#হিয়ার_মাঝে ৬
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
ত্রিমুখী রাস্তার মোড়। স্কুলের রাস্তায় পা’ রাখতেই আবুল চাচার দোকান থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল। নুবাহ থমকাল। আঁড়চোখে দেখল, বাবলু তাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। সাথে চামচিকাগুলাও দাঁত কেলিয়ে হাসছে। একজন তাকে পিছু ডেকে উঠল, আরে ভাবীজান কেমন আছেন? আম’গো ভাইরে মিস করতে করতে দেহি একবারে শুকাইয়া গেলেন গ্যা। চিন্তা কইরেন না ভাবী, আমগো ভাই খাওয়াই খাওয়াই মোটা বানাই দিবো।
বাবলু এসব কথা নির্দ্বিধায় গিলছে। মুখে হাসি ঝুলছে। তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখনও। নুবাহর এক জঘন্য অনুভূতি হচ্ছে। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। পায়ের গতি বাড়িয়ে ধুপধাপ শব্দ করে দ্রুত স্কুলের দিকে পা বাড়াল।
গজগজ করতে করতে ক্লাসে ঢুকল। তমা তাকে দেখে কপাল কুঁচকাল।
‘কি’রে মুখ এমন পেঁচার মত হয়ে আছে কেন?’
‘ঐ মদনার বাচ্চার সাথে থাকা চামচিকাগুলা আরও অ,সভ্য। কিসব বাজে ইঙ্গিত করে। গা কেমন রি রি করছে।’
তমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘চিন্তা করিস না। এগুলোর একটা বিহিত করব, দাঁড়া।’
লিমা আজ তাদের পাশে বসেছে। জেবা, রেবা দুই কাজিনও আছে। লিমা নুবাহকে ডাকল। তার হাতে থাকা একটা গিফট বক্স দিল। নুবাহ ‘হা’ হয়ে আছে। এটা কিসের বক্স লিমা। লিমার মুখে মুচকি হাসি। মিষ্টি গলায় বলল, এটা নিভান আর নীলাভের জন্য। নুবাহ ইস্ততঃবোধ করছিল। নিতে চাইল না। কিন্তু লিমা বেশ জোর করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। তমা নুবাহকে বলল, নিয়ে নেয় এটাই সুযোগ। দুইদিন পর লিমা হাওয়া হয়ে যাবে। তখন আর খুঁজে পাবি না। এখন যা খাইতে পারিস।
এটা শুনে সবাই খিলখিল করে হেসে দিল।
নুবাহ চুপিচুপি সাজেশন দেখাল তমাকে। সে দেখে ‘হা’ করে বসে আছে। কৌতুহলী দৃষ্টিতে বলল, কোথায় পেলি?
নুবাহ সত্যিটা বলল না। উল্টো ঠোঁট বাঁকাল। ‘টপ সিক্রেট’।
তমার সন্দিহান দৃষ্টি এবার।
‘কে এই দয়াবান, তোর মত বদ মহিলাকে এত সুন্দর করে সাজেশন বানায় দিল।’
নুবাহ রাগে ফুঁসে উঠল।
‘আমারে একদম বদ মহিলা বলবি না, মিস তামা তামা।’
তমা নুবাহর বাহুতে দুই আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরল। টিপ্পনী মেরে বলল,
‘সত্যিটা বলবি নাকি আমার সেই বিখ্যাত চিমটি টা দিমু।’
এই ম্যাইয়া ডাকাত থেকেও কম না। একবার যদি চিমটি দেয় সারাদিন হাত ব্যথা করবে তার। কিন্তু এখন সত্যিটা বলবেও না। নুবাহ অজুহাত ধরল,
‘স্কুল থেকে যেতে যেতে বলব। আসলে অনেক লম্বা গল্প তো, এখানে বলা যাবে না।’
তমা কিছুটা শান্ত হল। কিঞ্চিৎ মাথা নাড়িয়ে বলল, ঠিক আছে মনে থাকে যেন।
_______________
স্কুল থেকে ফিরে মাত্রই বাড়ি প্রবেশ করতে যাবে নুবাহ। হঠাৎই চোখ পড়ল বাচ্চা একটি ছেলের উপর। ছেলেটা নীলাভের বয়সী। কিন্তু সে তার বোনের সাথে ঝগড়া করছে কেন? সে হিরোইনের মত এন্ট্রি নিল। হুংকার ছাড়ল সবার উদ্দেশ্য।
‘কি ব্যাপার! কি হচ্ছে এখানে।’
নীলাভ বোনকে দেখে খুশিতে আটখানা। মনে বেশ জোর পেয়েছে। তাই ভণিতা না করেই বলল,
‘আপু রাফি ক্লাশে আমার খাতা ছিঁড়ে ফেলেছে। সে কথা আমি মিসকে বলেছিলাম। সেজন্য মিস ওকে বকেছিল। তাই রাস্তায় এসে আমার সাথে ঝগড়া করছে। আবার আমায় হুমকিও দিচ্ছে। আমাকে না’কি নালায় ফেলে দিবে। ছেলেটা বড্ড খারাপ, সব স্টুডেন্টের সাথে ঝগড়া করে শুধু।’
নুবাহ ছেলেটির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ‘কি ব্যাপার! রাফি এগুলো কি শুনছি। আমি কি এখন তোমার আম্মুকে ডাকব, নাকি তুমি ডাকবে? রাফি ভয়ে আৎকে উঠল। গলার স্বর ভীষণ কাঁপছে। না আপু, আমি আর করব না। নুবাহ ধমক দিল। মনে থাকবে এ কথা। রাফি হ্যাঁ’ বলে উপর নিচ মাথা নাড়াল। নুবাহ এবার শান্ত গলায় বলল, আজ থেকে তুমি নীলাভকে আপু ডাকবে। ঠিক আছে।
রাফির চক্ষুদ্বয় বড় বড় হয়ে গেল। আমতা আমতা করল, ‘কিন্তু নীলাভ তো আমার ছোট।’
‘এটাই তোমার শাস্তি।। আর যদি না ডাকো, তাহলে তোমার আম্মুকে গিয়ে বলব। রাফি নীলাভকে নালায় ফেলে দিয়েছে। তখন তোমার শাস্তি আরও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এবার ভেবে দেখ, তুমি কি করবে?
কথাগুলো বলেই নুবাহ আর নীলাভ ভাব দেখিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। রাফি কিছু সময় পর পিছু ডাকল। ধরা গলায় বলল,
‘আজ থেকে নীলাভকে আপু ডাকব কিন্ত ক্লাসে ডাকব না। ক্লাসে ডাকলে সবাই হাসবে।’
নুবাহ ফের বলে উঠল, ‘তা তো হবে না। তোমাকে সবসময় আপু ডাকতে হবে। নয়ত তোমার আম্মুকে গিয়ে এখনি বলব সব।’
রাফি এবার চোখের জল ছেড়ে দিল। নাক টেনে বলে উঠল, ‘আপু আমি আর কখনও নীলাভকে মারব না। তার খাতাও ছিঁড়ব না। আমাকে মাফ করে দেন।’
নুবাহ কিছুক্ষণ চুপ থাকল। ফের বলল,
‘ঠিক আছে, যাও মাফ করলাম। তবে আজীবন যেন আজকের কথা মনে থাকে।’
রাফি হ্যাবলার মত চেয়ে আছে। আজকে সে চরম শিক্ষা পেয়েছে। নুবাহ বোনের হাত মুষ্টিবদ্ধ করল। দু’জনেই বিজয়িনীর বেশে বাসায় ফিরল।
_________________
বিছানায় গা এলিয়ে বসল নুবাহ। বক্ষস্থল ভীষণ কাঁপছে। আনমনে বিড়বিড় করল, ইমদাদ। নামটা ভীষণ সুন্দর। নামের মত তার সব পছন্দও। বালিশ ঝাপ্টে ধরে শুয়ে পড়ল। দু’চোখ বন্ধ করতেই মুঠোফোনে টুংটাং শব্দ হল। হঠাৎ মুঠোফোনের টুংটাং শব্দে তার চোখ খুলে গেল। দেখল অনাকাঙ্ক্ষিত একটা মেসেজ।
❝My Dear’s Student, তুমি পার্সেল পেলে আমাকে দ্রুত জানাও। আর কখন ফ্রি থাক, তার সিডিউল’টা বল। যাতে তোমায় পড়াতে পারি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত তোমার অধম টিচার। ❞
মেসেজ পড়ে পুরাই তব্দা নুবাহ। তার নিজের একজন টিউটর প্রয়োজন। কিন্তু এ সুযোগ নেওয়া আদৌ ঠিক হবে কি। উদ্ধিগ্ন দু’চোখের পাতা আপনা আপনি মুদে এল। কিন্তু নিজের থেকে কোন উত্তর এল না। এক মন হ্যাঁ’ বললে অন্যমন না’ বলে উঠে। সিদ্ধান্তহীনতায় যখন ভুগছিল। আনমনে বিড়বিড় করল।
‘হোক না কিছু ক্ষতি, যদি তা উপকারে আসে।’
অবশেষে সিডিউল তৈরি করল।
‘আপনার পার্সেল পেয়েছি। তবে আমি বিকেল তিন’টা থেকে চার’টা আর সন্ধ্যা সাত’টা থেকে আট’টা। এ সময় ফ্রি থাকি। কিন্তু আমি মেসেজ/কল না দিলে আপনি কল দিবেন না। ব্যক্তিগত কোন কথাও জিজ্ঞেস করতে পারবেন না। বাহ্যিক গল্পও করা যাবে না। কল কেটে গেলে ভুল করে দ্বিতীয়বার কল করবেন না। যদি আমি আপনাকে দ্বিতীয়বার কল না দেই। এসব শর্তে রাজি থাকলে তাহলেই আমি আপনার কাছে পড়ব, নয়ত না’।❞
মেসেজের উত্তর দিতে না দিতেই কল। খুকখুক করে কেশে উঠল নুবাহ। বক্ষস্থলে হাত চেপে আছে এখনো। রিসিভ করে বলল,
‘এত তাড়াতাড়ি কল।’
অপর পাশে মুচকি হাসির শব্দ হল।
‘ফ্রি আছ দেখে কল দিলাম। আচ্ছা, তোমার WhatsApp আছে।’
নুবাহ ইস্ততঃবোধ করল। জড়ানো গলায় বলল,
‘আসলে আমার বাটন ফোন। স্মার্টফোন আম্মুর কাছে আছে। তবে পরীক্ষার জন্য আমার ধরা নিষেধ।’
‘আচ্ছা, কোন সমস্যা নেই। আমি তোমাকে মেসেজ এ বলব, নয়ত কল দেব।
হুমম বলে নুবাহ কল কাটল। দু’চোখের পাতায় ঘুমে’রা হানা দিল। রাতেও টুকটাক কথা হল মেসেজের মাধ্যমে। এভাবে শুরু হল তাদের গল্প।
_____________
মধ্যরাত। সুনশান নিরাবতায় আছন্ন। আচমকাই মুঠোফোন কম্পিত হল। নুবাহ অবাক হল। আজকে আরও এক অপরিচিত নাম্বার। এত অপরিচিত নাম্বার তার ফোনে কোত্থেকে আসল। অবাকের চরম শিখরে। কলটা রিসিভ করে কথা বলল না। শুধু শুনতে চাইল কে হতে পারে। রিসিভ করতেই কেউ একজন কর্কশ শব্দে কথা বলল,
‘এতবার কল দিলাম রিসিভ কর না কেন?’
নুবাহ অবাক হল। কখন কল দিল। হঠাৎই মনে হল। কিছু অপরিচিত নাম্বার দেখছে কয়দিন ধরে। এগুলো কার হতে পারে। তার ভাবনার মাঝে একটা শব্দ ভেসে এল।
‘বউ কথা বলও না ক্যা?’
নুবাহর মেজাজ বিগড়ে গেল। দু’শব্দের গালি দিয়ে কল কেটে দিল। কিন্তু তাতেও লাভ হল না। পুনরায় কলের বহর আসা শুরু হল। সহ্য হল না তার। দ্রুতই ফোন অফ করল।
চলবে,,,,,,,,