড়বড় হয়ে এলো,
“মানে?”

“মানে খুব সহজ। তোর আমার বিয়েটা হয়নি। তখন তো আমরা কেউই মন থেকে রাজি ছিলাম না। তাই না?”

ঝুমুর শক্ত গলায় এবার বলে, “রাজি না থাকলেও
শরীয়ত মতে বিয়ে হয়ে গেছে।”

“বিয়ের ওপর পিএইচডি করেছিস দেখছি।”

ঝুমুর বিরক্তি নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ করেছি। তাতে আপনার কি? সবসময় আমাকে
কষ্ট দিয়ে কথা বলেন৷ খুব পস্তাবেন…”

“আমি তো সবসময়ই পস্তাই।”

“হুহ!”

ঝুমুরের মুখ রাগে-অভিমানে লালবর্ণ ধারণ করে। তাখলিফ ওর কোমড় টেনে কাছে এনে বলে, “ক্ষিধে পেয়েছে, খাবো।”

“খাবার নেই।”

“অভুক্ত রাখবি? এই তোর স্বামীর প্রতি ভক্তি?”

“এক্ষুনি যে বললেন বিয়ে হয়নি? তাহলে আপনি আমার কিসের স্বামী…”

ঝুমুরের কথা শেষ হবার আগেই তাখলিফ ফট করে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দেয়। ভেজা চুল ওর গালে, নাকে ঘষে এরপর বলে, “এমন স্বামী।”

ঝুমুর শিহরিত হয়, পরক্ষণেই রাগ নিয়ে বলে,
“কচুর স্বামী।”

বলে ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। কিছুক্ষণ পর খুলে উঁকি দিতেই দেখে তাখলিফ থামে হেলান দিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ কেমন শুকনো দেখাচ্ছে। ওর এমন রুপ ঝুমুরের বুকের ভেতর ঝড় বইয়ে দেয়, একদম দম আটকে আসে। মনে হয় মানুষটা কষ্টে আছে। ও আর অভিমান করে থাকতে পারলো না। মুখ ফুলিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলে,
“আসুন তো, খাবার দিচ্ছি।”

তাখলিফ মৃদু হাসলো,
“কচুর স্বামীর জন্য এত দরদ? নাকি এসব নাটক…”

“হ্যাঁ দরদ। আপনার মতো নির্দয় তো আর না।”

তাখলিফ চুপ করে গেলো। ওর মনটাও সেইসাথে ভালো হয়ে গেলো। এই মেয়েটার মাঝে কি যেন
একটা আছে, ওর কাছে এলেই জাদুর মতো টানে তাখলিফকে। সব ভুলিয়ে দেয়৷ ও অফিসের ব্যাগটা সোফার ওপর রেখে ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই দেখলো
ঝুমুর গামছা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে এগিয়ে দিতেই বলল, “কার না কার গামছা, আমি ব্যবহার করি না…”

ঝুমুর চোখ গরম করে বলল, “এটা আমার গামছা।”

বলে চলে যেতে নিলেই তাখলিফ ওর হাত টেনে ধরলো। এরপর ঝুমুরকে হতবাক করে দিয়ে গামছা না নিয়ে ওর ওড়না দিয়ে হাতমুখ মুছতে লাগলো। ওকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলি না কেন? তোকে নিয়ে যায়নি?”

ঝুমুর আমতাআমতা করে বলল, “আমার অনেক এসাইনমেন্ট বাকি। তাছাড়া দাদীর কোমড় ব্যথাটাও বেড়েছে। একা রেখে তো আর যেতে পারি না।
সেজন্যই যাইনি…”

তাখলিফ ওর দিকে সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকালো। পরক্ষণেই মৃদু হেসে বলল, “তাই বল। তোর ভাবগতিক সুবিধার না…”

বলে ডাইনিংয়ে বসে পড়লো। ঝুমুর জ্বলে ওঠে বলল,
“আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি সত্যিই এজন্য যাইনি..”

তাখলিফ সন্দেহপ্রবণ ভাবে তাকালো,
“আমি কি ভাবছি?”

“ভাবছেন আমি আপনাকে দেখার জন্য যাইনি।”

তাখলিফ অবাক হয়ে বলল, “তাই?”

ঝুমুর মুখ কালো করে বলল, “আর তাতেও কি?
আপনাকে দেখার জন্য থাকতেই পারি। এটা আমার ইচ্ছে।”

তাখলিফ এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ালো না। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “রান্না কে করেছে?”

“তুসি ভাবী। কেন ভালো হয়নি?”

তাখলিফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“হয়েছে। তুইও শিখে নে, কাজে লাগবে।”

ঝুমুর ভেঙচি কাটলো, “আমি মাশাল্লাহ সব পারি।
ভাত, পোলাও, সব্জি, খিচুরি, মাছ-মাংস এভরিথিং।”

তাখলিফ ঠোঁট চেপে হাসলো
“তোর তো অনেক গুণ, ভালো বর পাবি।”

ঝুমুর লজ্জা পেয়ে গেলো। বলল,
“পেয়েছিই তো, আপনাকে।”

তাখলিফ দৃঢ় স্বরে বলল,
“আমি ভালো লোক না। দেখি এদিকে আয়।
হা কর…”

ঝুমুর তড়িঘড়ি করে কাছে গিয়ে তাখলিফের হাতের লোকমাটা খেয়ে নিলো। সুযোগ একদম ছাড়ে না সে। তখনি ভেতর থেকে সাজেদা বেগমের গলা শোনা গেল, “কে আইছে রে ঝুমুর? আমার নাতির গলার মতো লাগে দেহি!”

ঝুমুর মুখে খাবার নিয়েই জবাবে বলল, “হুঁ, ওনিই।”

“ওরে আমার ঘরে আইতে ক।”

ঝুমুর বলল,
“ভাত খাচ্ছে। খেয়ে যাবে।”

তাখলিফ খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে দাদীর ঘরে গেলো। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে৷ সাজেদা বেগম কোরআন শরীফ পাঠ করছেন। নাতিকে দেখে বিগলিত চিত্তে কাছে ডেকে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন৷ ঝুমুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো, ওকেও ডেকে নিয়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। তাখলিফ দাদীর কাছে বসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। কথায় কথায় তিনজনের অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো৷ বাইরে তখন গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। একসময় দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ হতেই ঝুমুর ছুটে গেলো। খুলে দেখলো ফুয়াদের জন্মদিনের দাওয়াত খেয়ে সবাই এসে গেছে। ঝুমুরের একটু ভয় ভয় লাগলো। মা যদি দেখে তাখলিফ এসেছে যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে? হুহ! ঝুমুর একদম নিতে পারে না সেসব। এদিকে ভেতরের ঘরে কারো অস্তিত্ব পেয়ে পাখি বেগম মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে এসেছে রে?”

ঝুমুর অন্যমনস্ক স্বরে বলল, “ওনি।”

পাখি বেগম সরু চোখে তাকালো,
“ওনি মানে? ওনিটা কে?”

ঝুমুর থতমত খেয়ে বলল, “ত তাখলিফ ভাই।”

শুনেই পাখি বেগমের মুখ কালো হয়ে এলো। ঝুমুর মা’কে বলল, “এতো রাগের কি আছে মা? এটা তো ওনারও বাড়ি, ওনারও পরিবার। যখন-তখন আসতেই পারে। তুমি ওনাকে দেখলেই কেমন একটা করো,
এসব কি ঠিক?”

পাখি বেগম রেগে গেলেন, “তুই আমায় ঠিকভুল শেখাইবি না। আমার রাগের যথেষ্ট কারণ আছে। আর তুই এত ওর পক্ষ হইয়া কথা কস কেন?”

ঝুমুর আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালো না। মায়ের সন্দেহজনক দৃষ্টি থেকে বাঁচতে নিজের ঘরে চলে গেলো। পাখি বেগম তা দেখে আরও রেগে গেলেন,
“একটা অমানুষের জন্য আমার মাইয়া গলা চড়ায়।”

এরপর ডাইনিংয়ের দিকে তাকাতেই দেখতে পান
প্লেট, বাটি, খাবার। এসব দেখে তিনি জ্বলে ওঠেন। ঝুমুরকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “ওয় কি এইহানে খাইছে নাকি?”

ঝুমুর স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,
“হুম।”

পাখি বেগম বিদ্বেষ নিয়ে বললেন,
“কি পোলারে বাবা! মাইনসের বাড়িতে আইসা খায়..”

ঝুমুর রেগে বলল,
“না জেনে কথা বলো না। ওনি চায়নি, আমিই দিয়েছি। অফিস থেকে ফিরেছে, চাচা নেই তাই ভাবলাম এখানেই খেয়ে যাক। তাছাড়া চাচারা আলাদা থাকলেও এটা ওনাদেরও পরিবার। তুমি ভুলে যাও নাকি মা? সমস্যাটা কি বুঝি না।”

পাখি বেগম রেগে গেলেন,
“তুই দিছিস? এত দরদ কেন এই পোলার প্রতি?”

ঝুমুর অবাক হলো,
“এখানে দরদের কি আছে মা? সামান্য খাবারই তো খেয়েছে, পৃথিবী তো আর গিলে নেয়নি। তুমি এমন আচরণ কেন করছো?”

পাখি বেগম ধমকে ওঠলেন,
“আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস তুই?”

ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না মা। যাও এখান থেকে। উল্টাপাল্টা কিছু বলে দিলে পরে তোমার খারাপ লাগবে।”

পাখি বেগম তাজ্জব বনে গেলেন,
“ওই পোলার লাগি… ”

“দয়া করে যাও মা।”

ঝুমুর এবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে গেলো। মা’কে কোনো কথার জবাব দিলো না। পাখি বেগম ওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না৷ ঝুমুরটা ইদানীং বাড়াবাড়ি করছে, ওর সামনে তাখলিফকে নিয়ে কিছু বলা অবধি যায় না। কি চলছে ওর মধ্যে? তাখলিফকে তিনি বিশ্বাস করেন না, এই ছেলে আবার তার মেয়ের মাথাটা খায়নি তো? পাখি বেগমের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে!


______________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
আরেকটু ধৈর্য্য ধরুন৷]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here