#হিয়ার_মাঝে ১০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
বাড়ি ফিরল দ্রুতই। ক্ষুদেবার্তা পেয়ে তার মন অস্থির হয়ে ছিল। ফিরে আসতেই শীতলতা অনুভূত হল নুবাহর। কথা বলতে ব্যাকুল হয়ে আছে সেই তখন থেকে। দীর্ঘ সময় পর সতেজ নিশ্বাসে বক্ষস্থল হালকা হল। মুখের কোণে লাজুক হাসি ঝুলছে। বিছানায় শুয়ে মুঠোফোন হাতে নিল। ত্বরিত ছোট্ট এক বার্তা পাঠাল।
“কেমন আছেন অধম টিচার।”
মূহুর্তের মাঝে ফিরতি ফোনকলে কম্পিত হল তার মুঠোফোন। রিসিভ করতেই উদ্বিগ্ন ভরা নরম সুর ভেসে এল,
‘কেমন আছ? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি? আজ এত দেরি হল কেন তোমার উত্তরের?’
এক সাথে এত প্রশ্নের বহর দেখে নুবাহ কিঞ্চিৎ বিচলিত হল। দ্রুতই জবাব দিল।
‘বান্ধুবীর বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল আজ। তাই বাড়ি আসতে দেরি হয়েছে। সর্যিই স্যার!’
ইমদাদ কপাল কুঁচকালো। কিন্তু অপর প্রান্তে থাকা নুবাহর জানা হল না সেই কপাল কুঁচকানোর কারণ। ভেজানো নরম গলা তার,
‘কিছু কথা জিজ্ঞেস করব? সত্যি বলবে তো! বাবলু নামে তোমাকে কেউ বিরক্ত করে, নুহা?’
নুবাহ চমকালো। সহসাই এমন প্রশ্নে কিঞ্চিৎ গলার স্বর কম্পিত হল।
‘আ,,আপনি কিভাবে জানেন?’
‘আগে বল, তোমাকে বাবলু নামে কেউ বিরক্ত করে?’
কিয়ৎক্ষন ভাবল নুবাহ। বলা উচিৎ হবে, না’কি হবে না। আমতা আমতা করল,
‘আ,,আসলে মাঝেমধ্যে বিরক্ত করে। এই আর কি? তেমন সি,,সিরিয়াস কিছু না।’
‘তুমি সত্যি বলছো তো।’
‘হুমম।’
‘তবে একটা কথা বলি, সাবধানে থেকো। যদি পারও তোমার মোবাইল নাম্বার চেইঞ্জ করে ফেল।’
‘কিন্তু কেন?’
‘কারণ, বাবলু মির্জা বিভিন্ন মোবাইল নাম্বার থেকে তোমাকে বিরক্ত করবে, তাই বলছিলাম আর কি?’
নুবাহ আৎকে উঠল। মোবাইল নাম্বার চেইঞ্জ করবে! এই কথা জানলে হাজার’টা প্রশ্ন করবে তার জ,ল্লাদ বাপ। কেন? কি জন্য? এই ছেলে নাম্বার পেল কিভাবে? তখন তো অধম টিচারের সাথেও কথা বলা বন্ধ হয়ে যাবে তার। ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘অসম্ভব! মোবাইল নাম্বার চেইঞ্জ করা যাবে না। উল্টো আব্বু আমাকে খারাপ ভাব্বে। অন্য কোন উপায় বলুন। কি করা যায়?’
‘আচ্ছা তাহলে একটা উপায় আছে। যেই নাম্বার থেকে কল আসবে সাথে সাথে ব্লক করে দিবে।’
‘ব্লক কেমনে করে? আমি তো জানি না।’
‘আচ্ছা, আমি শিখিয়ে দিব। ঠিক আছে। এখন ঘুমাও। তোমার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম, সর্যিই!’
পুরাই থ’ নুবাহ। এভাবে সর্যিই বলার কি দরকার। মাত্র দু’মিনিট কথায় তো বলেছে। এ আর এমন কি। বিড়বিড় করল আপনমনে। কল কেটে গেছে কিছু সময় পূর্বে। তার বিড়বিড় করা কথা অপর পাশে পৌঁছালো না। বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। মূহুর্তের মধ্যে ঘুমের অতলে পাড়ি জমালো সে।
গোধূলির লালচে-ধূসর রঙা গগন বক্ষ। রুকাইয়া চুলায় চায়ের পাতিল বসিয়েছে। বিকেলের নাস্তা হতেই ছেলে-মেয়েদের হাঁক ছাড়লেন। নীলাভ নিভান এসে হাজির হলেও নুবাহ ছিল অনুপস্থিত। বোনকে না দেখে নিভান এলোমেলো কদমে ছুটল তার রুমের দিকে। নুবাহ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিভান নানা কসরত করল। কিন্তু বোনের সাড়া পেল না। সময় পেরুলো অনেকক্ষণ। হঠাৎই চোখ খুলল নুবাহ। নিভানের দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় নিদ্রারত নুবাহর অবশেষে সাড়া পেল। নিভান আধো বুলিতে বলে উঠল,
‘নিতাত, আম্মু দাকে তো। উতো না। নাস্তা তাবে না।’
নুবাহ ভাইয়ের ডাক শুনে হাসল। আলতো করে মাথায় হাত বুলালো। ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
‘তুমি যাও, আমি আসছি।’
নিভান নাছোড়বান্দা। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে বোনকে ছাড়া যাবে না। নুবাহ অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দু’চোখের পাতায় তখনো ঘুমের রেশ রয়ে গেছে।
_________
সময় বাড়ল। দিন গড়ালো সপ্তাহের মাঝে। ইদানিং বাবলুকে স্কুলের সামনে দেখা যায় না। নুবাহ বেশ সাচ্ছন্দ্যবোধ করল। যাক এই আপদ তাহলে দূর হয়েছে। তার অধম টিচারের সহায়তায় পড়াশোনার গতি বেড়েছে বহুগুণ। আতঙ্কের আরেক নাম ছিল ম্যাথ নামক বিষয়’টা। কিন্তু আজকাল ম্যাথ তার প্রিয় এক বিষয় হয়ে উঠেছে। বেশ সানন্দে নিজে অংক কষে। এভাবেই তার সময় কাটছে। প্রায় দশদিন পর এল আরেক ভয়ংকর দিন।
সেদিনের সেই মূহুর্ত ভাবলে আজও গা শিউরে উঠে নুবাহর। দিনটা বৃহস্পতিবারের এক উষ্ণময় দিন। কোচিং শেষে বাড়ি ফিরছিল সে আর তমা দু’জনেই।
ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে দু’জন মাত্র। মধ্যাহ্নের সময় রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে প্রায়। তার মধ্যে এসময় অটোরিকশা পাওয়া বেশ দুর্লভ। অগত্যা হেঁটে স্কুল থেকে বাড়ি যাচ্ছিল তারা। কিছুদূর যেতেই পেছন থেকে এক তেজী কন্ঠস্বর ভেসে এল। দু’জনের পায়ের কদম থেমে গেল। পিছনে থাকাতে দেখল বাবলু মির্জা তাদেরকে ডাকছে। নুবাহ বাবলুর আপাদমস্তক ভালো করে দেখল। আজকের পোশাক বেশ ভিন্ন। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী। চোখের মাঝে কালো চশমা। আজ পারফিউমের মিষ্টি সুগন্ধি ভেসে আসছে তার থেকে।
‘কেমন আছো নেশারানী। বাড়ি যাচ্ছো বুঝি?
দু’বাক্যে বলেই দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠল বাবলু।
নুবাহ, তমা রীতিমতো হতভম্ব। দু’জনের দৃষ্টিতে আজ ভয়ের আভাস। তমা অভয় দিল ভয় পাস না, আমি আছি তো। পাশে চোখ বুলাতে দেখল বাবলু আজ একা নয় পাশে তার দু’জন চামচিকাও আছে। কিন্তু খটকা লাগল অন্য এক বিষয় নিয়ে। তাদের থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে একটা কালো প্রাইভেট কার দেখে। সময়’টা মধ্যাহ্ন বলে লোক সমাগম একদমই নেই। তার উপর স্কুল মেইন শহর থেকে সামান্য একটু দূরে। তারা যেখানে আছে এটা নির্জন এলাকা। তমা অভয় দিলেও নুবাহ বেশ বুঝল। তমাও কিঞ্চিৎ ভয় পাচ্ছে। দু’জনেই সন্দিহান। বাবলুর মতলব’টা কি? কি করতে চাইছে আজকে?
বাবলু আরও দু’কদম এগিয়ে এসে নিজের দূরত্ব কমাল। নুবাহর সামনে আসতেই তমা জবাব দিয়ে উঠল।
‘পথ আগলে কেন দাঁড়িয়েছেন বাবলু ভাই?’
‘প্রেম করতে’
বাবলুর সোজাসাপ্টা জবাব।
পাশে থাকা তার চামচিকারা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, চাইলে বেয়ান তুমিও আমাদের সাথে প্রেম করতে পার। তারপর বত্রিশ দন্তপাটি দেখিয়ে সেই কি এক বিকৃত হাসি তাদের। রাগে আর ঘৃণায় শরীর রি রি করছে তমার। কিন্তু মনের মাঝে কিঞ্চিৎ ভয়ও উদয় হচ্ছে। নুবাহ তমার হাত শক্ত করে ধরল। নিজমনে বিভিন্ন কু-চিন্তা হানা দিল। ভাবতেই শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল তার।
বাবলু পায়ের কদম আবারও বাড়াল। নুবাহর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি তার। ঠোঁটের কোণে ঝুলছে এক বিকৃত হাসি।
‘নেশারানী, তোমার লগে আমার কিছু প্রাইভেট কথা আছে। একটু এইদিকে আইবা।’
বাবলুর এমন প্রস্তাব শুনে নুবাহ শুকনো ঢোক গিলল। আশেপাশে মানুষজন কেউ নেই। এমন নির্জন জায়গায় দু’জন মেয়ে তারা। ভয়টা চেপে ধরল ভীষণভাবে।
নুবাহর নিশ্চুপতায় তমা জবাব দিল।
‘ওর সাথে কিসের কথা বলবেন বাবলু ভাই। যা বলার এখানেই বলেন।’
বাবলু তমার কথায় বিশেষ গুরুত্ব দিল না। সোজা নুবাহর সামনে দাঁড়াল। তার দিকেই স্থিরদৃষ্টি, ‘আমি তোমার লগে কথা কইতাছি নেশারানী। তুমি কি স্বইচ্ছায় যাবা না’কি তোমায় জোর কইরা নিয়া যাইতে হবে।’
নুবাহ আৎকে উঠল। সহসাই বক্ষস্থল কেঁপে উঠল ভীষণভাবে। শরীর অসাড় হওয়ার উপক্রম। নিশ্বাসের শব্দও ভারী হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘কি,,কি ব,,বলবেন এখানে বলুন।’
বাবলু আরও দু’কদম পা বাড়াল। রগড় গলায় বলে উঠল, ‘সবকিছু কি সবার সামনে কমু না’কি? প্রাইভেট কথা আমগো দুজনের, তাও শুনতে চাইছো যহন বলি। আইজগা দু’জন মিইলা ঘুরম, গল্প করুম, রেষ্টুরেন্টে খামু। আরও মেলা কিছু আছে। সব তো আর এহানে বলা যাইব না।’
কম্পিত গলায় আবারও জবাব দিল নুবাহ। ‘দেখুন দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। বাড়িতে সময় মত না গেলে আম্মু চিন্তা করবে। অন্যদিন না হয় যামু আপনার সাথে।’
বাবলুর মুখে তাচ্ছিল্যের সুর।
‘সামনে দেখলে কথা কও না। ফোন দিলেও কথা কও না। এখন তো আবার তোমার নাম্বারে আমি কলও দিতে পারি না। আমার সবগুলো নাম্বার ব্লক কইরা দিছ। দীর্ঘ এক বছর ধইরা তোমার পিছনে কুত্তার মত ঘুরতাছি। আর তুমি আমারে পাত্তাই দাও নাই। উল্টো খারাপ ভাষায় গালি দিছ। অহন যা ভাবার ভাইবা নিছি।’
‘কি করবেন আপনি?’
মদনা দুই হাত কোমরে গুজে নিল। রক্তিম অক্ষিজোড়া। কিন্তু মুখে আক্ষেপের সুর।
‘আমি কি দেখতে এতই খারাপ। তবে তুমি আমারে পছন্দ কর না ক্যান। তয় এখন পছন্দ কর আর না কর সেটা দেখার বিষয় না। এবার সবকিছু আমার নিজের ইচ্ছায় হইব। যেটা আমার, সেটা আমি যেভাবে হোক আদায় করেই ছাড়ব।’
‘আদায় করবেন মানে, কি করবেন আপনি?’
বাবলু ভাবলেশহীন। মুখে ক্রুর হাসি।
‘বিয়ে করব, তাও আজকেই। তারপর দেখবে আমি কি করতে পারি।’
এহেন বাক্যেই ধ্বক করে উঠল নুবাহর বক্ষস্থল। ভয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল তার। দু’পাও কাঁপছে ভীষণ। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। উত্তরে কি বলবে ভাষা খুঁজে পেল না। সময়’টা বড্ড অশুভ মনে হচ্ছে এখন। এরপর কি হবে তার জানা নেই। শুধু মনে হচ্ছে এই বুঝি সে চৈতন্যহীন হবে।
পাশে থাকা তমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। সে রুক্ষভাষায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ফাইজলামী পাইছেন। যা খুশি তা করবেন। এখান থেকে যাবেন নাকি মানুষ ডাকব।’
বাবলু বেশ মজা পেল তমার কথায়। পাশে থাকা চামচিকাদের সাথে সেও উচ্চশব্দে হেসে উঠল। সবার মুখে কুটিল হাসি। তাদের মাঝ থেকে একজন বলে উঠল, মানুষ আসতে আসতে ততক্ষণে বিয়ে হয়ে বাসরও হয়ে যাবে। বেয়াইন একটা কথা আছে না, ডাঃ আসিবার আগে রোগী মরিয়া গেল।’ এটা বলে আবারও এক বিকৃত হাসি দিল সবাই।
বাবলুর কথায় ভীত তটস্থ দু’জন। আচমকাই শব্দ করে কেঁদে দিল নুবাহ। ত্বরিত মদনার পা ধরে বসল। কান্নামিশ্রিত অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, ‘বাবলু ভাই আমারে একটু সময় দেন। অন্তত আমার পরীক্ষা পর্যন্ত। এরপর আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব। এটুকু কথা রাখুন না বাবলু ভাই। প্রতিজ্ঞা করছি রোজ দু’ইশবার আপনার সাথে কথা বলব। আজকের মত মাফ করে দেন। আর আপনারে কোনদিন এড়িয়ে যামু না।’
এমন কথায় বাবলু অবিশ্বাস্য নজরে তাকাল নুবাহর দিকে। মুখে তাচ্ছিল্যের সুর টেনে বলল,
‘আমি ভালো করেই জানি, তুমি আমার কথা কেমন শুনবা। আজকে ছাইড়া দিলে কালকের পর তোমাকে খুঁজেও পাওন যাইব না। আর কোন সময় দেয়া যাইব না। বিয়ে তো আজকেই হইব, নেশারানী।’
কথা শেষ করে বাবলু তার চামচিকাদের ডাকল। চল দু’জনকেই উঠিয়ে নিই। একজন সাক্ষীরও প্রয়োজন আছে। আবার নুবাহর দিকে তাকাল। বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে নেশারানী। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নুবাহ, তমা নির্লিপ্ত দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল দু’জন।
চলবে,,,,,,,,