#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ০৫
লম্বা শাওয়ার নিয়ে কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমে আসে আরহাম। ব্যাগ থেকে টাউজার বের করে পরে নেয়। তারপর ল্যাপটপ নিয়ে আরাম করে বিছানায় বসে। মায়ের সাথে কথা বলতে ভিডিও কল দেয়। কিছুক্ষনের মধ্যেই কল রিসিভ করে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠে একটি হাস্যজ্জ্বল মেয়েলি মুখ।
-ভাইয়াআআআ, কেমন আছো তুমি?
আরহাম মৃদু হাসলো ছোট বোনের কথা শুনে। শান্ত কণ্ঠে বলল,
-ভালো আছি। তোরা ভালো আছিস? মা কেমন আছে?
-আমরাও ভালো আছি আম্মুও ভালো আছে। তবে আম্মু তোমার সাথে ভয়ংকর রাগ করেছে একটুও কথা বলবে না।
-আম্মুর সামনে যেয়ে ফোন ধর আমিও দেখি কিভাবে রাগ করে থাকেন তিনি।
আরহামরা দুইবোন একভাই। তাঁদের বাবা মারা গিয়েছে দুই বছর হবে। দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকলেও আরহাম তাঁদের সাথে ততো একটা কথা বলে না। মা আর দুইবোনকে নিয়েই তার পরিবার। একজনের নাম সুনহেরা আরেকজনের নাম সনিয়া। সনিয়ার বিয়ে হয়ে গিয়েছে আর সুনহেরা মেডিকেলে পড়ছে ফার্স্ট ইয়ারে। ভাইয়ের কথা মতো সুনহেরা ফোন তাঁদের মা জিয়া বেগমের সামনে নিয়ে ধরে। মুখ ভার করে সোফায় বসে আছেন তিনি। আরহাম মায়ের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে হেসে ফেললো। একটু দুঃখী দুঃখী ফেইস করে বলল,
-মা তুমি কথা বলবে না আমার সাথে? সরি না, আর কখনও তোমার কথা অমান্য করবো না।
জিয়া বেগম কিছু বললেন না। একই ভঙ্গিতে বসে রইলো। আরহাম বলল,
-আমি প্রমিস করছি একমাসের মধ্যে আমি ঢাকায় আসবো। তারপর তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো।
জিয়া আড়চোখে ফোনে ছেলের দিকে তাকান। সন্দীহান কণ্ঠে বললেন,
-তুই সত্যি বলছিস আরহাম?
-একদম সত্যি। এখন তো মাফ করে দেও।
জিয়া বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। গদগদ করতে করতে বলল,
-ভালো আছিস বাবা? শরীরটা ভালো তো?
-ভালো আছি তোমার সাথে কথা বলে এখন আরো ভালো হয়ে গেলাম।
জিয়া প্রসন্ন হাসলেন। আরহাম বলল,
-সনিয়া কেমন আছে? আর তার পুঁচকু?
-সবাই ভালো আছে। আমরা তোকে ভীষণ মিস করছি বাবা জলদি চলে আয়।
-বললাম তো আসবো আম্মাজান।
-এবার আসলে একবারে বিয়ে করেই তোকে যেতে দেবো। আমার ভীষণ মনে ধরেছে একটি মেয়েকে। এখন ছেলের বউ তো আমি তাকেই বানাবো।
আরহাম পর পর কয়েকবার ঢোক গিললো। কোনোরকম কথা পরিবর্তন করে ফেলে। এই বিয়ের কথা শুনতে শুনতে সে এখন বিরক্ত। তার মতে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সই তো হয়েছে এখনই বিয়ের জন্য এতো তাড়া কেনো! আরহামের বিয়ের প্রতি অহীনতার আরেকটি কারণও আছে। কোনো মেয়েই চাইবে না তার স্বামী তার কাছ থেকে বছরের পর বছর দূরে থাকুক। আরহাম হলো ব্যস্ত মানুষ। তার কাজটাই এমন যার দরুন সে ওয়াইফকে সময় দিতে পারবে না, তার সাথে ঘুরতে পারবে না এককথায় অন্য কাপলদের মতো স্বাভাবিক সংসার তার ধারা হবে না। এইরকম নানান কারণে তার বিয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। শুধুই বউ নামক ঝামেল্লা মাথায় নেওয়ার থেকে আজীবন সিঙ্গেল থাকাই শ্রেয়।
_________________________
মাত্রই অহনার চাচার বাসায় এসে পৌঁছালো সবাই। একে একে অটো থেকে নেমে পরলো। চারতলার আধুনিক ডিজাইনের বাড়িটা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত লাল, নীল, সাদা রঙের কৃত্রিম বাতি দিয়ে সাজানো। মাহানুরের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো বাতির আলোতে। অহনার চাচা চাচীসহ অনেকেই এগিয়ে আসলো তাঁদের স্বাগতম জানাতে। যেহেতু বিয়ে বাড়ি মানুষজন তো হবেই। ছাদ থেকে উঁচুস্বরে গান বাজানোর আওয়াজ আসছে। তিনতলায় থাকে তারা। মাহানুর ভদ্রতার খাতিরে অহনার চাচাচাচীকে সালাম দিলো। অহনার দাদিও এগিয়ে আসলো। মাহানুরের সাথে সে ভিডিও কলে কথা বলেছিলো আগে। মাহানুর তার সাথে কথা বলল। অহনার চাচী বলল,
-কথাবার্তা পরে হবে অহনা মা তোমার বন্ধুদের রুমে নিয়ে যেয়ে বসাও। ক্লান্ত তারা একটু বিশ্রাম নেক।
অহনা চাচীর কথা মতো তাঁদের গেস্টরুমে নিয়ে যায়। রুমে আসতেই সিয়াম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে বলল,
-ভাই এতো মানুষের মধ্যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
মাহানুর বিছানায় ব্যাগ রেখে পা ছড়িয়ে বসে। মাথার হিজাব খুলতে খুলতে বলল,
-বিয়ে বাড়িতে মানুষ থাকবে না তো ভুত থাকবে নাকি! মগা।
মুহিব এতক্ষনে ফোন নিয়ে বসে পরেছে। কিছুসময়ের মধ্যে একজন মহিলা আসে তাঁদের জন্য শরবত আর কিছু নাস্তা নিয়ে। তার পিছু পিছু অহনা মা, চাচীর সাথে একজন ছেলে আর মেয়ে রুমে ঢুকে তাঁদের সাথে আরো কয়েকজন বাচ্চারাও আসে। মেয়েটি দৌড়ে এসে অহনাকে জড়িয়ে ধরে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,
-কতদিন পর তোকে দেখছি অহনা। আজ যদি তুই না আসতি তাহলে আমি তোর সাথে কোনোদিনও কথা বলতাম না।
-তোর বিয়ে আর আমি না আসবো হাফসা বা’ন্দর।
হাফসা নামক মেয়েটি অহনাকে ছেড়ে পাশে দাঁড়ায়। ছেলেটি এগিয়ে আসে। ক্ষণেই ছেলেটা বারবার মাহানুরের দিকে তাকাচ্ছে। মাহানুর সেটা খেয়াল করে মনে মনে হাসলো। মোটামোটি সুদর্শন ছেলেটিকে মাহানুরের কাছে খারাপ লাগলো না। স্মিত হেসে ছেলেটি বলল,
-কেমন আছিস অহনা?
-ভালো আছি হানিফ ভাই। তুমি ভালো আছো? বাহ্!কয়েক বছরে দেখি আরো সুদর্শন হয়ে গিয়েছো!
হানিফ মুচকি হাসলো। শান্ত স্বরে বলল,
-এইতো আছি কোনোরকম। ছোট বোনের বিয়ে আমি কী আর ভালো থাকতে পারি!
অহনা হাসলো। হাফসা অহনাকে বলল,
-তোর ফ্রেন্ডদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দে ছিনিয়ে নিবো না।
মাহানুর নড়েচড়ে একটু ভদ্রভাবে বসে। অহনার চাচী তাঁদের খাওয়ার জন্য জোর করতেই মাহানুর শরবতের গ্লাস তুলে নেয়। অহনা মাহানুরকে দেখিয়ে বলল,
-ও হলো মাহানুর। আর ঐ দুইটা সিয়াম আর মুহিব।
হাফসা ছুটে মাহানুরের কাছে যেয়ে বসলো। মাহানুরকে আগাগোড়া পরোক্ষ করে বলল,
-তোমার নাম আমি অহনার মুখে অনেকবার শুনেছি। ভীষণ দেখার ইচ্ছে ছিল তোমাকে।
মাহানুর স্বজনমূলক হালকা হাসলো। হানিফ সিয়াম আর মুহিবের সাথে হাত মেলালো। আড়চোখে আরো কয়েকবার মাহানুরের দিকে তাকালো। উপস্থিত সকলেই হানিফের বিষয়টা লক্ষ্য করছে। অহনার চাচী ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। কিছুক্ষন থেকে বড়রা ও হানিফ চলে গেলো। হাফসাকে সাজাতে পার্লার থেকে লোক এসেছে তাই সেও বিদায় নিয়ে চলে গেলো। মুহিব বিরক্ত হয়ে বলল,
-গোড়ার ডিম আমি একটু শান্তিতে আমার গফদের সাথে কথাও বলতে পারছি না।
-দুইদিনের জন্য ফোন পকেটে রাখ বুঝলি?
সিয়ামের কথায় মেয়েদের মতো মুখ বাঁকালো মুহিব। অহনা মাহানুরের পাশে এসে বসে বলল,
-আমি কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম গাইস।
-আমিও তো বুঝলাম। (সিয়াম)
মাহানুর ফোন হাতে নিয়ে জিগ্যেস করলো,
-কী?
-হানিফ ভাইয়ের মনে লাড্ডু ফুটছে তোকে দেখে।
মাহানুর ধমকের স্বরে বলল,
-চুপ বেয়াদপ মহিলা।
-সত্যি শুধু অহনা না আমিও খেয়াল করছি। দেখ আবার বিয়ের প্রস্তাব পাসনি মাহানুর!
মাহানুর কিছুই বলল না। ব্যাগ খুলে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। অহনা পুনরায় বলল,
-জানিস হানিফ ভাইয়া একজন আর্মি।
মাহানুর মৌন থেকেই ইয়ারফোন নিয়ে রুমের জানালার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। কানে ইয়ারফোন গুঁজতে গুঁজতে বাহিরে তাকাতেই নজর আটকে যায় তার। চমকিত নয়নে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-ওয়াও কী সুন্দর প্লেস! অহনা ঐটা কী?
মাহানুরের কথায় অহনা আর সিয়াম দৌড়ে আসে দেখার জন্য। ফোনে নজর ছিল মুহিবের মাহানুরের কথা সে শুনেনি। আচমকা তাঁদের দুইজনকে দৌড়াতে দেখে আঁতকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে। বিচলিত হয়ে বলল,
-কী হয়েছে? কোথায় আগুন লেগেছে ভাই?
-তোর মাথার পিছনে।
সিয়ার জানালার বাহিরে দৃষ্টি রেখেই বলল। অহনা মাহানুরের কথায় প্রতিউত্তরে বলল,
-আমি বলেছিলাম না চাচাদের বাসা থেকে আর্মি ক্যান্টনমেন্ট দেখা যায়। ঐটাই ক্যান্টনমেন্ট। রাতে চকচকে লাইটের আলোতে আরো বেশি সুন্দর লাগছে।
-আমি সেখানে যেতে চাই। (মাহানুর)
-সেখানে সাধারণ মানুষদের যাওয়ার অনুমতি নেই তবে আমি হানিফ ভাইয়াকে একবার বলে দেখবো নে। সে ঐখানেই থাকে। কাল সকাল ভোরে ঘুম থেকে উঠবি তারপর দেখতে পাবি কিভাবে ট্রেনিং করানো হয়।
-এখান থেকে দেখা যাবে?(মাহানুর)
-যাবে। নাহয় ছাদে চলে যাবো।
-ওকে ওকে। (মাহানুর)
রাত নয়টার দিকে হলুদের ফাঙ্কশন শুরু হয়। মাহানুর আর অহনা লাল রঙের হালকা ডিজাইনের থ্রি-পিস পরেছে। মাহানুরের সাজগোজের প্রতি এলার্জি তাই সে সবসময়ের মতো শুধু লিপস্টিক দিয়েছে। তার মতে সৃষ্টিকর্তা তাকে এমনেই সুন্দর বানিয়েছে তাই শুধুই টাকা অপচয় করে এক্সট্রা সুন্দরী হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তারা দুইজন বাদে সব মেয়েরা শাড়ী পরেছে আর পুরুষরা পাঞ্জাবী। অহনার ফুঁপ্পিরা মুখ ছিটকাচ্ছে। তাঁদের কাছে মেয়েদের ছেলে বন্ধু থাকা মানেই ভয়ংকর পাপ করে ফেলেছে সেই মেয়েটি। তাই আগেপিছে অহনা আর মাহানুরকে নিয়ে গসিপ করছে তারা।
হানিফ ক্ষণে ক্ষণে মাহানুরকে দেখছে। মাহানুরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।
গানবাজনায় বিরক্ত হয়ে মাহানুর ছাদের খোলা একপাশে চেয়ার নিয়ে বসে। লাইটের আলোতে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মৃদু বাতাসে কিছুক্ষন পর পর ছাড়া চুলগুলো উড়ছে। চুলগুলো ঠিক করে তার বাবাকে কল দেয়। কিছুক্ষন পরিবারের সকলের সাথে কথা বলে ফেইসবুক লগ ইন করে। সিয়াম আর মুহিব ভালোই মিশে গিয়েছে হাফসার কাজিনদের সাথে। অহনা তার দাদিকে রুমে দিয়ে এসে মাহানুরের পাশে এসে চেয়ার পেতে বসে পরে। মাহানুর তাকে দেখে বলল,
-এখানে কী করছিস ওদের সাথে যেয়ে এনজয় কর।
-আমার ভালো লাগছে না।
-শরীর অসুস্থ লাগছে? জ্বরটর এলো নাকি আবার!
-মুলাকে মনে পরছে আমার।
অন্যমনস্ক হয়ে মুখ ফোঁসকে কথাটা বলে ফেলে অহনা। ত্বরিত দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ডেকে ফেলে। সরমে সে আর নেই! মাহানুর উঁচুস্বরে হেসে বলল,
-আই ক্যান্ট বিলিভ! আমাদের অহনা শেষমেষে কিনা একটা মুলার প্রেমে পরলো! ওহ মাই গড!
অহনা আর মুখ ফুটে কিছু বলল না। মাহানুর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে এমন অবস্থা। দুইটা আইসক্রিম নিয়ে তাঁদের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিলো হানিফ। মাহানুরকে এভাবে হাসতে দেখে বিস্ময় হয়ে প্রশ্ন করলো,
-কী বেপার এতো সুন্দর হাসির কারণটা কী?
মাহানুরের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
-তেমন কিছু না ভাইয়া।
ভাইয়া বলায় মন ক্ষুন্ন হলো হানিফের। হাতের আইসক্রিম অহনার হাতে দিয়ে বলল,
-নেও তোমাদের আইসক্রিম।
অহনা একটা নিজে নিয়ে আরেকটা মাহানুরকে দিলো। তারপর হানিফের উদ্দেশ্যে বলল,
-ভাইয়া তোমার সাথে আমার কথা আছে বসো না আমাদের সাথে।
হানিফ ভীষণ খুশি হলো অহনার কথায়। মনে মনে থ্যাংক ইউ বলল অহনাকে। এখন সামনে বসে মাহানুরকে দেখতে পাবে। চেয়ারে বসে বলে,
-বলো কী বলবে?
-ভাইয়া আমরা আই মিন মাহানুর না আর্মি ক্যান্টনমেন্টে যেতে চায়। তুমি একটু ব্যবস্থা করে আমাদের একটু সেখানে ঘুরতে নিয়ে যেও।
মাহানুর রাগে কিড়মিড় করতে করতে অহনাকে অনেকগুলো বকা দিলো মনে মনে। তার নাম কেনো বলতে হবে আমরা বললেই হতো!
হানিফ বলল,
-সেখানে তো নরমাল মানুষের যাওয়ার অনুমতি নেই।
-ভাইয়া একটু ব্যবস্থা করেন না আমার অনেক দেখার ইচ্ছে।
রিকোয়েস্ট স্বরে বলল মাহানুর। হানিফ মোমের মতো গলে গেলো মাহানুরের কথায়। কোনোদিক বিবেচনা না করে বলল,
-যেহেতু তুমি যেতে চাও সেহেতু যেভাবেই হোক আমি নিয়ে যাবো।
-অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
হানিফ আরো কিছুক্ষন কথা বলে চলে যায়। অহনা মাহানুর হেসে ফেললো একসাথে। অহনা আপসোস স্বরে বলল,
-বেচারা তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে ভাই!
বোকা মাহানুর! আঁধারে একটা জোড়া জ্বলজ্বল দৃষ্টি সেই প্রথম থেকে তাকে পরোক্ষ করে চলেছে অথচ এর বিন্দুমাত্রও টের পেলো না সে। অগ্নিলাল আঁখিজোড়া ধপ করে বন্ধ করে ফেললো। নিস্তব্ধ রাত, স্বল্প আলোয় বিশাল দেহের অধিকারী মানুষটিকে আবছা দেখা যাচ্ছে। যদি মাহানুর একবারের জন্য মাথাটা ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাকাতো তাহলে হয়তো সেও দেখতে পারতো।
ক্যান্টনমেন্টে তিনতলায় আরহামের রুম। জোবান ভিতরে ঘুমিয়ে আছে। সে খোলা লম্বা বারান্দায় ব্যায়াম করছিলো। পরনে হাঁটু পর্যন্ত শর্ট পেন্ট আর একটি টি-শার্ট। বাতাসেও ঘেমেনেয়ে একাকার সে। কপাল দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে ঘাম ঝরছে। একান্ন নাম্বার পুশআপ করতে যেয়ে আকস্মিক তার দৃষ্টি আটকে যায় একটি চারতলা বাড়ির ছাদে। তার জানা মতে ক্যাপ্টেন হানিফ খোন্দকারের বাড়ি সেটা। অনেক ভালো সম্পর্ক তার হানিফের সাথে। আজ তো তার বোনের গায়ের হলুদ আগামীকাল বিয়ে। তাঁদের কয়েকজনকেও ইনভাইট করেছে। আরহাম দৃষ্টি সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বোতল নিয়ে পানি খেতে খেতে পুনরায় তার অবাধ্য বেহায়া নেত্র সেখানে চলে যায়। স্পষ্ট ভাবে মেয়েটির মুখ দেখতে না পারলেও মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বার বার চুল ঠিক করছে সেটা ভালোই খেয়াল করলো সে। অজান্তেই মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠলো আরহামের। তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে রুমের ভিতরে চলে যায়।
_______________________
সকাল ছয়টায় মানুষের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে মাহানুরের। রাতে অহনা, সে আর হাফসা একসাথে ঘুমিয়েছিল। মুহিব, সিয়াম হানিফের রুমে ঘুমিয়েছে।
পাশ ফিরে আরাম করে ঘুমাচ্ছিলো সিয়াম হঠাৎ সে অনুভব করে পিছন থেকে একটি হাত তাকে আঁকড়ে ধরে। ঘুমের মধ্যেই মৃদু নড়েচড়ে উঠে সিয়াম। আবারও গভীর ঘুমের মগ্ন হতেই সে অনুভব করে হাতটা তার কোমর থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। সিয়ামের সুন্দর ঘুম চট করে ভেঙে যায়। চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখে বিছানা খালি। হালকা ঘাড় বাকিয়ে পিছনে তাকাতে দেখে মুহিব তাকে ধরে রেখেছে। ঘুমের মধ্যেই মুহিব বলল,
-বেবি নড়াচড়া করো না আমাকে ঘুমোতে দেও।
সিয়াম বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো। হালকা হাতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো মুহিবের কাছ থেকে। মুহিব বিরক্তে কপাল কুঁচকে বলল,
-বেবি বললাম না আমাকে ঘুমাতে দেও। যাও রাতে আদর করে দেবো নে।
বলে ঘুমের মধ্যেই সিয়ামের গালে কিস করতে যাবে সিয়াম না পেরে লা’থি দিয়ে বিছনার নিচে ফেলে দেয় মুহিবকে। পরিহিত টি-শার্ট টেনেটুনে ঠিক করতে করতে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
-মাদার** তুই যে একটা গে সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম। আমারই ভুল হয়েছে তোর সাথে ঘুমানো আরেকটু হলে আমার ইজ্জত লুটে নিতি তুই!
মুহিব ঘুমের কারণে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। কোমরের ব্যাথায় “আহ” শব্দ করে উঠলো। সিয়াম সেটা দেখে বিড়বিড় করে বলল,
-শা’লায় এখন আবার মেয়েদের মতো অশোভনীয় শব্দ করছে!
মুহিব চোখ ডলে সামনে তাকায়। বিছানায় সিয়ামকে শুয়িত দেখে অবাক হয়ে বলল,
-কিরে বেটা তুই এখানে কবে আসলি? আর আমার জিএফ রুবি কোথায় গেলো!
সিয়াম রাগে নাক ফুলিয়ে বালিশ ছুঁড়ে মারে মুহিবের দিকে। মুহিব সেটা ক্যাচ ধরে উঠে দাঁড়ায়। কোমর ধরে বলে,
-ওরে আমার কোমর গেলো রে।
-তুই স্বপ্ন দেখে ঘুমের মধ্যে আমাকে রুবি মনে করে রোমান্স করছিলি আমার সাথে।
মুহিব পিটপিট করে তাকালো। সিয়ামের কথা তার বিশ্বাস হলো না। আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
-আবার তুই আমার ঘুমের ফায়দা নিয়ে কিছু করিসনি তো?
সিয়াম বিছানা থেকে নেমে মুহিবের পিছন সাইডে একটা লাথি দিলো।
-মাদার***
বকতে বকতে ওয়াশরুম চলে গেলো সিয়াম। মুহিব আধশোয়া হয়ে পুনরায় বিছানায় শুয়ে পরলো।
মাহানুর, অহনা, আতিকা আর হাফসা নাস্তা করেই ছাদে চলে আসে। মাহানুরের পরনে জিন্সপেন্ট আর কালো রঙের লং শার্ট। চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা, ঠোঁটে লিপজেল। ক্যান্টনমেন্টে চারপাশে লোহার ঘেরাও দেওয়া উঁচু করে যাতে অজ্ঞাত কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। জায়গায় জায়গায় দারোয়ান। বিশাল মাঠের মতো জায়গায় স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পিটি করার জন্যে যেভাবে দাঁড়ায় সেভাবেই অনেকগুলো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সারি সারি দাঁড়ানোর জন্য দেখতে অনেকবেশি সুন্দর লাগলো মাহানুরের কাছে। তখনই তাঁদের সামনে এসে উপস্থিত হয় কয়েকজন লোক। সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো সকলে একসাথে তাঁদের স্যালুট করলো। মাহানুর চেয়ার পেতে বসে দেখতে থাকে তাঁদের ট্রেনিং। ভীষণ উপভোগ করছে সে। এতো মানুষের মধ্যে আরহামকে সে খেয়াল করে না আসলে তার নজর শুধু আর্মি প্রশিক্ষণ ছাত্রদের ওপর।
এগারোটার দিকে হানিফ আসলো বাসায়। মাহানুরকে বলল ক্যান্টনমেন্টে যেতে চাইলে এখন তার সাথে যেতে পারে। মাহানুর হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো দ্রুত তৈরি হয়ে হানিফের সাথে যেতে রাজি হয়ে যায়। যেহেতু বেশি মানুষ একসাথে যাওয়া যাবে না তাই মাহানুর, অহনা, আতিকা আর সিয়াম গেলো। মাহানুর তো পারে না বেলীডান্স করে খুশিতে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অহনা বলল,
-আমার হার্টটাকে কন্ট্রোল করে রাখলাম না জানে কয়জনের ওপর ক্রাশ খায়।
মাহানুর শুধুই হাসলো। ক্যান্টনমেন্টে সুবিশাল লোহার দরজার সামনে এসে তারা থেমে যায়। হানিফ একটি কার্ড বের করে শিকউরিটি গার্ডকে দেখায়। হানিফ ভিতরে চলে যায়। গার্ড মাহানুরসহ সকলকে চেক করে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। আশেপাশে দেখতে দেখতে ভিতরে যাচ্ছে তারা। কত বড় বড় বিল্ডিং। অহনা ফুল গাছের সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। মাহানুর আর্মি পোশাক পরিহিত লোকদের দেখে এক দৃষ্টিতে তাঁদের দেখছে। হানিফ মাহানুরের সাথে কথা বলছে আর আগে বাড়ছে। হঠাৎ মাহানুরের হাতের ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে আয়াসের নাম দেখে কল রিসিভ করে বিড়বিড় করে বলল,
-আমি এখন বাহিরে আছি আয়াইস্যা পরে কল দিবো নে।
-জরুরি কথা আছে শুন।
মাহানুর ফোন হাতে নিয়ে একটু দূরে যেয়ে দাঁড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে হানিফের দেখা হয় আরহামের সাথে। হ্যান্ডশেক করে হানিফ জিগ্যেস করে,
-মেজর সাহেব এখানে?
-এপাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম দূর থেকে তোমাকে দেখলাম তাই একটু কথা বলতে চলে এলাম।
-ওহ আচ্ছা।
অহনা আর সিয়াম বিস্ময়বিমূঢ়। ডাগর ডাগর নজরে তাকিয়ে রইলো আরহামের দিকে। তারা আরো বেশি অবাক হলো আরহামকে আর্মি পোশাক পরিহিত দেখে। আরহাম দূর থেকে তাঁদের দেখলেও মাহানুরকে খেয়াল করেনি। মাহানুর কোনোরকম কথা শেষ করে কল কেটে দেয়। তপ্ত নিঃশাস ছেড়ে পিছনে ফিরতেই তার ছোটোখাটো একটা হার্টএট্যাক হয়। ক্ষণেই একবার আঁখিজোড়া বন্ধ করে পুনরায় খুললো। না সে ভুল দেখছে না। সেইদিন রাতের জিরাফকেই আর্মি রূপে দেখছে সে। কাঁপাকাঁপি পায়ে এগিয়ে আসতেই হানিফ তার উদ্দেশ্যে বলল,
-মাহানুর মিট মাই ফ্রেন্ড এন্ড স্যার মেজর আরহাম চৌধুরী।
>>চলবে।
(আসসালামু ওলাইকুম পাঠকগণ। আপনারা নেক্সট না লিখে পর্বটা কেমন হয়েছে সেটা বললেও তো পারেন! নেক্সট আপনাদের বললেও দেবো না বললেও দেবো। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে বলবেন। ধন্যবাদ। ❤)