অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-১২

0
128

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

তাখলিফ অন্যদিকে ফিরে এরপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“তুই কিছুই করবি না, আমাকে কথা দিতে হবে
এরপর বাকিটা আমি দেখবো…”

কথাটা বলার সময় তাখলিফের গলাটা কেঁপে যায়।
ঝুমুরের চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল গাল বেয়ে টুপ
করে কার্পেটের ওপর পড়ে যায়। পেছন থেকে তাখলিফকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভালোবাসি।”
___________

সময়টা আগস্টের মাঝামাঝি। আকাশে নীল ঘন
মেঘ। চারদিকে সূর্যের দ্রাব দাহ আর গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। কোথাও একটু বাতাস নেই, জনজীবনে স্বস্তি নেই। তেমনি একফোঁটা স্বস্তি নেই তাখলিফের মনেও। এ ক’টা দিন ভেবেছে সে, কি করবে! বাবা
নেই, খুলনায় গেছে। ফিরতে আরও ক’দিন লাগবে।
এ সময়টাতে প্রতিনিয়ত নিজের মনের সাথে যুদ্ধ
করেছে কিভাবে কি করলে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি
পর্যায়ে না যায়, কিভাবে শান্ত হয়ে সামলাবে সে, কিভাবে বাবাকে দিয়ে বিস্তারিত বোঝাবে এবং কি
করে পরিস্থিতি সামলাবে সে! ও বললে সানওয়ার
হক সবটা মেনে নেবে ঠিকই, কিন্তু শামসুল হক আর পাখি বেগম কিছুতেই মানবে না। আর তাখলিফের দুচিন্তা ঠিক এখানেই। ওদিকে ঝুমুর মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওর সাথে দেখাও করতে পারছে না। ম্যাসেজগুলোয় ওর আকুতি, কাতরতা, কান্না, ভালোবাসা মিশে থাকে; তাখলিফ তবুও ফিরতি ম্যাসেজে ওকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। যেখানে ও নিশ্চিত যে চাচা-চাচী তাদের মেয়েকে ওর হাতে তুলে দেবে না সেখানে ও মিথ্যে সান্ত্বনা দেবে কোন দুঃসাহসে?
তবুও সে ব্যাপারটা সবার সামনে আনবে এবার। কোনো না কোনোদিন তো সামনে আসতোই, তখন যে ঝড়ের মুখোমুখি হতো নাহয় কিছুটা আগেই সেই ঝড়ের সম্মুখীন হলো সে!

পরের চারটে রাত তাখলিফের চোখে ঘুম ধরা দিলো না। মনের ভেতর খচখচানিটা গেলো না। অথচ সে চাইলেই পারে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ঝুমুরকে নিজের করে নিতে, কারো তোয়াক্কা না করে নিজের মনের কথা শুনতে। কিন্তু সে কিছুতেই তা পারছে না! বিবেকবোধের তাড়নায় নিজের কাছেই কেমন ছোট মনে হয় নিজেকে। এমনিতেই তার জীবনটা অপরাধে ভরপুর, সেখানে বাবা-মায়ের থেকে মেয়েকে কেড়ে নিয়ে আরও অপরাধী হতে চায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এদিক ওদিক তাকেতেই তাখলিফের চোখ স্থির হয়ে আসে তমালিকার ছবিতে। সেকেন্ডও গড়ায় না, চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে। জ্বলে ওঠে মস্তিষ্ক! একটা খু’নী সত্তা নিজের ভেতর লুকিয়ে আছে। অভিশপ্ত নিজেকেই তো কোনোদিন ক্ষমাই করতে পারবে না সে, অন্যেরা কীভাবে করবে?

সারাটাদিন কোনো একভাবে কেটে গেছে। ফোনের টুংটাং নোটিফিকেশনের শব্দে ভাবনার প্রহর কেটে গেলো তাখলিফের। ও চোখ তুলে তাকায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে কবেই! বাইরে অন্ধকার জেঁকে বসেছে। ও ফোন স্ক্রল করতেই দেখে ঝুমুরের ম্যাসেজ। লিখা, “দরজা খুলুন।”

খানিকটা অবাক হয়েই দরজা খুলে দেয় তাখলিফ।
ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে। পরণে বাটিকের থ্রি-পিস। মাথায় বরাবরের মতোই ওড়না দেওয়া। চোখমুখ বিষন্ন হয়ে আছে। চারদিন যাবৎ দেখেনি তাখলিফ ওকে। আপাদমস্তক লক্ষ্য করে এরপর ভেতরে ঢুকতে দিয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
“বেল চাপলেই হতো, ম্যাসেজে লিখলি যে?”

ঝুমুর ওড়নার নিচ হতে খাবারের বাটি বের করে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “বাজিয়েছি, টোকাও দিয়েছি। আপনি বোধহয় বয়রা হয়ে গেছেন তাই শুনেন নি।”

তাখলিফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। মনে পড়লো তখন সে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো! এ ব্যাপারে আর কথা না বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “এলি যে? কিছু হয়েছে নাকি আবার?”

ঝুমুর ব্যস্ত কন্ঠে শুধালো,
“সে তো প্রতিদিনই হচ্ছে। আমি এসেছি আপনার জন্য ভুনা খিচুড়ি নিয়ে। দেখুন তো খেয়ে, কেমন হলো?”

তাখলিফ একপলক খাবারের দিকে তাকিয়ে এরপর জিজ্ঞেস করলো, “কে রেঁধেছে?”

ঝুমুর উৎসাহ নিয়ে বলল,
“আমি। কাল রেঁধেছি, কিন্তু নিয়ে আসার সুযোগ হয়নি। ফ্রিজে তুলে রেখেছিলাম আপনার জন্য। মা কোথাও বেরিয়েছে, সেজন্য নিয়ে এলাম।”

তাখলিফ সিরিয়াস গলায় বলল,
“বাসি খাবার নিয়ে এসেছিস? আমি তো বাসি খাবার খাই না।”

ঝুমুরের মুখ কালো হয়ে গেলো। এত কষ্ট করে লুকিয়ে-চুরিয়ে লোকটার জন্য রান্না করলো, আর সে বলছে বাসি খাবার খায় না? ঝুমুর কি ইচ্ছেকৃত ওকে বাসি খাবার দিচ্ছে? খাবারের সাথে যে ওর ভালোবাসাটা আছে সেটা দেখতে পাচ্ছে না? অভিমানে চোখ ভারী হয়ে ওঠলো ওর। শক্ত হয়ে এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। তাখলিফ ওর লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মনে মনে হাসলো। এই মেয়ে সংসার করবে কি? এখনো বাচ্চা! এতটুকু কথায় মাইন্ড খাওয়ার কি আছে বুঝলো না সে। তবে ধীরেসুস্থে টেবিলে বসে প্লেটটা টেনে নিতেই ঝুমুর তৎক্ষনাৎ সেটা কেড়ে নিয়ে বলল, “খেতে হবে না, দরজা খুলে দিন। আমি যাচ্ছি।”

তাখলিফ কপালে ভাঁজ ফেলে রেগে বলল, “অভুক্তের মুখের সামনে থেকে খাবার কেড়ে নিলি তো? দেখবো কিভাবে কি করিস…”

ঝুমুর বোকার মতো তাকালো। পরক্ষণেই প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বিষন্ন গলায় বলল, “আমাকে ভয় দেখাবেন না একদম। এখন খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে!”

তাখলিফ ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে খাবার মুখ তুলে নিলো। ঝুমুর ওর প্রতিক্রিয়া দেখার আশায় পাশাপাশি একটা চেয়ার টেনে বসলো। খুব ভালো বা খারাপ কোনোটাই হয়নি, তবে খেতে ভালোই। ঝুমুর এটুকু শুনেই দারুণ উৎফুল্ল হলো। পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। আরো দু-চামচ খিচুড়ি বেড়ে দিলো। তাখলিফ ওর চিকচিক করা চোখদুটো দেখলো। খেতে খেতে ভাবলো, এই মেয়ের এত পতিভক্ত কেন? কোথা থেকে এলো? কে শেখালো? এত ভক্তিতা না আবার দুঃখ এনে দেয় ওকে! এরকম মনোভাবের মেয়েরা আবেগপ্রবণ হয় বেশিরভাগ সময়। ওর ভয় হলো, এই মেয়ে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে, তাহলে ওর জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে পুরোপুরি। আর কখনোই সেই জীবনে আলো জ্বলবে না। উসখুস শুরু হলো মনের মধ্যে!

“নে, হা কর।”

তীব্র অস্বস্তি নিয়ে কথাটা বললো তাখলিফ। টেবিল থেকে চিবুক তুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো, চোখদুটো আপনাআপনি বড়বড় হয়ে এলো ঝুমুরের।
তাখলিফ ধমক দিলো, “নিলে নে নয়তো ফুট।”

ঝুমুর তড়িঘড়ি করে রোবটের মতো ওর এগিয়ে দেওয়া লোকমাটা খেয়ে নিলো। চোখ ছলছল করে ওঠলো তবে বুঝতে দিলো না তাখলিফকে। মানুষটা তো আর জানে না, ঝুমুর এখনো নিজের রান্না খেয়ে দেখেনি এর জন্যই তো! ওর খাওয়া দেখেই চোখ জুড়াবে বলেই তো এতসব আয়োজন! এখন দেখো, ওকে ছাড়া খেতে পারছে না! এই রগচটা, উলটপালট লোকটা এরপরেও স্বীকার করবে না, বলবে না তুই আমার সব! হুহ! তাতে কি? ও তো ঝুমুরেরই! তবে এক লোকমা খেয়েই শান্ত হলো না৷ ভুগিচুগি আর নানান বাহানায় তাখলিফের হাতে মোট এগারোটা লোকমা খেলো সে। খাওয়া শেষে তাকিয়ে দেখলো তাখলিফ রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

“আমার জন্য এনেছিলি? নাকি নিজের জন্য? সব তো তুই খেয়ে হজম করে নিলি!”

ঝুমুর বোকাবোকা হেসে বলল, “ক্ষিধে ছিলো তো,
বুঝি নি।”

তাখলিফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“সব নাটক তোর।”

ঝুমুর মিনমিন করলো,
“সরি।”

তাখলিফ শক্ত গলায় বলল,
“গ্রান্টেড না।”

“কি করলে হবে?”

“কান ধরে উঠবস।”

ঝুমুর চোখের পলকে ওঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কান ধরে উঠবস শুরু করলো। ওর বোকামি দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেলো তাখলিফ। এই মেয়ে কি সত্য-মিথ্যা, মজাটজার পার্থক্য করতে পারে না? সাধারণ একটা কথাকে সিরিয়াস বানিয়ে উঠবস করছে। ও প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “এত গাধা কেন তুই? ভার্সিটিতে পড়িস, পতিভক্তি বুঝিস, নাটক-সিনেমা বুঝিস আর সামান্য জোক বুঝিস না? ফালতু যত্তসব।”

ঝুমুর বুঝতে পারলো তাখলিফ রেগে গেছে। ও কান থেকে হাত নামিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল, “না মানে আপনি তো…”

তাখলিফের তীক্ষ্ণ কন্ঠ,
“আমি তো কি?”

ঝুমুর ভড়কে গিয়ে বলল,
“আপনি তো জোক করার মানুষ না, কীভাবে বুঝবো কোনটা সিরিয়াস কথা আর কোনটা জোক? আপনার কথা না মানলে যদি আমাকে দূরে করে দিন! আর আপনি বললে তো আমি হেসে হেসে ম’রেও যেতে পারবো…”

তাখলিফ বিরক্তিতে আবারও চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। ভেবেছিলো বড় হওয়ার সাথে সাথে এই গর্দভের বুদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু না গদর্ভটা এখনো বোকাই রয়ে গেছে। ও ওঠে দাঁড়াতেই ঝুমুর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। ওড়না দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে বলল,
“আ আমি খুব খুশি। আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”

অবশ্য তাখলিফের অনুমতির অপেক্ষা না করেই ওর বুকে মাথা রাখলো ঝুমুর। কান পেতে শুনলো হৃদপিন্ডের শব্দ, অনুভব করলো ওঠানামা। দ্রিমদ্রিম শব্দটা এত জোরালোভাবে হচ্ছে কেন? সেখানে কি ঝুমুরের নাম বাজছে? তবে যেটাই হোক না কেন, ওর ভীষণ শান্তি লাগছে! এই শান্তি অন্যরকম, ভীষণ প্রশান্তিজনক। তাখলিফ একসময় চোখমুখ শক্ত করে বলল, “তোর পাগলামি কমা। আমি তো বলেছিই বাবা এলে কথা বলবো। তুই হুটহাট এসব করলে ব্যাপারাটা আরো ঘেঁটে যাবে। যা ভাগ!”

ঝুমুর ওর বুকে নাকমুখ গুঁজে বাধ্য মেয়ের ন্যায়
মাথা নাড়লো, “আরেকটু, হুঁ!”

মন খারাপের এই এক বিষন্ন সন্ধ্যায় তাখলিফের ভেতর অদ্ভুত শিহরণ আর টান অনুভূত হলো। প্রথমবার মনে হলো এই ঝুমুরটাকে ছাড়া হয়তো বেঁচে থাকতে পারবে ও, তবে ভীষণ কষ্ট হবে। তাতে হয়তো মৃত্যু হবে না, তবে পুরো একটা জীবন কেটে যাবে দীর্ঘশ্বাসে!

____________________

সানওয়ার হক ‘নিরিবিলিতে’ যেদিন ফিরলো, সেদিন রাতেই বাবাকে সব জানিয়ে দিলো তাখলিফ। ছেলের মুখে এই অভাবনীয় ঘটনা শুনে তিনি বিমূঢ় হয়ে গেলেন একদম!

সেবার ডিসেম্বরে বেশ ঠান্ডা পরেছিলো। কুয়াশাজড়ানো প্রকৃতি হয়ে ওঠেছিলো মোহমনীয়। অদ্ভুত ছিলো সবকিছু। প্রকৃতি সেজেছিলো বিষন্নতার সাজে। নিরিবিলি বাড়িটা বহুদিন নিষ্প্রাণ হয়েছিলো বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য সাজেদা বেগমের অসুস্থতায়। দীর্ঘ দুই মাস হাসপাতালে যমে-মানুষে টানাটানি করার পর অবশেষে সুস্থ করে বাড়িতে নিয়ে এলো সবাই। মা’কে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে প্রার্থনা করে ফিরিয়ে এনে তিন ছেলেই সন্তুষ্টি আদায় করলেন। আর সাজেদা বেগম মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে ভাবলেন অনেক তো হলো এই সংসার, সন্তানের জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়া। এবার না-হয় একটু নিজের মনের খোরাক মেটানো যাক! কখনো, কোথাও ঘুরতে না যাওয়া সাজেদা
বেগমের বহুদিনের ইচ্ছে ছিলো দেশটা ঘুরে দেখার। সংসারের যাঁতাকলে যা কখনো হয়ে ওঠেনি। ছেলেদেরকে জানালেন সেই কথা! কবে আবার কি হয়ে যায় তা কি আর বলা যায়? মায়ের কথা শুনে তারা জানতে চাইলো, “কি চান আম্মা? আপনি যা চাইবেন তা-ই হবে। একবার বলুন।”

সাজেদা বেগম ডিসেম্বরের এই ছুটিকালে সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়ির সকলকে নিয়ে ভ্রমণ করবেন। এই যান্ত্রিক শহর থেকে দূরে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে দু-দন্ড শান্তিতে কাটাতে চান তিনি। যেই ভাবা সেই কাজ! মায়ের কথায় সকলেই রাজি হলো। বাচ্চাদের স্কুল ছুটি, অফিসেও শীতকালীন আর ক্রিসমাসের ছুটি সব মিলিয়ে ক’টা দিন কোথাও কাটিয়ে আসা যেতেই পারে। কখনো তো দলবেঁধে ভ্রমণে যাওয়া হয় না। বেশ মজা হবে সাথে মায়ের ইচ্ছেও পূরণ করা যাবে। খোঁজখবর নিয়ে ইয়াসিফ জানালো শ্রীমঙ্গলে যাওয়া যায়। সেখানে না-হয় রিসোর্ট ভাড়া করে নেবে৷ তাছাড়া ওর এক সিলেটী বন্ধুর বাবার রিসোর্ট আছে। সেখানে পরিচিত হিসেবে আলাদা একটা ডিস্কাউন্টও পাওয়া যাবে। সব চিন্তাভাবনা, মতামত শেষে এটাই ফাইনাল হলো। বাড়ির সকলে এমনকি নিশি-তিথি, ঝিনুক-ঝুমুরসহ ওদের ফুফুরাও হৈ হৈ করে রাজি হয়ে গেলো।
সকলেই পরিবারসহ হাজির। এদিকে ট্যুরে যাওয়া
হচ্ছে শুনে তাখলিফ বেঁকে বসলো। সে কোথাও যাচ্ছে না। একগাদা মানুষের মাঝে হৈ হৈ করতে তার বিরক্ত লাগে। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই এসব ফ্যামিলি গ্যাদারিং ওর কাছে নেহাৎই যন্ত্রণার। সেখানে একদল মানুষ নিয়ে রিসোর্টে হৈ হৈ করা ওর পক্ষে নেহাৎই বিলাসিতা। সানওয়ার সাহেব অনেক বোঝালেন, কিন্তু তাখলিফ নিজের সিদ্ধান্তে অটল! বড় নাতি না গেলে সাজেদাও যাবে না এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। বাড়ির সকলের আনন্দে ভাটা পড়লো। নিশি-তিথিসহ ছোটরা কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। মুখভার হয়ে গেলো পাখি, প্রমিলা, ঝিনুকের। এত প্ল্যান সব ধুলোয় গেছে তাদের! রাগে ঝুমুর তো তাখলিফকে বউহারা হওয়ার অভিশাপ পর্যন্ত দিয়ে ফেললো। অবশ্য পরে দাদীর জেদের জন্য তাখলিফ অবশ্য যেতে রাজি হয়েছিলো। এরপর ডিসেম্বরের বাইশ তারিখ হৈচৈ করে সকলে চললো শ্রীমঙ্গল। ইয়াসিফ অবশ্য সিলেট থেকে এসে যোগ দিয়েছিলো পরিবারের সাথে। ও তখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

ঝুমুরটা তখন কৈশোরে পদার্পণ করেছে৷ বয়স ষোলো কি সতেরো। খেলাধুলায় চঞ্চল আর পড়াশোনায় মাথামোটা ঝুমুর মায়ের কড়া শাসনের জন্য প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ততোটা আগ্রহী ছিলো না।
তবে কৈশোরকালীন সময়ে ফুটে ওঠা সৌন্দর্যে ভাসছিলো সে! গোলাপি গাল, টানা চোখ আর মিষ্টি হাসিতে অনিন্দ্য লাগতো ওকে! দেখলেই যে কেউ তাকিয়ে থাকতে বাধ্য!

রিসোর্টের পাশেই ছিলো বিশাল চা-বাগানের সমাহার। সেখানে কাজ করতো বাগানীরা। দু’বার পাতা তুলতো। তাদের বাসও এখানেই। ঝুমুররা এদিকওদিক ঘুরে এলো, দেখে এলো তাদের জীবনযাপন। তবে প্রকৃতির অবিরাম সৌন্দর্যের মাঝেই একটা কুৎসিত বিষয় ঝুমুর নিজমনে আবিষ্কার করতে পারলো। এখানে অনেক মাদকাসক্ত, পশু আচরণের মানুষ আছে। যারা মেয়ে দেখলেই নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। একদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে তিথির সাথে বাগানের শেষদিকের একটা ঝর্ণা দেখতে গেলো। রাতেই গোপনে ঠিক করে রেখেছিলো দু’জন। তবে ঘুরাঘুরির এক পর্যায়ে হুট করেই ওদের তিনজনকে ঘিরে ঘরলো একদল ছেলে-পেলে। কুৎসিত তাদের হাসি এবং দৃষ্টিভঙ্গি। ঝুমুররা বিপদ বুঝে পালাতে গেলেও পারলো না। তাছাড়া দুজনেই সেদিন ভীষণ ভয় পেয়েছিলো। এক বখাটে তো খুব বাজেভাবে ঝুমুরের গায়ে হাত দিয়েছিলো। ঝুমুর যখন কেঁদে ওঠে বলল, “আমাদের যেতে দিন, দয়া করে এমন করবেন না।”

তখন কুৎসিত মনের মানুষরুপী পশুগুলোর দল উত্তর দিলো, “তোমার মতো সুন্দরীরে যাইতে দিলে হয়? তুমি হইলা আকাশের চান, আইজ মাটিতে পাইছি। কেমনে যাইতে দিই? একটু তো আমাগো খায়েশ মিটাইবা নাকি গো?”

এসব কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে ঝুমুর ঘাবড়ে গেলো আরো। তিথি ভয় পেয়ে কান্না শুরু করলো জোরে জোরে। একজন ধমকে ওদের মুখবন্ধ করার চেষ্টা করলো কিন্তু থামানো গেলো না। তারা অতিষ্ঠ হয়ে আলোচনা করলো, “এই খুকিডারে ভাগাই দিই, বড়ডা তো আছেই।”

“একটার লগে আরো একডা ফিরি পাইছি মাম্মা, ছাড়ন যাইবো না।”

“আরে এমনে যে কানতেছে পরে যদি কেউ হুইনা ফালায়? তহন আমও যাইব, ছালাও। আমাগো তো নজর বড়ডার দিকে, আপাতত এইডারেই খা*।”

বলে বিশ্রি মন্তব্য করলো। হেসে ওঠলো সকলে। দৃষ্টি দিয়ে ছিঁড়েকুটে ফেলতে চাইলো ঝুমুরকে। বুঝলো এই লোকগুলো আগে থেকেই পরিকল্পনা করে এসেছে। এরমধ্যে একজনকে চিনতে পারলো ও, পরশুরাতে ঘুরতে বেরিয়ে এই ছেলের সাথে ঝামেলা হয়েছিলো ওদের। চায়ের দোকানে সব ভাইবোনরা যখন চা খেতে গেলো তখন এই ছেলে বারবার নোংরা দৃষ্টি দিচ্ছিলো ওর দিকে। তবে ব্যাপারটা কেউ খেয়াল না করে তাখলিফ করেছিলো। কষে একটা চড় মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলো সেখানে থেকে। এই ছেলেও কম না। কোথা থেকে ষণ্ডা পান্ডা নিয়ে এসে মুহূর্তেই বাগবিন্ডতা শুরু করে দিলো। তাখলিফ চায়ের কেটলি উলটে ফেলে দিলো ওর গায়ে। শাসিয়ে বলল,
“কু’ত্তার বাচ্চা। সাহস কত যে গ্যাং নিয়ে আসছিস! তোর চোখ উপড়ে নেবো। নামা নিচে…”

ইয়াসিফ গিয়ে অনেক কষ্টে সামলেছিলো তাখলিফকে। ঘুরাঘুরি বাদ দিয়ে রিসোর্টে ফিরেছিলো। এই ঘটনা অন্য কাউকে বলতে মানা করেছিলো ইয়াসিফ। তাখলিফ সেদিন ঝুমুরকেও প্রচন্ড ধমকেছে, “জামাকাপড় ঠিক থাকে না কেন তোর? আর একদিন যদি দেখি এমনে চলাফেরা করছিস কেটে জঙ্গলে পুতে দেব৷ ভাবিস না আমি ভালো, খু’নীর তকমা আছে।”

কখনো মাখোমাখো ভাই-বোনের আচরণ ছিলো না দু’জনের মধ্যে। তাখলিফের সাথে কথাই হতো না ঝুমুরের। চাচার একমাত্র ছেলেকে বড় ভাই হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। গলা উঁচু করে কথা বলা, আবদার করা কখনোই সেরকম কিছু হয়ে ওঠেনি। তবে সেদিন ঝুমুর সারারাত কেঁদেছিলো ওর বকাঝকার কথা মনে করে। ইয়াসিফ সান্ত্বনা দিয়েছিলো বোনকে। এখন বাগানে সেই বখাটে ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে আটকা পড়েই বিষয়টা মনে পড়ে গেলো ওর। মুহূর্তেই হাত-পা জমে স্থির! তিথিকে ওরা ছেড়ে দিয়েছে। ও দৌড়ে পগারপার। হয়তো রিসোর্টে ফিরে সবাইকে খবরটা দেবে কিন্তু ততক্ষণে? ততক্ষণে ওরা যদি ঝুমুরের সাথে বাজে কিছু করে তাহলে নিজেকে বাঁচাবে? একজন বিশ্রি হেসে জোর-জবরদস্তি করে ওর ওড়নায় হাত দিতেই ঝুমুর চোখে সবকিছু অন্ধকার দেখলো!

“কি হচ্ছে এখানে?”

আচমকা ভরাট অথচ পরিচিত কন্ঠটি শুনে ঝুমুরের প্রাণ ফিরে এলো যেন। দু’চোখ খুলতেই বেশ খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ানো তাখলিফকে দেখলো। সাতপাঁচ কিছু না ভেবে কান্নারত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠলো, “আমার সাথে ওরা বাজে কিছু করতে চায় তাখলিফ ভাই। আমাকে বাঁচান…”

তাখলিফ ঝুমুরকে দেখে হতভম্ব! এ এত সকালে এখানে কি করছে? তাও একা? বাড়ির লোকজন সব কোথায়? আশ্চর্য! মেয়ের কোনো খেয়াল নেই! ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো সাত-আটজনের দলটাকে। চা’য়ের দোকানের সেই চ্যাংড়া বখাটেকে দেখেই যা বোঝার বুঝে গেলো। মাথার সাথে সাথে রক্তও গরম হয়ে গেলো।রাগে হাত-পা নিশপিশ করতে লাগলো ওর। কি করা যায় ভাবলো! এতজনের সাথে পারবে না ও। তৎক্ষনাৎ একটা কথা মাথায় খেলে গেলো। ও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে সেলফোন বের করতেই ছেলেগুলোর মধ্যে একজন হেসে গালি দিয়ে বলে ওঠলো, “কি করিস শালা? ভিডিও করবি? কর, দেখি তোর কত দম। আজ এই সুন্দরীর সাথে সাথে তোরেও দেইখা নিমু…”

তাখলিফ একটুও ভড়কালো না। বরংচ শান্ত স্বরে বলল, “আমি তো পুলিশকে ফোন দিলাম।”

শুনেই বখাটেগুলো একে-অপরকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। সেই সুযোগে তাখলিফ বলল, “আসছে ওরা। বেশিক্ষণ লাগবে না। দেখ তোরা যদি পালিয়েও যাস, বাঁচবি না। আমি তোদের ভিডিও করে রেখে দিয়েছি। কোনো না কোনোভাবে ধর্ষণ মামলায় ঢুকিয়ে দেব।”

বখাটেরা হুড়মুড় করে পগারপার। ঝুমুর তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। তাখলিফ এবার রাগ নিয়ে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। মাটি থেকে ওড়না তুলে ঠাস করে চড় মেরে রুদ্রমূর্তি হয়ে ওঠলো, “এত সকালে মজা খাইতে আসছিলি? বেয়াদ্দব৷ কতবড় সাহস! আজ তোকে সত্যিই জঙ্গলে পুতবো। চল…”

বাকি কথা শোনার আগেই ঝুমুর চোখে অন্ধকার দেখলো। তাখলিফ ওকে দু’হাতে ধরে নিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল, “আমার সামনেই তোকে হেনস্তা হতে হয়, আর কাউকে পাস না?”

ঝুমুর অস্ফুটস্বরে “পানি খাবো।” বলেই জ্ঞানশূন্য হলো।

“আমি পানি সঙ্গে নিয়ে হাওয়া খেতে আসিনি।”
বিড়বিড় করে বলে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো ঝুমুরকে। এরপর হাঁটা ধরলো রিসোর্টের দিকে। কিছুদূর যেতেই দেখলো সকলে দলবেঁধে এদিকেই আসছে। ইয়াসিফ বোনের অবস্থা দেখে ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে?”

“অজ্ঞান হয়েছে। বখাটের খপ্পরে পড়েছিলো। এত
ছোট মেয়ে, এদিকসেদিক চলে যায়, দেখে রাখবি না? এখানে খারাপের অভাব নেই। যত্তসব…”

বিরক্তি নিয়ে বললো তাখলিফ। এরপর চললো রিসোর্টে। পাখি বেগম মেয়েকে এ অবস্থায় দেখে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরাতেই ঝুমুর মাকে জড়িয়ে মুখ গুঁজে কেঁদে বলল, “একা আর কখনো যাব না ওদিকে।”

_________

[বড় পর্ব।]

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। পরীক্ষা চলছে, তাই দেরি। দুঃখিত।]

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here