সূচনা_পর্ব #অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা

0
1109

ভার্সিটিতে ছাত্র পরিষদের কী এক প্রোগ্রাম ছিল। তা ফেলে বাড়ি ফিরল অন্তূ। আম্মার কল এসেছে বেশ কয়েকবার। তার ভাষায় খুব জরুরী কাজ। অন্তূ জানে, কোনো জরুরী কাজ-টাজ কিচ্ছু না। তবু এই সরলা মায়ের অ-জরুরী কাজও এড়ানো যায়না।

আগস্টের মাঝমাঝি। গরম না থাকলেও দুপুরের ঝাঁজালো রোদে বাড়ি ফিরে যে জরুরী কাজটা দেখল অন্তূ, তাতে তার মাথাও দুপুরের রোদের মতোই উষ্ণ হয়ে উঠল। তাকে দেখতে আসা হয়েছে। মেহমানদের তাকে দেখার ধরণ সেই জাহিলি যুগের মেয়ে বিক্রির মতো করে। ঠিক যেন অন্তূ কোনো পণ্যসামগ্রী।

-“আপনারা মেয়ে দেখতে এসেছেন নাকি হাঁটে গরু কিনতে এসেছেন?ʼʼ অকপটে কথাটা বলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয় অন্তূ।

সামনের সোফাতে পাত্রের বাড়ির লোক বসে আছে। অন্তূর কথায় হতবাক, সাথে বিস্ময় এবং অপমানে একাকার হলেন পাত্রর মা, বোন ও ফুপু! পাত্রর মা হতভম্বতা কাটালেন আগে, অসন্তুষ্ট মুখে বলে উঠলেন, “ওমা! এ আবার কেমন কথা? মেয়ে দেখতে এসে মেয়ের পা দেখতে চাওয়া কি অপরাধ নাকি?ʼʼ

-“জি না! ঠিক অপরাধ নয়, মূর্খতা। কারণ আমি কোরবাণীর হাঁটে তোলা কোনো প্রজাতির গবাদী পশু নই, যে সবচেয়ে নিখুঁত, আকর্ষণীয় গায়ের রঙওয়ালা, মাংস বেশী, হৃষ্টপুষ্ট দেখে কিনে নিয়ে যাবেন।ʼʼ

স্পষ্ট, ঝরঝরে শুদ্ধ ভাষা অন্তূর মুখে। পাত্রর ফুপু মুখ কেমন করলেন, “কোনদেশি কথা যে, মেয়েকে ভালোভাবে দেখা যাবে না? নাকি কোনো দোষ আছে? তাছাড়া কোনো মেয়ে আছে, যে পাত্রপক্ষের মুখের ওপর এরকম বদমায়েশের মতো কথা বলে? আশ্চর্য মেয়ে তো দেখছি! দেখতে আসছি, তো দেখব না?ʼʼ

-“হুম, নিশ্চয়ই দেখবেন। দোষ থাকা চলবে না, দরকার পড়লে মেয়ের দেহের প্রতিটা কোষ পর্যবেক্ষণ করা মেশিন এনে দেখবেন। কারণ, আপনারা মেয়ে কিনতে এসেছেন, খুঁত থাকবে কেন তাতে? পরনের সালোয়ার ঠ্যাঙে তুলে তারপর মেয়ের ঠ্যাঙ দেখবেন ফর্সা কি-না? রাইট! অথচ এটাকে আপনারা মেয়ে দেখা বললেও, আমি ছোটোলোকি বলছি। মেয়ে দেখতে এসে গাল ফেড়ে মেয়ের দাঁত দেখতে হবে, দাঁত উঁচু-নিচু আছে কিনা! মাথার চুল টেনেটুনে দেখতে হবে, চুল আসল না নকল, আছে না নেই, বড়ো না ছোটো? গলা বের করে, ঘাঁড়ের ওড়না খুলে, হাঁটিয়ে, নাচিয়ে এরপর পছন্দ হলে নিয়ে যাবেন! এটাই মেয়ে দেখা? অথচ বলুন তো, আমি যা যা বললাম, তা শুনতে এমন লাগল না, যে কোনো গৃহপালিত পশুর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। খরিদ্দার এসেছে গোয়াল থেকে পশু খুলে নিয়ে যেতে!ʼʼ

অপমান, অসন্তুষ্টি এবং বিরক্তি লেগে আছে মুখে তিনজনের। ছেলের ফুপু মুখ খুললেন “তো কীভাবে মেয়ে দেখে? তুমিই শেখাও কীভাবে মেয়ে দেখে?ʼʼ কথাটা বলে মুখ ঝামটি মারলেন মহিলা।

রাবেয়া পাশে দাঁড়িয়ে অন্তূর দিকে চোখ গরম করে তাকাচ্ছেন। ঘরে পাড়ার মহিলাও আছেন কয়েকজন, পাশেই ঘটক মহিলাটি বসে আছেন। তিনি বললেন, “এ কেমনে কতা কও, মেয়ে! দেখতে আইলে একটু ভালো কইরেই দেখে মেয়ে। না দেখে শুনে আবার নিয়ে যায় নাকি? বাড়ির বউ হইবা বলে কথা!ʼʼ

অন্তূর কাছে এ কথার জবাব আছে—দেখেশুনে নিয়ে যাওয়াটা দোষের নয়। তবে দেখার মধ্যে মার্জিত এবং শালীনতার ব্যাপার তো আছে? মহিলাগুলো রীতিমতো তাকে অসম্মানমূলক ভাবে মেয়ে দেখার নামে এক প্রকার অপমান করছেন। একটা মেয়ের পাত্রপক্ষের সম্মুখে মেয়ের আত্মমর্যাদা-মূল্য শব্দের অস্তিত্ব নেই। শুধুই একটি জড় সামগ্রী, যাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, বাজিয়ে, দরদাম করে, পছন্দ হলে দয়া করে কিনে নিয়ে যাওয়া হবে। অথচ শরীরে সামান্য কিছুটা র ক্ত অবশিষ্ট থাকতে এতটা আত্মসম্মান ও স্ব-মর্যাদাহীন হবার নয় অন্তূর! পারবে না সে।

এই কথাগুলো চেপে গিয়ে ঘটক মহিলাটির কথার জবাবে চমৎকার হাসল, “বাড়ির বউ হব? কে বলেছে, আমি বলেছি? আপনারা শুনেছন, অথবা আর কেউ বলেছে? অথবা আমার ভাগ্য? আমি এখনও অন্যের মেয়ে। আর অন্যের মেয়েকে বাজারের পণ্যের মতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখা, দরদামের কথায় আসা যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে মেয়ে দেখা হয়, তাহলে বিয়ে বোধহয় আমার জন্য না। তার ওপর দরদামও আবার কীভাবে হবে জানেন, যেখান থেকে মেয়ে নিবে, সেখানে থেকেই আবার চাহিদামতো আচল ভরবে। এই ব্যবসাটা আবার ব্যবসার রীতিও মানে না। ব্যবসায় মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। এখানে যেখান থেকে মেয়ে নামক পণ্য নেবেন, সেখান থেকে আবার বেশ কড়া একটা দান মারা হয়। বেশ লাভজনক তবে সস্তা ব্যবসা। যাকে ভদ্র ভাষায় ‘যৌতুকʼ অভিহিত করা হয়। আপনি বুঝতে পারছেন আন্টি আমার কথা? ʼʼ

অন্তূ ধারলো-নমনীয়! অদ্ভুত সমীকরণ না! ধারালো আর নমনীয়; বিপরীত দুটো অবস্থার সংমিশ্রণ!

পাত্রর মা অন্তূর মায়ের দিকে তাকিয়ে এবার কড়া স্বরে, তাচ্ছিল্যে করে মুখ বিকৃত করলেন, “আপা! সে আপনি মেয়েকে যতই শিক্ষিত করেন, আদর্শ শিখাইতে পারেন নাই। এরকম মেয়ে কার ঘরে যাবে, আল্লাহ মাবুদ জানে। আপনার কপালে কী আছে এই মেয়ে নিয়ে, আল্লাহ-ই জানে! অন্তত কোনো ভদ্র পরিবারে তো যাবে না।ʼʼ

অন্তূ কেমন করে যেন হেসে উঠল, “আপনি ভদ্রতা এবং আদর্শের কথা বলবেন না, শব্দ দুটো কষ্ট পাবে খুব। পরের মেয়েকে দেখতে এসে পান চিবোতে চিবোতে তাকে ম্যানিকুইনের মতোন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, দেখাটা কোথাকার আদর্শ! যেন আমি সুপার মার্কেটের দোকানে পোশাক পরিয়ে সাজিয়ে রাখা সেই পুতুলটা, আপনি এসেছেন পোশাকের সেই পুতুল মডেলটিকে দেখতে। পছন্দ হলে কিনবেন, অথবা অন্য দোকানে দেখবেন।ʼʼ

থামল অন্তূ। মাথা তুলে তাকিয়ে বেশ নরম এবং বিনয় “আত্নসম্মানহীনতা যদি আদর্শ হয়, আমি বরাবর অভদ্র এবং জঘন্য আদর্শে পালিত এক মেয়ে। অন্তত আমার বাপ আমাকে পড়ালেখা করিয়ে, খাইয়ে-পরিয়ে, আমার সমস্ত শখ, আহ্লাদ-চাহিদা সাধ্যমতো পূরণ করে, আদর করে আমাকে গরু বানায়নি, যে কারও সামনে বিক্রিযোগ্য পণ্যের ন্যায় দাঁড় হব। অন্তত এটুকু মর্যাদাবোধ তো রাখি নিজের মাঝে যে, অন্তত আপনার মতো ভদ্রদের ঘরে আমার কদম পড়বে না।ʼʼ

অন্তূ আর বসল না। সকলের বিভিন্নরকম দৃষ্টিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল নিজের রুমের দিকে। তার নামে এমনিতেও সমাজে রটা কথা কম নেই। প্রতিনিয়তই লোকে তাকে আলোচনায় রেখেছে–অন্তূকে তার মা-বাপ মিনসের মতো মানুষ করছে। নষ্টা মেয়ে, ভ্রষ্টা মেয়ে, বেয়াদব, অসভ্য, আদর্শহীন… পাড়ার লোকের দেয়া টাইটেলের অভাবের পড়েনা অন্তূর ভাগে।

কিছুক্ষণ পর সকলকে বিদায় করে রুমে এলেন রাবেয়া বেগম। তিনি কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই অন্তূ বলল, “এরকম লোকদের সামনে বসানোর জন্য তুমি আমায় টিউশনি কামাই করিয়ে বাড়ি ডেকে আনলে? তোমার আক্কেলকে আর কতটা সাধুবাদ জানাব আমি, আম্মা! এসব লোক আমাদের বাড়িতে ঢোকে কেমন করে?ʼʼ

রাবেয়া বেগম অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, “একটা থাপ্পড় মারব, বেয়াদব মেয়ে! দিনদিন বেলেহাজ হয়ে যাইতেছ তুমি? বেশি লাই দিয়ে ফেলতেছি নাকি আমি? আর কয়টা পাত্রর সামনে আমার মান-ইজ্জত নষ্ট করবি তুই? মা হিসেবে তোকে পার করতে চাওয়ার কোনো হক নাই আমার? পাড়ার লোকে একের পর কথা কথা বলতে ছাড়তেছে না প্রতিদিন। সে-সবই তো শুনতেছি। তুই পরিস্থিতি বুঝবি কোনোদিন? বেকায়দা মেয়েলোক জন্মেছে আমার পেটে!ʼʼ

-“আম্মা, তোমার তো সবসময় আমার উপর অভিযোগ থাকে। ধরে নিয়ে আসো এসব মূর্খ, ছোটো মানসিকতার লোকদের! তোমার কী ধারণা, যার তার গলায় ঝুলে পড়ব আমি? হোয়াট ননসেন্স… বিবেক নষ্ট হয়ে মানুষগুলো বোধহয় তোমার মতোই হয়!ʼʼ

-“তোর বিবেক কাজে লাগা। তা লাগালেই তো মিটে যেত সব। এই দিয়ে কতগুলার সাথে এমন হইলো? পাড়ার লোকে খুব ভালো কয় এতে, তাই না? ভার্সিটিতে পড়াচ্ছি তা নিয়ে কত কথা শুনলাম, এখন বিয়ে করাচ্ছি না তা নিয়ে লোকে কানাঘুষা শুরু করছে, এই যে এসব আচরণ করিস, লোকের কানে যায় না?ʼʼ

শাড়ির সেফটিপিনগুলো খুলে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রেখে বলল, “খুব যুক্তির কথা বলেছ। বুকের আঁচল নামিয়ে তাদের পেট-ও পিঠের রঙের সাথে মুখের রঙ মিলিয়ে দেখাতে হবে। এরপর সেখানে বিয়ে করে চলে গিয়ে পাড়ার লোকের মুখ বন্ধ করতে হবে, রাইট! ইয়াহ! এক্সাক্টলি! আচ্ছা! বিয়েটা কার, আমার না পাড়ার লোকের? আমায় বোঝাও, পাড়ার লোকের কেন ফাটছে? বিক্রি করে দাও, এমনিতেইও তো ভার্সিটিতে পড়ি অর্থাৎ, বিক্রিই তো হয়ে গেছি!ʼʼ

শেষের দিকে কঠিন হলো অন্তূর কণ্ঠস্বর, চেঁচিয়ে উঠল সে। রাবেয়া বেগম বললেন, “তুই এতো অবুঝ ক্যান, অন্তূ? মেয়ে মানুষের এতো মুখরা হতে নেই। সমাজে কথা হয়। এখন বিয়ে যদি নাও যদি করিস, পরে করবি তো! তখন যখন লোকে তোর ব্যাপারে শুনতে আসবে আশেপাশে, কী বলবে লোকে? মেয়ে মানুষের ঠান্ডা মেজাজের, নরম হতে হয়। এতো কথা, এতো যুক্তি, এতো প্রতিবাদ! এইসব কি পড়ালেখা থেকে আসতেছে? আমি কি এতদূর তোরে পড়ায়ে ভুল করছি?ʼʼ

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “আম্মা, বের হও। আমি চেঞ্জ করব।ʼʼ


সারারাত পড়ার পর সকালের দিকে ঘুমিয়েছে। আজ ক্লাসটেস্ট পরীক্ষা আছে। মাসখানেকের ছুটির পর আজ থেকে ক্লাস শুরু ভার্সিটিতে। আজকাল ঘনঘন ছুটি চলে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। ফজরের নামাজও কামাই হয়ে গেছে অন্তূর। উঠে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিলো, “কিছু খাওয়ার আছে নাকি, আম্মু?ʼʼ

তরকারী চুলায় বসাতে বসাতে বললেন রাবেয়া, “কী থাকবে? আব্বুর কাছে যা, দেখ বারান্দায় মুড়ি-চানাচুর দিছি।ʼʼ

-“কী রান্না করছ?ʼʼ

-“শুটকি মাছের ঝোল আর নিরামিষ।ʼʼ

নাক ছিটকায় অন্তূ, “ওয়াক থু! গন্ধ! আমার জন্য অন্যকিছু বানাও।ʼʼ

রাবেয়া বেগম রেগে তাকালেন, “গেলি এখান থেকে? সর, যা! আহ্লাদ!ʼʼ

চোখ উল্টায় অন্তূ, “যেন এই গন্ধের মধ্যে ঘুম দিতে এসেছি, ছিহ! কী ভয়ংকর গন্ধ আসছে। আজ বাড়িটা গোলাপ-জল ছিটিয়ে পাক-পবিত্র করতে হবে।ʼʼ

রাবেয়া বেগম চোখ পাকালেন, “আহা! যেন আমার মুখে শুটকির নাম থেকে গন্ধ আসতেছে, নাকি ঘরের দেয়াল থেকে? ঢং না করে সর এখান থেকে। শুটকি মাছ সেই ছাদে শুকাতে দেয়া এখনও! আনিই নি।ʼʼ

একটু থতমত খেল অন্তূ, মুখ গম্ভীর করে বলল, “শুটকি যেখানেই থাক, আমার নাককে আকর্ষণ করে খুব বাজেভাবে। ওয়েট, সারারাত কুয়াশায় ভিজিয়েছ?ʼʼ

বিরক্ত হলেন রাবেয়া, “না সকালে রোদে দিয়েছি।ʼʼ

-“গুড! বুদ্ধি হচ্ছে দিনদিন তোমার, বড়ো হচ্ছ তো! আম্মা! ভাবী কবে আসবে?ʼʼ

রাবেয়া বেগম কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, “জানি না।ʼʼ

আব্বুর পাশে এসে বসল, “আমাকে আজ নামিয়ে দিয়ে যাবে একটু ভার্সিটিতে?ʼʼ

আমজাদ সাহেব টান করে ধরে খবরের কাগজের পৃষ্ঠা উল্টালেন, “তোর ভার্সিটি তো সেই দশটায়, আমি সাড়ে আটটার ট্রেন ধরব, এখনই বের হব।ʼʼ

অন্তূ ঠোঁটে ঠোঁট গুজল। আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “ভার্সিটি থেকে নাকি হলে থাকার কথা বলেছে?ʼʼ

-“আম্মা কি আর রাজী হবে তাতে?ʼʼ

-“সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল কবে?ʼʼ

-“ক্লাস টেস্ট চলছে, খুব তাড়াতাড়ি ডেইট পড়বে মনে হয়।ʼʼ

খবরের কাগজটা অন্তূর হাতে দিয়ে উঠে পড়লেন আমজাদ সাহেব। অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “কবে ফিরবে তুমি?ʼʼ

উদাসীন কণ্ঠে বললেন আমজাদ সাহেব, “দু’দিন দেরি হবে হয়ত।ʼʼ


ভার্সিটির সামনে এসে রিক্সা ক’দিন আগেই তুমুল আন্দোলন হয়ে গেছে ছাত্রলীগে। হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী অন্তূ। দিনাজপুরের বাঁশেরহাট থেকে খুব বেশি দূরে নয় ওদের বাসা।

ভেতরে ঢুকে শহীদ মিনার চত্বরে পৌঁছানোর আগেই পেছন থেকে ডাক পড়ল তার। একজনের হাবভাব খুব উল্লেখযোগ্য। অন্তূর মনে হলো, সে চেনে লোকটাকে! মনে হলো, আগে দেখা মুখ, তবু মনে নেই বিশেষ কিছু।

ছেলেটা এগিয়ে এসে হাতের সিগারেটটা অন্তূর দিকে বাড়িয়ে বলল, “নাও, একটা টান দাও!ʼʼ

অন্তূ নিঃসংকোচ হাতে নিলো সিগারেটটা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, “টান না-হয় দেব একটা, কিন্তু এতে ফযিলতটা কী?ʼʼ

-“ফযিলত? এই যে আমি তোমায় টান দিতে বলতেছি, এর চাইতে বড়ো ফযিলত বা হাকিকত কিছু নাই। আর জরুরী তো মোটেই না যে সবকিছুতে ফযিলত থাকা লাগবে!ʼʼ

-“কিন্তু আপনি টান দিতে বললেই দিতে হবে, তা কেন? এটা আশিভাগ মুসলিমের দেশ, বাংলাদেশ। আমি পশ্চিমা সংস্কৃতির মেয়ে না। সিগারেট খাইনা আমি, তবু টান দিতে হবে কেন?ʼʼ

পেছন থেকে ক্যাটক্যাট করে বলল, “কারণ আমরা সিনিয়র। এরপর আর কোনো ফযিলতের খোঁজ করলে তুমি নিখোঁজ হয়ে যাবে।ʼʼ

পেছনের সকলে হেসে উঠল। অন্তূ মাথা নাড়ল, “উমমম! সাংঘাতিক ব্যাপার দেখছি! তবে সিনিয়র কাকে বলে, তা জানেন না, তাই না?ʼʼ

সিগারেটওয়ালা ভ্রু নাচিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল, পরের জন থেমে পিছিয়ে যায়। এবার সিগারেটওয়ালামুখের উপর ঝুঁকে পড়ল, “তুমি জানাবে তা?ʼʼ

অন্তূ ঘৃণায় মুখটা পিছিয়ে নেয়, নিজ গরিমায় বলে ওঠে মাড়ি শক্ত করে, “জানাতেই পারি। শিক্ষার বয়স হয় না।কোরআনেও বলা আছে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো।ʼʼ

পেছনের ছেলেটা মুখ কেমন করে যেন তাকাল, “হুঁশিয়ারী করছ? সিনিয়রদের সামনে মুখ চালাচ্ছ? মারা পড়বে, মেয়ে! কবে ভর্তি হয়েছ, বড়ো-ছোটো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারোনি মনে হচ্ছে?ʼʼ হাসতে হাসতে সাবধান করল যেন সে অন্তূকে।

অন্তূ হাসল, তা তার হিজাবের আড়ালে ঢাকা পড়ে রইল বোধহয়, হাসি চেপে বলল, “কুকুর ছোটো হোক অথবা বড়ো, তাকে কুকুর বলার সৎসাহসটুকু থাকা অবশ্যই ভালো গুণ! কী বলেন সিনিয়র মশাই!ʼʼ কথাটা অন্তূ, ঘাঁড় বাঁকা করে তাকিয়ে থাকা সেই সিগারেটওয়ালা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল। ছেলেটার ভ্রু কিঞ্চিৎ জড়াল, যা খুব সূক্ষ্ণ।

অন্তূ আবার বলল, “একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তাকে ডেকে সিগারেট টানতে বলা, পানির বোতল ভরানো, জুতো পরিস্কার করানো, আজেবাজে কথা চিরকুটে লিখে তা অন্যকে দেওয়ানো, হ্যারাস করা–এসব আপনাদের কাছে সিনিয়রের সংজ্ঞা? অথচ আমি যে বই থেকে সিনিয়রের সংজ্ঞা পড়েছিলাম, সেখানে লেখা ছিল–সিনিয়র হলো শিক্ষক, যে জুনিয়রকে আদব শেখাবে, শিষ্টাচার বোঝাবে, একটা ভুল করলে ধমক দিয়ে ভুলটা শুধরে দেবে, কোনো প্রয়োজনে সাহায্য করবে ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই লেখা ছিল। সেই বইটা কিনে নেবেন পারলে, হতে পারে নতুন করে মানুষের চামড়া গজাবে আপনাদের গায়ে।ʼʼ

সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চেপে পিষে আর তাকাল না ছেলেদের দলের দিকে, ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেগুলো এগিয়ে যেতে অগ্রসর হয় অন্তূর দিকে ক্ষিপ্র বেগে। জয় তাকিয়ে দেখল, তার সেই সিগারেট, মেয়েটা মাটিতে ফেলে পা মাড়িয়ে গেছে।

ছেলেদের থামালো জয়, “উহু! বয়েজ, কুল কুল! পাখিটা একদম আলাদা! সবার থেকে আলাদা। তার সঙ্গে খেলাটাও হবে একদওওম আলাদা! আমাকে চেনেনি মনেহয়।ʼʼ বেশ ভাবুক কণ্ঠে বলল কথাগুলো জয়।

আস্তে করে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল, “কুকুর বলেই খালাস হয়ে গেলে, মেয়ে! পেটে যে কুকুরের ভীষণ ক্ষুধা, সেটা খেয়াল করলে না! নট ফেয়ার, নোপ! দিস ইজ নট ফেয়ার!ʼʼ

হুট করে আবার আসমান থেকে চোখ নামিয়ে ঘাঁড় নাড়ল দুদিকে, “চ্যাহ! উহহ কী তেজ! আমি ডিস্টার্বড রে!ʼʼ ঝুঁকে পড়ে পিষে যাওয়া সিগারেটটা তুলল। সেটা কবীরকে দেখিয়ে বলল, “রেখে দে এটা যত্ন করে। পাখি শিকার করার পর একবার করে এটা দেখব, আর… তাই বলে আমার সাথে এভাবে? এ ও আমাকে চেনে?ʼʼ

সামনের দাঁতক পাটি ঘষল মৃদু। ঘাঁড়ে হাত বুলিয়ে আড়চোখে সামনে তাকিয়ে দেখল। ঘাঁড়ে হাত রেখে আবার আকাশের পানে তাকাল, “সামনে ইলেকশন, রে! জয় নিজেকে বাঁচিয়ে চলছে, তাতে দেখছি অনেকেই রঙ্গ-তামাশা দেখিয়ে চলে যাচ্ছে! এটা কি ঠিক হচ্ছে, বল তো! ইলেকশন তো শেষ হবে তাই না? এরপর কী হবে, তা ভাবছে না কেন এরা?ʼʼ

হিংস্র হয়ে উঠল জয়ের মুখ। উন্মাদের মতো হাসল। ভার্সিটি চত্বরে লোকজন কম এখন। ক্লাসের ফুল টাইম চলছে। লোক থাকলেও জয়ের যায়-আসার কথা নয়। সে আবার তাকাল অন্তূর চলে যাবার পানে। অন্তূ ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিল্ডিংয়ে।

চলবে…

#সূচনা_পর্ব
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

[কাহিনিটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তবে স্থান কিছু কিছুক্ষেত্রে অ-কাল্পনিক থাকবে। কিন্তু তার সঙ্গে শতভাগ বর্ণনার ধারা মিলবে না, এবং সেটা কাহিনি গঠনের স্বার্থেই। এখানে যে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা শুধুই বর্ণনার প্রয়োজনে। কোনো ভার্সিটি এবং বাস্তবতাকে অবমাননা বা ইন্ডিকেট করে নয়। সবশেষে এটি একটি রাজনৈতিক থ্রিলার। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here