প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৭
__________________________
শাহাজাহান বাড়ির ভেতরের পরিস্থিতি গুমোট এবং গম্ভীর৷ মোস্তফা সাহেব সোফায় বসে৷ আনোয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন৷ ওপর পাশের সোফায় ওহী সাহেব বসেছেন৷ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে সুমিতা বেগম৷ মুফতি বেগম ট্রে করে চা এনেছেন৷ মোস্তফা সাহেবের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে তারপর আনোয়ার সাহেবকে দিলেন৷ শেষ কাপ ওহী সাহেবের হাতে দিয়ে পাশেই ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শান্ত সুরে মোস্তফা সাহেব বললেন,
— অরু এখনো ছোট৷ মাত্র কলেজ উঠেছে৷ শাবিহা মাস্টার্স পড়ছে এখনো ওর বিয়ের কথা তুলছি না৷ সময় দিচ্ছি, দিব ভবিষ্যতে৷ এতো তাড়াহুড়োর কী প্রয়োজন আছে সুমিতা?
সুমিতা বেগম মাথা তুললেন না৷ নীচু স্বরে বললেন,
— ভাইয়া বলছিল শুধু ওদের আগধ করিয়ে রাখবে৷ অরু পড়াশোনা করবে সমস্যা নেই৷
আনোয়ার সাহেব রাগে থরথর করে কাঁপছেন৷ স্ত্রীকে কিছু বলবেন সেসময় মোস্তফা সাহেব তাকে চোখ রাঙালেন৷ তারপর ঠোঁটে হাসি স্মিথ হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
— অরু আমারও মেয়ে৷ শাবিহাকে যতটুকু ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি সমান ভালোবাসা দিয়ে ওকেও করেছি৷ শাবিহার জন্য যতটা চিন্তা করি ওকে নিয়েও ততটাই করি৷
আনোয়ার সাহেবের কন্ঠে অসহায়ত্ব বিদ্যমান,
— ভাইয়া আপনি…
— আমাকে আমার কথা শেষ করতে দাও৷ নাকি আমার সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই?
আনোয়ার সাহেব মন খারাপ করে ভেজা বিড়ালের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন৷ আঁড়চোখে বড়ো ভাইয়ের গম্ভীরমুখ খানা দেখলেন৷ আনোয়ার সাহেবকে খামোশ করে মোস্তফা সাহেব আবারো বলতে শুরু করলেন,
— অরুর বয়স নাহলে সাইডে রাখলাম আপাতত৷ তোমার ভাইয়ের ছেলের কথা বলি। তাদের বাড়ির ছেলে তো ভালো না৷ নেশাদ্রব্য পান করে৷ মেয়েদের ত্যক্তবিরক্ত করে৷ রাতবিরেত নাইট ক্লাব জয়েন করে৷ প্রায়শই বাড়ি ফিরে না৷ ভালো ব্যবহার জানেনা৷ তেমন শিক্ষিতও না৷ এমন একটা ছেলে আমার মেয়ের দু’হাত দূরে থাকবার ও যোগ্যতা রাখেনা৷
সুমিতা বেগম নিশ্চুপ৷ ওহী সাহেবের চা প্রায় শেষের পথে৷ তিনি কাপে লাস্ট চুমুক দিয়ে খালি কাপটি মুফতি বেগমের হাতে দিলেন৷ মোস্তফা সাহেবের দিক তাকিয়ে বললেন,
— ভাই আমার মনে এইসব বিষয় নিয়ে কথাবার্তা না বলাই ভালো৷ আমি দুঃখিত তবে ওই বাড়ির কোনোকিছুই আমার পছন্দ না৷ তাদের ব্যবহার চলাফেরা সবকিছু কেমন বিরক্তিকর দেখায় আমার কাছে৷ ওটা অরুর জন্য ভালো পরিবার নয়৷ একদমই নয়৷ আমার সিদ্ধান্ত চাইলে না বলবো৷
তিনি উঠে চলে যেতেই মুফতি বেগম তার পিছু ছুটলেন৷ মোস্তফা সাহেব ধীরেসুস্থে সুমিতা বেগমকে বললেন,
— তোমার কাছে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তোমার মেয়ে নাকি তোমার ভাই এবং ভাইয়ের পরিবার? সুমিতা!
তুমি তোমার ভাইদের আমার থেকে ভালো চেনো এবং জানো৷ তাও বলছি, তুমি বিশ্বাস করবে নাকি জানিনা৷ যদি তোমার আর আনোয়ারের মধ্যে কখনো ঝগড়াবিবাদ হয়৷ আর তুমি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে তোমার ভাইয়ের বাসায় ওঠো, তারা তোমাকে একদিনও শান্তিতে থাকতে দিবেনা৷ তোমাকে ফেরত পাঠানোর জন্য উতলা হয়ে যাবে৷ তোমার সাথে কেমন ব্যবহার করবে তা তুমি ভালো জানো৷ তাহলে তেমন একটা পরিবারে তোমার আদরের একমাত্র মেয়েকে কীভাবে দিতে রাজি হলে?
সুমিতা বেগমের চোখে জল৷ গাল বেয়ে জল ফ্লোরে পড়ছে৷ তিনি মাথা উঁচু করে তাকানোর স্পর্ধা পাচ্ছেন না৷ মোস্তফা সাহেব পুনরায় বললেন,
— আমি ওই বাড়িতে মেয়ে দিতে ইচ্ছুক নই সুমিতা৷ তোমার ভাইয়ের পরিবার আমার মেয়েকে ডিজার্ভ করেনা৷ আমি এই বিষয়ে আর কিছুই শুনতে চাইনা৷ এবং আশা রাখবো এগুলো অরুর কানে যেন না যায়৷ ওর পড়াশোনার ডিস্টার্ব হবে৷ সামনে এক্সাম আছে ওকে কনসেনট্রেশান করতে দাও৷
মোস্তফা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বড়বড় পায়ের ধাপে নিজের রুমের দিক চললেন৷ সুমিতা বেগম নিশ্চুপ হয়ে কাঁদছেন৷ আনোয়ার সাহেব কিছুক্ষণ স্ত্রীর দিক তাকিয়ে রইলেন৷ মনে একরাশ রাগ ধামাচাপা দিয়ে তিনি মনকে শান্ত করলেন৷ সুমিতা বেগমের হাত ধরে নিজেদের রুমের দিক নিয়ে যাচ্ছেন৷ ভেতরে ঢুকে তিনি স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন৷ মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— আমি কখনোই তোমাকে অবিশ্বাস করিনি৷ সর্বদা তোমার ইচ্ছে, চাওয়া-পাওয়াকে সম্মান করেছি, এবং তা পূরণও করেছি৷ আমি জানি এটা তোমার ইচ্ছে বা চাওয়া নয়৷ কিছু একটা হয়েছে তোমার সাথে বা হচ্ছে হয়তো৷ সেগুলো আমাকে না বললে আমি কীভাবে বুঝব? কীভাবে সাহায্য করবো তোমায়? আমি চাই তুমি নিজে সেধে আমাকে সবকিছু সত্য বলবে৷ আমি সত্যটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই সুমিতা৷
স্ত্রীকে একা রেখে আনোয়ার সাহেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন সুমিতা বেগম৷ অঝোরে কাঁদছেন তিনি৷
তার কান্না চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ৷
ওহী সাহেব বিছানায় বসে শার্ট খুলছেন৷ শার্ট খুলে ছুড়ে মারলেন সোফায়৷ মুফতি বেগম সেটা তুলে ভাজ করছেন৷ আঁড়চোখে স্বামীর রাগী চেহারা দেখছেন৷ শার্টটা গুঁছিয়ে রেখে স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন৷ নরম কন্ঠে শুধালেন,
— তুমি রাগছ কেন?
— রাগবো না বলছ? ফাতরামি সব! কতটা নির্লজ্জ ওই পরিবার ভাবতে পারছ? এভাবেই সুমিতার নাম করে কতো ফায়দা নিচ্ছে আমাদের থেকে৷ সাহায্য নিতে নিতে ছোট ভাঙাচোরা বিজনেস উপরে উঠিয়েছে৷
— এখন নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ির মেয়ে নিতে চাচ্ছে আরও ফায়দা লুটতে৷ তাদের কথাবার্তার ধরনে বোঝা গেল সুমনা মেয়েটাকে তন্ময়ের গলায় ঝুলাতে চায়৷
ওহী সাহেব রাগী সুরে হাসলেন,
— আমাদের পরিবারের খারাপ রুপ দেখেনি তাই এমন চিন্তাভাবনা করতে পারছে৷ সুমিতার মুখের দিক তাকিয়ে বারবার রেহাই দিচ্ছি৷ যেদিন সুমিতা এসে সবকিছু খুলে বলবে, সেদিন ওদের পুরো খান্দান সাগরে চুবাব৷
— আচ্ছা তুমি শান্ত হও! তন্ময়ের সাথে কথা
বলেছ? ওকে জানিয়েছ কোম্পানির সম্পর্কে? অবস্থা ভালো না যে৷
ওহী সাহেব চিন্তিত সুরে বললেন,
— না বলিনি৷ ভাই বলতে না করেছে৷
— তুমি বরং একবার তন্ময়ের সাথে কথা বলেই দেখ! ও এসব শুনে বাড়িতে না আসলেও কোম্পানির দায়ভার নিবে৷
— দেখি কী করা যায়৷ তুমি তো জানো, তন্ময়কে এসব বললে ভাই রেগে যাবেন।
— রাগলে রাগবে৷ ছেলে সামনে আসলে রাগ হাওয়ায় উড়ে যাবে দেখ৷। ওহী সাহেব হাসলেন৷ বালিশে মাথা গুঁজে দিলেন৷ মুফতি বেগম কয়েক মাসের আগের বিষয়টি তুললেন৷
— রুবির জন্য যেই প্রস্তাব এসেছিল সেটা নিয়ে কিছু ভাবলে? শুনেছি ছেলে ভালো৷ পরিবারের অবস্থাও ভালো৷ সবকিছুই..
ওহী সাহেব স্ত্রীকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন,
— রুবি শাবিহার থেকে দু বছরের ছোট৷ যেহেতু শাবিহার বিয়ে নিয়ে এখনো কথাবার্তা হচ্ছেনা, তাই এখন রুবির বিয়ের বিষয় না তোলাই ভালো৷
মুফতি বেগম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন৷
—–
সামনে অরুর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম৷ নভেম্বরের পঁচিশ তারিখ থেকে শুরু৷ মাত্র ছয় দিন বাকি৷ কলেজের বেতন, পরিক্ষার ফি এবং যাবতীয় লেনদেন পরিশোধ করতে এবার শাবিহা যাবে৷ প্রত্যেকবার মোস্তফা সাহেব নিজে আসেন৷ তার আবার প্রিন্সিপালের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক৷ কিন্তু তিনি এবার ভীষণ ব্যস্ত। আসতে পারেননি৷ শাবিহার রিকশা মাত্রই থেমেছে ভার্সিটির সদরদরজার সামনে৷ সবুজ শার্ট-প্যান্ট পরে লাঠি হাতে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে৷ রিকশাভাড়া দিয়ে শাবিহা ভেতরে ঢুকলো৷ প্রথমেই স্কুল৷ স্কুলের পাশে বড় গার্ডেন৷ তারপর আরেকটি বিশাল বড় দরজা সেটার পেছনে কলেজ সামনে ভার্সিটি৷ খোলামেলা জায়গার অভাব নেই চারপাশে৷ ঘাষের উপর শিক্ষার্থীরা বসে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত৷ কাঁধ ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শাবিহার পা জোড়া হুট করে থেমে গেল৷ সামনেই অয়ন দাঁড়িয়ে তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে৷ বাইকের সাথে ঠেলে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। হাতের কলম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলছে৷ শাবিহার ভীষণ নার্ভাস লাগছে৷ এই নার্ভাসনেস একদম পারসোনাল৷ চোখমুখ শক্ত করে সে আবারো হাঁটতে শুরু করেছে৷ আশেপাশে কোথাও তাকাচ্ছে না৷ অয়নের সামনে দিয়ে যেতে নিতেই তার বুক ধুকপুক করতে শুরু করেছে৷ হুট করে শুনতে পেলো অয়নের গলা,
চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে
রাগ করো না সুন্দরী গো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো৷
লজ্জায় শাবিহার কান গরম হয়ে উঠছে৷ মনেমনে বকল অয়নকে৷ ফাজিল ছেলে৷ বড়দের সম্মান করতে জানেনা৷ এদিকে অয়নের বন্ধুবান্ধব সিটি বাজিয়ে হাসছে৷ তবে অয়ন হাসছে না৷ কিন্তু তার ঠোঁট জুড়ে দুষ্টু হাসি৷ বন্ধুবান্ধবদ ফেলে দৌড়ে শাবিহার সামনে এসে দাঁড়ালো৷ শাবিহা তাকে ডিঙিয়ে যেতে চাচ্ছে আর অয়ন ঘুরেফিরে তার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে৷ শাবিহা রেগে তাকাল,
— সমস্যা কী তোমার?
— সুন্দর লাগছে আপনাকে৷ চুলের ঘ্রাণটা মারাত্মক সুন্দর৷ কী শ্যাম্পু দিয়েছেন?
— অয়ন! রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াও৷
— আপনার রাগী চেহারা আরও আকর্ষণীয়
দেখতে৷
শাবিহা রেগেমেগে অন্যদিকে হাঁটা ধরলো৷ এবার আর রাস্তা আটকে দাঁড়ায়নি অয়ন৷ বরং পিছুপিছু হাঁটছে৷ শাবিহাকে প্রিন্সিপালের রুমে যেতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ ঘুরেফিরে চলে এলো বন্ধুদের কাছে৷ বন্ধ সৌভিক বলল,
— শাবিহা আপুকে দেইখা মনেই হয়না সে মাস্টার্স পড়তেছে৷
অয়ন হেসে যাচ্ছে৷
–শালা মাইয়া পাস না খুঁইজা? তন্ময় ভাই জানলে তোর হাতপা কাইটা ফেলব৷
— বোনের জামাইয়ের হাতপা কাইটা ফেললে তার বোন কান্না করব ত৷
— জামাই? জাইগা জাইগা স্বপ্ন কম দেখ! আমি ভাবতেছি শাবিহা আপু তোরে এখনো জুতাপেটা করে নাই কেন?
— দুষ্টু সৌভিক কিছুই বুঝেনা৷ তোর শাবিহা আপুর ভালোবাসা আমি। ভালোবাসার মানুষকে কি কেউ জুতাপেটা করে নাকি? চুমু খায়, আদর করে৷
সৌভিক হাসছে৷ অয়ন তখনো ভার্সিটির কাউন্টারের দিক তাকিয়ে৷ সৌভিক এবার সিরিয়াস ভাবে বলল,
— দোস্ত তুই ফাইসা যাইতেছছ! আমার মনে হয়না শাবিহা আপু পটব কখনো৷ সবদিক দিয়া পারফেক্ট তিনি৷ দেখতে সুন্দর উচ্চবিত্ত পরিবার থেইকা, পড়াশোনায় ফার্স্টক্লাস৷ ক্যারিয়ার ও গড়ে নিছে৷ বাবার থেকে শুনছি ভালো ভালো পরিবার থেইকা তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসতেছে৷ বিয়েও হয়ে যেতে পারে৷ তুই পড়ে কিন্তু…
কথার মাঝপথে থামিয়ে দিলো অয়ন৷ চোখমুখে গম্ভীর ভাব৷ সৌভিকের চোখেচোখ রেখে বলল,
— ওর বিয়ে হইব৷ আর সেটা আমার সাথে৷ ওর পরিবার উচ্চবিত্ত আর আমার পরিবারও৷ ও পড়াশোনায় ফার্স্টক্লাস আর আমিও৷ ও ক্যারিয়ার গড়ছে আমিও গড়ব লাগলে। শুধু বয়সের গ্যাপ তো? আমি পুলিশ স্টেশন, কোর্ট, আদালত ঘুরে চার বছর বয়স বাড়াই নিব৷ ঠিকাছে না?
সৌভিক হেসে মাথা নাড়াল,
— মাম্মা তুই গেছোস৷ একদম গেছোস! প্রেমে পাগল হয়ে কবে যেন রাস্তায় ঘুরোছ৷ আমি মনপ্রাণ দিয়ে দোয়া করি, এই মাইয়া তোর কপালে পড়ুক৷ আমি আমার বন্ধুরে পাগল হইতে দেখতে পারমু না৷
অয়ন সৌভিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,
— হইবো কী? শাবিহা তো আমার৷ শুধুমাত্র
অয়নের!
অয়নের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফিরে এসেছে৷ সামনে শাবিহা৷ এদিকটায় আসছে৷ অয়ন ঠোঁট কামড়ে শাবিহার দিক তাকিয়ে রইলো৷ শাবিহার নেওয়া একেকটা পায়ের ধাপ গুনছে যেমন৷ শাবিহা ভার্সিটি থেকে বেরি দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ রিকশা ডাকবে তখনই তার সামনে বাইক নিয়ে অয়ন এসেছে৷ শাবিহা দেখেও না দেখার ভান করে রিকশা ডেকে উঠে বসলো৷ অয়ন রিকশার সাথে যাওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করছে৷ তবে হচ্ছে না৷ রিকশা যেই ধীরগতি অবলম্বন করে, এই গতিতে বাইক চালিয়ে মজা আছে নাকি?
—–
কিছুদিন ধরে ড়াশোনায় বিভোর অরু৷ গতকাল হায়ারম্যাথমেটিকসের এক্সাম গিয়েছে। তন্ময় যেহেতু তাকে শুধু ম্যাথম্যাটিকস করাতো, আর এখন ম্যাথম্যাটিকসের পরিক্ষা শেষ তাই আর পড়াশোনার ছুঁতো দিয়ে যেতেও পারছেনা তন্ময়দের বাসায়৷ আজ বন্ধ কাল আবার এক্সাম৷ কালকের এক্সামের জন্য শক্তপোক্ত প্রিপারেশন যে নিবে তাও পারছেনা৷ তন্ময়ের ভুত চেপেছে মাথায়৷ শুধু তন্ময়ের মুখমণ্ডল ভেসে উঠছে চোখের পাতায়৷ বই বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷ বিছানায় রাখা ফোন হাতে নিলো৷ দরকার ছাড়া কখনো তন্ময়কে কল করেনি৷ তন্ময়ও করেনি৷ ম্যাসেজ ও কখনো আদানপ্রদান হয়না প্রয়োজন ছাড়া৷ কিন্তু ইদানীং অরু চায় তন্ময় তাকে ম্যাসেজ করুক, কল করুক৷ কিন্তু লোকটা করেনা৷ অরু তন্ময়কে ম্যাসেজ গিফ পাঠাল ম্যাসেঞ্জারে৷ গিফ টি হলো একটা মেয়ে হাচি দিয়ে সর্দি দিয়ে চোখমুখ ভরিয়ে ফেলেছে৷ গিফ দিয়ে বিছানায় ফোন হাতে বসে রইলো৷ রাত বারোটা৷ এখন তন্ময়ের বাসায় থাকার কথা৷ রিপ্লাই কেন দিচ্ছে না? তন্ময়ের রিপ্লাই এলো না৷ এসেছে কল৷ অরু চমকে তাকিয়ে৷ ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো৷ মনকে প্রস্তুত করেছে বকা খাওয়ার জন্য৷ কিন্তু তন্ময় বকল না৷ গম্ভীর স্বরে বললো,
–কাল এক্সাম আছে না?
–আছে তো৷
— তাহলে তুই এখনো জেগে কেন?
–পড়ছিলাম৷
— সারাবছর কী করছিস?
— পড়েছি৷
— তাহলে আর পড়তে হবেনা৷ ঘুমাতে যা৷
–ঘুম আসছে না৷
— জোরপূর্বক ঘুমাবি৷
— জোরপূর্বক ঘুমানো যায়?
— যায়৷ যা চেষ্টা কর গিয়ে৷
অরু জবাব এবার নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ৷ বুকে হাত চেপে রাখল৷ বুকের ভেতরটা খুব জ্বালাতন করছে৷ শান্তি দিচ্ছে না একদম৷ হৃদয়টা কি লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে নাকি? অরু ধীর গলায় বলল,
— ঘুম আসছে না। কথা বলবেন আমার সাথে একটু?
— তোর সাথে কথা? ঠিকাছে বলবো৷ বড়ো হয়ে নে আগে তারপর৷
— আমিতো বড়৷ আমার অনেক বন্ধুদের বিয়েসাদী হয়ে গেছে৷ অনেকের তো বাচ্চা হয়ে গেছে৷
— এখন কী তুই বিয়ে করে ওদের মতো বাচ্চা নিতে চাস?
— না ছি ছি!
— তাহলে রাখ ফোন৷ যেদিন বিয়েশাদি করে বাচ্চা নিতে পারবি সেদিন কথা বলবি৷
কল কেটে গেল৷ অরু বোকার মতো ফোনের দিক তাকিয়ে৷ কথাটার আগামাথা বুঝল না অরু৷ কিছুক্ষণ ভাবলো তাও বুঝতে পারছেনা৷ অবশেষে আবারো ম্যাসেজ করলো তন্ময়কে,
— বুঝিনি৷ কথাটা আরেকবার বলবেন প্লিজ?
তন্ময়ের জবাব এলো সময় নিয়ে,
— আমার মাইর খাস না কতো মাস হচ্ছে যেন?
অরু একটা মন খারাপের একটা গিফ পাঠিয়ে অনলাইন থেকে চলে এলো৷ তন্ময় ঠিক কী বলেছিল সেটাই ভুলে গিয়েছে এখন! কী যেন বলেছিল লোকটা? ভাবতে ভাবতে টেবিল গুঁছিয়ে লাইট ওফ করলো৷ বালিশে মাথা দিতেই তার আবারো তন্ময়কে মনে পড়তে লাগলো৷ হুট করে চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সেদিনের অপ্রস্তুত দৃশ্যটি৷ দৃশ্যটি ভাবতেই অরুর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো৷ শক্ত করে চোখজোড়া বন্ধ করলো। মনেমনে নিজেকে নিজেই বকাঝকা করছে৷
চলবে