#হিয়ার_মাঝে ৩২.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
দরজার চৌকাঠে দন্ডায়মান জিতুকে দেখে সবাই হতভম্ব। শেরওয়ানি রেখে কালো স্যুট কোট পরেছ। তবে কালো স্যুটে তার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু বিয়ের শেরওয়ানি না পরায় সবাই কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন। বন্ধুমহলের বাকি’রা সোনালি রঙা একই বর্ণের শেরওয়ানি পরিহিত। জিতু বর তাই ওর শেরওয়ানিতে সামান্য ভিন্নতা ছিল। কিন্তু এই ছেলে সবার ইচ্ছেতে এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছে। বন্ধুমহলের বাকি’রা একে অপরের দিকে মুখ চাউয়া-চাউয়ি করছে। চিন্ময় মুখে হতাশার সুর তুলল,
‘বহুত আফসোস করবি পরে, যখন হুরপরীর সাথে কালো আমসত্ত্বকে দেখবি।’
মুবিন চিন্ময়কে থামানোর জন্য তার কাঁধে হাত রাখল। ইশারায় চুপ থাকতে বলল। জিমান মুখ টিপে হাসল। সানি রকি কিছু বলার জন্য হাসফাস করছে। কিন্তু মুবিনের কঠিন চাউনি দেখে বলার সাহস পেল না। আজমল নিচে বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। আচমকাই নিজের ছেলেকে বন্ধুদের সাথে নামতে দেখে উচ্ছ্বসিত হল। অবশেষে ছেলে রাজি হয়েছে। ফরিদা ছেলেকে মিষ্টিমুখ করার জন্য ক্ষীর বানিয়ে বাটিতে সাজিয়ে রেখেছেন। ছেলে তার নতুন জীবনে পা রাখবে, ভাবতেই চোখের কোণে জল জমল। কবে তার ছোট্ট জিতু বড় হয়ে গেল বুঝতেই পারল না। সোফায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো দু’জনেই। দিলারা হুইলচেয়ার চেপে এগিয়ে এল। নাতী তার বউ আনতে যায়। নিজচক্ষে দেখবে নাতী যাওয়ার বেলায়। দাঁত বিহীন চোয়ালে আলাদা দাঁত বসানো। সেই আলাদা দাঁত বের করে তিনি হাসছেন। নাতীকে আজ রাজপুত্রর মত লাগছে। এবার ভালোয় ভালোয় রাজকন্যা নিয়ে আসলেই হয়।
জিতু বাবা মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দু’জনকে একসাথে সালাম দিল। আজমল এগিয়ে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন। ফরিদা বাটি থেকে ক্ষীর ছেলের মুখে তুলে দিল। কোন বাক্যে বিনিময় ছাড়া ক্ষীর খেয়ে নিল সে। পাশে থেকে দিলারা কাছে ডাকলেন। জিতু হাটু মুড়িয়ে দাদুর পাশে বসল। মুখের কোণে হাসি ঝুলছে দিলারার। তিনি নাতীর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আফী ভাই জলদি কইরা আমার সতীন’রে নিয়া আইসো। সেই কবে থেইক্যা সতীন’রে দেখার লাইগা মনটা হাসপাস করতাছে। তয় সতীন’রে আইজকে রাইতে কিন্তু তোমারে দিমু না। আমার লগে রাখুম, কইয়া দিলাম।’
জিতু হুট করে বলে উঠল, ‘একরাত কেনো সারাজীবনের জন্য রেখো দিও। আমার লাগবে না।’
দাঁতের মাড়ি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে আকস্মিক দিলারা শব্দ করে হেসে উঠল। বাকি’রা জিতুর কথা না শুনলেও আন্দাজ করে নিল দু’জনেই কিছু একটা নিয়ে মজা করছে। আজমল ছেলেকে গাড়িতে উঠতে বললেন। জিতু নিজের বন্ধুদের সাথে গাড়িতে উঠল। বড়সড় গাড়ি। অনায়াসেই দশ/বারো জন মানুষ বসতে পারবে। তাও জিতুর হাসপাস লাগছে। কেমন অস্থির হয়ে আছে তনুমন। এত কিছুর ভীড়েও এক শুভ্র মুখশ্রী ভেসে বেড়াচ্ছে। না চাইতেও সে এসে হানা দিচ্ছে বার বার। কেন এমন হচ্ছে তার জানা নেই। তার ইচ্ছে করছে এই মেয়েকে গিয়ে শাসাতে। এই মেয়ে একদম আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করবে না। তোমার জন্য আমি ঠিকভাবে ঘুমাতে পারি না। এভাবে আমাকে জ্বালানোর জন্য তোমার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু নিজের বিয়ের কথা ভাবতেই আবার মন বিষন্নতায় চেয়ে গেল। এত কষ্ট কেন হচ্ছে তার জানা নেয়। নিশব্দে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
চিন্ময় আচমকাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘গাড়ি থামান ড্রাইভার চাচা। কি দুর্গন্ধময় বায়ু ছাড়ল রে, গাড়িতে বসায় দায় হয়ে গেছে। একটু সতেজ নিশ্বাস নিমু। জলদি থামান তো।’
জিতু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এরকম বন্ধু থাকলে শত্রুর দরকার নাই। এক একটা হাড়বজ্জাত। গাড়ি থামাতেই সেও নেমে পড়ল। ড্রাইভার গাড়ির মধ্যে এয়ারকুলার ছেড়ে দরজা জানালা খুলে দিলেন। যাতে দুর্গন্ধ দ্রুতই চলে যায়। জিমান সানি রকির দিকে তাকাতেই রকি তড়িৎ বলে উঠল,
‘আল্লাহর কসম, বিশ্বাস না হলে দেখ পশ্চিম দিকে ফিরা কইতাছি, আমরা এমন আকাম করি নাই।’
জিমান নিজের চিবুকে হাত রেখে বলে উঠল, ‘তাহলে আকাম’টা কে করছে? সত্যিই করে বল।’
সানি হুট করে বলে উঠল, ‘ঐ গন্ধের মধ্যে আমার নাকে বিরানির গন্ধ লাগছে। নির্ঘাত বিরানি খাইয়া এমন আকাম’টা করছে সে।’
মুবিন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘দুপুরে আমরা সবাই বিরানি খাইছি, সানলাইট।’
হুট করে সবাই জিতুর দিকে তাকালো। জিমান বলে উঠল, ‘তুই বিকেলে পিৎজা খাইছিলি, সাথে ডিঙ্কসও ছিল কিন্তু।’
জিতু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। দু’চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘আমি একা খাইছি না’কি, সাথে চিন্ময়ও ছিল। ও তো আমার থেকে আরও বেশি খাইছে। দেখ গিয়ে, আকাম’টা সেই সারছে।’
জিতুর থেকে চোখ সরাতেই দেখল চিন্ময় পেটের মধ্যে এক হাত চেপে রেখে হাসতে হাসতে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। সানি রকি এবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেখ কে আকাম’টা করছে। গ্রুপে কিছু থেকে কিছু হইলেই সবাই ভেটকি মাছের মত আমাগো দিকে চাইয়া থাকস। এখন দেখ, কে করছে।’
জিমান চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুই নামেই হিরো, কিন্তু কাম করছ ভিলেনের মত। তোর জায়গা এখন ড্রাইভার চাচার সাথে। আমাদের সাথে বসবি না আর।’
মুবিন পকেট থেকে একটা ইনু বের করে হাফ বোতলে ঢেলে কিছুক্ষণ ঝাঁকিয়ে নিল। বোতল’টা চিন্ময়ের হাতে দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নেয়। পেটের গ্যাসের সমস্যা দূর হবে।’
আগের মত সবাই গিয়ে গাড়িতে বসল। বসার আগে চিন্ময়কে ১৪৪ ধারা জারি করা হল। পরের বার আকাম করলে গাড়ি থেকে উষ্ঠা মেরে বাইর করে দেয়া হবে। কিন্তু চিন্ময় পেট চেপে এখনো হেসে যাচ্ছে। বাকি’রা নিজমনে দোয়া পড়ছে। ভালোয় ভালোয় বিয়ে’টা যেনো হয়। জিতু কপালে এক হাত ঠেকিয়ে বসেছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে আবার। সহসাই গাড়ির ভেতর মৃদু শব্দের বাংলা গান বেজে উঠল।
‘আজ বলবে হঠাৎ কেউ এসে
আলতো হেসে চোখে চোখে,
তোর জন্য এসেছি আমি
ভালোবাসতে যে তোকে।’
______
কৃত্রিম আলোকসজ্জায় আলোকিত কনভেনশন হল। একে একে বন্ধুমহলের সবাই গাড়ি থেকে নামল। গাড়ি থেকে নামতেই জিতুর চোখ ছানাবড়া। তার বাবা লুকিয়ে কত কি আয়োজন করেছে। সে’তো এত কিছুর কথা জানেই না। অতিথিতে গমগম করছে পুরো কনভেনশন হল। প্রবেশদ্বারে গুটিকয়েক মেয়ে দেখা যাচ্ছে। পরনে লাল নীল হলুদ রঙা লেহেঙ্গা। রংধনুর মত সাতরঙে রঙিন মেয়েদের দল। জিতুর কিঞ্চিৎ লজ্জা লাগছে। সত্যিই তার বিয়ে! ধীর কদমে বন্ধুদের সাথে হেঁটে প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়াল। জিতু মাথা নিচু করে আছে। সামনে ফিতা ধরা। এই ফিতা কেটে তবেই প্রবেশ করতে হবে। ওপাশ থেকে ফিসফিসানির শব্দ ভেসে এল। বর কোনটা? জিতু ছাড়া বাকি’রা শেরওয়ানি পরিহিত। সবার সামনে চিন্ময় দাঁড়ানো। বরের মত নরম সুরে বলল,
‘শালীগণ কেমন আছেন আপনারা?’
মেয়েদের মাঝ থেকে একটা ধমকের সুর ভেসে এল। জুঁই চেঁচিয়ে বলল, ‘শুধু শালী কেন, শালীর চৌদ্দগুষ্টি ভালো আছে। তা আপনি ভালো আছেন দুলাভাই।’
মুহুর্তে বন্ধুমহলে হাসির রোল পড়ে গেল।
চিন্ময়সহ বাকীরাও ভ্যাবাচ্যাকা খেল। জুঁই কনে পক্ষের হয়ে কথা বলছে। জুঁইয়ের সাথে লরিন, সিমি তারাও হাজির। মুবিনের অপলক দৃষ্টি তখন জুঁইয়ের দিকে। হলুদ রঙা লেহেঙ্গা পরিহিত জুঁই। খোলা চুলে বেলীফুলের গাজরায় যেনো এক হলুদ পরী লাগছে। তার উপর মেয়েটাকে হাসলে অসম্ভব সুন্দর লাগে। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে তার,
‘জুঁইফুল এভাবে হাসবে না। তোমার হাসিগুলো জমিয়ে রাখও বাক্সবন্দী করে। কোন এক নির্জনে তুমি আমি একাকী বসব নিরালায়। সেদিন তুমি মন খুলে হাসবে। সেই হাসি শুধু আমি দেখব।’
দীর্ঘশ্বাসে বক্ষস্থল ভারী হল মুবিনের। আদৌ এই স্বপ্ন তার পূরণ হবে। জানা নেই। তার তো জিতুর মত বড়লোক বাবা নেই, আর না জিমানের মত কর্ণেল বাবা আছে। না আছে চিন্ময়ের মত ক্ষমতাধর ওসি মামা। আর না সানি রকির মত যৌথ পরিবারের আদরে বড় হওয়া নিশ্চিন্ত জীবন। তার যে কিছুই নেই। তবে মা নামক ছায়া আছে। আছে দু’বোন। আছে পরিবার নামক এক দায়িত্বের ভার। তবুও মন মানে না। লুকিয়ে লুকিয়ে অজস্র বার তার জুঁইফুলকে দেখে যায়।
চিন্ময়ের হতশ্রী আঁখি জোড়া জুঁইয়ের মাঝে নিবদ্ধ। আজ যেনো হলুদিয়া পাখি লাগছে জুঁইকে। কিন্তু তার মন বড্ড খারাপ। জুঁইফুল তাকে নিয়ে মজা উড়াচ্ছে। শেষে কি’না তাকে দুলাভাই ডাকছে। এভাবেই সবার সামনে তার ইজ্জতভ্রষ্ট। এটা খুব বাজে হল। লজ্জায় আড়ষ্ট হল সে। নিজের ইজ্জত বাঁচাতে জিতুকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। মেয়েদের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
‘এই হচ্ছে আপনাদের আসল দুলাভাই, আমি তো উনার বন্ধু মাত্র।’
মেয়েদের মাঝে তখন তীব্র কৌতুহল। কে বর? নীল রঙা লেহেঙ্গা পরিহিত নীলাভ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার আপুর বর কে? কালো স্যুট কোট পরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা এই ভদ্র লোক। সবার থেকে সেই শুধু আলাদা ড্রেস পরেছে। বাকিদের প্রায় একই ধরনের শেরওয়ানি। সকল কল্পনা জল্পনা শেষে বরকে পেয়ে মেয়েদের দল উচ্ছ্বসিত। বর তো নয় যেন সিনেমার হিরো। লাল রঙা লেহেঙ্গা পরিহিত হৃদি যেনো ভাবতেই পারছে না। এটা তাদের দুলাভাই। তবে দুলাভাইয়ের বন্ধুগুলোও এক একজন সিনেমার নায়ক থেকে কম না। মুচকি হাসি দিয়ে তার হাতে থাকা ছোট্ট থালাটা এগিয়ে দিল জিতুর দিকে। জিতু কিঞ্চিৎ উঁকি দিয়ে দেখল ফুলেল থালায় ছোট একটা কাঁচি রাখা। পাশে দাঁড়ানো জিমান ফিসফিসিয়ে বলল।
‘কাঁচিটা হাতে নিয়ে ভাই ফিতাটা কাট।’
জিতু কিছু সময় থম মেরে ছিল। কত মেয়ে এখানে। অথচ তার মন মস্তিষ্ক অন্যকিছু ভাবছে। তার না হওয়া বউটা দেখতে কেমন। সেও কি তার মত তাকে নিয়ে ভাবছে। জিতুর এভাবে চুপ হয়ে থাকা দেখে চিন্ময় ওর হাতে কাঁচি’টা তুলে দিল। কানের কাছে এসে ক্ষীণস্বরে বলে উঠল,
‘জলদি ফিতা কাট ভাই, বাথরুম যাওয়া লাগবে। আমার দুই চাপছে।’
চিন্ময়ের কথা মেয়েদের কানে না গেলেও পাশে থাকা বন্ধুমহলের কানে ঠিকই পৌঁছাল। সানি হুট করে বলে উঠল, ‘জিতু জলদি কর, চিন্ময় মিশাইল ছাড়ার আগে।’
জিতু আর কিছু ভাবল না। তড়িঘড়ি ফিতা কাটল। সবাই করতালিতে তাদের বরণ করল। কিন্তু চিরকুট দিয়ে ভর্তি ফুলেল অন্য একটি থালাও জিতুর দিকে এগিয়ে দিল। কিঞ্চিৎ বিস্মিত হল সে। ফের থালা কেন? জিমান থালাটা থেকে একটা চিরকুট উঠালো। তাতে লিখা পনেরো হাজার টাকা। জিতু টাকার সংখ্যা দেখে এবার বুঝল ফিতা কাটার আসল কারণ। জিমান বিনাবাক্যে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে দিল। জিতুর বাবা টাকার পরিমাণ আরও বেশি দিয়েছে। কোন ঝামেলা যাতে না হয়, তার ছেলেও বিরক্তবোধ না করে। দ্রুতই যেন বিয়ে সম্পন্ন হয়। টাকা পেয়ে মেয়ে’রা প্রবেশপথ ছাড়ল।
জিতু ভেতরে প্রবেশ করতেই তার মাথায় ফুলের পাঁপড়ির বর্ষণ হল। সে চারপাশে একবার চোখ বুলালো। ছোট বড় সব ছেলে মেয়ের হাতে ফুলের থালা। এরাই তাদের উপর ফুলের পাঁপড়ি ছিটাচ্ছে। নিচে কালো রেড কার্পেট বিছানো। নিজেকে আজ তার সেলিব্রেটি মনে হচ্ছে। বিষয়টা অতও মন্দ নয়।
ভেতরে প্রবেশ করে আরও একবার ভ্যাবাচ্যাকা খেল। ফুলের তৈরি পর্দা বানানো হল। সেই ফুলের পর্দার আড়ালে লাল বেনারসির লম্বা ঘোমটা টানানো এক নববধূ বসে আছে। মেহেদী রাঙানো হাতে দু’হাত ভর্তি পাথরের আর সোনার চুড়ি। এক মুহূর্তের জন্যে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। মেয়েটাকে দেখার তীব্র মনোবাসনা জাগল। কিন্তু তার এই অদম্য ইচ্ছেকে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে মেয়ে পক্ষের লোক তাকে নিয়ে বসালো সামনে রাখা সোফায়। ঠান্ডা শরবত দেয়া হল তাদের। তার সাথে বাকি’রাও খেলো। কিন্তু তার চোখ জোড়া নিবদ্ধ ঐ বেনারসির লম্বা ঘোমটায় আবৃত কনের দিকে। নিজমনে বিড়বিড় করল, নতুন বউ। উঁহু, তার বউ।
নাস্তা পানীয়জল খাবার শেষে তাকে ডাকা হল সেই ফুলের তৈরি পর্দার সামনে। একপাশে বরের জন্য নরম গদির আসন, সেখানে সে বসবে। ফুলের পর্দার ওপাশে আগেই থেকেই বসে আছে বউ। বউয়ের গায়ে পরিহিত লেহেঙ্গা আর সাজসজ্জা দেখে পুরাই অবাক। এমন নববধুর সাজ সে’তো নুহাহকে নিয়ে ভাবত। কিন্তু এই সাজের কথা এরা জানলো কিভাবে? নিশ্চয় এটা ঈশিভাবীর কারসাজি। তার ডায়েরি পড়েছে। এই মহিলা তার সব গোপন কথা জেনে গেছে। এখন সবগুলো এই মেয়ের উপর প্রয়োগ করবে। পর্দার পাশে বসতেই তার দৃষ্টি পড়ল মেয়েটার হাতের দিকে। একই রকমের মেহেদী রাঙানো হাত সে আজ দুপুরেও দেখেছে একজনের হাতে। হতে পারে কাকতালীয়। কিন্তু এত মিল কিভাবে সম্ভব! তার কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। অস্থিরতায় হাসফাস করছে। কি এক আজব দহনে পুড়ছে সে। অজানা এক শিহরণ হচ্ছে তার। মন কেমন উথলা হয়ে আছে। বউয়ের মুখটা দেখার জন্য। তবে অদ্ভুত হলেও সত্য, আজ ৫ই ডিসেম্বর। তিন বছর আগের এই দিনেই সে নুহাহর সাথে প্রথম কথা বলেছিল। তার বোকা পাখির সাথে। আর আজকের দিনে সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে অন্য এক নারীর সাথে।
লম্বা ঘোমটার আদলে মুখ ঢাকায় নুবাহ বেশ নিশ্চিন্তে বসে আছে। অন্তত নিজের লজ্জা, অস্বস্তি লুকাতে পারছে। কিন্তু মাথা নিচু রাখতে রাখতে ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেছে। সেই কখন থেকে তাকে এভাবে বসিয়ে রেখেছে। আর সহ্য হচ্ছে না। কবে শেষ হবে এই বিয়ের কার্যক্রম। এত বড় লম্বা ঘোমটার জন্য আশেপাশে কি হচ্ছে তার জানা নেই। তবে বর আগমনের অস্তিত্ব টের পেয়েছে। সবার শোরগোলের মাঝে ঘোমটা থেকে একঝলক সে তাকিয়েছিল। কিন্তু বরকে দেখা হয়নি তার। মর্মদহনে ব্যথিত তার তনুমন। নিজেকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে এখন। যা হবার হোক। সে আর কিছুই করবে না।
কাজি এসে উপস্থিত। তিনি আসতেই হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। কাজি এসে বরের পাশে বসলেন। শুরু হল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। জিতুর বক্ষস্থল ভীষণ কাঁপছে। অজানা আতংকে বার বার অস্থির হচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পুরো বন্ধুমহল। মেয়ের পাশে তার আত্নীয় স্বজন আর পরিবার দাঁড়ানো। আচমকাই তার চোখ গেল তার বাবার দিকে। তার বাবা সোফায় বসে আছে। দু’হাত উপরে তুলে মোনাজাত ধরে আছে। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। তার বাবা কাঁদছে, শুধু তার জন্য। কেন এত চিন্তা করে তার বাবা। সেই তো বিয়ে করছে। আর পাগলামি করেনি তো।
কাজি বিয়ে পড়ানো শেষে কনের দিকে তাকালেন। বলে উঠলেন, বল মা কবুল। নুবাহ কিছু সময় নিল কবুল বলতে। তারপর মৃদুস্বরে কবুল বলে কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ালো। জিতুকে কবুল বলতে বললে সে খুব বেশি সময়ক্ষেপণ না করেই কবুল বলল। সবাই আমিন বলে মোনাজাত শেষ করল। কাজি উঠে গেলেন। পাশে থাকা আত্নীয় স্বজন সবাই সরে দাঁড়ালো। বরকে বলা হল বউয়ের মুখ দেখতে। জিতুর হাতে একটা ডায়মন্ডের রিং দেয়া হল। বউকে পরিয়ে দিতে। জিতু কিছুসময় ভাবল। কোন আঙ্গুলে রিং পরা যায়। তারপর নিজের এক হাত বাড়িয়ে বউয়ের বামহাতের মধ্যমা আঙ্গুলে রিং পরিয়ে দিল। পরার সময় খেয়াল করল মেয়েটার হাত কাঁপছে। সে কিঞ্চিৎ অবাক হল। এত কাঁপার কি আছে। সে কিছু করেছে নাকি! রিং পরিয়েছে শুধু।
নুবাহর হাতেও একটা ডায়মন্ডের রিং দেয়া হল বরকে পরিয়ে দেয়ার জন্য। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোরকম রিং পরিয়ে দিল। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কেনো কাঁপছে তার জানা নেই। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে ততই শরীরের কাঁপুনি বাড়ছে তার। দু’হাত তার কোলের মধ্যে। লজ্জায় নিজের এক আঙ্গুল দিয়ে অন্য আঙ্গুল ঘষে যাচ্ছে।
এবার বউয়ের মুখ দেখার পালা। বরকে বউয়ের ঘোমটা তুলতে হবে। জিতু একবার চারপাশে চোখ বুলালো। তার হাড়বজ্জাত বন্ধুগুলো মোবাইলের ক্যামেরা তার দিকে তাক করে আছে। শুধুমাত্র তার রিয়্যাকশন দেখার জন্য। পরে এটা নিয়ে তার মজা উড়াবে। এক একটা হাড়বজ্জাত বন্ধু পাইছে সে। অবশ্য এদের জায়গায় সে হলেও এটাই করত। তাদের আর কি দোষ। অস্বস্তিতে ডুবে আছে এখনো। বক্ষস্থলে উচ্চশব্দে ঢিপঢিপ শব্দ করছে। হার্টবিট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। দীর্ঘ সময় নিয়ে আলতো করে বউয়ের ঘোমটা তুললো। তুলতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। তড়িৎ ঘোমটা আগের মতই লম্বা করে টেনে দিল। কয়েক মুহুর্তের সেই দেখা নববধূ তার জীবনে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে আনল। হৃদকম্পন হুট করে বেড়ে গেছে। নিশ্বাস উঠানামা করছে দ্রুতই। এটা কি সত্যিই! সে সত্যি দেখেছে। ফের একবার ঘোমটা টেনে তুললো। অবিশ্বাস্য নজরে তাকালো আবার। এটা তার বউ! সত্যি তার বউ!
চলবে,,,,,
সবচেয়ে বড় পর্ব ২২০২ শব্দের। এরপরও ছোট বললে বুঝমু আপনে বে-রোজধারী। (–_–)
বি:দ্র: গল্পে কিন্তু ২০২৩ চলছে।