#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব০৭
“হ্যালো মিস?উঠুন এবার।বাসায় যাবেন?নাকি এভাবেই গাড়িতে ঘুমিয়ে রাত পার করে দিবেন।আমার কাঁধটাকে তো একদম শিমুল তুলার বালিশ বানিয়ে নিয়েছেন।”
লিয়া ঘুমের মধ্যে একটু নড়েচড়ে উঠে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে। টেনেটুনে চোখের পাতা খুলে নিজের মাথাটা জারিফের কাঁধে দেখতে পাওয়ার সাথে সাথেই লিয়া দ্রুত ছিটকে দূরে সরে বসে। লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখে।
জারিফ সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লিয়ার দিকে শান্ত চাহনিতে চেয়ে ফের বলে উঠলো,,”গাড়ি চলে এসেছে।তা নামবেন?নাকি এভাবেই থাকবেন?যদিও আপনার ঘুম ভাঙ্গানোর আমার কোনোই ইচ্ছে ছিলো না।তথাপি না ভাঙ্গিয়ে উপায়-ও ছিলো না।আমাকে নামতে হবে।আর গাড়ি শহরে পৌঁছে গিয়েছে।এটাই লাস্ট স্টপেজ।”
কথাটা শেষ করেই জারিফ বাস থেকে নামার প্রস্তুতি নিতে থাকে। লিয়া ভাবে, কতক্ষন এভাবে ছিলাম? আল্লাহ মালুম। বিষয়টা কি বাজে আর বিশ্রী। উফ্!লজ্জায় আর অস্বস্তিতে লিয়ার গলা কাঁপছিলো কথা বলতে।তবুও লিয়া স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করে।লিয়া মৃদুস্বরে বলে উঠলো,,”হ্যা।আমিও নামবো।”
জারিফ দ্বিতীয় কথা না বলে নিজের মতো নামতে থাকে।লিয়া জারিফের পিছু পিছু নামতে থাকে।জারিফ বাস থেকে নামতেই লিয়া পেছন থেকে ডেকে বলে উঠলো,,”এই শুনুন ,শুনুন।”
জারিফ থেমে যায়।ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে তাকিয়ে ডান ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বোঝায়,”কি সমস্যা?”
লিয়া নিজের গায়ে থাকা জ্যাকেটের দিকে ইশারা করে বলে,,”এটা ফেলে যাচ্ছেন যে।”
কথাটা শেষ করেই লিয়া জ্যাকেটটা খুলতে যাবে। সেই মূহূর্তে জারিফ বললো,,”থাক লাগবে না।”
লিয়া ঠোঁট প্রসারিত করে কিছু বলতে যাবে।তার আগেই অতিপরিচিত কন্ঠস্বরে রাস্তার ওপাশ থেকে ডেকে উঠলো লিয়াকে। কন্ঠটা শুনে লিয়ার এক সেকেন্ডও দেরি হলো বুঝতে।কে ডাকছে।লিয়ার আব্বু মোটা গলায় লিয়াকে ডেকে রাস্তা পার হয়ে এ পার আসতে থাকে।জারিফকে কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও এনামুল খানের উপস্থিতি নজরে আসতেই লিয়া থেমে যায়। এনামুল খানের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে লিয়া। ড্রাইভার আঙ্কেল এসে লিয়ার ব্যাগটা গাড়িতে তুলতে থাকে। রাস্তার পাশের হলুদ রঙের সোডিয়ামের আলো জ্বলছে।তাতে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।লিয়া খানিকটা ভ’য় পাচ্ছিলো আব্বু কড়াকরে কিছু বলবে হয়তো। কিন্তু লিয়াকে অবাক করে দিয়ে এনামুল খাঁন গাড়ির দরজা খুলে কন্ঠে একরাশ স্নেহ মিশিয়ে বললেন,,
“লিয়া তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।তোমার শরীর খা’রাপ করছে কি?চোখ মুখ কেমন জানি ফ্যাকাশে লাগছে।তুমি ঠিক আছো?”
লিয়ার মনটা উসখুস করছিলো জারিফের থেকে বিদায় নিয়ে আসতে।আর মিষ্টি করে একটা থ্যাংকস দিতে। কিন্তু সেসব আর হলো কই।তার আগেই আব্বু চলে আসলো।লিয়া তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে,,”হুম।গাড়িতে বমি হয়েছিলো।এখন ঠিক আছি।তারপরেও খুব টায়ার্ড লাগছে।”
এনামুল খাঁন গম্ভীর কন্ঠে বললেন,,”বাসায় চলো।তোমার আম্মু খুব টেনশন করছে।”
লিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে জারিফের দিকে একনজর তাকায়।দুইহাত প্যান্টের পকেটে গুজে দাঁড়িয়ে আছে।হয়তো রিকশার জন্য ওয়েট করছে।লিয়া পিছন দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খায়।মৃদু আওয়াজে আহ্ শব্দ উচ্চারণ করে। তারপর দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে।
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে রিকশার দেখা মেলা ভার। প্রায় মিনিট পাঁচেকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে কোনো রিকশা বা অটোর দেখা না পেয়ে জারিফ হেঁটে সামনে এগোনোর কথা ভাবে।কয়েকপা এগিয়ে যেতেই জারিফের দৃষ্টি পড়ে পিচের রাস্তায় জ্বলজ্বল করে জ্বলে থাকা বস্তুতে।জারিফ কৌতুহল বশত ভালো করে নজর দেয়।একটা পায়েল দেখতে পায়।জারিফের তীক্ষ্ণ নার্ভ জানান দিচ্ছে এই পায়েলটা সে কোথাও দেখেছে। প্রায় দশ সেকেন্ড পর জারিফের মস্তিষ্ক স্থির করে,পায়েলটা বাসে বসা মেয়েটার। আজকে বাস যখন থেমে ছিলো।ঐসময় লিয়া গাড়িতে উঠছিলো।তখন জারিফ লিয়াকে লক্ষ্য করতে গিয়ে পায়েলটা নজরে পড়েছিলো।জারিফ একহাতে পায়েলটা তুলে নেয়।তারপর আলগা ময়লা ঝাড়তে ফু দেয়। সযত্নে নিজের পকেটে রেখে দেয়।
.
দুইদিন পর,,
নাতাশা ওর মিসের সাথে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।এমন সময় নাতাশা ঘাড় উঁচু করে সুমি মিসের দিকে তাকিয়ে বললো,,”মিস মামা এখনো আসছে না কেনো?”
সুমি স্মিত হেসে বলে,,”চলে আসবে এখনই।আমি ফোন করে বলেছি তো।আসতে একটু সময় লাগছে।এই আরকি।কেনো নাতাশা বেবি। তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
নাতাশা ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে বলে,,”উহুম।সমস্যা হচ্ছে না। উফ্!তবে প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে।”
“তাহলে ভিতরে চলো। ততক্ষণে পানি খেয়ে আসবে।আর এরমধ্যে তোমার মামা চলে আসবে।”
নাতাশা কিছু ভেবে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”নাহ্ ,মিস।থাক।বাসায় গিয়েই খাবো। মামা তো এখনই চলে আসবে বলছো।”
নাতাশা আবার ভিতরে যেতে রাজি না হওয়ায় সুমি বলে,,”আচ্ছা।ঠিক আছে,বাবা।তুমি এখানে চুপটি করে দাড়িয়ে মামার জন্য অপেক্ষা করো।আমি বাসার ভিতর থেকে তোমার জন্য ওয়াটার নিয়ে আসছি।কেমন?”
সুমি ভিতরে যায়। নাতাশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।একহাতে জামার সামনে থাকা কাপড়ের ফুলটা নাড়তে থাকে।লিয়া প্রাইভেট পড়তে আসছিলো। গেইট দিয়ে ঢুকে সামনে নাতাশাকে দেখে কাছে এগিয়ে যায়। নাতাশার সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলে,,”হ্যালো কিউটি পাই!কেমন আছো?”
নাতাশা কোনো উত্তর না দিয়ে কপাল কুঁচকে লিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।কোনো উত্তর না পেয়ে লিয়া অবাক হয়।লিয়া নাতাশার দিকে ঝুঁকে একহাতে নাতাশার গাল ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,,”কিউটি পাইয়ের কি মন খা’রাপ?কথা বলছো না যে।তোমার মামার জন্য ওয়েট করছো বুঝি?”
মামা কথাটাশুনে নাতাশার কপালের ভাঁজ প্রগাঢ় হয়।নাতাশা ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে সুন্দর করে বলে উঠলো,,”তুমি মামাকে চেনো?কে তুমি?আর আমি অপরিচিত কারো সাথে কথা বলি না,হু।”
লিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে,,”বাব্বাহ!”
নাতাশার কপালের উপর আসা চুলগুলো একহাতে সরিয়ে দিয়ে লিয়া মিষ্টি হেসে ফের বলে,,”আমি তোমার মামাকে চিনি।খুব ভালো করে।তোমার মামা আমার পরিচিত।তাহলে এবার আমাকে অপরিচিত বলো না, প্লিজ।”
নাতাশা ঠোঁট মেলে হাসে।তারপর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,,”ওহ্!তাই বুঝি।তুমি মামার পরিচিত। আচ্ছা আগে বলো,কিকরে মামাকে চিনো তুমি?”
“কিউটিপাই সেসব নাহয় পরে বলবো। তার আগে তুমি বলো,এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো যে।”
নাতাশার এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকার কারন শোনার সাথে সাথেই লিয়া পিঠ থেকে নিজের ব্যাগটা নামিয়ে ওয়াটার বোটলটা বের করে নাতাশাকে পানি খাইয়ে দেয়।জারিফ গেইট দিয়ে ভেতরে আসতে গিয়ে এটা দেখতে পায়।লিয়া সুন্দর করে নিজের ওড়না দিয়ে নাতাশার মুখটা মুছে দেয়।নাতাশা মিষ্টি হেসে বলতে থাকে,,”তুমি আমার খালামনির মতো মিষ্টি।আমার খালামনিও আমাকে এভাবে আদর করে খাইয়ে দেয়। আবার মুখ মুছে দেয়।তুমি জানো আমার আরেকটা ভালো আন্টিও আছে।সেও আমায় খুব আদর করে।”
লিয়া মৃদু হাসে। অতঃপর বলে,,”আমাকেও তোমার আরেকটা আন্টি ভাবতে পারো।”
নাতাশা কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে ফের বলে উঠলো,,”তোমাকে কি বলে ডাকা যায়।উমম!মিষ্টি আন্টি।তুমি অনেক মিষ্টি দেখতে।তাই তোমাকে মিষ্টি আন্টি বলবো,কেমন।”
লিয়া নাতাশার গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিঃশব্দে হেসে বলে,,”ওকে সোনা।”
এমন সময় পরিচিত গলার আওয়াজ শুনে লিয়া পেছন ঘুরে তাকায়।জারিফ ডেকে বলে,,”নাতাশা।”
নাতাশা জারিফের দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসে।একদৌড়ে জারিফের কাছে চলে যায়।জারিফ নাতাশার হাত ধরে চলে যেতে নেয়।কয়েক পা সামনের দিকে অগ্রসর হতেই।জারিফ থেমে যায়।নাতাশাকে বলে এখানে দাঁড়াও।আমি আসছি ওয়ান মিনিট। নাতাশা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা সম্মতি দিতেই জারিফ লিয়ার দিকে এগিয়ে আসে। জারিফ যতই লিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।আর ক্রমশ লিয়ার হার্টবিট বেড়ে চলছে।লিয়ার হৃদযন্ত্রটা বোধহয় ছিটকে বাইরে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। কেনো জানি না এই মানুষটাকে দেখলে লিয়ার চিন্তা ভাবনারা এলোমেলো হয়ে যায়।সেদিনের পর থেকে চোখ বন্ধ করলেই সুদর্শন আকর্ষণীয় ফেসটা মনের আয়নায় ভেসে উঠে।লিয়া ওড়নার কোনা হাতের মুঠোয় পাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।জারিফ লিয়ার সামনে এসে থামে। বিষয়টাতে লিয়া আশ্চর্যান্বিত হয়।লিয়ার অবুঝ মন নানান কিছু ভেবে চলছে।সেই মুহূর্তে জারিফ পকেট হতে কিছু একটা বের করে লিয়ার সামনে মেলে ধরে। জারিফের হাতে নিজের পায়েলটা দেখে লিয়া অবাক হয়।পায়েলটার আশা দুইদিন আগেই লিয়া ছেড়ে দিয়েছিলো।সেদিন রাতে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হতে বসেই লিয়ার নজরপড়ে পায়ে পায়েল নেই।পায়েলটা বাইরে পড়েছে এটা লিয়া শিয়র হয়।তাই এটা পাওয়ার আশাও রেখেছিলো না। এইমূহুর্তে জারিফের কাছে পায়েল দেখে লিয়ার নিটোল কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হয়।
“এটা বোধহয় আপনার। আমার যদি ভুল নাহয় তাহলে এটা আপনার-ই হবে।কি হলো কথা বলছেন না যে। আপনার নয় এটা?”
লিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে।অবাক হয়ে বলে,,”হ্যা। এটা আমার।আপনি কোথায় পেলেন?”
জারিফের একশব্দে স্পষ্ট উত্তর,,”রাস্তায়।”
জারিফ একটু থেমে ফের বলে,,”আপনি পড়তে আসবেন।এটা ভেবেই সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।বাই দ্যা ওয়ে,কালকে বোধহয় আপনি পড়তে আসেননি?”
জারিফের কথার পিঠে লিয়া চঞ্চল কন্ঠে বলে উঠলো,,”কেনো আমায় খুজেছিলেন বুঝি? এছাড়া তো জানার কথা নয়।আমি যে কাল পড়তে আসিনি।”
“হুম।”
জারিফের হ্যা সূচক উত্তরে লিয়ার মনে খুশিতে লাড্ডু ফোঁটে।লিয়ার অবুঝ মন সেকেন্ডেই রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।লিয়া মনেমনে আওড়ায়, তাহলে কি আমার মতো উনিও আমাকে মিস করছিলেন?আমার কথা ভাবছিলেন?আমাকে দেখার জন্য ওনার মনটা ছটফট করছিলো?
লিয়ার আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই জারিফ গম্ভীরভাবে বলে উঠলো,,”পায়েলটা আপনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য আপনার খোঁজ করেছিলাম।”
কথাটা শেষ করেই লিয়ার হাতে পায়েলটা ধরিয়ে দিয়ে জারিফ পিছন ফিরে চলে যেতে থাকে।জারিফের যাওয়ার দিকে লিয়া আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।জারিফের শেষের কথা লিয়ার মনমতো না হওয়ায় লিয়ার মুখভার হয়ে আসে।তবে পায়েলের দিকে নজর দিয়ে লিয়ার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফোটে।লিয়া ভাবে,সামান্য একটা পায়েল এত সযত্নে নিজের কাছে রেখেছেন।আবার ব্যাক করার জন্য সাথে করে নিয়ে দুইদিন ঘুরছে।বিষয়টা কি এমনি এমনি?এই এমনি এমনির মাঝে কি কোনো কিছুই নেই?
এমন সময় সুমি এসে লিয়াকে নাতাশার ব্যাপারে জিগ্গেস করে বলে,,”এখানে একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলো।লিয়া তাকে দেখেছো?”
লিয়া কিছু বলার আগেই সুমির ফোনে মেসেজ আসে।জারিফ টেক্সট করেছে। টেক্সট টা পড়ে সুমি বলে উঠলো,,”ওহ্।ওর মামা নিয়ে গিয়েছে।আমার একটা কল আসায় আসতে আসতে দেরি হয়ে গেলো।”
কথাগুলো শেষ করে সুমি প্রস্থান করে। লিয়া পায়েলটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হাঁসি রেখে গুনগুনিয়ে গাইতে থাকে,
মার ভি গায়ি তো মে তুঝে,কারতি রাহুঙি পেয়ার।সাতো জনম মে তেরা,সাত রাহুঙি ইয়ার।
এরমধ্যে রুপন্তী এসে লিয়াকে পরখ করে। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,”কি ব্যাপার লিয়া।মুখে গ্লুকোজ মার্কা হাসি।তারপর গুনগুনিয়ে গাইছিস।ব্যাপার স্যাপার কি দোস্ত?”
লিয়া এতক্ষণ খেয়ালই করেনি রুপন্তীকে। রুপন্তীর কথায় লিয়া হকচকিয়ে উঠে।লিয়া নিজেকে তটস্থ করে আমতা আমতা করে বলতে থাকে,,” ক কই কিছু নাতো।এমনি। রুপু তোর শুধু আজগুবি কথাবার্তা।”
রুপন্তী অবাকের সুরে বলে,,”আমি আবার আজগুবি কি এমন বললাম? অদ্ভুত! আচ্ছা হয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি ভেতরে যাবি।”
রুপন্তী সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।সেই মুহূর্তে
লিয়া পিছু ডেকে বলতে থাকে,,
“ওয়েট,ওয়েট।এই রুপু।”
রুপন্তী পিছন ফিরে তাকিয়ে ইশারায় বোঝায়,,”কি হয়েছে?”
লিয়া এগিয়ে যায়।এক আঙ্গুল নাকের দিকে ইশারা করে বলে,,”দেখতো আমার নাকটা কি চাইনিজদের মতো বোচা?আমার চোখ কি ব্যাকা?দেখতে কি আমি খুব কুৎসিত?”
লিয়ার এহেন প্রশ্নে রুপন্তী অবাকের উপর অবাক হয়।বিস্ময়কর চাহনিতে চেয়ে রুপন্তী শুধায়,,”হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছিস? আশ্চর্য!তোর এমন কথার ধরণ সবকিছু আমার মাথার দশ ইঞ্চি উপর দিয়ে গিয়ে বারি খেয়ে গেলো।এমন বোকা বোকা প্রশ্ন কেনো দোস্ত।মাথা টাথা ঠিক আছে তোর?তুই সুন্দরী এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।তবে এরকম বো”কা প্রশ্ন শুনে আমি আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি।”
“মাথা আমার অলওয়েজ ঠিক থাকে।আর এখনও আছে।তবে মনটা ঠিক নেই।ভাবছি আমার প্রতি কারো ফিলিংস না আসার কারন কি হতে পারে?আমার মায়ায় না পড়ার কারন কি হতে পারে?”
রুপন্তী ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে,,”কেউ কেউ সৌন্দর্যের মায়ায় পড়ে।কেউ আবার কারো কথার মায়ায় পড়ে।কেউ কারো চোখের মায়ায় পড়ে।কেউ আচরণের মায়ায় পড়ে।বুঝলি।”
“হুম। বুঝলাম।তবে আমি চাই আমার প্রিয় মানুষ আমার সব কিছুর মায়ায় জড়াবে।তার চোখের নীলাভাকার জুড়ে আমার বসবাস হবে।তার রাজ্য জুড়ে আমার রাজত্ব চলবে। সেখানে অন্যকারো ছায়াও থাকবে না।হাজারো ব্যস্ততার মাঝে আমার মুখটা তার দুচোখে ভেসে উঠবে। দিনশেষে সে আমাকেই খুঁজবে।সকল সমস্যার মাঝেও তার সুখের ঠিকানা আমি হতে চাই।জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে একটি কথাই বলবে,তুমিই আমার সুখের ঠিকানা।”
.
.
বর্তমান,,,,,
লিয়া অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে বলে,সেই স্বপ্ন আমার স্বপ্ন-ই রয়ে গেলো। উফ্!সেটাকে এখন আর আমি স্বপ্ন মনে করি না।সেটা শুধুই আমার জন্য দুঃস্বপ্ন ছিলো।আমার স্বপ্নগুলোকে নদীর শেষে নীল আকাশের কিনারায় ফেলে দিয়েছি।সময়ের বালু ঝরে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।আমি আপনাকে নিয়ে সুখের ঠিকানার রঙিন স্বপ্ন দেখলেও।আপনিতো অন্য কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন।সব কিছুকে অমিট করা গেলেও ভাগ্যকে কখনো অমিট করা যায়না।
তুলি সরু নজরে তাকিয়ে একহাতে লিয়াকে ধাক্কা দিয়ে বলে,,”এই লিয়া, লিয়া।কোথায় হারিয়ে গেলি?আর কিসব বিড়বিড় করে বলছিস?কি হয়েছে?কোন জগতে আছিস তুই,হ্যা?”
তুলির ধা”ক্কায় লিয়ার হুঁশ ফেরে। লিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘনঘন বলতে থাকে,,”কই কিছু নাতো।”
লিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ভেতরে যেতে থাকে।তুলি একহাত উঁচু করে ডেকে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,,
“এই লিয়া।তোকে কি বললাম।তুই কিছুই তো বললি নাহ্।ইভেন জারিফ ভাইয়া আর বাচ্চা মেয়েটার ছবি দেখালাম।তবুও কিছুই বললি না যে।কিছু তো একটা বল।”
লিয়া রুমের ভেতর যেতে যেতে বলে,,”তোকে অতো ভাবতে হবে না।আর বাচ্চাটার নাম নাতাশা। ওনার বোনের মেয়ে।”
তুলি জিহ্বায় কামুড় দিয়ে ঠোঁট আওড়ায়।এইরে না জেনেশুনে কতকি বলে ফেললাম।
.
.
ওদিকে জারিফরা বাসায় যাওয়ার পর নাতাশা এসে গাল ফুলিয়ে বলতে থাকে,,”তোমাদের সবার সাথে আমার আড়ি আড়ি আড়ি।তোমরা আমাকে নিয়ে যাওনি কেনো?খালামনি বললো তোমরা মামার জন্য বউ দেখতে গিয়েছো?আর আমার জন্য মামী আনতে।”
নীল এসে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে।নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বলে উঠে,,”এইযে নাতাশা তোমার জন্য তো বাতাসা আনি নাই।তাই বুঝি গাল ফুলিয়ে টমেটো বানিয়ে রেখেছো।মন খা’রাপ করো না।এর পরের বার ঠিকই বাতাসা নিয়ে আসবো।”
নাতাশা নাকমুখ কুঁচকে বলে,,”নীল মামু তোমাকে কতবার বলবো,আমি বাতাসা খাইনা।”
নাতাশা জারিফের হাত ঝাঁকিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় ফের বলতে থাকে,,”মামা তুমি কেনো আমাকে নাওনি বলো।আমি মামীকে দেখতে চাই চাই চাইই।”
জারিফ একহাতে নাতাশার চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলে,,”সরি।তোমাকে না নিয়ে যাওয়ার জন্য।অতদূর জার্নি করলে তোমার শরীর খা’রাপ করবে তাই নেওয়া হয়নি।উম!সোনা তুমি খুব শীঘ্রই তোমার হবু মামীকে দেখতে পারবে কেমন। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”
নাতাশা অবাক হয়ে বলে,,”সারপ্রাইজ!ওয়াও!কিসের সারপ্রাইজ মামা?”
জারিফ হাঁটু ভেঙ্গে নাতাশার সামনে বসে বলে,,”বললে তো সারপ্রাইজ থাকবে না সোনা। সিক্রেট থাকলো কেমন । কয়দিন পর তোমার বার্থডে সেখানে তোমার মামীকে দেখতে পাবে।আর আমি শিয়র দেখে তুমি একদম সারপ্রাইজড হয়ে যায়। এবং খুব খুশি হবে।”
নাতাশা জারিফের গালে চুমু খেয়ে হাসিমুখে বলে,,”ঠিক আছে।”
.
.
তুলি তুষার লিয়াদের বাসায় এসেছে আজকে দুপুরে।আজকে নাতাশার জন্মদিন উপলক্ষে জারিফদের বাসায় সবার দাওয়াত আছে ।সবাইকে দাওয়াত দিলেও বিভিন্ন কাজের জন্য বড়রা যেতে পারবে না।তবে ইনভাইট রক্ষার্থে ছোটরা যাবে। সন্ধ্যার পর যাবে।এখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে।তুলি আসার পর থেকে লিয়াকে বলে চলেছে।অথচ লিয়ার এক-ই কথা।সেখানে কোনো নড়চড় নেই।লিয়ার একটিই কথা।শরীর খা’রাপ লাগছে।সো এখন কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।লিয়া ওর রুমের বিছানার একপাশে বসে আছে।তুলি পা ঝুলিয়ে বেডে শুয়ে আছে।লিয়ার আবারো একই জবাবে তুলি শোয়া থেকে উঠে বসে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,
“এই লিয়া কখন থেকে বুড়ো মানুষের মতো একই কথা বলে চলেছিস,হ্যা।বুড়ো মানুষের মতো তোর কি জয়েন্টে জয়েন্টে পয়েন্টে পয়েন্টে ব্যাথা নাকি?যে কোথাও গেলে শরীরের ব্যাথা বাড়বে।সেই ভ’য়ে কোথাও যেতে চাইছিস না?ঘরকুনো হয়ে থাকতে চাইছিস।”
ব্যাথাটা শরীরের নয়।ব্যাথাটা মনের।শরীরের ব্যাথার জন্য মেডিসিন আছে।মেডিসিন নিয়ে শরীরের ব্যাথা কি’ল করা যায়।তবে মনের ব্যাথার কোনো মেডিসিন নেই কেনো? পৃথিবী তো এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে। পৃথিবী ছেড়ে মানুষ হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরের নাম নাজানা গ্রহ উপগ্রহের তথ্য কালেক্ট করছে।কত কিছু আবিষ্কার হয়েছে।সেখানে বিজ্ঞানীরা আজও কেনো মনের ব্যাথার মেডিসিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি?”
উফ্!লিয়া আড়ালে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফের মনেমনে আওড়ায়, উফ্!আমি যেতে চাচ্ছি না।এর পিছনে কারন একটাই।ঐ মানুষটার মুখোমুখি হলেই।না চাইতেও আমার হৃদয়ে ব্যাথা অনুভব হয়।যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম।আমার প্রথম ভালোলাগা আর প্রথম ভালোবাসার অনুভূতির মানুষ।সে কিনা আমারই বড় বোনের উডবি।আমি মনকে শত বোঝানোর চেষ্টা করছি।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি।তবুও বেহায়া মন।আমার বেহায়া নজর ঘুরেফিরে ঐ মানুষটাতেই নিবদ্ধ হয়।কিকরে আমি আমার বেহায়া মনকে বোঝাই?বোঝানোর কোনো ভাষা নেই। প্রেমে পড়লে সবাই কি আমার মতোই এতটা বেহায়া হয়?নাকি আমি নিজেই এতটা বেহায়া?তার থেকে পাওয়া অপমান নিয়েও আমার মনটা বারংবার তাকেই খোঁজে।তবে যাইহোক না কেনো।আমার অনুভূতিগুলোকে আর জাগ্রত করা মোটেও ঠিক হবে না। যতদ্রুত সম্ভব তাকে নিয়ে সৃষ্টি হওয়া আমার সব ফিলিংস ধুয়ে মুছে সাফ করতে হবে।তবে আদৌ কি কখনো সম্ভব হবে?
এসব কথা মনেমনে ভেবে লিয়া মাথা ঝাড়া দিলো।লিয়ার একরোখা জবাব ফের এলো,,”তোরা সবাই তো যাচ্ছিস যা।আমার ভালো লাগছে না।তাই যেতে পারবো না।”
তুলি দাঁত পিষে ফের বললো,,”আঠারো বছর বয়স কবিতা পড়েছিস কখনো?কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কি বলেছেন,আঠারো বছর বয়সীরা সব কিছু করতে পারে,হুম।শুধু এরজন্য মনে জোড়,উদ্দামতা আর সাহস থাকতে হবে।এই বয়সে কোনো না শব্দ মানায় না।তাই বলছি এই শরীর ভালো লাগছে না। হেনোতোনো কথা বাদ দিয়ে ফাস্ট রেডি হয়ে নে।তুই না গেলে আপুও ভীষণ মন খা’রাপ করবে।এমনিতেই আব্বু অসুস্থ আবার চাচ্চুরা অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় যেতে পারছেন না।”
রাজিয়া সুলতানাও লিয়াকে কয়েকবার বলার পর অবশেষে লিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেডি হয়।লিয়ার চাচাতো ভাই তুষার ড্রাইভ করছে।সামনে রাহবার বসেছে। পিছনে তুলি আর লিয়া। তাসনিম মেডিকেলে আছে।ওখান থেকে ওর যাওয়ার কথা আছে।”
.
পুরো বাড়ি জাঁকজমকপূর্ণভাবে সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।নাতাশা পিংক কালারের বার্বি লং ড্রেস পড়েছে। উপরের চুলগুলো প্রজাপতি ক্লিপ দিয়ে আটকানো।বাড়ির সবাই এটাসেটা কাজে ব্যস্ত। গেস্টরা আসতে শুরু করেছে। এরমধ্যে নাতাশা জারিফের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,,”মামা সবাই আসছে তো।মামী কই?মামী এখনো আসছে না যে।আর আমার সারপ্রাইজ?”
জারিফ স্মিত হেসে বলে,,”ওয়েট করো সোনা মামী এখনি চলে আসবে।আর তুমি তোমার মামীকে আগে থেকেই চেনো।উম!দেখলেই তুমি আশ্চর্য হবে।”
নাতাশা বড়বড় চোখ করে বলে উঠলো,,”তাই।ওয়াও!”
জারিফ পকেট থেকে ফোন বের করে তাসনিমের কাছে কল করতে থাকে।
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]
(লিয়া,জারিফ, তাসনিম ওরা যতই ওদের মনের আকাশে রঙিন ঘুড়ি উড়াক না কেনো।লাটাই থাকবে আমার হাতে।সো প্রিয় পাঠক পাঠিকা আপনারা আগে থেকেই কেউ কান্নাকাটি করবেন না।কারো বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত,একটু ধৈর্য্য ধরুন, প্লিজ।আর রেসপন্স করার অনুরোধ রইলো 🖤)