#নিশীভাতি
#৫৩তম_পর্ব
“হইবো না কেনো? গত রাতরে আমানরে ফুলিশ ধইর্যা লইয়্যা গেছে”
রাশেদার কথা শেষ হবার পূর্বেই আতিয়া খাতুন হতবাক স্বরে শুধালেন,
“কও কি? হাছা নি?”
“হ চাচী, তা কচ্ছি কি? পুলিশের জিপ রাত্তিরে আইলো। এক লগে ফাঁচজন ঢুকিলো। এক দেড় ঘন্টা বাদে বাইর হয়ে আইলো। আমানের হাতে হাতকরা”
“কেনো ধরলো?”
“জানে কেডা। ওই বাড়ির কাজের লোকও তো মুখ খুলে না। সালমা ভাবীর রক্তচাপ বাইড়ে একাকার অবস্থা। মাথায় ফানি পুনি দেলো। কি কান্ড”
আতিয়া খাতুনের কৌতুহল বাড়লো খানেক। প্রশ্নের মাত্রাও বাড়লো বেশ। রাশেদাও কথা চালাচালিতে বেশ পটু। তার সুবিধা হলো রসিয়ে রসিয়ে মানুষের হেসেলের খবর বলতে। এর মাঝে হুমায়রা নিশ্চুপ। আলাপনের কথাগুলো কর্নকুহরে এসেও যেনো প্রবেশ করছে না। বারবার স্মৃতিতে একটি গাঢ় স্বর ই ভাসছে,
“তুমি আর ভয় পাবে না”
কাজটির পেছনে যে ফাইজানের স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই হুমায়রার। এতোদিনে খুব না হলেও এটুকু বুঝে গেছে ফাইজান ইকবাল তার কথার নড়চড় করে না। সে এক কথার মানুষ, যদিও তার কথায় মারপ্যাচ থাকে অনেক। কথার মাঝে থাকে জমাট প্রহেলিকা। কিন্তু সেই প্রহেলিকাগুলো ধীরে ধীরেই কেটে যায়। শুধু ধৈর্য্য ধরতে হয়। হুমায়রার পাতলা ঠোঁটের কোনায় সপ্রতিভ হাসির রেখা উদ্দীপিত হলো। হুমায়রা লক্ষ্য করলো অজান্তেই মানুষটির প্রতি খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে সে। না মানুষটি তাকে নিজের উপর নির্ভরশীল বানিয়ে ফেলছে। আগে সবকিছুর পূর্বে ভাইজানকে স্মরণ হতো। অথচ এখন যেকোনো পরিস্থিতিতেই ফাইজানের কথা স্মরণ হয়। ব্যাপারটি খুব বাজে। অসম্ভব বাজে। কারণ এই মানুষটি ছাড়া সে কিছু কল্পনাও করতে পারে না। অথচ এই বিবাহে তার আপত্তি ছিলো সর্বোচ্চ। মানুষটি অপছন্দের তালিকাতে ছিলো সবার প্রথমে। আজ সমীকরণটা বদলে গেছে। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে মানুষটি।
“বুবু হাসো কে রে? তোমার শ্বশুরবাড়িতে একবার যাওন উচিত”
আতিয়া খাতুনের কথায় ধ্যান ভঙ্গ হলো হুমায়রার। স্মিত স্বরে বললো,
“বিকালে যাবো দাদী। তোমরা কথা বলো, আমি একটু ভাবীকে দেখে আসি”
আতিয়া খাতুন হেসে বললেন,
“যাও”
রান্নাঘরের ছনপাতা দিয়ে কুন্ডলি পাকিয়ে ছাই রঙ্গের ধোঁইয়া মিলিয়ে যাচ্ছে মাঘের সমীরণে। রাতের জন্য রান্না করছে ইলহা। মাটির চুলাতে শুকনো আমপাতাগুলো ঠুসে পুরলো ইলহা। চোঙাতে ফুঁ দিয়ে আগুনের আঁচ বাড়ালো। মশলা কষার গন্ধে হেসেলের কোনা কোনা পূর্ণ। ধোঁয়ার মাত্রা বাড়লে গলায় ঝাঁঝ লাগে। ফলে কেঁশে উঠে ইলহা। দাদা মারা যাবার পর থেকেই দাদী সংসার থেকে হাত তুলে নিয়েছেন। ঘরের মাঝেই থাকেন। নামায কালাম আগেও পড়তেন, কিন্তু এখন যেন প্রভুভীরুতা আরোও বেড়েছে। সারাক্ষণ প্রয়াত স্বামীর জন্য হাত তুলেন জায়নামাযে বসে। নয়তো তসবি গুনেন। নিস্পৃহ আত্মার মত মাঝে মাঝে চেয়ে থাকেন আমগাছের পানে। ভাবেন মৃত্যুর পূর্বে স্বামী কি দেখতো নিলীন চোখে। ফলে ইলহা নিজ দায়িত্বে সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে। মন্দ লাগছে না। মাঝে মাঝে শরীরটা দূর্বল হয়ে যায়। কিন্তু সেই দূর্বলতাকে বুঝতে চায় না সে।
“তুমি কি হাসপাতালে যাবে না ঠিক করলে? তাহলে চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছো?”
হুমায়রার কথায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় ইলহা। মিষ্টি হেসে বলে,
“এমন প্রশ্নের কারণ?”
“ডাক্তার সাহেবা, স্টেথোস্কোপ ছেড়ে খুন্তি হাতে নিয়ে বসে আসেন কি ভাববো?”
“এটা তোমার ভুল ভাবনা। এটা নারীর হাত, এই হাতে খুন্তিও শোভা পায় আবার স্টেথোস্কোপও”
হেসে উত্তর দিলো ইলহা। হুমায়রাও প্রত্তুত্তোরে হাসলো। প্রসন্ন স্বরে বলল,
“তাই যেন হয়। খুন্তির চাপে স্টেথোস্কোপ ছেড়ে দিও না”
“পাঁকা বুড়ি হয়ে গেছো একেবারে। তা এই বড় বড় কথা কি নেতাসাহেবের বদৌলত?”
“এ ভারী অন্যায় ভাবি, সকল কৃতিত্ব তার আর দোষের ভাগীদার খালি আমি। এ কেমন বিচার?”
এবার সশব্দে হেসে উঠলো ইলহা। ফুলকপি গুলো কষা মশলায় দিয়ে বললো,
“ক্ষমা করে দাও। আর হবে না। তবে জামাই এভাবে চলে গেলো কেনো। কদিন থেকে যেতে পারতেন”
“উনার সময় কই ভাবী। ভোটে জেতার পর থেকেই ঢাকায় যেতে হচ্ছে ঘন ঘন। রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো তো বুঝোই। শুনলাম নাকি মন্ত্রীত্ব পাবার কথা হচ্ছে”
“সে তো ভালো কথা”
“কিসের ভালো? শত্রু বাড়ানো। ভয় হয় ভাবী। উনার তো ভয় ডর নেই। আমার হয়”
“তাহলে বলে দেখো। ছোট বউ এর কথায় রাজনীতির পাঠ চুকে যাক”
“তুমি তাকে চিনোই না ভাবী। রাজনীতি তার রক্তে মিশে আছে। ক মাসের বউ এর জন্য দশ-বারো বছরের প্রেমকে ছাড়বেন না”
ইলহা হেসে উঠলো। হুমায়রা এর মাঝেই বলে উঠলো,
“আচ্ছা, ভাইজান কোথায়? দেখছি না অনেক ক্ষণ”
“বের হলে তো বলে যান। দেখো ঘরেই আছে”
“না ঘরে নেই তো, আমি দেখে এসেছি”
হুমায়রার উত্তরে ইলহার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। অবাক স্বরে বলল,
“উনি কি তাহলে থাকে গেলো?”
থানার কথা শ্রবনেন্দ্রিয়তে পৌছাতেই ফ্যাকাশে হলো হুমায়রার মুখখানা। আতংকিত হলো ফর্সা মুখখানা। ইলহাকে কিছু না বলেই উঠে দাঁড়ালো। ছুটে গেলো নিজ ঘরে। ফোন খানা চার্জে ছিলো। সাথে সাথে ডায়াল করলো ফাইজানের নাম্বার। কিন্তু ওপাশের মানুষটা ধরলো না। ফলে কপালে জমলো মুক্তদানার মতো ঘাম। চুলের ধার দিয়ে গড়িয়ে পড়লো সেই ঘাম। কাওছার যদি কিছু বলে দেয়? কি হবে তখন? এর মাঝেই একটি অচেনা নাম্বারের ফোন এলো হুমায়রার নাম্বারে। নাম্বারটি চিনে না হুমায়রা। অবাক হলো সে ভীষণ। সংকোচ নিয়ে ফোনখানা ধরলো সে, অপর পাশ থেকে চিকন মহিলা স্বর ভেসে উঠলো,
“হুমায়রা আমি যুবাইদা বলতেছি”
যুবাইদার কন্ঠে খানিকটা অবাক হলো সে। তার নাম্বার যুবাইদার কাছে কি করে এলো। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই যুবাইদা বলে উঠলো,
“কাওছার জেল থেইক্যা বাইর হইয়্যা যাইবো আজ কালকের মধ্যি। কালাম কেস তুইল্যা নিছে। আমার ভয় হইতাছে। কাওছার পারে না এমন কিছু নাই”……………………
চলবে
(আজ একটু ছোট পর্ব দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ, আগামীকাল বড় পর্ব দিবো)
মুশফিকা রহমান মৈথি
৫২তম পর্ব
https://www.facebook.com/share/p/2LBsLUusumC2SymH/?mibextid=oFDknk