#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১৮_১৯
পর্ব ১৮
অহনার কথা শ্রবণ হতেই বাকি ঘুমটুকু উড়ে গেলো মাহানুরের। চোখ খুলে গেলো আপনা আপনিই। হৃদপিন্ড ধক ধক শব্দ করতে লাগলো তার। অহনা মাহানুরকে আরেকটু ভীত করার জন্য বলল,
-দোস্ত ফার্স্টনাইট ওর বাসরারাত মানে তো জানিসই! আমরা কিন্তু একজন আরেকজনকে প্রমিস করেছিলাম ফার্স্টনাইটে কে কী করবো তা দুইজন দুইজনকে বলবো। আগামীকাল তোকেও কিন্তু বলতে হবে।
মাহানুর রোবটের মতো শুইয়ে রইলো। অহনা মুখ চেপে হাসলো। আপসোস স্বরে একা একাই বলল,
-কোথায় মাহানুর আমাদের বলেছিলো সে কখন বিয়েই করবে না! অথচ আজ বাদে কালই সে আর ভা’র্জি’ন থাকবে না! আপসোস আর আপসোস।
অহনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানায় উঠে বসলো মাহানুর। চুল খোঁপা করতে করতে অদ্ভুত মুখ ভঙ্গি করে বলল,
-ছি! কী বলছিস এসব তুই!
মাহানুর বিছানা থেকে নেমে ব্যাগ খুলে ড্রেস বের করে। বিকৃত মুখে বিড়বিড় করে বলে,
-ছি ছি! ছি!
ওয়াশরুম চলে গেলো মাহানুর। অহনা ভেবছেকা খেয়ে শুয়ে রইলো। মাহানুর এতবার ছি ছি কেনো বলল বুঝতে পারলো না সে। হয়তো অতিরিক্ত শক খেয়ে নিজের অস্তিত্বই ভুলে গিয়েছে মাহানুর।
একবারে গোসল করেই বের হয় মাহানুর। আজ সকালে তাকে আর সুনহেরাকে একসাথে হলুদ গোসল দেওয়া হবে। রাতে বিয়ে আর আগামীকাল সবাই বাসায় চলে যাবে। রিসেপশনের ফাঙ্কশন একমাস পর করা হবে কারণ বিয়ের তিনদিন পরই সুনহেরার এক্সাম। এদিকে মাহানুরের প্ল্যানিং আগামীকাল ভোরেই সে রওনা হবে তার মঞ্জিলে। মেহরাব খান, হামজা খানের সাথে কথা বলেছে সে। দুইজনই তাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। এখন আরহাম কোনো গেঞ্জাম না করলেই হলো!
সোফায় বসে বসে ভেজা চুল ঝাঁড়ছে মাহানুর। জগড়া করতে করতে সিয়াম আর মুহিব মাহানুরদের রুমে প্রবেশ করে। ভিতরে এসেও তারা নিজেদেয় মধ্যে ঝগড়া করেই যাচ্ছে। অহনা নাক, মুখ কুঁচকে ধমকে উঠলো দুইজনকে।
-চোপ বা’ল। এভাবে মেয়েদের মতো ঝগড়া কেনো করছিস তোরা?
-এই মুহিব হা’রা’মিই এসে গায়ে পরে ঝগড়া করছে। আর কাজকাম নাই শা’লার।
-তোদের ঝগড়া দেখে আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় তোরা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড!
-যা সর। উল্টাপাল্টা কথা বলবি না একদম।
বলল সিয়াম। মুহিব মাহানুরকে দেখে সন্দীহান নজরে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। কণ্ঠস্বর খাঁদে ফেলে বলল,
-মাহানুর তুই কী কাল রাতে আরহাম ভাইয়ের সাথে থেকেছিস নাকি?
-দুর না। কী সব বলছিস!
-না মানে সকাল সকাল গোসল করেছিস তাই জিগ্যেস করলাম!
মাহানুর বসা থেকে উঠে মুহিবের মুখে তোয়ালে ছুঁড়ে মারে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-তোর মতো আ’বা’লকে আইতে ঝা’ড়ু যাইতে জু’তা দেওয়া দরকার! কু’ত্তার নানা।
-আচ্ছা ভাই তোরা ঝগড়া পরে করিস এখন নিচে চল। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।
অহনার কথায় সহমত মুহিব। সিয়ামকে ভেংচি কেটে বলল,
-আমার পেটেও ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। চল জলদি।
চারজন মিলে বক বক করতে এগোচ্ছে সামনে। মাহানুর আজকে নিজের মধ্যে নেই। কী থেকে কী হয়ে গেলো সবটা ভাবছে সে। তার সাজানো গোছানো জীবন পুরোটাই এলোমেলো হয়ে গেলো! দুঃখ, কষ্টে বুক ভারী হয়ে এলো মাহানুর। মুহিব, অহনা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা আগে চলে গিয়েছে। সিয়াম মাহানুরকে অন্যমনস্ক দেখে জিগ্যেস করলো,
-কিরে কী হয়েছে তোর? কোনোকিছু নিয়ে টেনশনে আছিস নাকি?
ধেন ভেঙে গেলো মাহানুরের। ঘাড় বাকিয়ে সিয়ামের দিকে তাকালো। করুণ কণ্ঠস্বরে বলল,
-ওপর দিয়ে তো সব ঠিকঠাক আছে তবে আমার মনের ভিতরে ঝড়তুফান চলছে।
সিয়াম মাহানুরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারা খুব কমই মাহানুরকে দুঃখী মুখে দেখেছে। সবসময়ই এই মেয়ে তাঁদের হাসায়। অন্যদের বকাঝকা করে। মাহানুরকে এইরকম শান্তশিষ্ট সাজে না। তাকে জংলী বিল্লি রূপেই ভালো লাগে। মনে মনে ভাবলো সিয়াম। মাহানুরকে বলল,
-নিজেকে সময় দে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়াও আরহাম ভাই যথেষ্ট ভালো পুরুষ।
-সে ভালো নাকি খারাপ সেটা আমার ভাবার বিষয় না। কিন্তু আজ আমার নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে! চোখের পলকে আমার সব স্বপ্ন এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি!
ভাঙা কণ্ঠস্বর মাহানুরের। সিয়াম শান্ত কণ্ঠে বলল,
-আসলে তোদের বিয়েটা এইরকম ভাবে হয়েছে এটা মেনে নেওয়া একটু কঠিন। কিন্তু কিছু করার নেই দোস্ত। এখন তোর জীবনের আরেকটা সূচনা শুরু হয়েছে। নিজেকে এতো সহজে ভেঙে পরতে দিবি না। আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখ সেগুলোকে পূরণ করার চেষ্টা কর।
-আমি জানি না কী করবো আর সামনে কী হবে!
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল মাহানুর। সিয়াম আস্থা দিয়ে বলল,
-চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।
-হবে। এখন বল তুই কবে বিয়ে করছিস? না কোনো রিলেশনে জড়াচ্ছিস আর না কোনো বিয়েসাদিতে!
-আমি তো ভেবেছি সিঙ্গেল হয়েই জীবন পার করবো। কয়েক মাস পর বিদেশ চলে যাবো তারপর আর কী শুধু চিল আর চিল করবো।
-যে আজ পর্যন্ত জানতেই পারলো না তোর মনের ফিলিংসের কথা তার জন্য তুই দেবদাস হবি? এভাবে জীবন চলে না ভাই!
সিয়াম নজর লুকালো। মুখ ঘুরিয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে রইলো। মাহানুর আবারও বলল,
-কী মনে করিস তুই? বিদেশ চলে গেলে তাকে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা লাগবে না অনেক ভালো থাকবি তুই? আমাদের ছাড়া ভালো থাকতে পারবি?
-আর কিছু বলিস না এখানেই থেমে যা।
ব্যথিত কণ্ঠস্বরে বলে সিয়াম। মাহানুর মলিন হেসে বলল,
-যা চুপ হয়ে গেলাম। আমি তোদের চোখের ভাষা পড়তে পারি সিয়াম তাই আমার থেকে কিছু লুকানো বৃথা।
সিয়াম মাথার পিছনে হাত দিয়ে হাসলো। কথা বলতে বলতে নিচে এসে পরলো তারা। আয়াস মাহানুরকে দেখে দৌড়ে আসলো। শুকনো মুখে মাহানুরকে দেখে বলল,
-রাতে কী না ঘুমিয়ে মশা মেরেছিস?
-মানে কী? মশা কেন মারবো?
-তাহলে মুখ বিষন্ন কেনো? রোগা রোগা লাগছে।
-যা গোড়ার ডিম শয়’তা’নি ভালো লাগছে না।
তাঁদের কথার মাঝেই আসীন আসে। আয়াসকে হাসতে দেখে জিগ্যেস করে,
-এভাবে হাসছিস কেনো পাগলের মতো? আমার বোনের মুড নষ্ট করছিস নাকি?
-হ্যাঁ আসীন ভাই। তোমার ভাই পাগল হয়ে গিয়েছে ওকে পাগ’লাগা’রে নিয়ে যাও।
-বাঁ’দর ছেড়ি আমাকে পাগল বলে!
-ঐ আমার বোনকে বাঁ’দর বলছিস কোন সাহসে?
দুই ভাইয়ের ঝগড়া দেখে মাহানুর হেসে ফেলে। আসীন একহাতে আগলে ধরে বুকে জড়িয়ে নেয় মাহানুরকে। তিন ভাইবোন কথা বলতে থাকে নিজেদের মধ্যে।
আরহাম তার ভাই বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিলো। সামনে মাহানুরকে খিলখিল করে হাসতে দেখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
নাস্তা করা হলে মহিলারা মিলে সুনহেরা আর মাহানুরকে পাতলা সুতির শাড়ী পরায়। মাহানুর মুখ বুজে বড়দের কথা শুনছে। দুইজনকে একসাথে ছাদে নিয়ে বসানো হয়। আগের থেকেই অহনা আরো কয়েকজন মেয়ে মিলে একটুআরেকটু ডেকোরেশন করে রেখেছিলো। নিচে পুল সাইডে ছেলেদের হলুদ গোসলের আয়োজন করা হয়েছে। আয়াস সেন্টগেঞ্জি পরে আসে। আরহাম শার্ট পরা ছিল। সে হলুদ লাগবে না। আরহামের বন্ধুরা জোর করেই তার শার্ট খুলে ফেলে। হলুদের মাখিয়ে দেয় দুইজনকে। আরহামও রিদকে হলুদ ভুত বানিয়ে দেয়। একজন আরেকজনকে পুলে ফেলে দেয় ধাক্কাধাক্কি করে। উপরে মেয়েদেরও হাত, পায়ে, মুখে হলুদ মেখে দিচ্ছে। মাহানুর হলুদের গন্ধে নাক চেপে রেখেছে। হলুদ দেওয়া শেষ হলে বালতি ভর্তি পানি দুইজনের ওপরে ঢেলে দেওয়া হয়। কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহানুর। এখন রুমে যেয়ে ড্রেস চেঞ্জ করবে। অহনা মাহানুরকে তাঁদের রুমে নিয়ে আসে। সুনহেরা একা একাই যাচ্ছিলো তার রুমে। শাড়ীর ওপরে তোয়ালে পেঁচানো তার। আচমকা ফিহা পিছন থেকে দৌড়ে আসে। সুনহেরাকে বলল,
-সুনহেরা ভাবি আমি আপনাকে হলুদ লাগাতে পারিনি।
-ওয় তাই নাকি! তাহলে এখন লাগিয়ে দেও আমার ছোট ননদী।
সুনহেরা নিচে ঝুঁকে। ফিহা হাত ভর্তি হলুদ তার দুই গালে লাগিয়ে দেয়। খুশিতে আবার দৌড় দেয় সে। সুনহেরা হাসতে হাসতে পিছনে ফিরতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যেতে নেয়। দুটো শক্ত হাত ধরে ফেলে তাকে। অর্ধ উন্মুক্ত হলুদের মাখো মাখো আয়াসকে নিজের এতো নিকটে দেখে গলা শুকিয়ে এলো সুনহেরার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি নত করে ফেললো। আয়াসও নিজের হাত ছাড়িয়ে অগোছালো নজরে আশেপাশে তাকালো।
-ঠিক আছেন?
-হুম।
সুনহেরা আর দাঁড়ালো না। তোয়ালে চেপে ধরে বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো। আয়াসের সামনে থাকতে তার ভীষণ সরম করছিলো। আজ হঠাৎ এতো সরমের কারণ অজানা সুনহেরার।
______________
আরহামের রুমের স্মুখীন দাঁড়িয়ে আছে মাহানুর। এখন বেলা তিনটা বাজে। পার্লারের মেয়েরা এসেছে। সুনহেরাকে সাজাচ্ছে তারা। বড় একটি নিঃশাস নিয়ে দরজায় ঠোকা দেয় সে। দরজা খোলাই ছিল। আরহাম ভিতর থেকে উঁচু স্বরে বলল,
-দরজা খোলাই আছে।
মাহানুর ভিতরে প্রবেশ করে। আরহাম বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। মাহানুরকে তার রুমে দেখে অবাক হয়ে যায়। ল্যাপটপ কিনারে রেখে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। কপালে ভাঁজ পরলো তার। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-বাহ্! মাহানুর খান আমার দরবারে এসেছে! কোনদিকে সূর্য উঠলো আজ!
-আমি কিছু বলতে এসেছি আপনাকে।
-হুম। শুনছি আমি।
-আপনি শপিং কখন করলেন?
-গতরাতেই। ড্রেস ফিট হয়নি তাই তো? আমি সাইজ বুঝতে পারিনি।
মাহানুর একহাত দিয়ে আরেকহাত ঘষছে। কিছুক্ষন আগে সনিয়া তার রুমে কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে যায়। যেহেতু সুনহেরার সাথে তারও বিয়ে হচ্ছে তাই আরহাম তার জন্য বউয়ের শাড়ী থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিস নিয়ে আসে। মাহানুর এতকিছু দেখে কিছুক্ষন স্তব হয়ে বসে থাকে। তারপর কী মনে করে আরহামের রুমে আসলো। আরহামের কথায় মাহানুর বলল,
-না সেরকম কিছু না। আমি আজ আপনার আনা ড্রেস পরতে চাচ্ছি না।
-কেনো?
-বিয়ের শাড়ী, বউ সাজা এইসব নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন আছে। সত্যি বলতে আমি আমাদের বিয়ে মানি কিন্তু আপনাকে হাসব্যান্ড হিসেবে মানতে পারছি না আমি। আর যাকে হাসব্যান্ড হিসেবে মানতেই পারছি না তার জন্য আমি সাজতেও চাচ্ছি না।
শক্ত কণ্ঠস্বরে বলল মাহানুর। আরহামের দিকে তাকিয়ে আরো বলল,
-আমি আমার মনের কথা বলেছি। এখন আপনি যদি জোরজবরদস্তি আপনার আনা শাড়ী পরে তৈরি হতে বলেন তাহলে আমি সেটাই করবো।
-আমিও চাই আমার স্ত্রী মন থেকে আমার জন্য সাজবে। মতের বিরুদ্ধে যেয়ে না! তোমার যেটা ভালো মনে হয় পরো।
মাহানুর মাথা নাড়ায়। আর কিছু না বলেই চলে যায় সে। আরহাম খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
-আমার আশা আছে একদিন তুমি নিজ থেকে আমার জন্য নিজেকে বউ রূপে সাজাবে নুর।
মাহানুর রুমে আসে। অহনা আরহামের দেওয়া শপিং ব্যাগ থেকে মাহানুরের জন্য শাড়ী বের করছে। টুকটুকে লাল রঙের শাড়ী। অহনা মুগ্ধ কণ্ঠে বলে,
-আমার জিজুর পছন্দ আছে বলতে হবে! তোকে ফুটন্ত লাল গোলাপ লাগবে দোস্ত।
-শুধু শুধু এগুলো বের করিস না আমি পরবো না।
-পরবি না মানে?
মাহানুর শাড়ী ব্যাগের ভিতরে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
-আমি এখনই তার সাথে কথা বলে আসছি। তাকে বললাম আমি এখন তার জন্য বউ সাজতে চাই না। সে বলল আমার যেটা ভালো লাগে সেটাই যেনো করি।
অহনা রেগে উঠলো মাহানুরের কথায়। খানিকটা উঁচু গলায় বলল,
-ভাই আমি বুঝতে পারছি না তোর অ্যাকচুয়ালি প্রবলেম কোথায়? বিয়ে হুট করে হয়েছে সেটা তুইও জানিস আমিও জানি। তবুও দেখ আরহাম ভাই তোকে কত সুন্দর মেনে নিয়েছে! তোর জন্য, সে নিজের বউয়ের জন্য সেই রাতেই শপিং করে নিয়ে এসেছে! তোদের সম্পর্ককে সে যদি এতো ইজিলি এক্সসেপ্ট করতে পারে তাহলে তোর প্রবলেমটা কোথায় বইন? এইটুকু করতে পারতি না তুই?
-চুপ কর অহনা। তোর এইরকম সিচুয়েশনে বিয়ে হয়নি তাই তুই আমার অনুভূতি বুঝতে পারছিস না। আজ আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি।
অহনা ভীষণ ঠান্ডা মনের মানুষ। সে সহজে রেগে যায় না। তবে আজ মাহানুরের ওপর ভয়ংকর ক্ষেপে উঠলো সে। রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
-তোকে কেউ বিয়ের জন্য জোর করেছিল? আমি তারপর আঙ্কেল আমরা কয়বার তোকে বোঝালাম ভেবেচিন্তে ডিসিশন নে। কিন্তু না! তুই বিয়ে করেই দম নিলি। তাহলে এখন তোর এতো প্রবলেম হচ্ছে কোথায়? তোর বুঝতে হবে মাহানুর তোর জন্য আরেকজনের লাইফ নষ্ট হতে পারে না!
-বেস্টফ্রেন্ড হয়ে যদি আমাকেই বুঝতে না পারিস, বেস্টফ্রেন্ড এর কষ্ট বুঝতে না পারিস তাহলে প্লিস দোয়েয়া করে আমার লাইফে আর ইন্টারফেয়ারও করিস না। আমারটা আমাকে বুঝতে দে।
কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে মাহানুর। অহনা রাগে লাল হয়ে গিয়েছে। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
-ঠিক আছে করলাম না। আমি সত্যি বললেই সবার কাছে খারাপ হয়ে যাই। তোর যা মন চায় কর।
মাহানুর কিছু বলল না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। অহনা চলে যেতে উদ্যত হতেই থেমে যায়। পিছনে ফিরে তিক্ত স্বরে বলে,
-আরহাম ভাই আরো বেস্ট কাউকে ডিসার্ভ করতো! দেখিস একদিন তুই তার প্রেমে পরে যাবি। অনেক ভয়ংকর প্রেমে। তখন সে তোকে দাম দিবে না দেন তুই আপসোস করবি। সময় আছে নিজেকে সংযম কর মাহানুর।
ধুরুমধুরুম পা ফেলে চলে গেলো অহনা। মাহানুর দরজা লাগিয়ে মেঝেতে বসে পরলো। দুইহাত দিয়ে চুল মুঠি করে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলো সে।
অহনা রুমের বাহিরে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে তারও এক ফোটা দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরছে। সিয়াম পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। হাতে চকলেটের প্যাকেট তার। অহনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো।
-আটাময়দা না মেখে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস তুই?
অহনা সিয়ামের দিকে তাকায়। অহনার চোখে পানি দেখে সিয়াম চমকায়। বিচলিত হয়ে বলে,
-কাঁদছিস কেনো? কে কী বলল?
-মাহানুরের সাথে ঝগড়া হয়েছে। আমি ওকে অনেক আজেবাজে কথা বলে ফেলেছি।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল অহনা। সিয়াম না বোঝার ভনিতায় বলল,
-ঝগড়া হয়েছে বুঝলাম আগে তুই চোখ মুছ তারপর ক্লিয়ারলি বল।
-ওর খারাপ সময় সঙ্গ না দিয়ে আমি আরো ওকে বকলাম। কেমন বেস্টফ্রেন্ড আমি! ও আমাকে কখনই মাফ করবে না!
-চোখ মুছতে বলেছিস কিন্তু আমি।
অহনা চোখের পানি মুছলো। কাঁপাকাঁপি কণ্ঠস্বরে বলল,
-হাজেরা বা লুৎফা চাচিকে একটু ডেকে নিয়ে আয়। যা।
-যাচ্ছি।
পর্ব ১৯
বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আরহাম, আয়াস সম্পূর্ণ রেডি। বন্ধুর দলরা তাঁদের ঘিরে শয়’তা’নি করছে। আয়াস বেচারা সরমে শেষ। এক তো আরহাম তার বোনের জামাই আবার বউয়ের বড় ভাই। সে পারে না এখান থেকে উঠেপুটে পালায়। বউরাও রেডি। কাজীও এসে পরেছে। আরহাম আর আয়াস স্টেজে যেয়ে নিজেদের স্থানে বসে পরলো। সুনহেরা খয়েরি রঙের ভারী ডিজাইনের বেনারসি শাড়ী পরেছে আজ। তার বোনরা তাকে ধরে ধরে নিয়ে আসে। আয়াস মোহিত নজরে তাকিয়ে রইলো নিজের হবুবউয়ের দিকে।
মাহানুর রুম থেকে বের হতেই আশেপাশে তাকালো। অস্থির হয়ে উঠলো সে অহনাকে কোথায়ও না পেয়ে। সিয়ামকে দিয়ে ডেকে আনায় অহনাকে। অহনারও খুশিতে মন ভরে উঠে। মনে মনে অনুতপ্ত সে। মাহানুর বেবিপিঙ্ক কালার লেহেঙ্গা পরেছে। পুরো লেহেঙ্গায় চকচকে সাদা পাথরের কাজ। মাহানুরের একপাশে তার বাবা আর বড়বাবা আরেকপাশে অহনা। আরহাম তাকিয়ে রইলো। শুধুই তাকিয়ে রইলো। তার মনে পরে যায় মাহানুরের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এর কথা। সেই ঝগড়ুটে মেয়েটা আজ তার স্ত্রী! তবে ঐ মাহানুর আর আজকের মাহানুরের মধ্যেই বিশাল পার্থক্য। সেইদিনের মাহানুরের মধ্যে ছিল বাচ্চামো, রাগ, জেদ। আর আজকের মাহানুরের মধ্যে তার আসল বয়স ফুটে উঠেছে। অনেকটা মলিন আর শ্রী লাগছে।
আরহাম আর আয়াস এগিয়ে এসে নিজেদের বউকে ওপরে তুলে। স্টেজে বসে সবাই। অনেকক্ষণ ফটোশুট চলে। সকলের মধ্যে কথাবার্তা হয়। তারপর কাজী আসে। সকলের স্মুখীন কবুল শব্দটি উচ্চারণ করে বিবাহ নামক সম্পর্কে আবদ্ধ হয় তারা। কাগজে সিগন্যাচার করার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পরে সুনহেরা। একবার ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার অন্যদের দিকে। আরহাম বসা থেকে উঠে বোনের কাছে আসে। বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। শান্ত হতে বলে। মাহানুর আজ অটল। বসার সময় তার মুখ ভঙ্গি যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে। সে যেনো জেন্ত রোবট হয়ে গিয়েছে। একমাত্র অহনাই বুঝলো মাহানুরের মনের অবস্থা। নিস্পলক তাকিয়ে রইলো সে মাহানুরের দিকে।
মাহানুর চেয়ারে বসে আছে অহনা খাইয়ে দিচ্ছে তাকে। দুইজন সেই একই সাথে আছে তবে কেউ একটি বারও কারো সাথে কথা বলছে না। রিদরা বাসরঘর সাজাতে গিয়েছে। সুনহেরাকেও তার বোন খাইয়ে দিচ্ছে। আরহাম মেহমানদের আপ্যায়ন করছে। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে আসে আয়াস। আশেপাশে নজর বুলিয়ে মাহানুরকে বলে,
-তুই সত্যি আগামীকাল ভোরে সাদাফদের সাথে মেঘালয় যাচ্ছিস মাহানুর?
-উফফ এই সাদাফ হা’রা’মিটা তোকে বলে দিলো! হ্যাঁ ওদের সাথে আমিও ট্যুরে যাচ্ছি। ভাবি আর তুই যাবি? আয় তিনজন যাই মজা হবে।
-পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? আজই তো ধরতে গেলে তোর বিয়ে হলো! আগামীকাল বাসায় যাওয়ার পর গেলেও অন্য কথা ছিল।
-তাহলে তোর বন্ধুকে বল আগামীকাল রাতে যেতে।
-তুই তো অন্যদিনও যেতে পারতি।
-না আগামীকালই যাবো। বাবাও অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।
আয়াস আর কিছু বলল না। মাহানুরকে বোঝানো মানে তার সময় নষ্ট করা। অহনা চুপচাপ তাকে খাইয়ে দিলো। খামোখা কিছু বলে ঝগড়া বাড়াতে চায় না সে।
___________________
খাওয়া দাওয়ার পর্ব ঠুকিয়ে অনেকেই চলে গিয়েছে আবার কিছু কিছু মেহমান আগামীকাল যাবে। মোটামোটি সব কাজ শেষ এখন বউদের রুমে নিয়ে যাওয়ার পালা। সুনহেরার চোখ মুখে সরম উতলে পরছে। মাহানুর স্বাভাবিক। বেচারীর ভাইয়ের বাসরঘরের গেট ধরার স্বপ্ন অপূরণই রয়ে গেলো। এখন নতুন বউ রূপে গেট ধরলে বেপারটা ভালো চোখে দেখায় না। সায়রিন, আয়াসের কাজিনরা মিলে সুনহেরাকে নিদিষ্ট রুমে নিয়ে আসে। ফুলে সজ্জিত রুম দেখে সুনহেরা ঢোক গিললো। সায়রিন তাকে ধরে বিছানার মধ্যখানে বসিয়ে দিলো। বাসরারাত নিয়ে কতগুলো জ্ঞান দিলো সে। যেসব শুনে সুনহেরার কান গরম হয়ে এলো। মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললো সে। সুনহেরাকে সরম পেতে দেখে হাসাহাসি করতে করতে চলে গেলো তারা।
মাহানুরকেও আরহামের থাকার রুমে নিয়ে আসে। এই রুমটা তেমন সাজানো হয়নি শুধু বিছানায় গোলাপের পাঁপড়ি ছিটানো। মাহানুর অহনাকে বলে তার ব্যাগ নিয়ে আসে। তাকেও বিছানায় বসিয়ে সবাই চলে যায়। মাহানুর স্বস্তির নিঃশাস নিলো। বসা থেকে উঠে রুমের আশেপাশে নজর বুলালো। দুইটা ল্যাপটপ আর একটা ফোন চার্জে দেওয়া। পাশেই আরহামের ব্যাগ। মাহানুর মুখ বাকিয়ে আয়নার সামনে বসে পরিহিত জুয়েলারি খুলতে থাকে। এতো হাবজাব পরে বিরক্ত সে। মাথার ওড়না খুলে বিছানায় রাখে। ব্যাগ থেকে ড্রেস বের করে ওয়াশরুম চলে যায় সে।
সুনহেরা বসে হাত ঘষছে। নিজের ভিতর কেমন অস্থিরতাবোধ করছে সে। হালকা কেশে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে আয়াস। সুনহেরা একটু নড়েচড়ে বসলো। আয়াস মাথা তুলে সামনে তাকালো। ফুলের সাজানো বিছানায় মাথা নত করে বসে আছে সুনহেরা। আয়াস ধুপধাপ পা ফেলে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলে,
-আপনি এখনও এইসব পরেই বসে আছেন! ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসুন।
-ঠিক আছে।
সুনহেরা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মাথার ঘোমটা খুলে আয়নার সামনে যেয়ে বসে। কানের দুল, টিকা, হাতের চুড়ি মোটামোটি সব খুলে ফেললেও গলার হাড় খুলতে পারছে না সে। একসময় বিরক্ত হয়ে টানাটানি করতে থাকে। আয়াস বিষয়টা লক্ষ্য করে এগিয়ে আসলো। শান্ত কণ্ঠে বলল,
-যদি কিছু না মনে করেন আমি সাহায্য করতে পারি? আস এ ফ্রেন্ড?
সুনহেরা উপায় না পেয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। আয়াস নিজ হাত সুনহেরার ঘাড়ে লাগাতেই মৃদু কেঁপে উঠলো সুনহেরা। আয়াস নরম হাতে খুলে দিলো সুনহেরার হাড়। তারপর মাথার ক্লিপ খুলতেও সাহায্য করলো। সুনহেরাকে অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে দেখে সে বলল,
-সুনহেরা স্বাভাবিক হন। আমাদের বিয়ে হয়েছে ঠিক তবে আমার আপনার প্রথমদিনের কথা মনে আছে।
-না মানে সেরকম কিছু না আর কী।
-ফ্রেশ হয়ে আসুন। সম্পর্কে আমরা স্বামী স্ত্রী হলেও আমি আপনার অনেক ভালো একজন বন্ধু হতে চাই। তাই আপনি আগের মতো বাঁচাল সুনহেরাই হয়ে যান প্লিস। এই লাজুক সুনহেরাকে দেখে আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগছে।
সুনহেরা আনমনে হেসে ফেললো। ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো।
রাত বারোটা বাজে। কাজ শেষ করে মাত্রই রুমে প্রবেশ করেছে আরহাম। বিছানায় অগোছালো ভাবে মাহানুরের লেহেঙ্গার ওড়না আর জুয়েলারি পরে থাকতে দেখে বিরক্তে কপাল কুঁচকে ফেলে সে। অগোছালো রুম তার একটুও পছন্দ না। বিছানার চাদর একটু কুঁচকালে সে বারে বারে সেটাকে টানটান করে। আর আজ কিনা তার মতো মানুষের কপালেই মাহানুরের মতো ছন্নছাড়া মেয়ে জুটলো! আপসোস স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
-আহারে বেচারা আরহাম তোর নসিবে যে আরো কী কী অদ্ভুত জিনিস লেখা আছে কে জানে!
পরিহিত পাঞ্জাবীর বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে গেলো। রুমে কোথায়ও মাহানুর নেই। হয়তো ওয়াশরুমে। আরহাম পরনে পাঞ্জাবীটা খুলে ফেলল। ব্যাগ থেকে টি-শার্ট বের করে লাগলো। গুনগুন গান গাইতে গাইতে বেলকনি থেকে রুমে আসলো মাহানুর। আরহামকে দেখে আহামরি রিএক্ট না করে একই ভঙ্গিতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো। আরহাম মাহানুরকে এতো শান্ত দেখে পিলে চমকায়। কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে সে। মাহানুর ফোনে দৃষ্টি রেখেই বলল,
-সুন্দর মেয়ে আগে কখন দেখেননি? নিলজ্জের মতো তাকিয়ে আছেন!
-নিজের বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছি অন্যের না। আর এটাকে নিলজ্জ দৃষ্টি বলে না অবাক দৃষ্টি বলে।
-এতো বউ বউ করেন কেনো আপনি?
-তো ওয়াইফ ওয়াইফ শুনতে চাচ্ছ?
নিলিপ্ত ভঙ্গিতে বলল আরহাম। মাহানুর আড়চোখে তাকিয়ে নিঃশাস ত্যাগ করলো। আরহাম লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেশ কিছুক্ষন পর বের হলো। মাহানুর ততক্ষনে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পরেছে। পাশ ফিরে ফোন টিপছে। আরহামের দিকে না তাকিয়েই জিগ্যেস করলো,
-আপনি তো আগামীকালই চলে যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ।
-বেশ ভালো।
আরহাম চুল ঝেরে সোফায় বসলো। মাহানুর মাথা ঘুরিয়ে তাকে বিছানায় না দেখে মুখ বাঁকালো। আরহাম নিজের ফোন আর ল্যাপটপ নিতে নিতে বলল,
-আজ আর তোমাকে বিরক্ত করলাম না। আরাম করে ঘুমাও আমি রিদের রুমে যাচ্ছি।
শব্দ করে দরজা লাগিয়ে চলে গেলো আরহাম। মাহানুর হতবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলো। আরহাম এতো সহজে অন্য রুমে চলে গেলো মাহানুরের বিশ্বাস হচ্ছে না। বিছানায় উঠে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে থাকে সে। এখন তাকে কেউ আটকাতে পারবে না মেঘালয় যাওয়ার থেকে।
রিদ মাত্রই জামা চেঞ্জ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। দরজায় ঠোকার আওয়াজ পেয়ে পিলে চমকে যায় সে।বিরক্তকর কণ্ঠে বলল,
-দুর ছাই! এখন আবার কোন শা’লায় আসলো!
খালি গায়েই রিদ দরজা খুলে দিলো। আরহামকে দেখে চেঁচিয়ে বলল,
-বাসরঘর রেখে এখানে কী করছিস? আমার শালিসাহেবা আবার তোকে রুম থেকে বের করে দিলো নাকি!
আরহাম কোনো উত্তর দিলো না। পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। রিদ দরজা লাগিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলল,
-তোর জ্বালাতনে আমার ঘুমের বারোটা বাজছে দেখছি! এখন বল আমার সাথে বাসর করতে এসেছিস নাকি আবার?
ছোট ছোট চোখ করে জিগ্যেস করলো রিদ। আরহাম বিছানায় বসতে বসতে ভয়ংকর কিছু গা’লি ছুঁড়ে দিলো রিদের দিকে। রিদ হতভম্ব হয়ে আরহামের পাশে বসলো। আরহাম ল্যাপটপ খুলে রিদকে বলল,
-আমার কিছু দরকারি জিনিস লাগবে দোস্ত।
-কী জিনিস আবার?
আরহাম রিদকে কিছু কথা বলতেই রিদ সবটা শুনে দাঁত বের করে হাসে। মাথা নাড়িয়ে বলল,
-আমার বাসায় চল তোর যা যা দরকার সব আমার রুমে আছে।
-ঠিক আছে।
আরহাম কিছু একটা ভেবে পুনরায় বলল,
-আমার অনুপস্থিতে কিন্তু তোর অনেক দায়িত্ব আছে বেটা।
-সেটা নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। চল তাহলে।
-হুম।
____________________
মধ্যরাত। নির্জন, নীরব ভুতুড়ে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে শোঁশোঁ শব্দ করে এগিয়ে চলছে মাহানুরের গাড়ি। আশেপাশে কোনো মানুষ বা গাড়ি নেই। কেমন সুনসান রাস্তাঘাট। আজ মাহানুর নিজেই ড্রাইভ করছে। কারে আবার গান ছেড়ে রেখেছে। কিছুক্ষন পর পর গানের সাথে তাল মেলাচ্ছে। স্প্রিডে গাড়ি চালানোর দরুন ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বাসার এসে পরলো সে। বাসার দারোয়ান এতো রাতে মাহানুরকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে যায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
-আম্মা আপনে এই রাত্রে বেলা? সব ঠিক আছে তো।
-হ্যাঁ চাচা সব ঠিক আছে। গেট খুলে দিন গাড়ি পার্ক করতে হবে।
-আম্মা আপনে যান আমি পার্ক করে দেই।
-আচ্ছা দেন তাহলে।
মাহানুর গাড়ি থেকে বের হয়ে চাবি ধরিয়ে দেয় দারোয়ানকে। হাতের মোটা চাবির গুচ্ছ ঘুরাতে ঘুরাতে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। চাবির সাহায্যে দরজা খুলে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে এগিয়ে যায়। লাইট জ্বালিয়ে আলোকিত করে দিলো পুরো বাড়ি। নিজের রুমে এসে ভিতরে ঢুকে। সাইড ব্যাগ বিছানায় ফেলে আলমিরা খুলে। মাঝারি সাইজের একটি ট্যুর ব্যাগ বের করে। একে একে প্রয়োজনীয় সকল জিনিস নিয়ে নিলো ব্যাগে ভরে। তার টাকাপয়সা, ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্ট আরো জরুরি কিছু কাগজপত্র আলাদা ছোট একটি ব্যাগে নিয়ে নিলো। সিম্পল কয়েকটা ড্রেসও ব্যাগে ভরলো। সব নেওয়া হলে মাহানুর দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো। পাঁচটা বাজে এখন। তাঁদের বাস ছাড়বে সাতটায়। মাহানুর বিছানায় বসে ফোন টিপতে থাকে। সহসা সাদাফ তাকে কল করলো।
-হ্যালো ভাইয়া।
-হ্যাঁ মাহানুর সাতটা বাজে বের হবো কিন্তু। তুমি সব গুছিয়ে ফেলেছো?
-অল ডান। আচ্ছা ভাইয়া এবারের ট্যুরও কী ফ্যামিলি ট্যুর নাকি?
-না। এবার কাপল ট্যুর। একদল বন্ধু বান্ধবীরা মিলে তাঁদের হাসব্যান্ড এন্ড ওয়াইফকে নিয়ে একসাথে ট্যুরে যাচ্ছে।
-বাহ্! ভীষণ মজা হবে তাহলে!
-সেটা তো হবেই। আচ্ছা রাখি তাহলে?
-হুম।
মাহানুর হাত, মুখ ধুয়ে আসলো। জিন্স পেন্টের সাথে হাটু পর্যন্ত টপ্স পরেছে সে। গলায় স্ক্যাফ পেঁচানো। চুলগুলো উঁচু করে দুই ঝুঁটি করলো। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা পরে নিলো। ধুলোবালিতে যদি চোখে এলার্জি হয় তাই আগের থেকেই সে সাবধান। হঠাৎ তার নজর পরে নাকে। চকচকে ছোট পাথরের একটি নাকফুল। জয়া বেগম এটা দিয়েছে তাকে। বলেছে সবসময় পরতে। তাই মাহানুর আর খুললো না। ঘড়িতে সময় দেখে বেরিয়ে পরলো সে। দারোয়ান নিজেই ড্রাইভ করছে আর মাহানুর ফোনে নজর বুলাচ্ছে। বাস স্টেশনে আসতেই গাড়ি থেমে যায়। মাহানুর বের হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে সাদাফকে খুঁজতে থাকে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সাদাফ হাত উঁচু করে ইশারা করলো। মাহানুর মুচকি হাসলো। ব্যাগ টাইট করে ধরে এগিয়ে গেলো।
-ঠিক সময়ে এসেছো। এইযে বাস।
-মিনি বাস এবার!
-হ্যাঁ। কম মানুষ তো তাই মিনি বাসই নিয়েছি।
-আচ্ছা আমি একটু কেনাকাটা করে আসছি।
-হ্যাঁ দরকারী সব জিনিস নিয়ে নেও।
মাহানুর দোকান থেকে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে নিলো। বাস কিছুক্ষন পরই ছেড়ে দেবে। সাদাফের সাথে কথা বলতে বলতে বাসে উঠে সে। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বামপাশের তিন নাম্বার সিটটা তার। মাহানুর গলা উঁচু করে নিজের সিটের দিকে তাকাতেই শুকনো ঢোক গিললো। তার পাশের সিটে একজন পুরুষ বসে আছে। ইতস্তত করতে করতে এগিয়ে গেলো মাহানুর। অজ্ঞাত লোককে বলল,
-ভাইয়া একটু সাইড দিন ঐপাশে আমার সিট।
লোকটা কিছু বলল না। পা সরিয়ে জায়গা করে দিলো মাহানুরকে যাওয়ার জন্য। মাহানুরের রাগ হলো অজ্ঞাতর ওপর। তার সাথে এটিটিউড দেখালো! আর কথাই বলবে না। মনে মনে ভাবলো মাহানুর।
মাহানুর সামনে পিছনে তাকিয়ে দেখলো সবাই জোড়ায় জোড়ায়। তার এখন নিজেকে এতিম এতিম মনে হচ্ছে। সাদাফ সহ আরো দুইজন লোক গাইড হিসেবে যাচ্ছে। ক্ষণেই বাস চলতে শুরু করে। এখন তাঁদের যাত্রা সিলেট। বাসের সবার কথাবার্তা, হাসিমজাক দেখে বেশ এনজয় করছে মাহানুর। দুইজন মেয়ে নিজ থেকেই তার সাথে পরিচিত হলো। মাহানুর আড়চোখে পাশের মানুষটির দিকে তাকায়। মাথায় ক্যাপ পরা আবার মুখে ম্যাক্সও। এই লোক কী অসুস্থ নাকি! কতকিছু পরে আছে!
মাহানুর আর বেশি মাথা ঘামালো না। ফোনে মনোযোগ দেয় সে। অহনা, তার বাবাকে ফোন করে বলল বাস ছেড়ে দিয়েছে। ফোন ব্যাগের রাখার সময় হঠাৎ বাসের ঝাঁকির কারণে সামনের সিটের সাথে মাথায় বারি খেতে নেয় মাহানুর। তখনই পাশের জন মাহানুরের কোমর চেপে ধরে তাকে নিজের নিকটে নিয়ে আসে। মাথায় বারি না লাগলেও মনে বড়োসড়ো একটা বারি খেলো মাহানুর। অচেনা একজন পুরুষ তার কোমর চেপে ধরেছে ভাবতেই শরীর কিড়মিড় করে উঠলো তার। রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে কিছু বলতে তার পূর্বেই পাশের জন মুখ থেকে ম্যাক্স খুলে ফেললো। মাহানুর অজ্ঞাত ব্যক্তির মুখ দেখে আকাশ থেকে পরলো। আঁখিজোড়া গোলগোল হয়ে গেলো তার। এতোটাই আশ্চর্য হয়েছে কোনো প্রতিক্রিয়া করতেও ভুলে গেলো সে।
আগন্তুক মাহানুরের বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুরুষালি ওষ্ঠে বাঁকা হেসে বলল,
-হ্যালো ওয়াইফি।
>>>>চলবে।