#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৯)
তানভীর এরিয়া ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। পাশেই তার গাড়িটা পার্কিং করা। আজ সকালে গাড়িটা ধোঁয়া হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত ছিলো মার্কারের লেখাটা। এটা যে লাবিবার লেখা তা দেখেই বোঝা যায়। গুটানো গুটানো লেখা।এর আগে কখনো লাবিবার লেখা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আন্দাজে ঢিলটাও ছুঁড়তে হয়নি। যে কেউ বলে দিতে পারবে এটা লাবিবার লেখা। সে নিজেও যেমন তার লেখাও ঠিক তেমন। কিন্তু চিন্তাভাবনা গুলো বিশেষ করে আজ তানভীর তার প্রমাণ পেলো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সল্প পরিসরেই পায়চারি করলো। হাঁসফাঁস লাগছে। কেমন যেনো দমবন্ধকর পরিবেশ। দুপুরের রোদে চারিদিকে শুনশান। একটা মানুষ অব্দি নেই। অদূরে সোনালু গাছে কাক কাকা কাকা করছে। তানভীর কে ডাকতেই ফাহাদ বাইরে এসেছে।
” স্যার। আপনাকে ভেতরে ডাকছে। ”
” হুম। ”
” এনি প্রব্লেম স্যার? রোদে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?ভেতরে চলুন।”
‘ সিগারেট হবে? ”
“হ্যা?”
” সিগারেট।”
“স্যার..র!আমিতো খাই না।”
“তোতলাচ্ছ কেনো? তুমি আমার ছাত্র?আমার প্রতিষ্ঠানে ছিলে? দ্বিধা কিসের এতো?”
ফাহাদ দু মনা করতে করতে কি যেনো ভেবে সিগারেট বের করে দেয়। লাইটারে আগুন ধরিয়ে তানভীর গাড়ির পেছনে গিয়ে সুখটান দেয়। ধোঁয়া ছাড়তে থাকে।
“মেয়ে দেখতে এসেও সাথে সিগারেট! কয়টা চলে দিনে?”
“স্যার ইদানিং অভ্যাসটা ঝেকে বসেছে। কিছুতেই ছাড়াতে পারছিনা। ”
তানভীর আর কথা বলেনা। সিগারেট শেষ করে ফাহাদের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে। লাবিবা এখনো সেখানে উপস্থিত। প্রস্থান করার অনুমতি টুকু দেওয়া হয়নি। চ্যাংড়া ছেলেটা এখনো হা করে আছে। তানভীর গিয়ে লাবিবার পাশে দাঁড়ায়। সবাইকে দেখে নিয়ে লাবিবাকে বলে,
” তুমি এখন যেতে পারো। এখানে আর থাকার প্রয়োজন নেই।”
তানভীর মুখ খুলতেই সিগারেটের গন্ধ সরাসরি লাবিবার পেটে ঢুকে যায়। ওক্ করে উঠে একহাতে টুটি চেপে আরেক হাতে মুখ চেপে ধরে। উর্মিলা তাকে টেনে সরায়। তানভীর ভেতরে ভেতরে প্রমোদ গুনে। ফাহাদ চুপি চুপি চুইংগাম এগিয়ে দেয়। আস্তে বলে,
” সরি স্যার। চুইংগামের কথা মনে ছিলো না। আপনিও তো বললেন না। ”
“আমি সিগারেট খাই না।”
” মানে?”
“সিগারেট ছাড়ো। লাবিবা সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না।”
” সময় লাগবে স্যার। তাছাড়া আমি সবসময় মাউথওয়াশ ব্যবহার করবো।”
তানভীর মুচকি হাসে। ফাহাদের কাঁধ থাপড়িয়ে বলে,
“মুখটাকে পবিত্র রাখো। ম্যারিড লাইফে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটাই ফাস্ট প্রায়োরিটি হবে। ”
তানভীর মুরুব্বিদের সাথে আলোচনায় যোগ দিলো। দুই পরিবারের বন্ধন অটুট করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আগামী শুক্রবার কাবিন করা হবে। ছেলেকে চাকরীস্থলে যেতে হবে। তারপর বিয়ের উদ্দ্যেশে দীর্ঘ ছুটি কেটে অনুষ্টান করে মেয়েকে ঘরে তোলা হবে।
সন্ধ্যার আগেই খাওয়া দাওয়া শেষ করে ছেলেপক্ষরা চলে যায়। আগামী শুক্রবার কাবিন করা হবে খবরটা লাবিবার কাছেও যায়। লাবিবা কারো সামনে তেমন রিয়েক্ট না করলেও ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে। সে জানতো এটাই হবে তারপরেও মনকে বোঝ দিতে পারছেনা। রুমে এসে বিছানায় শরীর ছেড়ে দেয়। সারাদিনের টেনশনে দূর্বল হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টানে। এভাবে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করার পর চট করে উঠে বসে। ফেসবুক লগ ইন করে ফাহাদকে সাথে সাথে ব্লক করে দেয়। হুয়াটস এপ থেকেও ব্লক করে। ইমু, টেলিগ্ৰাম ও বাদ যায়না।তারপর কলেজের গ্ৰুপে ঢুকে তানভীরের আইডি খুঁজে বের করে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই মেজেস অপশনে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে টাইপ করে,
” স্যার হয়ে কিভাবে পারেন ছাত্রীর সাথে অসভ্যতা করতে? মুখের উপর সিগারেটের গন্ধ বের করে কি শান্তি পেলেন? ছিহ! ”
সেন্ড করেই লাবিবা রাগে গজগজ করতে থাকে। মাথার চুল টেনে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। পারে না। পর পর আরো লিখে সেন্ড করে
” স্যার স্যারের মতো থাকবেন। ”
” ছাত্রীর ব্যাপারে এতো নাক গলানো কেনো?”
” নিজে একবার বিয়ে করে শখ মেটেনি? না মিটলে আবার বিয়ে করেন তাও ছাত্রীদের কপালে কুঠার লাগানো বন্ধ করুন। ”
সেন্ড করেই লাবিবা স্কিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেসেজ ডেলিভারি হয়েছে কিন্তু সিন করা হয় নি। অনলাইনে থেকেও কেনো সিন করছে না? লাবিবার আবার রাগ লাগে। বিছানা ছেড়ে ধপ ধপ পা ফেলে বেরিয়ে আসে। কিচেনে এসে দাঁড়ায়। দুজন কাজের লোক সহ লাবিবা মা কাকী সব রান্না খাবার বাসন গোছগাছ করে রাখছে। লাবিবা হাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। রান্না করা মাংস থেকে বেছে বেছে সব থেকে শক্ত হাড্ডিগুলো বেছে নেয়। সাবিনা চেঁচিয়ে উঠে,
” আরে করছিস কি? এগুলো পায়ার হাড্ডি খেতে পারবি না কুকুর কে দিবো। নরম গুলো নে। ”
লাবিবা রক্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়। সাবিনা বুঝতে পারে মেয়ে খুব রেগে আছে। বিয়েটা একদমি করতে চায়না। তাই বলে কি আর বিয়ে ছাড়া থাকা যায়? আজ নয় কাল বিয়েতো করতেই হবে। মেয়ের কথায় সায় দিলে তো আর চলে না। এগিয়ে এসে চামচ ধরতেই লাবিবা ঝাকি দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। গলায় শান দিয়ে মায়ের উপর চেঁচিয়ে উঠে,
” আমি তো কুকুর ই। পোষা কুকুর। প্রয়োজন শেষ অন্যত্র ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। দিবেই যখন এতো মায়া দেখানোর কি আছে?”
” লাবি মা শোন।”
“দূরে থাকো। একদম দরদ দেখাতে আসবে না।”
যেভাবে এসেছিলো সেভাবে ধপ ধপ করে পা ফেলে চলে গেলো। সাবিনা করুন মুখে জায়ের দিকে তাকালো।
” এতো বোঝালাম মেয়েটা বুঝে না কেনো?” বলেই টুলে বসে পড়লো।
সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো নিরীহ হাড্ডির উপর। দাত দিয়ে শত চেষ্টা তে ও ভাঙতে না পেরেও লাবিবা থামলো না। যুদ্ধ চালিয়ে গেলো। কট করে একটা দাঁত নড়ে উঠলো। আরেকটা দাত কোনা কোনি ভেঙেও গেলো। হাতে উঠে আসতে দেখে লাবিবা ক্ষান্ত হলো। রাগটাও কমে এলো। অভিমানে চোখের জল গড়ালো। মেসেজ গুলোর কথা মনে পড়তেই টনক নড়লো। ‘ সর্বনাশ ‘ বলে চিৎকার দিয়ে লাবিবা ছাঁদ ছাড়লো। রুমে এসে তাড়াহুড়ো করে বিছানা এলোমেলো করে ওয়ার্ডড্রোবের উপর ফোনটা পেলো। পেয়েও লাভ হলোনা। এতোক্ষণে যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে। মেসেজ সীন করে ফেলেছে। নিচে ডট ডট উঠছে। রিপ্লাই টাইপ করছে। তারমানে মেসেজ মাত্র ই সীন করেছে এবং তানভীর খান ইনবক্সেই আছে। তাড়াহুড়ো করে সব মেসেজ আনসেন্ড করে দেয় লাবিবা। ছোট্ট করে লিখে দেয়,
” স্যার সরি।”
পর পর মেসেজ আসে।
” বেয়াদব।”
লাবিবার কাছে মেসেজটা বড্ড কঠিন লাগে। বেয়াদব ! এতো বড় বেয়াদবি করে ফেললো! তাও আবার তানভীর খানের সাথে। নিজের মাথার চুল এবার নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। লাবিবা সাথে সাথে অফলাইনে চলে গেলো। তবুও নিস্তার পেলোনা। তৎক্ষণাৎ কল এলো। লাস্ট ডিজিট দেখেই লাবিবার মাথায় বাজ পড়লো। প্রিন্সিপালের নাম্বার চেনেনা এমন কেউ মনে হয়না কলেজে আছে। লাবিবা ভয় পেয়ে গেলো। কল রিসিভ করলো না। তৎক্ষণাৎ মেসেজ আসলো,
” বেয়াদব! কি লিখেছো এসব? চাপকে সোজা করে দিবো মেয়ে।”
তাইতো! কি লিখেছে লাবিবা? একটু আগের লেখা গুলোও মনে করতে পারলো না। সব ভুলে বসে রইলো। ফোন বন্ধ করে দিলো। ফোন বন্ধ পেয়ে রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তানভীরের। কতবড় বেয়াদপ হলে স্যারকে এসব মেসেজ দেয়! কলিজায় কি ডর ভয় নেই? সাওয়ার নিয়ে আসতেই দেখে ফোনে ছোট্ট আলো জ্বলছে। হাতে নিতেই দেখে এসব উল্টা পাল্টা মেসেজ। তাও আবার একটা মেয়ের। আইডি নাম
‘ সুবোধ বালিকা।’ সুবোধ গিরি ছুটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আইডিতে নাম্বারটা পেয়ে ফোন লাগায়। এর সুবোধগিরী বের করেই ছাড়বে। কলেজের স্টুডেন্ট!একবার পাক। উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে।
হাফ বিল্ডিং একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে লাবিবা আর নাকিব। গেটের উপর বড় বড় করে লেখা
” আহমদ ভিলা।”
লাবিবা জিজ্ঞেস করে,
” এই বাড়িটাই?সিউর?”
” হ্যা চল।রোজি মেয়েটা পরশুই এসেছে। কালই চলে যাবে। আজ না এলে পেতামই না।”
দুজনে ভেতরে যায়। নাকিব ডাকে,
” রোজি আপু? আমি গতকাল যে এসেছিলাম। নাকিব।”
“ভেতরে এসো।”
ডাক পরে ভেতর থেকে। নাকিবের পিছু পিছু লাবিবাও যায়। সোফায় বসে গুটিসুটি হয়ে। মিনিট দুয়েকের ভেতরেই ফুটফুটে একটা মেয়ে আসে। গায়ে বাদামী রঙের শাড়ি। বয়স কত হবে? লাবিবার ছোট ই হবে। মিষ্টি হেসে লাবিবার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ছেড়ে দিয়ে বলে,
” মাশাআল্লাহ আপু। তুমি তো খুব সুইট। ফাহাদ ভাইয়ের পছন্দ আছে।”
” তোমার হাজবেন্ডের ও পছন্দ আছে বলতে হয়। এটা তোমার বাবার বাসা? কবে এসেছো?”
” হ্যা আপু। পরশুই এসেছি। ডাক্তার দেখাবো আজকে রাতে। কাল চলে যাবো।”
” বাবার বাড়ি চিকিৎসা! কেনো শ্বশুড়বাড়ি কি চিকিৎসা করায় না?”
” করায়। ফার্মিশির ডাক্তার কি আর বড় ডাক্তারের ঔষধ দিতে পারে?”
তাচ্ছিল্য হাসে রোজি। লাবিবা নড়েচড়ে এগিয়ে বসে রোজির দিকে। হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলে,
” আমাকে নাকিব কিছু কথা বলেছে। সেগুলো কি সত্যি? তুমি ভালো নেই রোজি। তোমার মতো আমি হতে চাই না। ছোট্ট একটা জীবনে আমি অনেক ভালো থাকতে চাই। ”
মলিন হাসে রোজী।। কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বলে,
” সব এই কপালের লেখন। তোমার কপালে থাকলে তোমাকেও ভূগতে হবে। ছা পোষা হয়ে আমার মতো জীবন কাটাবে। শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সেবা করে জীবন চলে যাবে। কয় মাস পর পর জামাই আসবে দুটো মিষ্টি কথা বলবে শরীরের খিদে মেটাবে আবার ফেলে চলে যাবে।”
” একজন অফিসার হয়ে কি করে এসব সাপোর্ট করে? ফাহাদ ও কি এসব সায় দিবে?তার সাথে তো আব্বুর ডিল হয়েছে। আব্বু যা যা শর্ত দিয়েছে তারা সব মেনেছে।”
” সেটাতো আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে আপু। পড়াশোনা করাবে কথা দিয়েছে। রাণীর মতো রাখবে। কোন অভাব হবেনা। মন চাইলেই ঘুরতে বেরোবে। বাবা মাকে দেখতে চাইলেই এসে দেখে যাবে। আরো কত কি! কত আশা সপ্ন দেখিয়ে আমার জীবনটাই শেষ করেছে। বাবা মার ব্রেইন ওয়াশ করে আমাকে নিয়ে গেছে। আজ বিয়ে না হলে আমি কি স্বাধীন থাকতে পারতাম না? আমার বাবা মা কি আমাকে পড়াতো না? এখন আমি বছরেও বাবা মা মুখ দেখতে পারিনা। রাণী হয়ে গিয়ে হয়ে গেছি চাকরানী। স্বামীর কোন ব্যপারেই থাকতে পারিনা। ফোনে দু চারটে কথা ছাড়া কিছুই হয়না। পুরুষ মানুষ বাইরে থাকে কি না কি করে বেড়ায় কিছুই জানতে পারিনা। চোখ বন্ধ করে দিয়েছে আমার। পুলিশ অফিসার! তাদের বিরুদ্ধে কোন স্টেপ ও নিতে পারিনা। বড় সংসার। কাজ করতে করতে কোমড়ে ব্যথা ধরে গেছে ফার্মেশি থেকে দুটো বড়ি ছাড়া কিছুই জোটে না। চিকিৎসার উছিলায় তাওতো বছর পর আসতে পারলাম। নাহলে তাও পারতাম না। ”
রোজী নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগলো। লাবিবার হাত দুটো মুঠোয় পুরে বললো,
” এ বিয়ে করো না। তোমার সম্পত্তির উপর তাদের লোভ পড়েছে। মেয়ে তুমিও কম যাও না। এতো রুপ কে লালন করতে বলেছে তোমাকে? রুপ না থাকলে তোমাকে চোখেই ফেলতো না। উনারা যত ই আধুনিক হোক। বাইরেই সব। আজ পর্যন্ত বলতে পারবেনা কোন পার্টিতে কোন বউ গিয়েছে। এলাকা ছাড়া তাদের কেউ চিনে না। সারাদেশে একেকজন চাকরী করে বেড়ায়। ভয় অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন পার করতে হয়। ”
নাকিব জানতে চায়,
” ফাহাদ ভাই কেমন আপু?”
” উত্তম সন্তান। বংশের গর্ব। বাবা মার কথা ছাড়া এক পা নড়ে না। সবার আদরের । বেশ হাসিখুশি। রসিক ও বটে! ”
” গার্লফ্রেন্ড আছে নিশ্চয়।”
” আমরা তা জানি না। থাকলেও বাবা মার কথা ছাড়া কিছুই করবেনা। ”
” দোস্ত উঠ। এই বিয়ে তোকে করতে হবেনা। ভয় পাসনা। আমাদের সতেরো বছরের বন্ধুত্বের কসম তোকে আমরা হারাতে পারবোনা। ”
চলবে,