#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬৬)
পুরোটা রাত কাটে লাবিবা বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। ভেবেছিলো তানভীরের রুমে থাকলে অন্তত শান্তি পাবে। কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছে ততো যেনো তানভীরকে মিস করার পাল্লা ভারী হচ্ছে । তানভীর কে কাছে চাইছে। লাবিবা কি চায়? ভালোবাসার মানুষ টা চোখের সামনে থাকলেও শান্তি। এইযে লাবিবা সারাদিন নিজেকে স্বাভাবিক দেখায়। আদৌ কি সে স্বাভাবিক আছে? তার সুখের বাড়িতে তানভীর খান নামক চোর সিধঁ কেটেছে। মনটা তো নিয়েছেই সাথে ভাবনা, চিন্তা, খুশি সবই নিয়ে গেছে। লাবিবার ভেতরের চাঞ্চল্যকর অনুভূতি গুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে না? হচ্ছেই তো। শুধু অপেক্ষা আর ভয়। কাছে থাকলে লাবিবা চিন্তামুক্ত থাকতো। প্রাণ ভরে জীবনটাকে উপভোগ করতো। একটা বিষয়ে তো নিশ্চিত থাকতো- সে আছে, পাশেই আছে। তানভীরের রুম, বিছানা, বালিশে লাবিবা একটুও ঘুমোতে পারলো না। মাঝরাতে বালিশের নিচে মাথা গুঁজে দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো তানভীর কে, ‘ খান সাহেব, আই নিড য়্যু। প্লিজ টেক মি ইন য়্যুর আর্মস। আই ওয়ান্ট টু ফিল য়্যু টু ডেথ। ‘
সাউন্ডপ্রুভ রুম হওয়ায় লাবিবার চিৎকার এর সাক্ষী হলো সুসজ্জিত দেয়াল আর আসবাবপত্র।
রোজী বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই লাবিবার খোঁজ করলো। লাবিবা নিজের রুমে জানতে পেরে রোজী আগে ফ্রেশ হতে গেলো। রোজী রুমে ঢুকে দেখলো অনেকটা অগোছালো হয়ে আছে। তামিম হসপিটালে যাবার সময় মনে হয় অগোছালো করে রেখে গেছে। গেঞ্জি পড়ে আছে চেয়ারের উপর। টাওয়েল বিছানার উপর। ডেস্কের বই সামনে দুইটা সামনের দিকে একটু বেরিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাহেব খুব তাড়াহুড়োতে বেরিয়েছে। রোজী আগে রুমটা টিপটাপ করে গুছিয়ে নিলো। তারপর গেলো ফ্রেস হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে জবেদা দাড়িয়ে নাস্তার ট্রে হাতে। রোজীর ক্ষুধা পায় কম। তবুও আজকাল জোর করেই খাওয়া দাওয়া করে যাতে স্বাস্থ্যটা একটু ফেরে। লম্বা চওড়া মানুষটার সাথে নিজেকে বড্ড বেশি বেমানান লাগে। দিন দিন যেতো পুতুল হয়ে যাচ্ছে। দুটো স্যান্ডুইচ আর দুটো আপেল। সাথে এক গ্লাস শরবত। এই সামান্য খাবার খেয়েই রোজীর পেট ভরপুর। একটু রেস্ট নিয়েই লাবিবার রুমে যাবে রোজী ভাবলো। কিন্তু তার আর যেতে হলো না। রোজী এসেছে খবর পেয়ে লাবিবাই রোজীর কাছে চলে এসেছে। দুজন দুজনকে পেয়ে যেনো কি ফিরে পেলো! দুজনের মুখ থেকে হাসি সরছে না। লাবিবা রোজীকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি বড় জা? বাপের বাড়ি থাকো কেনো? আমি ভাইজানের জন্য কি মন পুরে না?’
‘ কিছু দিন থাকো এখানে তারপর দেখো বাপের বাড়ি যে গিয়ে থাকবে আর আসতেই মন চাইবে না। ‘
‘ তোমার দেবর কে ছাড়া? একদিনও না। ‘
‘ সে দেখা যাবে। ‘
‘ এতো পাষান কেনো তুমি? তারপর বলো তোমরা দুজন মিলে কেমন আছো?’
রোজী মিষ্টি হাসলো। বললো, ‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘
‘ সব ঠিকঠাক করে নিয়েছো?’
রোজী মাথা নাড়ালো। ‘ না ‘ ।
‘ কি প্রব্লেম? ‘
রোজী অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। লাবিবার হাত মুঠোয় নিয়ে বললো, ‘ তুমি ছিলে না আমার মনে হতো সমুদ্রে সাঁতার কাটছি। এখন একটু সাহস পাচ্ছি। ‘
‘ ওকে। টেনশন নিও না। আমি হেল্প করবো। ‘
তামিম শুনলো রোজী এসেছে। বাইরে অযথা সময় নষ্ট করলো না। বাড়ি ফিরলো গরম গরম জিলাপির প্যাকেট হাতে। রোজীর জিলাপির প্রতি দুর্বলতা আছে।এটা জানতে পেরেছিলো রোজীর এক খালাতো ভাইয়ের মুখে। বাড়ি ফিরে পেলো ফিরোজ খান কে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে টেন্সট মনে হচ্ছে। নানান ঝামেলার মানুষটার একদন্ড টেনশন ছাড়া থাকার উপায় নেই। তামিম জবেদাকে ডেকে জিলাপির প্যাকেট হাতে দিয়ে বললো সবাইকে সার্ভ করতে আর বড়বউ, ছোটবউকে ডেকে আনতে। তামিম গিয়ে ফিরোজ খানের সামনা সামনি বসলো। ফিরোজ খান একবার তামিমের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ‘ ওহ তামিম ‘ বলে আবার চিন্তায় মশগুল হয়ে গেলো। তামিম আশপাশ চোখ বুলালো। সোহানা নেই। সেজন্য জিজ্ঞেস করলো,
‘ মম কোথায়?’
‘ ক্লাবে গেছে। চলে আসবে। ‘
‘ পাপা তুমি কি কোনো বিষয়ে টেন্সট? ‘
‘ হুম। ‘
‘ বলা যাবে কি?’
‘ সলুশন আছে তোমার কাছে?’
‘ প্রব্লেম না জানলে সলুশন কিভাবে দেবো?’
‘ ব্যবসার দিকটা তো তুমি একটু দেখতেই পারো। ‘
তামিম নড়ে চড়ে বসলো। ‘ পাপা আমি কিভাবে?’
‘ তোমার হাতে সপ্তাহে তিন দিন সময় থাকে। সোনার ব্যবসার দিকটা দেখলেও তো আমাদের একটু উপকার হয়। পাপা আর ছোটভাই খেটে খুটে মরছে আর তুমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমার একটাই ছেলে। আমার দিকটা বুঝে আমার হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ‘
‘ পাপা আমি তোমার বিজনেসে ইন্টারেস্টেড নই। ‘
‘ সেটাই আমার দুর্ভাগ্য। ভেবেছিলাম বড় ছেলে আমার বাধ্য, শান্ত আর বুদ্ধিমান। সেই আমার পরবর্তী হাল ধরবে। ছোট ছেলে ছোট থেকেই অবাধ্য বেয়াড়া। তাকে উপর ভরসা রাখিনি কখনোই। আজ ছোট ছেলেই আমার জন্য করে যাচ্ছে। ‘
তামিম মাথা নিচু করে নিলো। তার কিছু বলার মুখ নেই। অতীতের সময়ের কথা মনে পড়লো। তার বাবা তাকে যেভাবে দেখতে চায় সেতো সেরকমই একজন ছেলে ছিলো। যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান। নিজের সপ্নের পাশাপাশি বাবাকেও সাহায্য করে যেতো। এক দমকা হাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেলো। সবকিছু।
সোহানা ফিরে এসে দেখলো ফিরোজ খান চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। আর তার সামনে মাথা নিচু করে আছে তামিম। সোহানা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হয়েছে? ফিরোজ?’
উত্তর না পেয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রোজী,লাবিবা। ইশারা করতেই তারা মাথা নাড়ালো । কিছু জানে না। সোহানা তামিমের মাথা উপর দিকে তুললো।
‘ কি হয়েছে? তামিম? ‘
তামিম সোহানার হাত মুঠোয় নিয়ে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ পাপা আই এম সরি। আমার সময়টা খুবই খারাপ ছিলো। ‘
‘ এখনো খারাপ আছে? তুমি কি বলবে তোমার পাপা তোমার ভালো সময়ের জন্য কিছুই করেনি? এখন কি প্রব্লেম?’
‘ তুমি যা চাও তাই হবে পাপা। আমি তোমার ব্যবসায় সময় দিবো। তার আগে একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাই। ‘ বলেই তামিম রোজীর দিকে তাকালো। সোহানা তামিমের কপালে চুমু দিয়ে বললো, ‘ য়্যু ক্যান টেক য়্যুর টাইম। ‘
গরম গরম জিলাপী ঠান্ডা হতে হয়ে এলো। ফিরোজ খান প্লেটে হাত বাড়িয়ে একটু নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি এনেছো?’
‘ হুম পাপা। ‘
ফিরোজ খান ডাকলো, ‘ মামুনিরা এদিকে এসো। ‘
রোজী লাবিবা এগিয়ে এসে বসলো। জিলাপী দেখে রোজী মুচকি হেসে তামিমের দিকে তাকালো। তামিম আগে থেকেই তাকিয়ে ছিলো রোজীর হাসি হাসি মুখের দিক। সোহানা ফিরোজকে হুঁশিয়ার করলো কম খেতে বলে। লাবিবা একটু নিয়েই রুমের দিকে পা বাড়ালো।
লাবিবার এরকম চুপচাপ হয়ে যাওয়া মোটেই ভালোলাগছেনা সোহানার। রোজীও ঠোঁট উল্টে বসে থাকে। যতক্ষন একসাথে থাকে রোজীকে নিয়েই গল্প হয়। অথচ লাবিবার গল্পের কোনো অন্ত নেই। রুমেই থাকে বেশিরভাগ। সোহানা তানভীর কে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করলো। কিন্তু লাবিবা সাফ সাফ জানিয়ে দিলো তার সম্পর্কে তানভীরকে কিচ্ছুটি যেনো না বলে। সে যে এখানে আছে সেটাও যেনো না জানায়। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে সে তানভীর কে এভাবেই পানিশ করবে বলে ঠিক করলো। এইযে কথা বলে না খবর জানায় না এটা কি কম বড় পানিশমেন্ট? তানভীর তো শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে এটাও জিজ্ঞেস করতে পারবেনা যে লাবিবা কোথায়? লাবিবার নিজের ও তো কম কষ্ট হচ্ছিলো না। তবুও জেদ ধরে বসে থাকলো। সতেরো দিনের মাথায় সোহানা লাবিবাকে জোরে জোরে ডেকে জানালো তানভীর আসছে। লাবিবা কোনো রিয়েক্ট ই দেখালো না। শ্বাশুড়ির রুম থেকে থেকে গুটি গুটি পায়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলো। চোখ দুটো বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস টানলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েই ফিক করে হেসে ফেললো। ভেতরে ভেতরে প্রবল উত্তেজনা বোধ করলো। সব যেনো ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে চাইছে। এই মুহূর্তে কেউ দেখলে লাবিবা নিশ্চিত ভীষণ লজ্জা পেয়ে বসতো। আজকাল একটুতেই লজ্জা নামক রোগটা চেপে ধরে। কি এক যন্ত্রনা! কি মনে করে উঠে ভেনিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের প্রতি গভীর নজর দিলো। হায় হায়! ডান গালে ব্রণের দুটো দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কপালেও দুটো ব্রণ গোটা গোটা লাল হয়ে আছে। ইসস! কি বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। সবকিছু বাদ দিয়ে লাবিবা লেগে পড়লো রূপচর্চায়। চেহারার বাজে অবস্থা একদমি রাখা যাবেনা। চুল গুলো আঠা আঠা হয়ে আছে। কবে তেল দিয়েছিলো শ্যাম্পু করা হয়নি। লাবিবা দেড় ঘণ্টা লাগিয়ে গোসল করলো। কিচেনে এসে জবেদাকে বলে খাবার গরম করে খেলো। লাবিবাকে দেখে রোজী মুচকি হাসলো। লাবিবা রোজীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপু কি বেরোচ্ছো?’
রোজীর সময় নেই। তামিম বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। যেতে যেতেই বললো, ‘ তোমার ভাইয়ের সাথে। ‘
লাবিবা হাসি মুখে বিদায় জানালো। সোহানা লাবিবার মাথায় হাত রেখে প্রাণ ভরে দোয়া করলো। অবশেষে মেয়েটার হাসি মুখের দেখা পেয়েছে বলা যায়। লাবিবা অনেক বার জিজ্ঞেস করতে চাইলো তানভীর কখন এসে পৌঁছাবে বলেছে? কিন্তু বাঁধা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারছেনা। সোহানার পাশে বসে ছটফট করছে।
সোহানা খেয়াল করলো লাবিবার অস্থিরতা। মেরুন রংয়ের থ্রিপিচে মেয়েটা ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। মেরুন শাড়িতে নিশ্চয় আরো সুন্দর লাগবে। সোহানা অফার করলো, ‘ শাড়ি পড়বে? ‘
‘ সামলাতে পারিনা। ‘
‘ দুই চারদিন পড়লেই পারবে। চলো শাড়ি পরানো শিখিয়ে দিচ্ছি। ‘
সোহানা আলমারি থেকে মেরুন রংয়ের আডং এর সুতি শাড়ি বের করে আনলো। এখনো পাটভাঙা হয়নি শাড়িটার। ভীষণ সুন্দর শাড়িটা দেখে লাবিবা বেশ খুশি হয়ে গেলো। কিন্তু সেই রংয়ের ম্যাচিং ব্লাউজ খুজে পেলো না। সোহানার চোখ পড়লো ডিজাইনার ব্লাউজ গুলোর দিকে। সেখান থেকে একটা ব্লাক স্লিভলেস ব্লাউজ বের করে নিলো। লাবিবা আমতা আমতা করতে লাগলো। সোহানাই সাহস বাড়িয়ে দিলো।
‘ শ্বশুড় আর ভাসুরের সামনে পড়লে মাথায় এমনিতেই ঘোমটা দিতে হয়। সমস্যা নেই তো। ‘
লাবিবা লজ্জা পেয়ে পেছন থেকে সোহানাকে জড়িয়ে ধরে। আদুরে গলায় বলে, ‘ মামুনি তুমি অনেক ভালো।’
‘ আই নো। ‘
তানভীর বাড়িতে ঢুকেই গিয়ে সোহানাকে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু দিয়ে সোহানা বলে,’ আই মিস য়্যু বাবা। ‘
‘ মিস য়্যু টু মম। আর সব কোথায়?’
‘ বাইরে আছে। ‘
তানভীর ড্রাইভারকে লাগেজ গুলো নিজের রুমে পৌঁছে দিতে বলে সোহানাকে বলে,
‘ আমি এখটু আসছি মম। ‘
‘ কোথায় যাচ্ছো? ফ্রেশ হয়ে রেষ্ট নাও। এখন কোথাও যেও না বাবা। ‘
তানভীর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ ওকে এনে একেবারেই রেষ্ট নিবো। আসছি। ‘
‘ কাকে এনে ? লাবিবা? আরে লাবিবা তো এখানেই। তানভীর। শোনো বাবা। ‘
ততোক্ষনে তানভীর গাড়িতে গিয়ে বসেছে। খান বাড়ির চত্বর ছেড়ে গাড়ি পাকা রাস্তায় চলতে শুরু করে। সোহানা লাবিবাকে ডাকতে ডাকতে উপরে আসতেই দেখে লাবিবা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে ___
®লাবিবা তানহা এলিজা
( গল্পটি সম্পূর্ণরুপে কপি পোস্ট করা নিষেধ। তবে শেয়ার দিতে পারেন। অনান্য আইডি বা পেইজে কপি, ইউটিউব ভিডিও বা থিম কপি করার অনুমতি নেই। )