– “গতকাল বাসার ভাই আমার বুকে হাত দেয়ার চেষ্টা করেছিল, ফুফু!”
কথাটা শেষ করা মাত্রই নয়নার ফর্সা গালে থাপ্পড় পড়ে। মেয়েটি টাল সামলাতে না পেয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ে। হাতের কাছে কাঁচের গ্লাস ছিল সেটাও জমিনে ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে যায়। ফিনকি দিয়ে নয়নার ঠোঁট কে’টে র’ক্ত ঝড়ছে। মস্তিস্তের নিউরনে জানান দিচ্ছে, ব্যথা অনুভব করার তীব্র যন্ত্রণা।
নয়নার ফুফু আকলিমা রুটি তৈরী করার জন্য আটা মাখছিলেন, সেই হাতেই ভাইজির গালে থাপ্পড় বসান; রাগে তার শরীর কাঁপছে। লাখে একজন বাসার, ইন্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরি খুঁজছে। অমন সোনার টুকরো ছেলের সম্পর্কে অযাচিত কথা আকলিমা কেন কোনো মা-ই বিশ্বাস করবে না।
নিচে পড়ে নয়না কাঁদছে, কপালের বাম পাশটায়ও কে’টে র’ক্ত ঝড়ছে; সেদিকে তার চেতনা নেই। ভাগ্যের আকস্মিক উত্থান তাদের পরিবারকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সবার জায়গা তিন হাত মাটির নিচে থাকলেও নয়না ও তার বাবার জীবন এখনো নশ্বর এই পৃথিবীতেই আছে।
রিহান দৌড়ে আসে প্রিয় বোনকে বাঁচাতে। সম্পর্কে সে নয়নার ফুফাতো ভাই, বয়স দশ বছর। নয়নাকে ধরতে গেলে সে হাত ঝাড়া দিয়ে ওঠে, ছোট্ট রিহান টাল সামলাতে না পেরে কাঁচের উপর পড়ে যায়, মুহূর্তেই আর্তনাদ করে উঠে। তার কষ্টে নয়না অন্তর মুচড়ে ওঠে। নিজের ব্যথার কথা বেমালুম হয়ে রিহানকে বুকে জড়িয়ে নেয়। হাতে ভাঙা গ্লাসের টুকরো বাজেভাবে গেঁথে গেছে। নয়না এক টানে বড়ো টুকরো বের করে ফেলে। নিজের ওড়না দিয়ে চেপে ধরে খুব শক্তকরে।
.
কিছু সময়ের ব্যবধানে বড়ো ঘটনা ঘটে গেল। আকলিমা পুরোটা সময়ে ঘোরের মধ্যে থেকে যায়। যখন চেতনা ফিরে আসে ততক্ষণে ব্যাপারটা অনেক অতলে ডুবে গেছে। আকলিমা দর্জির কাজ করে। কাপড় পরিমাপের লম্বা স্কেল হাতের কাছে ছিল। রাগে সেটার দ্বারা নয়নার পিঠে আঘাত করতে থাকে সাথে বিশ্রী গালি।
– “নিজের ভাই-বোনদের খেয়ে এখন আমার ছেলেকে খেতে চাইছিস? দূর হো আমার ছেলের কাছ থেকে। তোর মতো অপয়া মেয়ের আমার ঘরে কোনো জায়গা নেই, বের হো আমার বাড়ি থেকে বের হো।”
উন্মাদের মতো আকলিমা নয়নাকে মারছে। রিহানকে বাঁচাতে নয়না সহ্য করে নিচ্ছে। রিহান এতক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নয়না উপায়ন্তর না পেয়ে চিৎকার করে বলে,
– “আর মেরো না, ফুফু। রিহানকে হাসপাতালে নিতে হবে।”
আকলিমা থেমে যায়। বাসার বাহিরে ছিল, এসে রিহানের অবস্থা দেখে নয়নার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। আকলিমা তখনই নিজের ঝাল মেটায়, ছেলের কানে বিষ ঢুকিয়ে দেয়,
– “ভাইজি বলে এই অপয়া মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। এখন আশ্রয়দাতাকেই ভক্ষন বলছে। আবার রিহানকে মে’রে ফেলতে চাইছে। এর আজকে একটা ব্যবস্থা কর, বাসার! নয়তো এই মেয়ে আমাদের সবাইকে মেরে জমি জমায় হাত বসাবে।”
বাসার ছোঁ মেরে রিহানকে নয়নার থেকে কেঁড়ে নেয়। নয়নার পেট বরাবর লাথি মেরে জমিনে ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আকলিমাও ছেলের পিছু দৌড়াতে থাকে।
নয়নার শরীরে অসংখ্য ক্ষত। চুইয়ে চুইয়ে সেখান থেকে রক্ত ঝড়ছে। তার সেদিকে ধ্যান মন কিছুই নেই। সে অনুতপ্ত রিহানকে আঘাত করে। তখন ব্যথার তাড়নায় ভেবেছিল তার ফুফু পুনরায় আঘাত করতে আসছে। ফেরাতে গিয়ে রিহানকে আঘাত করে বসে, বুঝতে পারে তার ভাইটা তার যন্ত্রণা ভাগাভাগি করতে এসেছিল। র’ক্তা’ক্ত ওড়না দেখে হকচকিয়ে উঠে নয়না। এই র’ক্ত তার রক্ষাকারীর, আদরের ভাইয়ের, যাকে সে নিজেই আঘাত করেছে। চিন্তন ফিরে আসতেই নয়না দৌড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।
পকেটে কানাকড়ি নেই, গাজীপুর শহরের পথঘাটও অচেনা। বিশ মিনিটের পথ এক ঘণ্টায় পায় হেঁটে গাজীপুর সদর হাসপাতালে পৌঁছায় নয়না। তার ফুফুদের চিকিৎসা এই হাসপাতালেই হয়ে থাকে। কাল বিলম্ব না করে মেডিসিন বিভাগে পৌঁছে কাঙ্খিত মানুষদের খোঁজা শুরু করে নয়না। চোখে তার অশ্রু, হাসপাতের সবাই অবাক নয়নে তাকে দেখছে। কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করার পর ইমারজেন্সি ঘরের সামনে আকলিমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নয়না। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
– “রিহান কেমন আছে, ফুফু?”
আকলিমার আক্রোশ তৎক্ষনাৎ বেড়ে যায়। নয়নার হাত চেপে ধরে সে। মা বলে মেয়েটা মেয়েটা আর্তনাদ করে উঠে। কাঁচ ফুটা জায়গায় আরো জোরে চেপে ধরে।
– “আমার জান বের হয়ে যাচ্ছে, ও ফুফু ছেড়ে দাও!”
– “তুই হয়েছিস তোর মায়ের মতো। অপয়া, অলক্ষ্যি; তোর মায়ের কারণে আমি বাপের বাড়ি থাকতে পারিনি। তার মেয়েদের নাকি আমি সহ্য করতে পারি না। ওরে হা’রা’ম’জা’দি, তুই-ই দেখছি আমাদের সুখ সহ্য করতে পারিস না। খেয়ে ফেললি না আমার ছেলেটাকে? আবার জিজ্ঞেস করছিস, রিহান কেমন আছে?”
আকলিমার চিল্লাচিল্লিতে ইমারজেন্সি রুমের দরজা খুলে যায়। মাক্স পরিহিত একজন যুবক বলে উঠে,
– “আপনাদের পারিবারিক প্রব্লেম বাহিরে গিয়ে মিটমাট করুন। আপনাদের জন্য আমাদের কাজের সমস্যা হচ্ছে।”
নয়না ব্যথাতুর দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকায়, অনুনয়ের স্বরে বলে,
– “আমাকে একটু রিহানের সাথে দেখা করতে দিবেন, প্লিজ! আমি একটু কথা বলেই চলে আসবো, ডাক্তার সাহেব!”
ছেলেটি কিছুক্ষণ নয়নাকে দেখে দরজা আটকে দেয়। নয়না ব্যথাতুর মনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীর ভেঙে আসছে। কিয়ৎ সময় পর বাসার ঔষধ হাতে উপস্থিত হয়, নয়নাকে দেখে রেগে তেড়ে আসে।
ভালোমানুষির আড়ালে লুকায়িত অমানুষটাকে মায়ের সামনে প্রকাশ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সে। আকলিমাকে আড়াল করে নয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিশ্রী হাসে।
কোমরে হাত ছুঁয়ে দেয়ার বাহানায় হাত এগিয়ে এনে বলে,
– “বুকে হাত দেয়ার কথা বলার পর তোর এই হাল হয়েছে তাহলে বুঝে নে, তোর শরীরের বিশেষ জায়গায় হাত দিলে তোর কী অবস্থা হবে? আরো বলবি, মায়ের কাছে?”
নয়না কাঁদতে কাঁদতে পিছনে সরে যাচ্ছে। হাত জোর করে অনুনয়ের সুরে বলছে,
– “আল্লাহ সইবে না, বাসার ভাই। আমি তোমার বোন হই।”
– “আজকালকার বোনেরা রক্ষিতাও হয়, আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যা, নয়না! তাহলে সবার জন্য ভালো হবে।”
ঘৃণায় নয়না মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুর্বল শরীরে পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে। আল্লাহ আল্লাহ বলে দোয়া করছে যেন কেউ এসে তাকে বাঁচিয়ে নেয়। বাসার নয়নার ওড়নার নিচে হাত নিবে তার আগেই ইমারজেন্সির দরজা খুলে যায়।
– “আপনার হাত থেকেও রক্ত ঝড়ছে, আসুন ড্রেসিং করিয়ে দেই।”
মেয়েলি কণ্ঠস্বর শোনা মাত্রই নয়না বাসারকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। ক্রন্দনমাখা চোখে মেয়েটির দিকে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলে, “আপনাকে আমি সারাজীবন মনে রাখব।”
পর্দার আড়ালে রিহানের চিকিৎসা চলছে। নয়না উঁকি দিয়ে দেখার বৃথা চেষ্টা করছে। রিহানের চিকিৎসা করছে সেই মাক্স পরা যুবক। হাতের ইশারায় নার্সকে এটা সেটা এগিয়ে দিতে বলছে। নয়নার চিন্তিত মুখখানা একবার দেখে সে বলে,
– “এখানে চিকিৎসা চলছে, সার্কাস নয়! ডাক্তারদের চেহারায় মধু লেগে নেই। অন্যকিছু দেখার চেষ্টা না করে, তাদের কাজ দেখুন।”
নয়না কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। লজ্জায় আড়ষ্টভাব চলে আসে নাকে মুখে। ফর্সা গাল দুটো নিমিষেই গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। সে তো রিহানকে দেখার জন্য উঁকি দিয়েছিল কিন্তু ডাক্তার তাকে কী ভাবলো? এদিকে নয়নাকে নিয়ে আসা মেয়েটি মুচকি মুচকি হাসে। নয়নার লাজরাঙা মুখশ্রীতে আরেকটু লাজ ঢেলে দেওয়ার জন্য বলে,
– “আমাদের স্যার কিন্তু ভীষণ হ্যান্ডসাম সাথে সিঙ্গেলও।”
নয়না বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। এতটুকু সময়ের মধ্যে নার্স নয়নার হাতের কাচগুলো বের করে পরিষ্কার করে ফেলে। বেন্ডেজ করার সময় তার নজর নয়নার হাতের কনুইয়ের উপর। জায়গাটুকু ফুলে লাল হয়ে আছে দেখে বুঝাই যাচ্ছে, আঘাতটা নতুন। নার্স নয়নাকে জিজ্ঞেস করে,
– “আপনার শরীরে এতো আঘাতের চিহ্ন কীভাবে? কে মেরেছে আপনাকে?”
– “ঐ কিছুনা।”
নয়না ইতস্ততভাবে উত্তর দেয়। নার্স কিছু না বললেও পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আসা ডাক্তার বলে উঠে
– “আজকাল বিবাহিতা নারীরা স্বামী দ্বারা অত্যাচারীত হয়েও ‘কিছু না’ বলে পাশ কাটিয়ে দেয়। এসব তুই বুঝবি না, ভাবনা।”
নয়না স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে আছে। সে বিড়বিড় করে বলে,
– “ডাক্তার কী আমায় বিবাহিতা মনে করেছে?”
(চলবে)…
#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_০১
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি
[নতুন গল্প, নিয়ে হাজির হলাম। আপনাদের রেসপন্সের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী পর্ব দিব।]