অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-১৩

0
109

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

“অজ্ঞান হয়েছে। বখাটের খপ্পরে পড়েছিলো। এত
ছোট মেয়ে, এদিকসেদিক চলে যায়, দেখে রাখবি
না? এখানে খারাপের অভাব নেই। যত্তসব…”

বিরক্তি নিয়ে বললো তাখলিফ। এরপর চললো রিসোর্টে। পাখি বেগম মেয়েকে এ অবস্থায় দেখে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। পানি ছিটিয়ে
জ্ঞান ফেরাতেই ঝুমুর মাকে জড়িয়ে মুখ গুঁজে কেঁদে বলল, “একা আর কখনো যাব না ওদিকে।”

_________

পাখি বেগম মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় খুব ভীত হয়ে পড়লেন। ঝুমুরকে ভীষণ বকাঝকাও করলেন। মেয়েকে বললেন একা কোথাও না যেতে, সাবধানে থাকতে! ক’দিনের জন্য ঘুরতে এসে এরকম বিপদে পড়ুক তা চান না তিনি। তবে ঝুমুরের কি তা আর মাথায় থাকে? দু’দিন পরের কথা! সারাদিন অনেক ঘুরাঘুরি করে রিসোর্টে ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে ভাতঘুম দিয়েছিলো সবাই। বিকেলে রিসোর্টের ফ্রন্ট ইয়ার্ডে সব ভাইবোনরা চায়ের আড্ডার ব্যবস্থা করলো। ঘুম থেকে ওঠে হৈ হৈ করে সকলেই সেখানে যোগ দিলো, তাখলিফ বাদে! ঝুমুরও সেখানে ছিলো। সকলের সাথে আড্ডায় মগ্ন। হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত থাকার এক পর্যায়ে ভীষণ মাথা ধরেছিলো ওর। রুমে ফিরে একা শুয়ে থাকতেও ইচ্ছে করছিলো না। তাই রিসোর্টের আশপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। তিনপাশে চা-বাগান, তার এক কোণে ওদের রিসোর্ট! এর পেছনেই ছোটখাটো জঙ্গল! ঝুমুর হাঁটতে
হাঁটতে ঠিক সেখানেই চলে এসেছিলো। কিছুক্ষণ
কেটে যাওয়ার পর আচমকা ঝোপের ভেতর থেকে দুটো হাত পেছন থেকে এসে রুমাল চেপে ধরলো ওর নাকেমুখে! তৎক্ষনাৎ বিষয়টি না ধরতে পারলেও একসময়।বিপদ বুঝে ধস্তাধস্তি করে নিজেকে মুক্ত করা আগেই ঝুমুর নেতিয়ে পড়লো একদম! ফ্রন্ট ইয়ার্ডে বসে আড্ডা দেওয়া কেউ একবিন্দু পরিমাণও টের পায়নি সেসবের কিছু।
অথচ ঝোপের ভেতর শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ, পায়ের শব্দ, কারো ফিসফিসানি আবছাভাবে শোনা যাচ্ছিলো দোতলার কোণের রুমটাতে। যেখানে তাখলিফ বিশ্রাম নিচ্ছিলো। মাত্রই ঘুম থেকে ওঠেছিলো সে। এরপরই কানে আসে অদ্ভুত কিছু ফিসফিস আওয়াজ। সন্দেহ হওয়ায় পর্দা সরিয়ে জানালা দিয়ে তাকায়৷ ওর রুম থেকে রিসোর্টের পেছনের জঙ্গল দেখা যায়। ভালো করে দৃষ্টি দিতেই তিন-চারজনের অস্তিত্ব টের পায়। তারা দ্রুত চলে যাচ্ছে। গতিবিধি সন্দেহজনক। আচমকা হলুদ রঙের কিছু একটার ঝলকানি দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে ওর। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না। তবে চট করেই মাথায় আসে ঝুমুরের কথা, আজ হলুদ জামা পরেছিলো মেয়েটা!

ও দ্রুত নিচে ছুটে আসে। চায়ের আড্ডায় সবাই বসা তখন। বড়রা নেই।।ওকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে সবাই সেদিকে তাকায়। তাখলিফ সেখানে ঝুমুরকে দেখতে না পেয়ে ধমকে জিজ্ঞেস করে,
“ঝুমুর কই?”

নিশি বলল, “আপুর তো মাথাব্যথা, এই ভেতরেই তো গেলো…”

তাখলিফ এটুকু শুনেই যা বোঝার বুঝে গেলো। বাকিরা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তাখলিফের তখন কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না। বড় বড় পা ফেলে ছুটে গেলো পেছনের জঙ্গলের দিকে। তাখলিফ নিশ্চিত হয়ে গেলো, ওই বখাটের দলগুলোরই কাজ এটা পায়ের ছাপ, ঝোপের ভাঙা ডাল দেখে দেখে এগুতে লাগলো। মেয়েটার সাথে দু’দিন আগেই যা ঘটে গেলো, এরপরেও বাড়ির লোক একটুও দেখেশুনে রাখলো না ভেবেই রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠলো। ছুটতে ছুটতে পকেট হাতড়ে সেলফোন বের
করার চেষ্টা করলো, পেলো না। তাড়াহুড়োয় বেরুতে গিয়ে আনা হয়নি। ও দাঁড়িয়ে পড়লো তৎক্ষনাৎ! সন্ধ্যা নামছে ধীরেধীরে। সামনের জঙ্গল আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে, একটু পর হয়তো তাও দেখা যাবে না। শিট, ঝোঁকের মাথায় কাউকে বলেও আসেনি! কি করবে এবার তাখলিফ? ফিরে যাবে? কিন্তু যদি দেরি হয়ে যায়? ঝুমুরের যদি কিছু একটা করে দেয়! জঙ্গলের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে ওর তখন নিজের বোকামির জন্য খুব অসহায় লাগছিলো। অন্ততপক্ষে কাউকে বলে আসলে খুব সাহায্য হতো! হলুদ কাপড় দেখেই সে ছুটছে, হতেও তো পারে এটা ঝুমুর নয়! ফিরে যাবে কি? কিন্তু যদি ঝুমুরই হয়? উফ, তাখলিফের মাথা কাজ করছে না! ও তখন টের পেলো ওর হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, বুক কাঁপছে!

এরপর সাতপাঁচ না ভেবে যা হবার হবে ভেবে সে আবারও জঙ্গল ধরে এগুতে লাগলো। একসময় সামনের জঙ্গল হয়ে এলো হালকা। গাছপালা কমে এলো। ভাগ্য ভালো থাকায় অন্ধকার পুরোপুরি হওয়ার আগেই জঙ্গল থেকে বেরুতে পারলো। এদিকওদিক তাকিয়ে কিছু ঘরবাড়ি দেখতে
পেলো সে। ভালোভাবে পরখ করতেই বুঝতে পারলো
এটা একটা গ্রাম। কিন্তু এখন কিভাবে খুঁজে বের করবে
ওই ছেলেগুলোকে? ভেবে পেলো না। বেশিক্ষণ
হয়ওনি ওরা এখানে এসেছে। কোথায় যেতে পারে? তাখলিফের কি করা উচিৎ? এসব ভেবে নিজেকে পাগল পাগল লাগছিলো ওর! এরপর আচমকাই কাকতালীয় ঘটনা ঘটে গেলো। ওকে দেখে একজনকে ছুটে পালাতে দেখলো সে, ছুটতে ছুটতে একবার পিছু ফিরে তাকালো ছেলেটা। তাখলিফ আর একদন্ডও সময় নষ্ট করলো না। ছেলেটাকে চিনতে পেরেছে সে। বখাটে গুলোর সঙ্গী!

অনেক কসরত করে ছেলেটাকে অবশেষে ধরতে পারলো ও। কানের নিচে কয়েকটা দিয়ে নিজের মনের ঝাল মেটালো। ঝুমুরের কথা জিজ্ঞেস করতেই অস্বীকার করলো। রাগে অন্ধ তাখলিফ ছেলেটাকে মাটিতে ফেলে গলা চে’পে ধরতেই মৃ’ত্যুভয়ে সব স্বীকার করলো ছেলেটা। সেদিনের ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই ঝুমুরকে তুলে এনেছে তারা, ওকে নষ্ট করে নিজেদের মনের খোরাক মেটাবে বলে! এরপর ওকে জিম্মি করে ওর পরিবারের থেকে টাকা আদায় করবে এমনই ধান্ধা ওদের! এখন ওরা ঝুমুরকে ওদের আস্তানায় আটকে রেখেছে। ও বাজারে যাচ্ছিলো বাংলা মদ কিনতে, আজ রাতটা সকলে ফুর্তি করে কাটাবে বলে। পথিমধ্যেই তাখলিফের হাতে ধরা খেয়ে গেলো! সব শুনে তাখলিফের পায়ের রক্ত মাথায় ওঠে গেলো যেন! ইচ্ছে করলো এখানেই সব ক’টাকে পুতে ফেলতে কিন্তু তাতে বড্ড সময় নষ্ট হবে। বখাটেরা ঝুমুরকে যেখানে আটকে রেখেছে সেখানে নিয়ে যেতে বললো। অবশেষে আধমরা বখাটেটা ওকে ছেড়ে দেওয়ার শর্তে তাখলিফকে এক নীরব অঞ্চলে একটা ক্লাবঘরে নিয়ে গেলো। পুরোনো ভাঙাচোরা লম্বা একটা টিনের ঘর, সামনে বারান্দা। বখাটেটা ওকে সেখানে পৌঁছে দিয়েই পালিয়ে গেলো। তাখলিফ ওকে বিশ্রি একটা গালি দিয়ে সামনে পা বাড়ালো! বারান্দাতে ওঠতেই মাথা ঝিমঝিম করে ওঠলো ওর বিশ্রি দুর্গন্ধে! এখানে যে মাদকাসক্তদের কারখানা আর অনৈতিক কার্যক্রম চলে তা ওর অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারলো। দরজা বন্ধ ছিলো ভেতর থেকে। ঘুণপোকায় খাওয়া সেই কাঠের দরজায় লাথি মারতেই তা খুলে গেলো। ভেতর থেকে দু’জন চ্যাংড়া ঢুলতে ঢুলতে এসে ওকে দেখে খ্যাঁকিয়ে ওঠলো। দুটোকেই চড় মেরে মাটিতে ফেলে দিলো ও। নেশায় বুঁদ হয়ে গালাগাল করলো ওরা তাখলিফকে। ভেতরে ঢুকে হন্যে হয় ঝুমুরকে খুঁজতে থাকে ও। তখনি পাশেই ভাঙাচোরা আরেকটা দরজা দেখে সে। বাইরে থেকে খিল দিয়ে রেখেছিলো। সেখান থেকে গোঙানির মতো শব্দ শুনা যাচ্ছিলো। তাখলিফ দ্রুত খিল খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে দড়ি দিয়ে ঝুমুরকে বেঁধে রেখেছে, মুখে কাপড় গুঁজা, গায়ে ওড়না নেই। বিধস্ত হয়ে আছে ফর্সা মুখ, চুলের খোপা খুলে জট পাকিয়ে আছে। ও তড়িঘড়ি করে দড়ি খুলে ওকে মুক্ত করতেই আতঙ্কে ঝুমুর ওর বুকে লুকিয়ে গেলো। ভয়ে জাপ্টে ধরে কান্নার সুর তুলে বলে, “আমাকে ওরা ধরে এনেছে আবার। আমার কোনো দোষ নেই, আমাকে বাঁচান…”

ঝুমুর অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছিলো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গেছে ওর। তাখলিফ ওকে স্বাভাবিক হতে দু’মিনিট সময় দেয়। পাশের ঘর থেকে নেশায় বুঁদ
থাকা দুটো নেশাখোরের গালি শোনা যাচ্ছে। আর বাকিগুলোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো আশেপাশেই আছে! তবে ওদের দ্রুতই এখান থেকে বেরুতে হবে। সব ক’টা এসে পড়লে ওদের সাথে লড়াই করা সহজ হবে না! ও ঝুমুরের মাথায় হাত দিয়ে ওকে শান্ত করে ওঠতে নেবে তখনি দেখে র’ক্ত! দ্রুত ঝুমুরের পা ওঠিয়ে দেখতে পায় সেখানটা বেশ কেটে গেছে, র’ক্তপাত হচ্ছে। এক্ষুনি বন্ধ করতে হবে। কিন্তু আশেপাশে কিছুই দেখলো না সে। একটা কাপড়ের টুকরোও না। বাধ্য হয়ে নিজের পরণে থাকা গেঞ্জিটা খুলে হাতার একাংশ টিনের ধারে কেটে সেটা দিয়েই ঝুমুরের পা বেঁধে দেয়। তখনি আচমকা পেছন থেকে দরজা লাগানোর শব্দ পায়। ঝুমুরের সাথে সাথে তাখলিফও অবাক হয়ে যায়, কি হলো ব্যপারটা? সবগুলো বখাটে এসে গেছে নাকি? আক্রমণ না করে তাহলে আটকে দিলো কেন? ওদের জিম্মি করে টাকা চাইবে এজন্য? তাখলিফ কিছুই বুঝতে পারলো না। রাগে টিনের বেড়ায়ই ঘুষি মারলো সে। না কাউকে জানিয়ে এসেছে, না এনেছে ফোন। এতবড় ভুল কেন করলো, কীভাবে করলো সে? সামনে যে বড় বিপদ তা বেশ টের পাচ্ছে এবার!

এরপরের ঘটনাগুলো ছিলো দুঃস্বপ্নের মতো! কস্মিনকালেও যা কখনো ভাবে নি, যা কখনো হবার নয় তা-ই হয়ে গেলো। বখাটেগুলো ওদের আটকে রেখে গ্রামের মানুষদের জড়ো করলো। খালি ক্লাবঘরে ওদের একঘরে অনৈতিক অবস্থায় পেয়েছে সেরকম কুৎসা রটালো। একগ্রাম মানুষের সামনে ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্ককে
ওরা এমন কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করলো যে তাখলিফের রাগে মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। যারা ওদের নিয়ে বাজে বকছিলো তাদের একজনের গলা চেপে ধরে উত্তমমধ্যম দিলো সে। হৈ হৈ করে ওঠলো গ্রামের লোক। ছুটে এসে কয়েকজন ওকে ছাড়িয়ে নিলো। এরপর বেঁধে ফেললো। ঝুমুর ভয় পেয়ে মাটিতে বসে কাঁদছে তখন। অনুনয় করে বলছে ওরা কিছু করেনি, ওকে তুলে আনা হয়েছে তাই তার ভাই এসেছে ওকে নিতে। কয়েকজন মহিলা ওকে
ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বলল, “ছিনাল’গিরি কইরা হক্কলেই নাগররে ভাই বানায় দেয়…”

ঝুমুর এসব ভাষা শুনে হতভম্ব! যে মহিলা ঝুমুরকে থাপ্পড় মেরেছে তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো তাখলিফ। তা দেখে একজন বলল, “তেজ কমে নাই, দেহো! নষ্টামি কইরা আবার চক্ষু তুইলা চায়, কিয়ামতের বুঝি আর দেরি নাই।”

গ্রামবাসী বলল, “এইসব পাপ আমাগো গেরামে
চলব না। এই অধপতম মাইনা নিমু না..”

“দেইখা তো ভালা ঘরের মাইয়া-পোলা লাগে।
বাপ-মারে কইয়া বিয়া করতো পারোস নাই? শরীলের ক্ষিধা মিডাইতে এইখানে আইসস!”

ঝুমুর কানে হাত চাপা দিয়ে কান্না করতে থাকে। জীবনেও এসব কথা সে শুনেনি। তবে নোংরা ইঙ্গিত দিচ্ছে তাখলিফ ভাইকে জড়িয়ে এটা যেন মৃত্যুর মতো কষ্ট দিচ্ছে ওকে। ওরজন্য তাখলিফকে আজ এত নোংরা কথা শুনতে হচ্ছে, মার খেতে হচ্ছে, সম্মান হারা হচ্ছে! ঝুমুর কেঁদেই যায়, ওর একটা কথাও কেউ বিশ্বাস করে না। তাখলিফ গ্রামের মূর্খ মানুষদের সব খুলে বললেও কেউ কোনো কথা শুনে না। সকলেই উল্টাপাল্টা কথা বলে মজা নিতে থাকে।
অনেকেই চোখ দিয়ে গিলতে থাকে ঝুমুরের সৌন্দর্য!
রাগে ওর মাথায় আগুন ধরে যায়। কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকায় কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাধ্য হয়ে একসময় ওদেরকে আরো যাচাই করতে বলে, ফোন নাম্বার দেয় ওর বাবা-চাচার। তবুও মূর্খ মানুষগুলোর তোলপাড়ে গ্রামপ্রধান সালিশে রায় দেয় এই কলঙ্কিত ছেলে-মেয়ে দুটোকে এক্ষুণি বিয়ে করিয়ে পাপমুক্ত করবে তাদের গ্রামকে! বিয়ের কথা শুনে তাখলিফ সরাসরি নাকচ করে দেয়। সবাই কটাক্ষ করে বলতে থাকে ‘নষ্টামি করতে পারে, বিয়া না। এই হইলো শহুরের পোলাপানগো অবস্থা। কচি মাইয়া পাইয়া এইহানে লইয়া আইছে। বুঝি না ভাবে কিছু।’
এদিকে ঝুমুরের ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়। এসব কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই সে বুঝতে পারে না। একটা সময় ঝুমুরকে কয়েকজন মহিলা এসে জোর করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়। কাটা পা নিয়ে ও হাঁটতে পারে না তা দেখেও নোংরা গালি দিতে ভুলে না কেউ। ঝুমুরের নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছিলো সেদিন। কোনোমতে ওকে হাতমুখ ধুইয়ে একটা সুতির
লালশড়ি পরিয়ে বিয়েতে বসায়। হুজুর ডেকে আনে। তাখলিফকে নানারকম ভয়ভীতি, হুমকি দেয়। তাখলিফ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। সে রাজি না হওয়াতে বন্দী করে কুকীর্তি রটিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। নিজের জন্য ভাবছিলো না তাখলিফ, ওর ভাবনাতে ছিলো ঝুমুর! একটা সময় বাধ্য হয় সে বিয়ে করতে। সেই রাতটা ওদের জন্য ছিলো বিভীষিকাময়। তাখলিফ অনেক কষ্টে একজনের থেকে ফোন জোগাড় করে। কাকে জানাবে প্রথমে ভেবে পায় না, ঝুমুরের থেকে ইয়াসিফের নাম্বারটা জেনে নিয়ে ওকেই ফোন করে। এদিকে ওদেরকে খুঁজে না পেয়ে বাড়ির সবাই চিন্তিত, কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে পাখি বেগম! শুনে তাখলিফ ওদের সাথে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা সংক্ষেপে বলে ইয়াসিফকে। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। তাখলিফ বিয়ের কথা কাউকে জানাতে বারণ করে ওকে। ইয়াসিফ ভাইয়ের কথা মেনে নেয় ও তৎক্ষনাৎ লোকেশন জেনে গাড়ি নিয়ে রওয়ানা দেয়। ওদের খোঁজ পাওয়া গেছে শুনে সবাই শান্ত হয়। বাড়ি ফিরতে অনেকটা সময় লেগে যায় ওদের। কাঁটাছেড়া, রক্তাক্ত তাখলিফ অথচ ঝুমুরকে লাল শাড়িতে দেখে দেখে সকলেই অবাক বনে যান। ধাতস্থ হয়ে বিয়ের কথা বাদ দিয়ে পুরোটাই তাখলিফ খুলে বলে সবাইকে। পাখি বেগম ভয় পেয়ে যান। এক মুহূর্ত আর সেখানে থাকতে চান না তিনি। তাখলিফের ওপর নিজের রাগ ঝাড়েন। কেন সে কাউকে জানালো না এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে বরং ওকেই দোষারোপ করলেন। ঘৃণা, বিদ্বেষ নিয়ে বলেন, “তুমি যেইখানে থাহো সেইখানে সবকিছু ছাই হইয়া যায়, কথাডা আবারও ফললো।”

পরপর এমন ঘটনা ঝুমুরের মনে ভীষণ প্রভাব
ফেলে। রাতে জ্বর ওঠে বেহাল দশা হয়। জ্বরের
ঘোরে উলটাপালটা কথা বলতে থাকে। অবস্থা হয়ে
যায় বেগতিক। পরের দিনই সবাই ফিরে আসে
বাড়িতে। তাখলিফ আর ইয়াসিফ রয়ে যায়। ওদের সাথে হওয়া ঘটনাগুলো লিখিত অভিযোগ দিয়ে
থানায় মামলা করে ওরা। এরপর সেই গ্রামে গিয়ে
গ্রাম সালিশের প্রধানকে তার নির্বুদ্ধিতা এবং অন্যায় রায় নিয়ে চোটপাট চালিয়ে আসে। বখাটেগুলো তখন গ্রামছাড়া! গ্রামের মানুষগুলো নিজেদের ব্যবহার নিয়ে লজ্জিত হলেও তাখলিফের তা মোটেও সহ্য হয় না। ইচ্ছে করে সবক’টাকে পুতে ফেলতে। এরা দেখতে সরল, সাদাসিধা হলেও একেকজন জঘন্য মস্তিষ্কের অধিকারী! দু’দিন পর ফিরে আসে ওরা বাড়িতে৷ তাখলিফ পুরোটা দুর্ঘটনা ভেবে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে, ঝুমুরের তখনো ভীষণ অসুখ!

সেদিন তাখলিফের অনেক ভুল ছিলো। নিজের
ভুলের জন্য একটা বাচ্চা মেয়েকে ভুগতে হয়েছে এটা ভেবেই বহুদিন মানসিক নিপীড়নে ছিলো সে। ইচ্ছে করেনি ঝুমুরকে কাছে টানতে, স্বামীত্ব দেখাতে। কখনো এই প্রসঙ্গে কথাও তুলেনি। ঝুমুরকে একদিকে দেখলে সে অন্যদিকে গিয়েছে। এরপরেও যে মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখতো তা টের পেতো তাখলিফ। অবশ্য সে না বোঝার ভান করতো সবসময়। এই ঘটনার প্রায় অনেকগুলো মাস পর ঝুমুর যখন ওকে এসে মিনমিন করে নিজের ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলো তাখলিফ নিজেকে সামলাতে পারেনি, রাগে এক চড় মেরে দাগ বসিয়ে দিয়েছিলো ওর গালে। এরপরও থামেনি মেয়েটা। ওর মতো শূন্য একটা মানুষকে কি করে যে এত ভালোবেসে ফেললো ঝুমুরটা! তাখলিফ পরবর্তীতে আর কখনো হাত ওঠাতে পারেনি ঝুমুরটার ওপর। মায়া না ভালোবাসা? নাকি অদৃশ্য দায়িত্ববোধ? আটকাতে পারেনি ওকে! খুব গোপনে ওর ঠিকই চিন্তা হতো ঝুমুরের জন্য! পুরোনো ঘটনাগুলো ভীষণ অপ্রিয় তাখলিফের। আজ পর্যন্ত যা বাড়ির সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে সবটা বাবার সামনে এনে নিজেকে ভীষণ হালকা মনে হলো ওর!


_______________________________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।একটা কনফিউশন দূর হলো তো? আমি আমার থিম মতো লিখছি, আপনাদের কথামতো লিখতে গেলে তো সেটা
আপনাদের গল্প হয়ে যাবে, আমার না!]

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here