#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ৬
ডাইনিং টেবিলের উপর থাকা কাচের গ্লাসটা ঠাস করে মেঝেতে পড়ে যাওয়ায় চারপাশে ঝনঝন আওয়াজ তোলে। কাচের টুকরোগুলো পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। রাগে আদ্রিশের সর্বাঙ্গ কাঁপতে থাকে। ইতোমধ্যে তার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ক্রোধে। পাশে থাকা কাচের গ্লাসটা এই মাত্র ভেঙেছে আদ্রিশ। ভাঙা কাচের টুকরো হাতে লাগায় বেশ খানিকটা হাত কেটে যায় তার। হাত থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত গরিয়ে পড়ছে মেঝেতে।
আদ্রিশের এমন রাগ দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে আলভি। ওর এমন রাগ এর আগে কখনো দেখেনি আলভি। এমনটা হবে জানলে সে আদ্রিশকে থাপ্পর মারত না। আলভি অনেকটা রাগের বশতবর্তী হয়ে থাপ্পর মেরে বসেছে আদ্রিশকে। নিজের বোনকে নিয়ে এমন উলোট পালট কথা, কোন ভাই সহ্য করতে পারে এসব?অরনীও বেশ অবাক হয় নিজের ভাইয়ের এমন আচরণে। টেবিলের উপর ধাম করে কয়েকটা ঘুষি মারে আদ্রিশ। অরনী গিয়ে আটকে ফেলে। অরনী ধমকের সহিত বলল
-‘ কি পাগলামী শুরু করেছিস তুই? হাত কেটে রক্ত পড়ছে তো। বন্ধ কর তোর এসব পাগলামী, যা বলবি ঠিকঠাক করে বল। অযথা ঝামেলা করিস না।
কথাটা বলেই হন্তদন্ত হয়ে ফার্স্ট এয়েড বক্স আনতে যায় নিজ কক্ষ থেকে অরনী। ব্যান্ডেজ করে দেয় আদ্রিশের হাতে অরনী। আদ্রিশের গালে আলতো থাপ্পড় মেরে বলল
-‘ কতোটা হাত কেটে গেছে, খেয়াল আছে কি কোনো?
অরনীর কথাতে অসহায় চাহনিতে তাকায় আদ্রিশ। অসহায় কণ্ঠে বলল
-‘ ওরা কেউ আমায় বিশ্বাস করবে না, আপু। বলেও লাভ হবেনা হয়তো। দেখো, আমার পুরো কথা না শুনেই আমাকে থাপ্পর মারতেও দুবার ভাবল না আলভি। আজ আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুও বিশ্বাস করছে না আমায়। এখন তো নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে আমার।
অরনী আশস্ত করে আদ্রিশকে। আদ্রিশ ভরসা পায় একটু। এই একটা মানুষই তার একমাত্র ভরসার স্থান, তার আপন বড় বোন অরনী। উঠে দাঁড়িয়ে আলভির কাছে গিয়ে কোনো ভনিতা ছাড়াই আদ্রিশ বলল
-‘ আলভি, তুই আমায় ভুল বুঝচ্ছিস। হ্যাঁ মানছি, আমি যেটা করেছি সেটা অন্যায়। কিন্তু এছাড়া তো আর কোনো উপায় ছিল না আমার। তোদের সামনে বড় বিপদ। তোরা যাদেরকে আপনভেবে নিজ বাসায় আশ্রয় দিয়েছিস, তারাই তোদের ক্ষতি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
আদ্রিশের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকায় আলভি। সন্দেহের সহিত বলে ওঠে
-‘ আবারও নিজের দোষ ঢাকতে মিথ্যের আশ্রয় নিচ্ছিস বুঝি?
আদ্রিশের রাগ হয় ভীষণ। টেবিল চাপড়ে জোড় গলায় বলল
-‘ আরে নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে, কিন্তু তুই কেন বুঝতে চাইছিস না। তোর চাচী আর চাচাতো বোন জারাই মুল কালপ্রিট। তারাই তো…
আদ্রিশের কথা শেষ হওয়ার আগেই আলভি থামিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলে ওঠে
-‘ খবরদার, ওদের সম্পর্কে একটা বাজে কথাও বলবি না, বলে দিলাম। উনি শুধু আমার চাচী নন, আমার দ্বিতীয় মা। নিজের দোষ ঢাকার জন্য এখন আমার চাচী আর জারার নামে মিথ্যে অপবাদ দিতে তোর লজ্জা করছে না? তোকে বিশ্বাস করে আমি প্রথম বার ঠকেছি। কিন্তু দ্বিতীয় বার আর এই একই ভুল করব না আমি।
আদ্রিশ এবার তেড়ে যায় আলভির কাছে। অরনী ধরে ফেলে। আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু আদ্রিশকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। আদ্রিশ এবার চিৎকার করে বলে ওঠে
-‘ তোরা দুই ভাই বোনই মাথামোটা। আচ্ছা, মেহরুনের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তুই, তুই কি কিছুই বুঝতে পারছিস না? আর কিভাবে বললে বুঝবি তুই?
মেহরুনের ফোন বাজচ্ছিল বলে ফোনটা রিসিভ করে ফোন কথা বলতে বলতেই রুমের বেলকনির পথে পা বাড়ায়। কথার বলার এক পর্যায়ে হঠাৎ নিচে এতো চিৎকার চেচামেচি আর কাঁচের কোনো কিছু ভাঙার শব্দে কিছুটা ঘাবড়ে যায় মেহরুন। ফোনটা কেটে দিয়ে তাই দ্রুত পদে নিচে নেমে আসে সে। মেহরুনকে নিচে নামতে দেখে আদ্রিশ মেহরুনের কাছে এসে তাকে তার রুমে আসতে বলল। মেহরুন দ্বিধায় পড়ে যায়। এজন্য চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আদ্রিশ কিছু দূর যাওয়ার পর যখন দেখে মেহরুন এখনো আসেনি। তখন পেছন ফিরে ভ্রু কুচকে ধমকের সুরে বলে ওঠে
-‘ কি হলো, আমার রুমে আসতে বললাম না তোমায়? শুনতে পাওনি নাকি?
কিন্তু মেহরুন তার জায়গা থেকে এক চুল পরিমাণও নড়ে না। এটা দেখে আদ্রিশ আরও রেগে যায়। আর কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আলভি বলে ওঠে
-‘ মেহু এখানে আর এক মুহূর্তও নয়, তুই আমার সঙ্গে বাড়ি চল এখনই।
ভাইয়ের কথা শুনে মেহরুন আরও বেশি দ্বিধা দ্বন্দে নিপতিত হয়। আলভি আরও একবার বলার সাথে সাথে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আদ্রিশ চিৎকার করে বলে ওঠে
-‘ মেহরুন আর এক পাও যদি সামনে আগাও তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে, বলে রাখলাম।
আলভি আদ্রিশের দিকে এক পলক তাকিয়ে মেহরুনের হাত ধরে সামনের দিকে যেতে থাকে। আদ্রিশ দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে ফেলে মেহরুনের। থমকে যায় মেহরুন। মেহরুন এবার বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল
-‘ আমার হাত ছাড়ুন আপনি।
-‘ ছাড়বো না কি করবে তুমি?
আদ্রিশ নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয়। আবারও আলভি যখনই মেহরুনের হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইল তখনই একটানে মেহরুনকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আদ্রিশ। ফলে মেহরুন হকচকিয়ে যায়। আলভি অবাক হয়ে তাকায় ওদের দিকে।
আদ্রিশ দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে
-‘ মেহরুন আমার বিবাহিতা স্ত্রী। ও এখানে আমার সাথেই থাকবে। আমি ব্যতিত ওকে জোড় করার অধিকার কারও নেই। আমিও দেখে নিবো কে আমার কাছ থেকে আমার বউকে সরিয়ে নেয়।
মেহরুন ক্রুদ্ধ গলায় বলে ওঠে
-‘ আমি মানিনা এই বিয়ে। আপনি আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার কাছ থেকে আমার পরিবারকে আলাদা করেছেন। এখন আমার ভাইকেও কেন আলাদা করতে চাইছেন আমার কাছ থেকে? আপনি বড্ড খারাপ মানুষ। এজন্য আপনার মতো মানুষকে দেখলেই আমার ঘেন্না হয় ভীষণ।
আদ্রিশ শক্ত করে চেপে ধরে মেহরুনকে। মেহরুন ককিয়ে ওঠে। আদ্রিশ আর এক মুহূর্ত সময় অপচয় না করে মেহরুনকে হঠাৎ কোলে তুলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিজ কক্ষে চলে যায়। আলভি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। অরনী মনে মনে বলে, ‘মেহরুনের কপালে কি আছে, কে জানে।’
ঠাস করে বেশ কিছুটা জোড়ে শব্দ করেই দরজাটা আটকে দেয় আদ্রিশ। মেহরুনকে বিছানায় আলতো করে বসিয়ে দেয়। মেহরুন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গুটিসুটি মেরে বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে থাকে। তিরতির করে তার লাল গোলাপের পাপড়ির মতো ওষ্ঠাধর কেপে উঠতে থাকে কিছুক্ষণ পর পর।
আদ্রিশ এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে মেহরুনের পাশে বসে। মেহরুনের চোখে অশ্রু টলমল করছে। আদ্রিশ তা দেখে স্বযতনে মুখে দেয়। গালটা টেনে দিয়ে মুচকি হেসে ফেলে বলল
-‘ বোকা মেয়ে, কাঁদছ কেন তুমি?
মেহরুন এবার ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। আদ্রিশ বুঝতে পেরে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় মেহরুনকে। মেহরুন আদ্রিশ হতে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করতে থাকে। আদ্রিশ ছেড়ে দেয় মেহরুনকে।
ক্রন্দনরত মেহরুনের থুতনিতে আলতো ভাবে হাত রেখে মুখের কাছে মুখ এনে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল
-‘ একবার যখন আমার জালে ওতো প্রতোভাবে জড়িয়ে পড়েছো, তখন আমি হতে এতো সহজে তোমার নিস্তার মিলবে না, মেহরুন। কারণ #আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি 💖
আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিছুতেই তুমি ছাড়া পাবে না আমার থেকে।
মেহরুন স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে আদ্রিশের পানে।
#চলবে ~