#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
১৬,,
হালকা গোলাপি রঙের একটা সুন্দর শাড়ি পরিহিত এবং চোখে মুখে হালকা সাজে মাথায় ঘোমটা টেনে দুজন অপরিচিত মহিলা এবং দুজন অপরিচিত পুরুষের সামনে পরিবার সহিত তিলো বসে আছে। তিলো পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে একবার মুখ তুলে প্রত্যেককে দেখে নিলো। শুনেছে পাত্র এসেছে। কিন্তু পুরুষ দুজনের কাউকে দেখে ওর একজনকেও পাত্র বলে মনে হচ্ছে না। হালিম সাহেব এদিকে তিলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিলো নিজের সম্পর্কে এতো প্রশংসা শুনে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে যে ও নিজেও জানে না ওর এসকল গুণ রয়েছে!! তবে কিছু কিছু অবশ্য সত্যি।
আনিস সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তাদের সামনে চা নাস্তা রাখা হয়েছে। কক্ষে উপস্থিত প্রত্যেকেই জানে যে, কেউই এই দুপুরে সেগুলো ছুঁয়েও দেখবে না কারণ তাদের দুপুরের দাওয়াত এখানে, বিকালের চা নাস্তার নয়৷ এরপরও আনুষ্ঠানিকতা একটা বিষয়। ওদের কথাবার্তার একপর্যায়ে তিলো বুঝতে পারলো পাত্র আসলে কে? আর সেটা বুঝতে পেরেই তিলোর মনটা ভেঙে গেলো। দুজন অপরিচিত পুরুষের মধ্যে তুলনামূলক কম বয়স্ক, তারপরও বয়স নিতান্ত কম নয়, লোকটিই পাত্র। তিনি চমকে দেওয়ার মতো খাটো। গতানুগতিক কর্মঠ পুরুষের গায়ের রং। মাথায় খরা প্রবনিত এলাকার মাঠের রঙ, তবে তার উপর যেন তেল মালিশ করা। জানালা থেকে আসা দিনের আলো যেন সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। ছোট ছোট চোখ। তবে নাক টানা। ক্লিন শেভ করা মুখটাও তেলতেলে। বলিষ্ঠ গোটা গোটা আঙুল বিশিষ্ট হাতে নীল সবুজ শিরাগুলো ফুলে উঠেছে যেন। তিলো একবার চিন্তা করলো, লোকটা কি খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রম করেন। তবে কথাগুলোর একপর্যায়ে লোকটার পেশা জানতে পেরে তিলো হতাশ হলো। কারণ এমন একটা ছেলেকে কেউই হাতছাড়া করতে চাইবে না যদিনা এমন পরিবার মেয়েকে ছেলের পেশার সাথে বিয়ে দিতে চায়। লোকটা উচ্চ পর্যায়ের একজন ফরেন অফিসার। যোগ্যতা এবং আশেপাশের ছাউনি খুবই মজবুত যে, নিশ্চিতভাবেই একপ্রকার বলা যায়, তিনি তাড়াতাড়িই একজন ‘এ’ ক্যাটাগরির অ্যাম্বাসেডর হিসেবে অধিষ্ঠিত হবেন। জি-সেভেনের যেকোনো দেশে। তার রাজনৈতিক আশ্রয়ও রয়েছে। লোকটার বয়স সাইত্রিশ।
তিলোকে খুব ছোট ছোট কিছু জিজ্ঞাসা করায়, সে সঠিক উত্তরই দিলো। হালিম সাহেব একপর্যায়ে নাসীরা পারভীনকে ইশারায় তিলোকে ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন। তিলো কারো ভাবভঙ্গিতে বুঝতে পারলো না, আসলেই ওদের মনে কি চলছে। কারণ শেষের দিকে ওদের আলোচনা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শুরু হয়েছে, যেটা চালিয়ে নিয়ে চলেছেন হালিম সাহেব।
তিলো রুমে আসতেই নাসীরা পারভীনের দিকে তাকিয়ে মাথার ঘোমটা ফেলে বললো,
-ওই লোকটা পাত্র?
নাসীরা পারভীন কেবল ছোট করে হুম বললেন। তিলো দুইহাত দুদিকে প্রসারিত করে ঠোঁট জোড়া সামান্য ফাঁকা করে হতাশার ইঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-আম্মা। শোনো, তিনি একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। আমি কি বললাম? তিনি একজন লোক আসলে। তার উচিত একজন মহিলাকে বিয়ে করা। আমি ছোট, একটা মেয়ে। মহিলা নই। আমার সবে একুশ বছর।
নাসীরা পারভীন শান্ত দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তোর কি কোনো পছন্দ আছে?
তিলো ঠোঁটের কোণা উঁচু করে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বললো,
-প্রশ্নটা তুমি করছো?
নাসীরা পারভীন আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। বিশাল এক আলোচনা সভার পর দুপুরে খেতে বসতে বসতেই প্রায় বিকাল হয়ে গিয়েছে। তিলোর আবারও ডাক পড়লো তাদের খাবার পরিবেশন করতে। তিলো যতটুকু পারে, ততটুকুই করলো। যাওয়ার আগে ওদের ভেতর একজন মহিলা সামান্য আনুষ্ঠানিকতার সহিত তিলোর অনামিকায় একটা আংটি পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। এমন ঘটনায় তিলো হতভম্ব হয়ে গেলো ঠিকই। তবে চমকে উঠলো হঠাৎই হালিম সাহেব আর নাসীরা পারভীনের উচ্চস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে ওঠায়। তিলো আনিস সাহেবের কন্ঠ শুনতে পেলোনা। ওর চোখ পানিতে ভরে উঠেছে, ওর মতামত নেওয়ার কি কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই?
ওরা চলে যাওয়ার পর পর হালিম সাহেবও চলে গেলেন। তিলো লিভিং এ সবার উদ্দেশ্যে বললো, এই বিয়ে ও করবে না। ওর ছেলেকে পছন্দ হয়নি। নাসীরা পারভীন ওকে কিছু বলার আগে আনিস সাহেব বলেন,
-ঠিক আছে। তোমার পছন্দ না হলে এই বিয়ে হবে না।
নাসীরা পারভীন বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কি বলছো কি তুমি? এমন একটা ছেলেকে হাতছাড়া করা যায়? নেহাত ভাইয়া ওমন একটা পর্যায়ে ছিলো বিধায়! না হলে, তুমি পারতে আমাদের তিলের জন্য এমন ছেলে এনে দিতে?
আনিস সাহেব হাত উঁচু করে ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-শুধু তার সামাজিক অবস্থান দেখছো? আমার মেয়ের ভালো না লাগলে, সে কিভাবে সুখী হবে? তাছাড়া ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতেও চাই না। লেখাপড়া করছে করুক।
-আরে বাবা, ওরা তো পড়াবে ওকে। অ্যাম্বাসেডর সাহেবের বউ অশিক্ষিত থাকবে নাকি? বললো তো পড়াবে। একবার ভাবো, তুষারের ভবিষ্যতও একেবারে সাজিয়ে দেওয়া যাবে। তুলি যা ঘটিয়েছে, তাতে তিলোর সমন্ধটা কতো ভালো!
নাসীরা পারভীন আর আনিস সাহেব কথা কাটাকাটি চালিয়ে যাচ্ছেন। তিলো বুঝতে পারলো, ওর বাবারও আসলে ছেলে পছন্দ হয়নি। তিলো ওনাদের ঝগড়ার মাঝে থাকতে চায়না। ওর বাবা একদমই একজন ফ্যামিলি ম্যান। ওনাদের ঝগড়া খুব কমই হয়। যতক্ষণ হয়, ছেলেমেয়ে কেউই ওনাদের ভেতরে ঢোকে না।
তিলো রুমে এসে আঙুলের আংটিটা খুলে টেবিলের উপর রাখলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অনলাইনে ঢুকে স্ক্রোল করতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের ভেতরই ওর এলোমেলো মেজাজটা ভালো হতে শুরু করলো।
কিছু সময় পর নাসীরা পারভীন তিলোর রুমে এসে ওকে বললেন,
-তুই ভেবে দেখিস মা। সময় নে। মাথা ঠান্ডা করে সবটা ভাব। তারপর সিদ্ধান্ত জানা। চেহারাই তো সব না। লোকটা ভালো। তোকে সুখে রাখবে। সময় নিয়ে একটু ভেবে দেখ। হুট করে একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিস না।
নাসীরা পারভীনের কন্ঠ ভেজা ভেজা। ওনি যে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। তিলো চিন্তা করলো, ওনাদের মাঝে গুরুতর কিছু হয়েছে কি? তিলো এরপরও কঠিন কন্ঠে বললো,
-হুট করে তো তোমরাও একটা সিদ্ধান্ত নিলে!
নাসীরা পারভীন তিলোর ছেড়ে রাখা চুলগুলোতে হাত দিয়ে আঙুলের ফাঁকা থেকে টেনে দিতে দিতে বললেন,
-তুই সময় নে। ভাব। ভেবে জানা।
নাসীরা পারভীন আর কিছু বললেন না৷ তিলোর রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিলো চোখের মণি ঘুরিয়ে ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে আবারও নিজের ফোনে মনোযোগ দিলো।
অরিক নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে জানতে পারে, ওর বাবা মা কালই চলে যাবেন নিজেদের বাড়িতে। শুক্রবার সবার দাওয়াত, তাই বাড়ি গোছানো প্রয়োজন। অরিক ভার্সিটিতে চাকরির সুবিধার্থে এই শহরে একটা বড় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ওর বাবা মা আর ভাইও এসে থাকে। যেমন, গত শুক্রবার থেকে আজ পর্যম্ত রয়েছে। অরিক আজ বেশ বিরক্ত। তিলো আজও ভার্সিটিতে আসেনি। ও নিজেও বুঝতে পারছে না, ওর আসলে হয়েছে কি? তিলোকে নিয়ে ও কেন ভাবছে? যে মেয়েটাকে ছোট থেকে দুচোখে দেখতে পারতোনা, এখন ভার্সিটিতে ওকে না দেখতে পেলে ভালো লাগে না। আজকে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বেশ অনেকগুলো কাজ ছিলো ওর। সব সেরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছে।
অরিক বাড়ি ফিরে একবার তিলোকে ফোন করবে ভাবলো। এরপরই ফাহমিদা বেগমের ডাক পড়ে খেতে যেতে।
রাতে খাবার টেবিলে সকলে একসাথে বসে খাওয়ার সময় বিভিন্ন কথার মাঝে হঠাৎই আকবর সাহেব বললেন,
-মৃদু(ফাহমিদা বেগমকে উদ্দেশ্য করে) আমাদের তিলের তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো।
কথাটা অরিকের কানে পৌঁছাতে সময় লেগেছে তবে ওর চমকে উঠে একটা হৃৎস্পন্দন হারিয়ে যেতে সময় লাগেনি। অরিক কৌতুহলী দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালো। ওনি সে দৃষ্টির দিকে চেয়েও দেখলেন না। ফাহমিদা বেগমের দিকে তাকিয়েই বললেন,
-ছেলে সে ফরেন অফিসার। হাই কোয়ালিফিকেশন। অ্যাম্বাসেডর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। একটাই সমস্যা। বয়স একটু বেশি। তাতে কি? এদিক ছাড় দিলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না।
ফাহমিদা বেগমের মুখ আপনাআপনি হাঁ হয়ে গিয়ে আবারও নিজেকে সামলে বললেন,
-বলো কি? তিলোর জন্য এমন সম্বন্ধ? কপাল করে জন্মেছিলো বলতে হবে। ওই গায়ের রঙে…
কথাটা ওনি শেষ করতে পারলেন না তার আগেই আকবর সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে ওনার নাম ধরে ডাকলেন। এটা ছিলো আসলে সতর্কতা। তিলোর রঙ নিয়ে সমালোচনা করা একজন ব্যক্তি ওনি। আর এটা আকবর সাহেব পছন্দ করেন না। ফাহমিদা বেগম চুপ করে সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে মনোযোগী হলেন।
এদিকে অরিকের গলা থেকে খাবার নামছে না৷ আজানা কষ্টে বুক ভার হয়ে আসছে। অরিক জানে না, কেন ও কষ্ট পাচ্ছে? তবে পাচ্ছে।
ও কিছু না বলে হঠাৎই উঠে গেলো খাবার ছেড়ে। ফাহমিদা বেগম ওকে ডেকেও থামাতে পারলেননা। অরিকের আজকের আচরণ ওনার বোধগম্য হলোনা। পুরোটা অভ্রের চোখে পড়লেও ও কেবল নির্বাক দর্শক ছিলো পুরো ঘটনার৷ অরিকের মাথায় কি চলছে, ও আন্দাজ করতে পারলেও অরিককে ধরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ ও করছে না। অরিক নিজেই খুঁজে নিক নিজের অনুভূতির উৎস।
অরিক তিলোর ফোনে কল করে ব্যস্ত পেলো। স্বগতোক্তি করে উঠলো,
-বিয়ে ঠিক হয়ে পারেনি আর বুড়োর সাথে গল্প শুরু করে দিয়েছে!
অরিক পরপর কয়েকবার দিয়ে ব্যস্তই পেলো।
তিলো সারারাত জেগে আছে। ও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হঠাৎ নয়। খুব ভেবেচিন্তে। ও জানাতে চায় ওর মাকে। কিন্তু এখন ওনি ঘুমাচ্ছেন।
তিলো ফজরের আযান পর্যন্ত জেগে, ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। এরপর অপেক্ষা করলো নাসীরা পারভীনের জেগে ওঠার।
নাসীরা পারভীন ওয়াক্ত মতোই উঠে ওজু করে নামাজ আদায় করতে দাঁড়ানোর আগেই তিলো ওনার ঘরের দরজায় নক করলো। আনিস সাহেব মনে একটা খটকা নিয়ে দরজা খুলতেই তিলো ভেতরে ঢুকে দুজনের উদ্দেশ্যেই বললো,
-আমি বিয়েতে রাজি আম্মা।
ওর এই ছোট একটা বাক্যে নাসীরা পারভীনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আনিস সাহেব কোনো অভিব্যক্তিই প্রকাশ করলেন না।
#চলবে