তবে_ভালোবাসো_কী ২ #Mehek_Enayya(লেখিকা) পর্ব ১৭

0
196

#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ১৭

আরহাম আর দাঁড়ালো না। যাওয়ার জন্য দরজা খুলতেই বাহিরে অহনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আরহামকে বের হতে দেখে অহনাও আশ্চর্য হয়ে যায়। আরহাম স্মিত হেসে বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। অহনা ভিতরে ঢুকে আয়নার সামনে ভোঁতা মুখে মাহানুরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিগ্যেস করলো,
-কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো মূর্তির মতো? আর আরহাম ভাই এসেছিলো?
মাহানুর অহনার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কিড়মিড় করতে করতে ব্যাগ থেকে সাদা রঙের একটি ব্লাউজ নিয়ে ওয়াশরুম চলে যায়। অহনা গাল ফুঁলিয়ে বিছানায় বসে জুয়েলারি পরতে থাকলো। তৎক্ষণাৎই মাহানুর ওয়াশরুম থেকে বের হলো। অহনা আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো মাহানুরের দিকে। আগের ব্লাউজই তো পরা তাহলে অন্য ব্লাউজ দিয়ে কী করলো ও!এইসব ভাবতে ভাবতে মাহানুরকে প্রশ্ন করে উঠলো,
-বুঝলাম না তুই পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি! ব্লাউজ কেনো নিয়ে গেলি ওয়াশরুমে? চেঞ্জও তো করিসনি! তাহলে কী করলি?
-চুপ একদম চুপ। বা’লের ব্লাউজ এনেছিস তুই!আজ তোর জন্য ঐ জিরাফ, উগান্ডার জংলীর কাছে আমাকে অপমানিত হতে হলো।
-কী হয়েছে?
-ম’রা ম’রছে, ম’রা!
-মানে? কিছুক্ষন আগেও তো ভালো ছিলি হঠাৎ রেগে গেলি কেনো?
মাহানুর কোনো উত্তর দিলো না। ধপ ধপ পা ফেলে ব্লাউজটা ব্যাগে ভরে রাখলো। চেঞ্জ করবে না সে। বিয়ে করেছে বলে তার কথা শুনতে হবে এরকমটা কোথাও লেখা নেই। মাহানুর বাকি জুয়েলারি পরতে পরতে বিড়বিড় করে বলল,
-শুনবো না আমি তার কোনো কথা। চান্দুর সাহস কত বড় আমাকে হুকুম দেয়! মাহানুরকে হুমুক দেয়! আসুক কিছু বলতে ঐ শা’লার ১৪ গুষ্টি এক করে ফেলবো। জিরাফের বাচ্চাকে মনে করাতে হবে ও কোনো সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করেনি আমাকে করেছে!

রুমের ভিতরে মায়ের সাথে রাগারাগি করছে ইকরা। চোখ, মুখ ফুলে বেহাল দশা তার। অতিরিক্ত কান্নার ফলে আঁখিজোড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে। রিনা খান মেয়ের রাগ দেখে ভীত হয়ে আছেন। কিছুক্ষন আগেই হামজা খানের সাথে দেখা হয়েছিল তার। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তাকে আর কখনই খান ভিলায় পা রাখতে না। যে নিজের আপন ভাইয়ের মেয়ের নামে এইরকম কথা রটায় তার সাথে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। রিনা খান সে কী কান্না! ভাইদের পারে না পা ধরেই মাফ চায়! তবুও হামজা খান নিজের কথায় অটল। অশান্ত মনে ইকরার রুমে এসেছিলেন দেখতে ইকরা তৈরি হয়েছে কী না। দুপুর থেকে ঘরবন্দি মেয়েটা। তার ভীষণ চিন্তাও হচ্ছিলো। রুমে এসে মেয়েকে এইরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে পিলে চমকে যায় সে। কারণ জিগ্যেস করলে উঠলো কতগুলো ঝাড়ি শুনলো।
-তুই যদি এখন আমাকে কারণ না বলিস তাহলে আমি কিভাবে বুঝবো মা? বল কী হয়েছে?
-তুমি কোনো কথাই বলো না মম। আজ তোমার জন্য শুধু তোমার জন্য আমার পছন্দের মানুষও ঐ মাহানুরের হয়ে গেলো!
-তুই কী কোনোভাবে আরহামের কথা বলছিস?
অবাক কণ্ঠে জিগ্যেস করলো রিনা খান। ইকরা চোখের পানি মুছে বলে,
-হ্যাঁ। আমি আরহামকে পছন্দ করতাম। ওর মতো ছেলের সাথে আমাকে মানাবে নাকি তোমার ঐ ভাইয়ের মেয়ের সাথে।
-আমি নিজেও বুঝতে পারিনি আরহাম মাহানুরকে বিয়ে করে ফেলবে। আমি তো শুধু মাহানুরকে খারাপ প্রমান করতে এইরকমটা করেছিলাম!
-প্রত্যেকবারই যখন তুমি মাহানুরের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করো সেটা আমার ওপর এসে পরে। আজই তাই হলো।
-তুই চিন্তা করিস না মা আমি দেখছি বেপারটা।
-তোমার আর কিছু করতে হবে না এবার যা করার আমিই করবো।
বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ইকরা। শাড়ী পরা ছিল সে। ওয়াশরুম যেয়ে মুখ ধুয়ে আসে। আয়নায় সামনে বসে মেকআপ করতে থাকে। রিনা খান মেয়ের হাবভাব বুঝলেন না। তিনি বললেন,
-তুই আসলে কী করতে চাচ্ছিস ইকরা মা?
-দেখো আমি কী করি। আরহামকে আমার পছন্দ হয়েছে মানেই সে শুধুই ইকরার। তাছাড়াও আরহাম জোরজবরদস্তি এই বিয়ে করেছে তাই তাকে পেতে আমার বেশি কষ্ট করতে হবে না।
-শুন যা করবি ভেবেচিন্তে করিস। মাহানুর কেমন মেয়ে ভালো করেই তো জানিস! এমনেও ও আমার ওপর রেগে আছে।
-আমার কিছুই করতে পারবে না ও।
-ও সবই পারবে। আয়াসের খালা রোকসানাকে কিভাবে কথা শুনিয়েছে নিশ্চই তুই দেখেছিস! বেচারী শেষে অপমানিত হয়ে চলেই গেলো।
-তার সাথে যা হয়েছে একদম ঠিক হয়েছে। আমার সাথেও শুধু তেড়া তেড়া কথা বলতো ঐ মহিলা।
-আমি চাই না ঐরকম কিছু আমাদের সাথে হোক।
-হবে না।
___________________
সব মেহমানরা এসে পরেছে। সুনহেরা আয়াসকে একসাথে বসানো হয়েছে স্টেজে। বড়রা হলুদ দেওয়া শুরু করেছে। মেহরাব খান মাহানুরকে খুঁজছে। সবাই এখানে অথচ তার মেয়ের খবর নেই। সকালের পর থেকে মাহানুরের ওপর বিশেষ নজর রাখছে সে। আরহামও তার বন্ধুদের সাথে। তার কলিগ ও বড় স্যাররা এসেছে তাঁদের আপ্যায়ন করছে।
সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে সিয়ামের সাথে কথা বলতে বলতে আসছে মাহানুর। মেহরাব খান দূর থেকে মেয়েকে দেখে এগিয়ে গেলেন। মাহানুর মেহরাব খানকে দেখে বলল,
-বাবা এভাবে আসছো কেনো? তোমার কী অসুস্থ লাগছে?
-না আমি ঠিক আছি। তোকেই খুজছিলাম। কিছু খেয়েছিস তো?
-হ্যাঁ সন্ধ্যাবেলা নাস্তা করেছিলাম। এখন বলো কেমন লাগছে আমাকে?
-আমার ছোট্ট পরীটি লাগছে।
হাসি মুখে বলল মেহরাব খান। মাহানুর বড় একটি হাসি দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। হামজা খান পিছন থেকে এসে বললেন,
-বাহ্ বাহ্! আমাকে তো সবাই ভুলেই গিয়েছে! কেউ বড়বাবা বলে ডাকও দেয় না!
মাহানুর তাকে ধরে টেনে নিয়ে আসলো। সিয়ামকে ফোন দিয়ে বলল,
-সিয়াইমা আমার দুইজন হ্যান্ডসামের সাথে সুন্দর সুন্দর করে কয়টা পিক তুলে দে।
সিয়াম আর মুহিব মিলে সুন্দর করে ছবি তুলে দেয়। ছবি তোলা শেষ হলে বাবা, বড়বাবার সাথে কথা বলতে বলতে স্টেজের সামনে আসে মাহানুর। সুনহেরা আয়াস মাহানুরকে দেখতে পেয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারা দুইজন সকলের অগোচরে কিছু একটা প্ল্যান করেছে। আরহাম গম্ভীর ভঙ্গিতে আশেপাশে নজর বুলাচ্ছে। তার অবচেতন মন খুঁজে চলেছে কাউকে। অহনার পাশে নজর পরতেই মেজাজ চটে গেলো তার। রুক্ষ দৃষ্টিতে কয়েকবার তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। জোবান মাহানুরকে দেখে চমকিত কণ্ঠে বলল,
-আরহাম স্যার ঐটা উইযে মাহানুর না? যে আপনাকে আঘাত করেছিল?
-হ্যাঁ জোবান সাহেব।
দাঁতে দাঁত চেপে বলল আরহাম। জোবান মেকি হেসে বলল,
-ও আপনার আত্মীয় হয়? আগে তো বললেন না!
-আমার ছোট বোনের ননদ হয়।
-আর আপনাদের মেজর সাহেবের মিসেসও হয়।
পাশ থেকে ফোড়ন কেটে বলল রিদ। জোবান অবাক। পাশের অন্য স্যাররাও একটু অবাক। একজন জিগ্যেস করলো,
-আরহাম আপনি বিয়ে কবে করলেন?
আরহাম চোখ রাঙিয়ে রিদকে ইচ্ছে মতো গালি দিচ্ছে। গলা ঝেরে ভদ্র ভাবে বলল,
-আজ সকালেই পারিবারিক ভাবে হটাৎ করে বিয়ে হয়েছে স্যার।
সবাই আরহামকে কংগ্রেস করলো। বড় স্যার যিনি কিনা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের হেডঅফিসার সে আরহামকে বলল,
-আপনার বিয়ের উপলক্ষে গিফট হিসেবে আপনাকে এক সপ্তাহ ছুটি দেওয়া হলো আরহাম সাহেব।
-কিন্তু স্যার ট্রেনিং তো পিছিয়ে যাবে!
-প্রবলেম নেই মিস্টার জোবান সামলে নেবে। আর আপনি এমনেও তিন বছরের মধ্যে তেমন কোনো লম্বা ছুটি নেননি তাই এটা আপনার পাওনা।
-জি ঠিক আছে স্যার। আপনারা সবাই বসুন। আমি এখানেই আছি যেকোনো দরকারে ডাক দেবেন।
রিদের ঘাড় ধরে তাকে কিছুটা দূরে নিয়ে যায় আরহাম। পিঠে কতগুলো কিলঘুষি দিয়ে বলল,
-তোকে বলেছিলাম তাঁদের সামনে বিয়ের কথা বলতে? বিয়ে হতে দেরি তোর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে সবাইকে জানাতে দেরি নেই!
-আরেহ আরেহ আস্তে মার ভাই! একদিন না একদিন সবাই তো জানতোই তাই আমি আজই বলে দিলাম।
-আর কিছু বলিসই না তুই মাদা***!
-বকাবুকা পরে দে আগে দেখ আমার জন আর তোর বেগমকে কত সুন্দর লাগছে! থু থু আমারই না নজর লেগে যায়!
অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল রিদ। আরহাম রাগে কটমট করতে করতে রিদের পিছনে লা’থি বসিয়ে দিলো। আয়াস আর সুনহেরা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সুনহেরা হাতে মাইক নিয়ে সকলের আকর্ষণ পাওয়ার জন্য বলল,
-হ্যালো এভরিওয়ান। আমরা আপনাদের কিছু বলতে চাই।
আয়াসের হাতেও একটি মাইক। আয়াস মুগ্ধ হয়ে বার বার সুনহেরার দিকে তাকাচ্ছে। সম্পূর্ণ হলুদ রঙের লেহেঙ্গা পরেছে সে। কাঁচা ফুলের গহনা। সুনহেরা কথার ফাঁকে ক্ষণে ক্ষণে বড় বড় আঁখিজোড়ার পলক ফেলছে যেটা আয়াসের কম্পিত চিত্তকে বেসামাল করে দিচ্ছে। আয়াসকে কিছু বলতে না দেখে সুনহেরা ঘাড় বাকিয়ে তার দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় কথা বলতে বলে। আয়াসের ঘোর কেটে যায়। মাইক মুখের সামনে ধরে বলল,
-প্রথমেই বলবো সবাইকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের এই বিশেষ দিনে উপস্থিত হয়ে আমাদের খুশিকে আরো বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আপনারা অনেকেই জানেন আজ সকালেই পারিবারিক ভাবে হুট্ করে আমার বোন মাহানুর আর সুনহেরার ভাই আরহাম ভাইয়ের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে। আমরা সবাই তাঁদের দুইজনকে কংগ্রেস জানাই।
সকলে একসাথে তালি দিলো। আয়াস একটু নিঃশাস নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে মাহানুরকে খুঁজতে লাগলো। এক কোণায় অহনার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে মাহানুর। বিড়বিড় করে আয়াসকে বকছে সে যেটা আয়াস বুঝতে পারলো। সুনহেরা বলল,
-আমি আমার ভাইয়ের অনেক আদরের ছোট বোন। কয়েক বছর আগে আমাদের বাবা মারা যান। তারপর থেকে আমার ভাই-ই আমাদের দুই বোনকে আঁকড়ে ধরেন। ছোট থেকে ছোট আবদার পূরণ করে এসেছেন তিনি আমাদের। সত্যি বলতে সবারই হয়তো মা বাবা সবচেয়ে প্রিয় থাকে কিন্তু আমার আমার ভাই সবথেকে বেশি প্রিয়। আম্মু আর আপুও অনেক প্রিয় তবে ভাইয়া একটু বেশি।
শেষের কথাটা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল সুনহেরা। নিস্পলক অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা আরহামের দিকে তাকায় সে। চোখ দিয়ে এক ফোটা দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে তার। আরহাম রাগী মুখ তাকাতেই সুনহেরা আলতো হাতে আঁখিজোড়া মুছে নেয়। স্মিত হেসে বলল,
-সরি একটু ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম। ছোটকাল থেকে ভেবে এসেছি একটা মাত্র ভাইয়ের বিয়েতে ইচ্ছে মতো এনজয় করবো। বাট এইরকম হঠাৎ ভাবে তার বিয়ে হয়ে যাবে কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। এখন হুট্ করে বিয়ে হলেও কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না ভাইয়ের বিয়েতে এনজয় করা থেকে!
সুনহেরার কথার মানে কেউই বুঝলো না। মাহানুর একবার রাগে কিড়মিড় করছে তো একবার সরমে মাটিতে লুটপুটি খাচ্ছে! সুনহেরা আয়াসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
-তোহ আমরা দুইজন ভেবেছি বিয়ে কেনো শুধু আমাদের হবে আমাদের নিউ কাপলদেরও তো হওয়া উচিত তাই না? আপনারাও একসাথে দুইটা বিয়ে এনজয় করতে পারবেন। ভাইয়া আর মাহানুর আপু উপস সরি এখন তো শুধু ননদ না বড় ভাবিও আপনি আমার! ভাইয়া আর ভাবি আপনারা একটু কষ্ট করে স্টেজে আসুন। প্লিস আমার আবদার এটা।
রিদ এক প্রকার আরহামকে ঠেলে স্টেজে পাঠায়। মাহানুর এক পা এগিয়ে গেলে আরেক পা পিছিয়ে যায়। এভাবেই মৃদু পায়ে স্টেজে উঠে সে। উঠার সময় শাড়ীর জন্য একটু বেগ পেতে হয়েছে। আয়াস তাকে উঠতে সাহায্য করে। আরহাম রেগে আছে তাই আর এগিয়ে যায়নি। দুইজনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে সুনহেরা বলল,
-আমাদের সাথে ভাইয়া আর ভাবির বিয়েটাও সম্পূর্ণ হবে যাবতীয় রীতি মেনে। আগামীকাল একই স্টেজে দুই জুটির বিয়ে হবে। আপনারা প্লিস কেউ না বলবেন না ভাইয়া আর ভাবি। আপনাদের কাছে এই ছোট্ট আবদার আমার।
আরহাম আড়চোখে মাহানুরের দিকে তাকায়। মূর্তির মতো শাড়ী ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। আরহাম শান্ত কণ্ঠে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-আমার বোনের আবদার আমি কিভাবে অপূরণ রাখি! তোদের যা যা মন চায় কর আমাদের দুইজনের কোনো আপত্তি নেই। তাই না মাহানুর?
মাহানুর অন্যমনস্ক হয়ে মাথা নাড়ায়। রিদ সহ আরহামের বন্ধুরা সিটি বাজাচ্ছে। মাহানুরের এখন ইচ্ছে করছে এই দুই ভাইবোনকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে! একবার তো বিয়ে হয়েছেই এতো আহামরি করার কী আছে! মাহানুর কোনোরকম স্টেজ থেকে নেমে পরলো। অহনা এক দৌড়ে মাহানুরের কাছে আসে। মাহানুরকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে ঘুরতে থাকে। মাহানুর ঝান্টা মেরে সরিয়ে দেয় অহনাকে। মুখ ফুঁলিয়ে চেয়ারে বসে পরে। একে একে সবার হলুদ দেওয়া শেষ হলে অনেকক্ষন নাচানাচি, গান হয়। মাহানুর গোমড়া মুখে বসেই দেখছে। একসময় অতিরিক্ত বিরক্ত লাগায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। অহনা আর হাজেরাকে বলে তার অসুস্থ লাগছে তাই সে রুমে চলে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ভবনের ভিতরে ঢুকতে যাবে তখন মাহানুরের পুলের কথা মনে পরে। বড় বড় পা ফেলে ভবনের পিছনে যায় সে। পুলের সাইটেও লাইটিং করানো হয়েছে তাই আলোয় ঝলমল করছে। একজন মানুষও নেই এখানে। মাহানুর আশেপাশে তাকিয়ে শাড়ী উঁচু করে পুলে পা চুবিয়ে বসে পরলো। ফোন হাতে নিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজলো।
আরহামের সাদা পাঞ্জাবীতে নিচের দিকে কিছুটা হলুদের দাগ বসিয়ে দিয়েছে রিদ। সেটা পরিষ্কার করতে পুলের দিকে যাচ্ছিলো সে মাঝ পথে তার রাস্তা আটকে দাঁড়ায় ইকরা। আরহাম আকস্মিক ইকরাকে এভাবে সামনে দেখে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে গেলো। অগোছালো ভাবে তাকাতেই দৃষ্টি নত করে ফেললো আরহাম। ইকরার শাড়ীর পরার ধরণ তার কাছে জঘন্য লাগলো। আরহামের মতে অর্ধেক শরীর উন্মুক্ত করে শাড়ী শুধু প’তি’তা মেয়েরাই পরে ভালো ঘরের মেয়েরা না। নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই গম্ভীরভাবে বলল,
-আমি একটু ব্যস্ত আছি ইকরা পরে কথা হবে।
-কিসের এতো ব্যস্ততা আপনার?
কিছুটা এগিয়ে গেলো ইকরা। আরহাম চোখ, মুখ শক্ত করে ফেললো। এই দিকটায় তেমন কোনো মানুষ নেই। একদম নির্জন। দৃঢ় কণ্ঠে আরহাম বলল,
-দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলুন ইকরা। আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক ভুলে যাবেন না।

গুনগুন গান গাইতে গাইতে বামপাশে তাকায় মাহানুর। আরহাম আর ইকরাকে এতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। দ্রুত কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ফেলে। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে বিষয়টা বুঝতে।
আরহামের কথায় নিলিপ্ত ভঙ্গিতে হাসলো ইকরা। ধীর কণ্ঠে বলল,
-আপনার মতো সুদর্শনকে শুধু আমার সাথে মানায়! জানেন প্রথম দিনই আপনাকে দেখে আপনার প্রেমে পরে যাই আমি। মাহানুরের সাথে তো আপনার নামের মাত্র বিয়ে হয়েছে। আপনি ওকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে এসে পরুন আরহাম। আমরা বিয়ে করে হ্যাপিলি লাইফ কাটাবো। আই সোয়ার আমি আপনাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবো।
আরহাম কুটিল হাসলো। ইকরার কথা তার কাছে অনেক ফানি জোকস মনে হচ্ছে। ইকরা মনে মনে ভাবলো আরহাম হয়তো তার কথায় গলে গিয়েছে। তাই সে মধ্যকার সবটুকু দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলে। আরহামের বুকের ওপরে পাঞ্জাবীর বোটামে হাত দিয়ে আবেদনময়ী কণ্ঠে বলে,
-আপনি বুঝদার। অবশ্যই পঁচা শামুকে পা কাটবেন না! যদি বলেন আজ রাতেই আমি আপনার সাথে থাকতে রাজি।
আরহাম হাসি মুখে ধীর কণ্ঠে বলল,
-আজ তুমি যদি আমার বোনের ননদ আর আমার স্ত্রীর কাজিন না হতে তাহলে, এইযে এতো নিকটে আসার জন্য আর আমার বক্ষস্থলে হাত দেওয়ার অপরাধে তোমাকে কষিয়ে দুটো চড় দিতাম আমি।
ইকরা চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলে। আরহামের কাছ থেকে এইরকম কথা সে মোটেও আশা করেনি। আরহাম একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো ইকরাকে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একই ভঙ্গিতে বলল,
-আর হ্যাঁ ঠিক বলেছো আমি অবশ্যই বুঝদার তাই পঁচা শামুকে পা কাটতে চাচ্ছি না।
ইকরা এবার আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরলো আরহামকে। আরহাম যেনো ভড়কে গেলো। এই মেয়ে তার ধয্যের বাঁধ ভাঙছে।
অন্যদিকে মাহানুর কিছুই বুঝলো না। তাঁদের মধ্যে কী কথা হচ্ছে বা ইকরা আরহামকে কেনো জড়িয়ে ধরলো কিছুই ঠাওর করতে পারলো না সে। শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। আরহাম ভালোভাবেই তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক বুঝ দেয় কিন্তু ইকরা জোঁকের মতো আরহামকে ধরে রেখেছে। আরহাম আর পারলো না নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। ক্ষেপা বাঘের মতো ইকরাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে ক্ষেত হলো সে। মাহানুর চমকিত হয়ে মুখে হাত দিলো। ইকরা গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। আরহাম ক্ষিপ্ত কণ্ঠে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-এই চড়টা তোমার গালে পরতো না যদি না আমার বউয়ের সম্পদ এই আমাকে টাচ করতে! নেক্সট টাইম আমার আশেপাশে ভীড়লেও ভয়ংকর খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।
ইকরা কান্না করতে করতে এক দৌড়ে চলে যায়। আরহাম চোখ বন্ধ করে বড় বড় নিঃশাস নেয়। আঁখিজোড়া খুলে সামনে পা বাড়ায়। পুল সাইডে তাকাতেই মাহানুরকে দেখতে পায় সে। পানিতে ডুবানো মাহানুরের উন্মুক্ত ফর্সা পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। মাহানুর সেই দৃষ্টি পরোক্ষ করে ত্বরিত পুল থেকে পা তুলে শাড়ী নিচে নামিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কোনোদিক না তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে যেতে নিলে আরহাম তাকে ডেকে উঠে। তবুও সে দাঁড়ালো না। আরহাম ছুটে এসে মাহানুরের স্মুখীন দাঁড়ায়। আচমকা সামনে আসায় মাহানুর আরহামের সুঠাম বক্ষের সাথে বারি খেয়ে একটু দূরে সরে যায়। আর্তনাদ করে উঠলো,
-আহহহ! এতো শক্ত মানুষের বুক হয় নাকি বাবা!
-তুমি একা একা এখানে কী করছো? আবার কোন দুর্ঘটনা ঘটানোর ফন্দি আটছো?
-ঐ বেটা মুখ বন্ধ কর। তখন থেকে তোর কথাগুলা শুনছি আমি! ভাই আমি তোর বউ, তোর টাকা দিয়ে কেনা গোলাম না যে তোর সব কথা শুনতে হইবো।
ছটপট বলল মাহানুর। আরহামের নাকের পাঠা ফুলে উঠলো। মাহানুরের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল,
-বউ দেখেই তো আমার সব কথা শুনতে হবে। বাই দা ওয়ে ব্লাউজ চেঞ্জ করোনি?
-হো করিনি আর করবো ও না। দরকার পরলে ড্রেস ছাড়া ঘুরবো। তুই কিছু বলতে পারবি না আমাকে।
-কিছু বলবো না ডাইরেক্ট পা ভেঙে রুমে বসিয়ে রাখবো আমি। তারপর ড্রেস ছাড়া থাকো বা পরে সেটা তোমার বেপার। আর এইযে তুই তুকারী বাদ দেও। এইরকম বেয়াদবি আমার সাথে চলবে না।
-তোকে আমি পরে দেখবো!
কটমট বলল মাহানুর। আরহাম ইনোসেন্ট মুখ করে মুচকি হেসে বলল,
-ওকে। যখন দেখবে আগে একবার বলে দিও একটু রেডি হয়ে থাকবো নে।
মাহানুর গটগট করে চলে যাচ্ছিলো কী মনে করে আবার পিছনে ফিরে তাকায়। পিটপিট তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-ইকরাকে থাপ্পড় কেন মারলেন?
-নিঃসন্দেহে বড় কোনো ভুল করেছে তাই শাস্তি পেয়েছে। তুমি করলে তুমিও পাবে।
মাহানুর উত্তর পেয়ে আর দাঁড়ালো না। আরহাম হাসতে হাসতে বলল,
-শরীর অসুস্থ লাগলে রুমে যেয়ে রেস্ট করো। তারপরও যদি অসুস্থ না কমে আমাকে বলিও আরো কয়েকটা ড্রিংক্স এর বোতল এনে দেবো নে।
মাহানুর আর পিছনে ফিরে তাকালো না। আরহামকে বকতে বকতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
_________________
সকাল সাতটা। এলোমেলো হয়ে ঘুমে বিভোর মাহানুর। পরনে লেডিস টি-শার্ট অর্ধেকই ওপরে উঠে গিয়েছে। কাঁথা অর্ধেক বিছানার নিচে আর বাকি অর্ধেক তার পায়ে। অহনা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে আবারও মাহানুরের পাশে শুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মাহানুরের মুখ ভঙ্গিমা দেখে মিটমিট হাসছে অহনা।
-মাহানুর?
মৃদু কণ্ঠে ডাকলো অহনা। মাহানুরের তরফ থেকে কোনো উত্তর নেই। অহনা আবারও ডাকলো।
-দোস্ত। উঠ না জলদি! মাহানুর?
-হুম।
ঘুমের মধ্যেই বলল মাহানুর। অহনা বিরক্ত হয়ে আবারও বলল,
-মাহানুরররর?
-কী হয়েছে? এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচামেচি কেনো করছিস বোকাচো***?
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল মাহানুর। অহনা মাহানুরকে আলতো হাতে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরলো। মাহানুরের কানে কানে বলল,
-দোস্ত আজ না তোর বিয়ে? তাহলে আজ রাতেই তো তোদের ফার্স্টনাইট!

>>>চলবে।
( প্রত্যেকটা মাহানুরের মতো ঘাড়তেড়া মেয়েকে সোজা করতে একজন রাগী, গম্ভীর আরহামের মতো জীবনসঙ্গী দরকার। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে বলবেন। আসসালামু ওলাইকুম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here