তবে_ভালোবাসো_কী ২ #Mehek_Enayya(লেখিকা) পর্ব ১৬

0
182

#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ১৬

সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছে। সকল মেহমানদের মধ্যে চাপাগুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সুনহেরা সেই কখন থেকে কেঁদেই চলেছে। তার ইচ্ছে ছিল সবাইকে নিয়ে অনেক হাসিখুশি ভাবে বিয়ে হবে তার। কিন্তু আজ কী থেকে কী হয়ে গেলো! মাহানুর নিজের রুমে রোবটের মতো বসে আছে। অহনা হাজেরা তার পাশে। মাহানুর না কিছু খাচ্ছে, না কোনো কথা বলছে। হাজেরা মাহানুরের এই রূপ সহ্য করতে পারছে সে। তার হাসিখুশি মেয়েটার হটাৎ কী হয়ে গেলো। কার নজর লাগলো মাহানুরের ওপর!
আরহাম এসেছে মেহরাব খান ও হামজা খানের সাথে কথা বলতে। মেহরাব খান গুরুগম্ভীর হয়ে বসে আছে। হামজা খান বললেন,
-তো তুমি এখন কী বলতে চাইছো আরহাম?
-আমি মাহানুরকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। সকলের মতে আমার জন্য যেহেতু ওর চরিত্রে দাগ লেগেছে তাই আমি নিজেই নিজের ভুল সংশোধন করতে চাই।
সোজাসাপ্টা বলে ফেললো আরহাম। মুখের কঠিন্য ভাব উপচে পরছে তার। বড়দের কিছু বলার আগেই আয়াস ক্ষিপ্ত কণ্ঠস্বরে বলল,
-আমি কোনোভাবেই আমার বোনকে আপনার সাথে বিয়ে দেবো না। আপনার জন্যই ও আজকে এতো কষ্ট পেয়েছে না জানে বিয়ের পর কত কষ্ট পায়!
-মুখ বন্ধ করো বেয়াদপ ছেলে। বড়দের সাথে এভাবে কথা বলে?
ধমকের স্বরে বলল হামজা খান। আয়াস হাত মুঠো করে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। মেহরাব খান বললেন,
-তুমি ভেবেচিন্তে বলছো নাকি রাগে?
-আমি সম্পূর্ণ জ্ঞানে বলছি। আমি চাচ্ছি না এইরকম একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে ওর আর আমার ভবিষ্যত নষ্ট হোক।
-মাহানুর রাজি হবে না। আমার মেয়েকে আমি ভালোভাবে চিনি।
-হবে।
অনেকটা নিশ্চিত হয়ে বলল আরহাম। মেহরাব খান গম্ভীর স্বরেই বললেন,
-রাজি হলেও আমার কিছু শর্ত আছে।
-বলুন?
-আমার মেয়ে যে পর্যন্ত তোমাকে, এই বিয়েকে নিজ থেকে না মেনে নেবে সে পর্যন্ত ও নিজের বাসায়ই থাকবে। এখন যেভাবে জীবনযাপন করছে এভাবেই থাকবে। তুমি কখনও তাকে কোনো বিষয় নিয়ে অধিকার ঘাটাতে পারবে না।
হামজা খান কিঞ্চিৎ ভড়কে তাকিয়ে রইলেন ভাইয়ের দিকে। আয়াসের পছন্দ হলো মেহরাব খানের প্রস্তাব। আরহাম কিছুক্ষন ভেবে বললেন,
-ঠিক আছে।
আরহাম আর দাঁড়ালো না। তাঁদের রুম থেকে বের হয়ে মায়ের রুমে আসলেন। জয়া বেগম বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন। তার পাশেই সনিয়া আর সুনহেরা বসা। আরহামকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেন তিনি। আরহাম নরম পায়ে মায়ের পাশে এসে বসলেন। জয়া বেগমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
-মা তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো?
-করি।
-আমি যদি এখন মাহানুরকে বিয়ে করি তোমার কোনো আপত্তি থাকবে মা?
মাথা তুলে তাকালেন জয়া বেগম। সনিয়া, সুনহেরা যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। আরহাম কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় জিগ্যেস করলো,
-কিছু তো বলো মা?
-আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং তুই যদি মাহানুরকে বিয়ে করিস তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউই হবে না বাবা।
মায়ের উত্তর শুনে প্রসন্ন হলেন আরহাম। জয়া বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।

মেহরাব খান মাহানুরের রুমে আসলো। অবচেতন হয়ে বসে আছে মাহানুর। মেহরাব খান তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আদুরে ভঙ্গিতে বললেন,
-যে যা মন চায় বলুক আমার মেয়ে কেমন সেটা আমি ভালো করেই জানি। আম্মা নিজেকে শান্ত কর।
মাহানুর কিছু বলল না। নিঃশব্দে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহরাব খান আবার বললেন,
-তবে তুই একটা দোষও করেছিস মা। নে’শাপানি ভালো মেয়েরা করে না! তুই কিভাবে এসব করলি?
লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো মাহানুর। পাশেই অহনা দাঁড়িয়ে ছিল ভীত কণ্ঠে বলল,
-আসলে আঙ্কেল ওর একার দোষ নয়। আমরা সবাই মিলেই এনেছিলাম। বুঝতে পারিনি এইরকম কিছু হবে।
মেহরাব খান অহনাকে কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন,
-আরহাম তোকে বিয়ে করতে চায় মা।
মাহানুর একবার বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে ফেললেন। মনে মনে অনেক কিছুর হিসাব মেলালো সে। তার মতে এখন আরহামকে বিয়ে করাই শ্রেয়। আর যাই হোক পরিবারের সম্মান বেঁচে যাবে। বাবা, বড়বাবাকে অপমানিত হতে হবে না। ভাবলেন মাহানুর। মেহরাব খান মাহানুরকে কিছু বলতে না দেখে বলেন,
-আম্মা তোকে আমরা কেউ জোর করবো না। এইরকম ক্ষুন্ন বিষয় কিছুই না। তুই রাজি না হলে আমি এখনই আরহামকে না করে দিয়ে আসবো।
-আমি রাজি বাবা। কাজীকে নিয়ে আসতে বলো।
মেহরাব খান মাহানুরের কথায় অতিকৃত হয়ে গেলেন। নরম কণ্ঠে বললেন,
-তুই শান্ত মাথায় ভাব আম্মা। তারপর বল।
-আমি শান্ত মাথায়ই আছি বাবা। তাকে যেয়ে বলো আমি রাজি।
-ঠিক আছে।
মেহরাব খান চলে যেতেই অহনা মাহানুরের পাশে এসে বসে। মাহানুরের গালে হাত দিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে বলে,
-দোস্ত তুই সত্যি বিয়ে করতে চাচ্ছিস! তোকে সারাজীবন তার সাথে সংসার করতে হবে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাব।
-আমার যা ভাবার আমি ভেবেছিস। আর বাকি পরে দেখা যাবে।

কিছু সময়ের মধ্যে রিদ কাজীকে নিয়ে আসে। যিনি কিছুক্ষন পূর্বেও ছিল মিসস মাহানুর খান সে এখন মিসেস মাহানুর চৌধুরীতে পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষন আগে সকলের উপস্থিতি ও সম্মতিতে তাঁদের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়। আরহাম ঝটপট কবুল বললেও মাহানুর বেশ সময় নিয়েই বলে। একজন যে পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বিয়ে করেছে, আরেকজন যে প্রিয়তমার গায়ে দুশ্চরিত্রা ট্যাগ ছাড়ানোর জন্য বিয়ে করেছে এদের শেষ পরিণতি কী হয় এখন সেটা দেখার পালা।
সুনহেরা স্তব্ধ। নিজের বিয়ের জন্য এসে এভাবে ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাবে তার কল্পনাতেও ছিল না। সবারই বিষয়টা স্বপ্নের মতো লাগছে। যারা এতক্ষন সমালোচনা করছিলো এখন তাঁদের মুখও বন্ধ। রোকসানা, রিনা মুখ লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। জয়া বেগম মাহানুরের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে চলে যায়। আয়াস আর সুনহেরা বাদে সবাই রুম থেকে চলে যেতেই মাহানুর বড় নিঃশাস ফেলে শান্ত ভাবে বসে। স্বাভাবিক ভাবেই দুইজনকে বলল,
-এই পর্যন্ত যা যা হলো এইসব নিয়ে তোমাদের মধ্যে যাতে কোনো ঝামেল্লা না হয়। আয়াইসা হলুদের ডেকোরেশন ঠিকঠাক হচ্ছে নাকি যেয়ে দেখ আর সুনহেরা ভাবি মন খারাপ করে বসে থাকবে না বলে দিলাম।
-আমরা নাহয় তোর কথা মানলাম তুইও রুমের ভিতরে অদমের মতো বসে না থেকে বাহিরে আসবি।
-আসবো না কেনো? আজব! আমার ভাইয়ের বিয়ে আমি তো এনজয় করবোই।
-হো গুড। আমি যাই তাহলে।
-হুম যা।
আয়াস চলে গেলো। সুনহেরা চোখের পানি মুছে মাহানুরকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-আপনি অনেক ভালো মাহানুর আপু। আই লাভ ইউ সো মাচ।
-ওরেরর! এতো ভালোবাসা আমি কোথায় রাখবো! লাভ ইউ টু।
অহনা শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। সুনহেরাকে চলে যেতে দেখে দরজা লাগিয়ে মাহানুরের কাছে আসে। মাহানুর চিৎপটাং হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। অহনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-তুই এটা কী করলি? এখন এই বিয়ে কিভাবে পালন করবি? কিভাবে সংসার করবি?
-জানি না আমি।
-এখন জানি না বললে হবে! প্লিস বলিস না তুই মুভির ন্যাকা নায়িকাদের মতো আরহাম ভাইকে বলবি এই বিয়ে আমি আমি মানিনা,পরিবারের জন্য বিয়ে করলেও আপনাকে আমি কখনই স্বামী হিসেবে মানতে পারবো না।
অনেকটা অভিনয় করেই বলল অহনা। মাহানুর ফিক করে হেসে উঠলো। অহনা কোমরে হাত দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
-তুই হাসছিস! ভাই আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমাদের সবার আগে তোর বিয়ে হয়ে গেলো! তাও আবার আমার ক্রাশের সাথে!
-পঁচা পানিতে চুবে ম’র তাহলে।
-হুসসস। এতো জলদি মরবো কেনো আমি!
মাহানুর কিছু বলল না। ফোন হাতে নিয়ে রুমের বেলকনিতে চলে আসে। কাঙ্ক্ষিত একটি নাম্বার ডায়াল করতেই কিছুক্ষনের মধ্যে কল রিসিভ করে অপরপাশের জন। মাহানুর বলল,
-সাদাফ ভাইয়া কী খবর? কোনো যোগাযোগ নেই যে?
-এইতো আমি আজই তোমাকে কল করতাম।
-কেনো? নতুন কোনো জায়গায় যাচ্ছেন নাকি?
-হুম। এবার বিশজনের গ্ৰুপ করে মেঘালয় যাচ্ছি। তুমি না বলেছিলে নেক্সট কোথায়ও ট্রাভেলে গেলে তোমাকে বলতে?
-ওয়াও! মেঘালয় যাচ্ছেন! আমার স্বপ্নের জায়গা।
-দুইটা সিট এখনও খালি আছে। ভেবেছিলাম তুমিও যাবে কিন্তু এখন তো আয়াসের বিয়ে।
-আপনি আসলেন না কেনো ভাইয়ার বিয়েতে?
-আমি অনেক বেশি ব্যস্ত বুঝলে তাই আর আসতে পারিনি। আয়াসকেও পাও ধরে সরি বলতে হয়েছে।
-ওহ!
-এখন বলো তুমি যাবে? পরশুদিন সকাল সাতটায় রওনা হবো আমরা।
-যাবো আমি। আপনি আমার জন্য সিট খালি রাখবেন আর আমি একবারে এসেই সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে দেবো।
-আরেহ তুমি হলে বন্ধুর বোন তোমার থেকে আবার কিসের টাকার হিসাব! তাহলে তুমি সিউর।
-জি ভাইয়া।
-ঠিক আছে। তাহলে দেখা হচ্ছে।
-হ্যাঁ। রাখি।
খুশিতে কল কাটে মাহানুর। মেঘালয় যাবে তার স্বপ্নের জায়গায় ভাবতেই তার মন নেচে উঠলো। এতক্ষনের সব ঘটনা যেনো ভুলে গেলো সে। মাহানুরের মাথায় শুধু ঘুরছে ট্রাভেলে যাওয়ার কথা। এখন বাবাকে রাজি করাবে। আর যদি রাজি না হয় তাহলে কাউকে না বলেই চলে যাবে বলে মনস্থির করলো মাহানুর।
______________________
রোদের প্রচন্ড তাপ। কপাল চুইয়ে চুইয়ে ঘাম পরছে আরহামের। পরিহিত আকাশি রঙের শার্ট ঘামে ভিজে চুবচুব। হাতে হাতে কাজ করছে আবার লোকদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে সে। এতো সহজেই নিজের পছন্দের মানুষকে পেয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আরহাম। বাহ্যিক দিয়ে চিন্তিত দেখালেও ভিতর ভিতরে তার চিত্ত উৎসব পালন করছে। সুনহেরা আয়াসকে খুঁজছে। সকাল থেকে আয়াসের সাথে তার কথা হয়নি। আয়াস কী কোনোভাবে তার ওপর রাগ! অনেক খুঁজতে খুঁজতে বাগানের দিকটায় পেয়ে যায় আয়াসকে। এখানে তেমন একটা মানুষ নেই। সুনহেরা নরম পায়ে হেঁটে আয়াসের স্মুখীন যেয়ে দাঁড়ায়। আয়াস ফোন থেকে চোখ তুলে সুনহেরার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,
-কোনো দরকার?
-হ্যাঁ। আপনাকে।
আয়াস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলেছে সুনহেরা। ত্বরিত হকচকিয়ে বলল,
-মানে আপনার সাথে কথা আছে আমার।
-হুম বলুন?
-আপনি কী কোনোভাবে আমার ওপর রেগে আছে?
-আপনার ওপর রেগে থাকবো কেনো?
সুনহেরা মাথার ওড়না টেনে আমতা আমতা করে বলল,
-না মানে সকালের জন্য যদি রেগে থাকেন।
-এখানে আপনার কোনো দোষ নেই তাই আমার আপনার সাথে রাগ করে থাকাটাও বেমানান।
-সত্যি রেগে নেই?
-না।
-ধন্যবাদ।
সুনহেরা মুচকি হাসলো। চলে যেতে উদ্যত হতেই আবার পিছনে ফিরে বলল,
-আপনি ততটাও খারাপ নন! তবে মাহানুর আপুর থেকে কম ভালো।
এক প্রকার দৌড়ে চলে গেলো সুনহেরা। আয়াস আনমনে হেসে উঠলো।

ফোন টিপতে টিপতে বাহিরে আসে মাহানুর। কেমন নজরে সবাই তাকে দেখছে। মাহানুর মনে মনে ভাবলো এখন সে অনেক উড়বে! নতুন বিয়ে করা বউ সে। সবাইকে দেখাবে সে অনেক হ্যাপি। রোকসানা আর রিনা বেগমকে উচিত শিক্ষাও দেবে তবে ধীরে ধীরে। সনিয়া এগিয়ে এসে মাহানুরের সাথে কথা বলছে। মাহানুর সনিয়ার এক বছরের পুচকু ছেলেকে কোলে নেয়। আসলে সনিয়ার একটু কাজ আছে তাই বাবুকে মাহানুরের কাছে দিয়ে গেলো। মাহানুর হাঁটছে আর বাবুর সাথে কথা বলছে। সে বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিতে পারে না ভালোভাবে। সামলাতেও পারে না। হাজেরা তাকে দেখে একসময় বলতো এই মেয়ে নিজের বাচ্চাকে কিভাবে সামলাবে কে জানে!
রিসোর্টের পিছনে সুইমিং পুলের সামনে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। মাহানুরকে দেখে আরহামের বন্ধুরা বলল,
-ঐ তো আমাদের ভাবি জি আসছে।
অহনা, সিয়াম মাহানুরকে দেখে হাসছে। কিভাবে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছে! অহনা দৌড়ে এসে বাবুকে কোলে নিয়ে নেয় মাহানুরের থেকে। মাহানুর পুলে পা চুবিয়ে বসতে বসতে বলল,
-যাক বাঁচা গেলো বাবা! আমি তো বাবুকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম কখন হাত থেকে পরে যায়!
মাহানুরের কথায় রিদ হাসতে হাসতে বলল,
-শালিসাহেবা বাবু সামলাতে পারো না?
-না ভাই।
-ভালো ভালো। আমার সাথে হাত মেলাও।
-তাও আপনার সমস্যা নেই বখাটে জিজু অহনা অনেক সুন্দর করে বাচ্চা সামলাতে পারে।
-তাই তো ভাবছি শুধু বিয়েটা হোক বছরে বছরে বাচ্চা নেবো। আইডিয়া টা সুন্দর না শালিসাহেবা?
-হো একদম জাক্কাস আইডিয়া!
মুখ টিপে হাসছে মাহানুর। অহনা সরমে চোখ মুখ খিচে বলল,
-ইসসস! এখন পর্যন্ত বিয়ের খবর নেই সে বাচ্চার প্ল্যানিং করছে!
-তুমি বললে এখনই বিয়ে করে ফেলি জানেমান?
-চুপ থাকুন আপনি। অসভ্য মানুষ!
সিয়াম, মুহিবের সাথে টুকটাক কথা বলছে মাহানুর। রিদ অহনার সাথে শয়তানি করছে। সবার ব্যবহারই স্বাভাবিক। যেনো এতক্ষন কোনো ড্রামা চলছিল! জয়া বেগম এসে বাবুকে নিয়ে যান। মাহানুরকে স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকতে দেখে তার ভীষণ খুশি লাগলো। তবে মেয়েটার চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। তিনি আবার ফিরে আসেন এক গ্লাস জুস নিয়ে। মাহানুরের কাছে এসে দাঁড়ায়। মাহানুর মাথা উঁচু করে জয়া বেগমকে দেখে বলে,
-আন্টি কোনো দরকার ছিল?
-না। নেও এটা ঝটপট খেয়ে নেও। মুখ কেমন শুকিয়ে গিয়েছে আর রোদে বেশিক্ষন বসে থেকো না।
মাহানুর গ্লাস নিতে নিতে বলল,
-জি আন্টি।
-সবসময় এইরকম হাসিখুশিই থাকবা। কেউ কিছু বললে এড়িয়ে চলবে নাহয় তাকে কতগুলো কথা শুনিয়ে এগিয়ে আসবে। বুঝলে মা?
-হুম আন্টি।
জয়া বেগম মাহানুরের কপালে চুমু দিয়ে চলে যায়। মাহানুর বিস্মিত হয়ে অহনার দিকে তাকায়। অহনা বুকে হাত মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
-তোর শাশুড়িকে আমাকে দিয়ে দে বইন!
-আই এম তো অবাক ভাই!
জুস খেতে খেতে বলল মাহানুর। অহনা বলল,
-যা তোর মা নেই তাই সৃষ্টিকর্তা তোকে দুই দুইটা মা দিয়ে দিয়েছে।
-হুম আর একটা মায়ের মতো শাসন করা বান্ধবীও।
তাঁদের হাসাহাসির মধ্যে আগমন ঘটে আরহামের। ভীষণ ক্লান্ত সে। কপালের ঘাম ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসে। রিদ চেঁচিয়ে বলল,
-আমাদের নতুন বিয়ে করা জামাইয়ের অবস্থা খারাপ নাকি!
-খারাপ না আবার ভালোও না।
এগোতে এগোতে বলল আরহাম। শার্ট থেকে ঘামের গন্ধ আসছে। আরহাম বিরক্ত হয়ে শার্ট খুলে ফেলে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাহানুরের কোলে শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে। তারপর বন্ধুদের পাশে যেয়ে বসে পরলো। মাহানুর ভ্রু কুঁচকে শার্টয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগে শার্টটা নিজের কোলের থেকে উঠিয়ে পাশে রাখলো। অহনা মিটমিট করে হাসছে।
রিদ আরহামের কানে ফিসফিস করে বলল,
-কিরে বন্ধু এখন বডি দেখিয়ে আমার শালিসাহেবাকে পটাতে চাচ্ছিস নাকি?
-তোর শালিসাহেবা বডি দেখে পটবে না। আর যদি পটে যায় তাহলে তো হলোই!
-আমার শালিসাহেবাকে পটানো সহজ না বেটা। অনেক কসরত করতে হবে।
-কসরত!
-হো আগে পটাতে কসরত করতে হবে তারপরই বিছানায় কসরতের সুযোগ পাবি।
দাঁত বের করে হেসে বলল রিদ। আরহাম রিদের পিঠে কিল দিয়ে বলল,
-চোপ শা’লা। তোর মাথায় সারাক্ষন খালি ঐসবই চলে! সময় আছে ভালো হো।
-বউদের মন পাইতে হলে একটু ঐরকমই হইতে হয় বন্ধু। আগের থেকাই প্রাকটিস করতেছি।
আরহাম হাসলো কিছু বলল না। রিদ আর আরহামকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেখে অহনা বলল,
-আপনারা কী বলছেন চুপে চুপে?
-ছেলেদের সিক্রেট কথা জানেমান। বাচ্চাদের শুনতে নাই।
অহনা মুখ বাঁকালো। রিদ মাহানুরকে জিগ্যেস করলো,
-তা শালিসাহেবা তারপর শশুরবাড়ি যাবে নাকি বাপের বাড়ি?
-কোনো জায়গায়ই যাবো না।
-মানে? তাহলে কোথায় যাবে?
-আমার স্বপ্নের দেশে যাবো।
আরহাম অবাক হয়ে মাহানুরের দিকে তাকালো। মাহানুরকে সুনহেরা ডাকছে। পানি থেকে পা তুলে অহনাকে নিয়ে চলে যায় সে।
__________________
সন্ধ্যা পরেছে। সকলে এখন রেডি হতে ব্যস্ত। ছেলেরা সবাই তৈরি। কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছে তো আবার কেউ কাজকাম দেখছে।
আজকে মেয়েরা সবাই সাদা লাল মিশ্রণের শাড়ী পরেছে। তরণী, মধ্যবয়স্ক সবাই এক। মেকআপ আর্টিস্টরা মেকআপ করে দিচ্ছে সুনহেরা আর অহনাকে। মাহানুর আজকে আগে আগেই তৈরি। অনেকেই তার সাথে শয়’তানি করছে। নতুন বিবাহিত বউ বলে কথা! মেকআপ করা আর শাড়ী পরা হয়েছে সে এখন তার রুমে যাবে জুয়েলারি পরতে। অহনা তাকে বলল,
-মাহানুর আসার সময় আমার জুয়েলারি গুলো নিয়ে আসিস।
-ওকে।
মাহানুর রুম থেকে বের হয়। গুনগুন গান গাইতে গাইতে হাঁটছে সে। নিজের রুমে এসে ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। শাড়ীর সাথে আজ তারা টাটকা লাল গোলাপের জুয়েলারি পরবে। আয়াস বিকালেই তাঁদের নিয়ে এসেছে। মাহানুর আয়নার সামনে সবকিছু বের করে সাজিয়ে রাখে। প্রথমে কানের দুল পরে তারপর হাতে ফুলের মালা পরে। সহসা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে পিছনে ফিরে তাকায়। আঁচলটা সুন্দর করে নিয়ে দরজা খুলে দেয় মাহানুর। দরজার বাহিরে আরহামকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। হেলফেল না করে দরজা লাগাতে নিলে আরহাম জোর করেই রুমে ঢুকে যায়। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে মাহানুরের দিকে তাকিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়ায়। মাহানুর বিরক্ত হয়ে বলল,
-সমস্যা কী? নাকি বিয়ে হয়েছে বলে জামাই বউ জামাই বউ খেলতে এসেছেন?
-কিভাবে খেলে? যদি একটু শিখিয়ে দিতে তাহলে ট্রাই করতাম।
মাহানুর তপ্ত নিঃশাস ফেলে সামনে থেকে সরে যায়। এই মানুষের সাথে তর্কে যেয়ে শুধুই নিজের ভালো মুডটা নষ্ট করতে চায় না সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের মালা বাধঁতে থাকে। আরহাম পিছন থেকে মাহানুরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত আগাগোড়া পরোক্ষ করে আঁখিজোড়া বন্ধ করে ফেলে। আশেপাশে তাকিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশাস নেয়। বার বার তার নজর যেয়ে ঠেকছে মাহানুরের অর্ধ উম্মুক্ত পিঠ আর কোমরের দিকে। শাড়ী পরানোর সময় ভালোভাবে সেফটিপিন দেওয়া হয়নি তাইতো এদিক সেদিক থেকে খুলে খুলে যাচ্ছে। মাহানুর কপালে ফুলের টিকা পরতে পরতে আয়নায় আরহামের দিকে তাকায়। আরহামের অস্বাভাবিক চাহনি দেখে মাহানুর দ্রুত আঁচল দিয়ে পিঠ ঢেকে ফেললো। আরহাম সাদা পাঞ্জাবী পরেছে আজ। বলিষ্ঠ দেহে আটসাট হয়ে লেগে আছে। হাতা ঠিক করতে এগিয়ে আসলো আরহাম। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-আমি কিছু বলতে এসেছিলাম।
-তো বলুন? আমি কী আপনার মুখে কোস্টিপ লাগিয়ে রেখেছি?
-চুপ। তুমি যদি ভেবে থাকো আমি তোমার থেকে প্রতিশোধ নিতে এমনটা করেছি তাহলে তুমি ভুল। এতো ছোট একটা বিষয়ের প্রতিশোধ আমি এভাবে নেবো না।
-অনেক মানলাম আপনি ইচ্ছে করে করেননি। তারপর?
আয়নায় পিঠ ঠেকিয়ে আরহামের দিকে ঘুরে বলল মাহানুর। বুকে দুইহাত গুঁজে রাখলো।আরহামও একই ভঙ্গিতে বলল,
-এখন তুমি কী চাচ্ছ? আর আমাকে ডিভোর্সের কথা বলে লাভ নেই কারণ আমি ডিভোর্স দেবো না।
-আমার সময় লাগবে।
-তোহ? আমি কী তোমাকে এখনই আমার সাথে শু’ইতে বলছি?
মাহানুর হকচকিয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিললো। আরহাম গাঢ় চোখে মাহানুরকে দেখছে। আরহাম আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তাঁদের মধ্যকার দ্রুত কিছুটা ঘুচিয়ে ফেললো। মাহানুর কেঁপে উঠলো আরহামকে হটাৎ এতো কাছে আসতে দেখে। আরহাম ধীর কণ্ঠে বলল,
-আমি কাল বাদে পরশু চলে যাবো চট্টগ্রাম। তারপর এক মাসের মধ্যে আমার কাশ্মীর বা ভারত যাওয়া হতে পারে। ওয়াইফকে পার্সোনালি সময় দেওয়ার মতো তেমন কোনো সময়ই আমার হাতে নেই। অন্য হাসব্যান্ডদের মতো তোমাকে আমি জায়গায় জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেতে পারবো না। এইরকম অনেক কারণে আমি কখনই বিয়ে নামক কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাইনি। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এখন তুমি আমার হয়ে গিয়েছো। তোমার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন একজন হাসব্যান্ড হিসেবে আমার। তাই তোমাকে আগেই আমি সবটা বলে রাখলাম।
মাহানুর মুখ ছোট করে ফেলে। পর পর দুইবার ভেংচিও কাটলো। আশেপাশে তাকিয়ে গলা ঝেরে বলল,
-আমি জানি এইসব কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তাছাড়াও আপনাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করিনি। আমার মনে হয় না আপনাকে আমার কখন প্রয়োজন পরবে! আপনি আপনার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন আর আমি আমার।
-কিন্তু আমার প্রয়োজন পরবে। আর যখন অতিরিক্ত প্রয়োজন পরবে সেদিনই তোমার ঢাকায় শেষ দিন হবে। আমার সাথে চট্টগ্রাম নিয়ে যাবো।
-পরেরটা পরে দেখা যাবে।
থমথমে কণ্ঠে বলল মাহানুর। আরহাম স্মিত হাসলো মাহানুরের অগোছালো নজর দেখে। ফুঁ দিয়ে মাহানুরের সামনে চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে বলল,
-তোমার বাবা আমাকে শর্ত দিয়েছে। তার মেয়েকে আমি কোনো বিষয় নিয়ে জোর করতে পারবো না। সে যে পর্যন্ত না আমাকে নিজ থেকে মেনে নেয় ঐ পর্যন্ত আমার তার ওপর কোনো অধিকার নেই। আমিও রাজি হয়ে গিয়েছি। কারণ আমার ভোলাভালা শশুরমশাই তো জানে না অধিকার দিতে নয় বানিয়ে নিতে হয়।
মাহানুর অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
-বাবা বলছে এটা?
-হ্যাঁ।
-দ্যাটস মাই ফাদার। আর আপনার কী এখন আমার কোলে উঠতে ইচ্ছে করতেছে? এতো কাছে আসছেন কেনো অসভ্যের মতো?
কটমট করে বলল মাহানুর। আরহাম বাঁকা হাসলো। মাহানুরের কাঁধের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। মাহানুর বুঝলো না এই চাহনির মানে। আরহাম নিচে ঠোঁট কামড়ে তাচ্ছিল্যা হাসলো। আঙুল দিয়ে কাঁধের দিকে ইশারা করে মাহানুরকে বলল,
-যে জামা পরলে ভিতরে থাকার জিনিসও সকলের নজরে পরবে ঐ ধরণের জামা পরা তোমার জন্য আজ থেকে নিষিদ্ধ।
মাহানুর ঘাড় বাকিয়ে কাঁধে তাকাতেই তার মাথা কা’টা পরে। সরমে সে শেষ। সে সবসময় শালীন ড্রেস পরে। এই ব্লাউজ অহনা এনেছিলো তাই গলা একটু বেশি বড়। এভাবে অপমানিত হয়ে মাহানুরের নিজেকে কে’টে টুকরো টুকরো করতে মন চাইলো। আরহাম পুনরায় বলল,
-এই ব্লাউজ চেঞ্জ করো। তোমার শরীর হলো তোমার হাসব্যান্ডের আমানত। অন্যের আমানত এভাবে লোকদের দেখানো গুনাহের কাজ।
মাহানুর শক্ত মুখে কিছু বলতে উদ্যত হতেই আরহাম মাহানুরের গালে হাত দিয়ে স্মিত হেসে রুক্ষ স্বরে বলল,
-আমি তোমার বাবা চাচা নই যে তোমাকে শুধু মাথায় তুলেই রাখবো! বউ দোষ করলে শাসনও করবো আবার ভালোবেসে বুকে জড়িয়েও রাখবো ঐরকম স্বামী আমি। বুঝতে পারছো?
-আমার ওপর অধিকার ঘাটানোর রাইট নেই আপনার আরহাম চৌধুরী। হতেই পারে আপনি অনেক বড় কেউ তবে আমার কাছে আপনি আমার পায়ের ধুলার সমতুল্য।
আরহামের আজ রাগ উঠলো না। শব্দ করে হাসলো মাহানুরের কথায়। নিলিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
-এটাকে অধিকার বলে না নিজের আমানত রক্ষা বলে। ওকে যাও আমি মুখে আর কিছু বলবো না।
আরহাম কিছুটা দূরে সরে যায়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-এখন আমি নিচে যাচ্ছি। যদি তোমাকে এই ব্লাউজ পরেই নিচে দেখি তবে রুমে নিয়ে এসে নিজ হাতে চেঞ্জ করে দেবো। আমার কিন্তু এতে লাভই হবে! তোমার বিষয় জানি না।

>>>>চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here