—পর্বটিতে বেশ কিছু অশালীন ভাষা থাকবে। সুতরাং আপনারা সেই মানসিকতা নিয়েই পড়বেন।
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
১৯.
সন্ধ্যার আকাশে কুয়াশার আবরণ পরিবেশকে আরও গুমোট কোরে তুলেছিল। অন্তূ দাঁড়িয়ে রয় ওভাবেই শক্ত হয়ে। পলাশের যেন ধৈর্য্যের বিচ্যুতি ঘটল। আবার এগিয়ে এলো অন্তূর দিকে, “খুলবা নাকি টেনে খুলে ফেলব? আমি একটা কথা বলতেছি, ওইডার পিছনে সাহস দেখায়ে আবার চুপ কইরা আছো? ঠিক না।ʼʼ
হাত বাড়ায় পলাশ। অন্তূ দু কদম পিছিয়ে যায় আবার। পলাশ হাসে, তার হাসিতে হাতের লোমগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় অন্তূর। অন্তূ কেন যেন জয়ের দিকে তাকাল একবার। কেন তাকাল, জানা নেই। তবে খেয়াল কোরে দেখলে তার চোখে অল্প আশা দেখতে পাওয়া যেত যেন, যা সে জয়ের কাছে করেছে। কোনো যুক্তি নেই সেই আশার, তবুও অন্তূর বোধহয় সেই ভয়টা লাগেনা জয়কে, যেটা পলাশের জন্য তৈরি হয়েছে এই কিছুক্ষণে। জয়কে সে চেনে, এতদিনে বহুভাবে অপমান করার পরেও জয় তার সাথে নোংরা আচরণ করেনি তেমন। তার এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, জয় বোধহয় ঠেকাবে।
জয় আরাম কোরে বসে বিয়ারের ক্যানে চুমুক দেয়। তার সামনে কিছু ঘটছে, তেমন খেয়াল পরিলক্ষিত হচ্ছিল না তার মাঝে। অন্তূ চোখ বুজে হাসল। ধীরে ধীরে তার হাসি চওড়া হলো। নিজের এমন বোকা আশার কথা ভেবে তাচ্ছিল্য এলো নিজের ওপর। জয় নাকি ওকে বাঁচাবে! আবারও অন্তূর কাছে প্রমাণ হয়ে যায়–জয় এসবের পেছেন প্রকটভাবে জড়িয়ে। আবার হাসল অন্তূ। জয়ের চোখে-মুখে সে স্পষ্ট লালসা দেখতে পাচ্ছে। তাকে একনজর নগ্ন অবস্থায় দেখার লালসা।
পলাশ এগিয়ে এসে আবারও একদম কাছে দাঁড়ায়। জয় এবার নিষ্পলক তাকিয়ে রয় অন্তূর দিকে। তার কোথাও একটা জিদ উঠছে, আর কেউ অন্তূর চেহারা দেখবে, যেটা তার নিজের পছন্দ, এটার জন্য রাগ হলো। অথচ বাঁধা দিলো না এক নোংরা লোভে—এমনিতে মেয়েটার চোখদুটো ছাড়া চেহারা দেখার উপায় নেই, এখন নেকাবটা খুলে ফেললে অন্তূর চেহারা দেখতে পাবে সে। কিচ্ছু বলল না, লোলুপ, অভিভূত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল অন্তূর দিকে। অধীর অপেক্ষা তার অন্তূর চেহারা অনাবৃত হবার। চেহারা দেখার চাহিদাকে ছাপিয়ে কেন জানি পলাশকে ঠেকানোর ইচ্ছে বা প্রয়োজনীয়তা কিছুই অনুভব করল না সে।
মুহুর্ত খানেকের ব্যবধানে পলাশ ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো আঁছড়ে পড়ে অন্তূর ওপর। অন্তূর বাহুটা জড়িয়ে ধরার সময় অন্তূর বুকের ওপরের ওড়নার প্রান্তটুকু পলাশের হাতের থাবায়। অন্তূ হাত দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করলে পলাশ অন্তূর হাতটা খামচে ছুঁড়ে ফেলে পেছনের দিকে। সজোরে আঘাত হানে হাতটা গিয়ে পেছেনর খচখচে দেয়ালে। সাথে সাথে জ্বলে উঠল হাতটা। নিশ্চিত চামড়া ছিলে র-ক্ত বেরিয়ে এসেছে। অন্তূর চোখে পানি, দৃষ্টির আর্তনাদ এতগুলো পুরুষের মাঝে কাউকে অল্প টলালো না। পলাশ অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে বলে, “খোল শালি! ন্যাকামি মারাস?ʼʼ একটানে খুলে নয় বরং ছিঁড়ে ফেলে অন্তূর চেহারার আবরণটা। অন্তূর গলা থেকে একটা সরু আহাজারী বেরিয়ে আসে। যেই আহাজারিতে চোখ তুলে তাকায় জয়। আর নজর ফেরায় না।
পলাশ ঝটকা খেয়ে অল্প সরে দাঁড়াল অন্তূকে ভালোভাবে দেখার জন্য। মেয়টার কান্না থেমে গেছে, চোখের পাপড়ি ভেজা, অথচ পানি গড়াচ্ছে না। মুখটা লাল হয়ে আছে। চিকন ঠোঁটের কিনারা মাঝেমাঝে উত্তেজনায় কেঁপে উঠছে। তবে চোখদুটো নিস্তেজ চেয়ে ছিল জয়ের নেশাক্ত দৃষ্টির দিকে। জয়ের দৃষ্টিতে শুধুই কামনাপীড়িত লালসা বোধহয়। পলাশ হাসছে। তার হাসি কথা বলছে, বলছে—জীবনে প্রথম হয়ত বহুল আকাঙ্ক্ষার বস্তু সামনে দেখতে পেয়েছে চোখদুটো। সে অভিভূত, সে আসক্ত। নিঃশ্বাস জোরে জোরে পড়ছে পলাশের। আশপাশে কমপক্ষে দশ-পনেরোজন পুরুষ অন্তূকে গিলছিল। অন্তূ তাকিয়ে ছিল জয়ের দিকে। হুট কোরে নজর ফিরিয়ে বিয়ারে ক্যানটার পাশে রেখে ঘাঁড় ঘুরিয়ে হাঁ কোরে শ্বাস ফেলল। অন্তূ আবার হাসে। নিজের ওপর হাসে, নির্মম পরিণতি এবং পরিস্থিতির পেঁজাকলের সফলতার ওপর হাসল মেয়েটা। তাদ একটুও কান্না পাচ্ছেনা। আব্বু বলতো, ছাগল যদি জবাই-ই হয়ে গেল, সেটাকে কাবাব করা হোক, ঝোল রেঁধে খাওয়া হোক, অথবা কিমা করা হোক ছাগলের কি আর কিছু যায় আসে?
পলাশ হেসে উঠল এবার শব্দ কোরে, “আরিব্বাস! তোমার বাপের ঘরে যে এরম একখান আইটেম আছে, জানলে কি আর বেঁচারা…
অন্তূর চোখে আবারও সেই কাতরতা ফুঁটে ওঠে। পরিস্থিতিটা কেমন যেন! সে একটা মেয়ে, যাকে নিয়ে এই নির্জন ছাঁদে পনেরো জন পুরুষ বিনোদনে মেতেছে, তার বিনিময়ে সে তার আব্বুকে এক নজর দেখতে পাবে। জানা নেই কী অবস্থায় দেখতে পাবে। মন একদম ভালো কিছু আশা করছেনা, অন্তূ ধমকেছে কয়েকবার মনকে, মন ধমকের পরোয়াই করল না! সে অন্তূকে দূর্বল থেকে দূর্বল কোরে তুলছে। অথচ অন্তূর কান্না পেল না আর। নেকাবের একাংশ ছিঁড়ে পলাশের হাতে গেছিল, সেটা পলাশ ছুঁড়ে ফেলেছে। যে অংশটুকু অন্তূর গলায় পেঁচিয়ে ছিল, তা সে নিস্তেজ হাতে আস্তে কোরে খুলে ছাদের সমতলে ছেড়ে দিলো। এখন শরীরে বোরকা, বুকের ওপর এক টুকরো ওড়না আছে। সকলে দেখতে তাকে। বিষয়টা তেমন জটিল নয়। ওড়না ক’জন ব্যবহার করে? কিন্তু যে করে, কোরে এসেছে এতগুলো বছর, বাঁচিয়ে এসেছে নিজেকে সকল লালসানিহত দৃষ্টি থেকে নিজের নারী-সত্ত্বাকে। সেই অন্তূর জন্য কষ্টসাধ্য ছিল, খুব কষ্টকর।
অন্তূ প্রস্তুত হয় আমজাদ সাহেবকে যেকোনো হালে দেখার জন্য। অথচ কলিজার ভেতরটা এমন মুচড়ামুচড়ি শুরু করেছে, অন্তূ বাঁ হাতের তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল সজোরে চেপে ধরে বুকের মাঝখানটায়। আকাশের দিকে তাকায়, “ও আকাশের মালিক? কীসের অরাজকতা বিরাজ করছে আপনার সৃষ্টিজগতে? আপনার নির্লিপ্ততার শেষ কোথায়? এত কী করে সহ্য করেন? আপনি কেন আল-ক্বাহার (দমনকারী, শাস্তিদাতা) নাম ধারণ করছেন না, কেন আল হালিম (ধৈর্য্যেশীল) নাম ধারণ কোরে বসে আছেন এইসবের পরেও? পাপীরা কেন আপনার ক্রোধের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়না? সে যাকগে, আপনি বিচার করবেন নাহয় পযে। আপনি তো পারেন সব সহ্য করতে। আপাতত আমাকেও সেই শক্তি দিন, এটা আমার দাবী রইল আপনার কাছে। হয় রেহাই দেবেন, অথবা সবর দেবেন আমায়। আমার দাবী মানতে হবে আপনাকে। সবর দিন আমায়, আপনার মতো সবর।ʼʼ মেয়েটার চোখের কোণা বেয়ে টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পানি শেওলার আবরণ জেগে ওঠা ছাদের সমতলে পড়ল। আসমানের মালিক শুনলো কিনা তার ফরিয়াদ জানা নেই।
দুজন দুপাশে ধরে আমজাদ সাহেবকে নিয়ে ছাদের ঘরে প্রবেশ করল। সে জায়গাটি আলোকিত। তার পাশের অন্ধকারের ভেতর বসে আছে জয়। ঠিক যেন যাত্রাপালা দেখছে সে। অন্তূ অবশ পায়ে দু-কদম পিছিয়ে ছাদের কার্নিশের সাথে লেগে যায়। পুরো শরীরটা একযোগে ঝনঝন কোরে ঝাঁকি মেরে শিউরে উঠল। থরথর কোরে কাঁপে মেয়েটার শরীর। বাপের দেহ থেকে নজর সরিয়ে আকাশের দিকে তাকায় মেয়ে। ফুঁপানোর আওয়াজ আসে, কিন্তু চোখে পানি নেই। বাচ্চাদের মতো থুতনিটা ভেঙে এলো এবার। আর রক্ষে নেই। হাউমাউ কোরে কেঁদে উঠল অন্তূ ছাদের এক কর্ণারে টলমলে পায়ে দাঁড়িয়ে। আমজাদ সাহেব থরথরে কাঁপা হাতটা বাড়াতে চায়, চোখে-মুখে আতঙ্ক, ডেকে ওঠেন অস্পষ্টস্বরে, “অন্তূ!ʼʼ
অন্তূ চোখ বুজে ফেলে। আমজাদ সাহেবের মুখটা থেতলানো প্রায়। শার্টের অধিকাংশ ছেঁড়া। হাতে কাচাকাচা দাগ। টলছেন উনি, চোখ খুলে রাখতে পারছিলেন না। ড্রাগ দেয়া হয়েছে বোধহয়। মেহেদি রঙানো দাড়িওয়ালা থুতনিতে গভীর থেতলানো ক্ষত। কী দিয়ে মেরেছে এরা? অন্তূ এবার গাল ভেঙে গা কাঁপিয়ে কেঁদে উঠল আকাশের পানে মুখ তুলে। অথচ তার কান্নার শব্দ নেই। শুধু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, একটা অসহায় বাপ-পাগলী মেয়ে তার ক্ষত-বিক্ষত বাপকে দেখে পাগলের মতো কাঁদছে। ওই কান্নার ভাবোক্তিতে যেকোনো পাথরে প্রাণ সঞ্চার হলেও হতে পারে। এদিকে মানুষ পাথরকেও গুঁড়ো কোরে কাজে লাগায়, কেটে রাস্তা বানায়। মানুষ গলবে কেন? পলাশ একজন মানুষ, দু’হাত-দু’পা ওয়লা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। সে গলবে কেন? গললো না সে।
অন্তূ দৌঁড়ে যায় আব্বুর দিকে। পলাশ ঝেপে পড়ে থাবা দিয়ে ধরে ফেলে অন্তূকে। অন্তূর পুরো শরীরটা আন্দোলিত হয় একবার পলাশের দেহের দেহের ধাক্কায়, মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গেল যেন একদম আগুনের তাপে পলিথিন যেমন কুঁচকে ঝলসে যায়, ঠিক তেমন। আমজাদ সাহেব কিছু বুঝলেন কিনা কে জানে? যতদূর সম্ভব কড়া ড্রাগ উনার শরীরে। কেন দিয়েছে? বাপকে টর্চার করলে ছেলে আসবে? এই জন্য কেউ এভাবে কোনও মানুষকে শারিরীক আঘাত করতে পারে? একদমই না। মানসিকতার ওপর ভিত্তি করে একেক মানুষ প্রজাতির তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি একেক জায়গায়। তেমন মানুষ যদি পিশাচ প্রজাতির হয়ে ওঠে, সে নিশ্চয়ই অপর একজন মানুষের শরীরের ব্যথায় করে ওঠা চিৎকার এবং ত্বক বিদীর্ণ হয়ে বেরিয়ে আসা লাল তরল দেখে তৃপ্তি পাবে! এখানকার মানুষের মতো দেখতে প্রাণিগুলোকে মানুষ বলা এক ধরণের মূর্খতা।
আমজাদ সাহেবেল কোনোদিকে খেয়াল ছিল না। সে কেবল অবচেতন অথবা প্রায় অচেতন চোখে মেয়েকে দেখছিলেন। পলাশের হাতের বেষ্টনিতে গ-লা-কা-টা মুরগীর মতো ছটফট করছে অন্তূ। তার মাথা আলগা, বুকের ওড়না ঠিক নেই, মুখে পর্দা নেই।
সহ্য করতে না পেরে টলমলে মাথাটা নামিয়ে নিলেন। ভিখিরির মতো ভিক্ষা চেয়ে উঠলেন, “ও পলাশ! আব্বা আমার! আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও, আব্বা। ও বাচ্চা মানুষ। পাপ আমার ছেলে করেছে, আমি করেছি জন্ম দিয়ে। ও তো কিছু করে নাই আব্বা। তুমি কী করছো ওর সাথে? আমার মেয়ের পর্দা কই? ও ছোট মানুষ বাপ! ওরে ছাড়ো। তুমি আমাকে মারো, ও পলাশ! আমাকে মারো, দেখবে ঠিক অন্তিক আসবে। তুমি আমাকে আরও মারো, পলাশ। পলাশ শোনো, আমি আমার সব দিয়ে দেব। তুমি কত টাকা পাও, তার ডাবল ডাবল দেব। পলাশ..ʼʼ তার বলা কিছু শব্দ বোঝা গেল, কিছু আর্তনাদ অস্পষ্ট জমা হলো কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির হাওয়ায় বোধহয়।
অন্তূর চোখে আজ ঝরনা নেমেছে, প্রাকৃতিক ঝরনাই বোধহয়। পানির ধারা থামছেই না তো। জয় একদৃষ্টে চেয়ে ছিল আমজাদ সাহেবের দিকে। ওর ভেতরটা রাগে নাকি হিংসায় অথবা জিদে জ্বলে উঠল। ও-ও মার খেয়েছিল। ভিপি নির্বাচিত হবার মাসকয়েক আগে ওকে মেরেছিল ছাত্রলীগের যুবসম্প্রাদক। যার বোনের ভিডিও বানিয়ে জয় মেয়েটাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিল, সেই ভাইয়ের নির্দেশে জয়কে শুধু জানে না মেরে বহুত মারা হয়েছে। শরীরে বিভিন্ন স্থানে বাঁশসুই গাঁথা হয়েছিল, তার ওপর লবন না দিয়ে পার্টির ছেলেরা বিট-লবনের গুড়ো ছিটাতো। খুব চিৎকার করেছিল জয় বন্ধ ঘরে। কই কেউ তো বলেনি সেদিন, ‘বাপ! ছেলেটাকে ছেড়ে দাও? আর কষ্ট দিও না আমার জয়কে!ʼ ন্যাকামি যত্তসব! সে কি বেঁচে নেই? সেসব আঘাতের দাগও এখন প্রায় মিলে গেছে শরীর থেকে, এখন ওর রাজ চলে পুরো দিনাজপুরসহ এই বাঁশের হাটে। ওর পিঠ বাঁকিয়ে হিপবোনের ওপরে কোমড় সংলগ্ন কশেরুকাতে টান ফেলা হয়েছিল, তা চিকিৎসা করতে পিঠে স্টেইনলেস রড ঢুকিয়ে কতদিন হাসপাতালের বেডে মরার মতো ফেলে রাখা হয়েছিল ওকে। ওর তো বাপ-মা কেউ আসেনি! বেশি পরিমাণ ড্রাগ দেয়ার ফলে কান-নাক এমনকি চোখের পানির সাথে রক্ত উঠে আসতো। তার জন্য এভাবে কেউ কাঁদেনি। শুধু হামজা প্রতিবেলা ঢাকা মেডিকেল কলেজ যাতায়াত করতো। তরু তখন ছোট প্রায়, সে থাকতো জয়ের পাশে।
কথাগুলো ভেবে কেমন কাতরে উঠল সে। আবার তাকাল আমজাদ সাহেবের দিকে। এই অবস্থায় মেয়ের জন্য এত ছটফটানি বাপের? বাপেরা কি এমনই হয়? সব বাপ? তাইলে তার বাপ কেন তাকে ফেলে রেখে ওপারে চলে গেছে? ফেলে গেছে তাকে এই দুনিয়ায় নষ্টামি কোরে বেড়ানোর জন্য? ঢোক গিলল জয়। তার ভেতরে কষ্ট হচ্ছে, তা বুঝে অবাক হলো। অল্প অল্প হিংসা হচ্ছে, অন্তূর ওপর ঘেন্না আসছে। ওই মেয়ে বহুতবার অপমান করেছে ওকে ভার্সিটিতে। আজ অন্তূও অপমান হয়েছে, বাঁচাতে যায়নি ও।
পলাশের কানে আমজাদ সাহেবের আর্তনাদ গেছে, শুধু কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারেনি। পলাশ হাসল, “কাকা! ডাক্তার, কসাই আর আমরা যদি মানুষের অনুরোধে গলি, তাইলে এসব পেশা ছেড়ে ট্রাস্ট এনজিও খুলতে হবে। যেখানে মানুষ-গরু সব ধরণের প্রাণির জান বাঁচানো হবে, তাদের সব ইচ্ছা পূরণ করা হবে। ডাক্তার প্রতিদিন হাজার রোগীর মৃত্যুর ঘোষনা দেয় হাতের পার্লস চেইক করে, তাদের মাঝে সব রোগীর আত্মীয়রাই চেঁচায়ে কাঁদে, সেখানে কোনো একজনের কাঁদা বিশেষ লাগার চান্স আছে? কসাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই। সব গরুই ছটফটায়, উঠে পালাতে চায়, তাই বলে কি সে জবাই করে না? আমাদের কাহিনিও সেম। আপনার মাইয়াডারে ভাল্লাগছে। সুন্দরের কাছে সকলে কাবু, আমিও। মাইয়াডারে দেন, সব মাফ।ʼʼ
আমজাদ সাহেব চুপ রইলেন। উনার বোধশক্তি ড্রাগের প্রভাবে বিলুপ্ত প্রায়। চারপাশ অন্ধকার দেখছিলেন। শুধু একবার পলাশকে দেখেছেন, পরের বার মেয়েকে। এবার আর পারলেনই না, ঢলে পড়লেন মেঝের ওপর। ঢিপ করে আওয়াজ হলো, যখন তার মাথা ছাদের ওপর পড়ল। অন্তূ ছটফটিয়ে ওঠে আবার। পলাশ আরও শক্ত হাতে চেপে ধরে হাতটা। অন্তূর কাধে মাথা রাখে জোর কোরেই। কুকুর যেমন গন্ধ শোঁকে, ওভাবে নাক টেনে বিশ্রী আওয়াজ করে মুখ দিয়ে। অন্তূ মনেমনে বারবার আল্লাহকে ডেকে উঠছিল। তার হাতের যেখানটায় পলাশ চেনে ধরেছিল, সেখানকার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে, রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অন্তূর এরই মাঝে নিজের ওপর তাচ্ছিল্য হয়। সিনেমায় এমন দৃশ্য দেখে মানুষ, বাস্তবে তো আড়ালে ঘটে এসব, তাই মানুষ প্রাক্টিক্যালি দেখতে পায়না। আচ্ছা! আঁখির সাথে কী হয়েছিল? এরাই কি করেছিল সেসব? যারা এদের শিকার হয় তারা আর বেঁচে থাকেনা মানুষকে তাদের ওপর হওয়া অত্যাচারের বর্ণনা করার জন্য! তাই মানুষ কঠিন সত্যিগুলোকে আজ সিনেমার দৃশ্যের নাম দেয়। পলাশ হাত ছেড়ে একহাতে অন্তূর চুলগুলো মুঠো কোরে ধরে অপর হাতে অন্তূর কোমড়টা পেঁচিয়ে ধরতেই জয় বলে উঠল, “ছাড়েন, ভাই!ʼʼ
পলাশ মজা হিসেবে নিলো, শুনলো না। জয় মনোযোগ দিয়ে হাতের নখের কোণা কাঁমড়ে বলল, “ছাড়েন, ছাড়েন।ছেড়ে দেন ওকে।ʼʼ চোখ তুলে তাকাল এবার। অন্তূ চোখ বুজে আছে। ঝরঝর কোরে পানি পড়ছে মেয়েটার চোখ বেয়ে। ঘেন্নায় চেহারাটা কুঁচকে আছে। জয় ডেকে উঠল, “পলাশ ভাই, ছাড়েন ওরে। ও বিরক্ত হচ্ছে মনে হয়।ʼʼ
পলাশ বলল, “চ্যাহ! থাম তো বাপ, পাগল টাগল হইলি নাকি? চুপচাপ গিলে যা আপাতত, পরে ভাগ দেব।ʼʼ
জয় উঠে এগিয়ে গিয়ে শান্ত হাতটা পলাশের হাতের ওপর রাখে, “চ্যাহ! ছাড়েন ওকে। ছাড়তে বলতেছি আমি।ʼʼ
উহ্য-লুকানো জিদ জয়ের স্বরে। পলাশও জিদ কোরে শক্ত কোরে চেপে ধরতে যায় জয়কে। ওর ছেলেরা পজিশন নিচ্ছে নিজেদের। আচমকা জয় জানোয়ারের মতো গর্জে উঠল, “ছাড়! ছাড়তে বলতেছিনা, ছাড়?ʼʼ পুরো রুফটপ কম্পিত হয় সেই স্বরে। একদম গুমোট হয়ে উঠল পরিবেশটা। ক্ষেঁপা মহিষের মতো শ্বাস ফেলল জয়।পলাশের হাতটা খামছে ধরে অন্তূর কোমড় থেকে সরিয়ে দেয় জয়। তার চেহারা দেখতে তখন মানুষের মতো লাগছিল না, দাঁতে পিষে আবার সামলালো। অন্তূর হাতটা এখনও পলাশের থাবায়। জয় পলাশের হাতের ওপর নখ গেঁথে দিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল যেন, “ছেড়ে দেন পলাশ ভাই, জিদ উঠতেছে আমার।ʼʼ
পলাশ হেসে উঠল, “জয়, আমি জানি তুই ক্ষেপা। তবে একদম বোকা না। কিন্তু এখন এইরকম বোকামি করতেছিস ক্যান ভাই? কার সাথে কী করতেছিস, হুশ আছে? একটা মা*গীরে ছাড়াইতে তুই …কেমনে কী জয়? আমার সাথে ..ʼʼ
জয় পলাশের হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বলল, “ব্যাপার সেইটা না, পলাশ ভাই। আপনি ওরে ধরেন, সমস্যা তো নাই। আপনার ইচ্ছে হইছে, আপনি ধরবেন । ধরবেন, এরপর যা মনে চায় করবেন। পারলে টেনে-টুনে ছিঁড়ে ফেলবেন। অ্যাবসিউলুটলি আই জাস্ট ফা-কিং ডোন্ট কেয়ার এবাউট দ্যাট। বাট, আপনি আমার কথা শুনবেন না? ভিত্রে কেমন জানি শুয়োর নাচতেছে, ভাই। মন চাচ্ছে সবগুলারে একদম ছেঁচে ফেলি! আপনার ইচ্ছে হইছে, আপনি ওরে ধরবেন। কিন্তু আমি যে বললাম, ছাড়েন। এই কথা মানার জন্য ওকে ছেড়ে দেয়ার ছিল । ওকে ধরাটা সমস্যা না। আমি যে বললাম, ছাড়েন, এইটা আপনি শুনতেছেন না, এইটা সমস্যা! একবার না, কয়েকবার কইছি ছাড়তে!ʼʼ
পলাশের লোকেরা ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে আসে জয়ের দিকে। চারপাশে তখন ঘন অন্ধকারের কুয়াশারা ভিড় জমিয়েছে। জয় খিঁচে টান মেরে অন্তূকে ছাড়িয়ে নেয় পলাশের হাত থেকে। পলাশ অল্প ছিটকে পড়ল। জয় পেছনের শার্ট উঁচিয়ে হোলস্টার থেকে পিস্তল বের কোরে হাতে রাখতেই সকলে একটু পিছিয়ে গেল। অন্তূ দৌঁড়ে গিয়ে বসে পড়ে আব্বুর পাশে। অল্প আলোতে দেখতে পায় আব্বুর কানের কাছটায় বিভিন্ন স্থানে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সিগারেট ঠেকিয়ে পোড়ানো হয়েছে। ত্বক ঝলসে গেছে সেসব স্থানের। অন্তূ পারল না বুকে ছুরি বসিয়ে বুকের আটকে আসা শ্বাসকে হালকা করতে। চোখের সামনে ভাসছে, যখন আব্বুর কানে জলপ্ত সিগারেটের হল্কা চামড়া বিদীর্ণ করে ক্ষত তৈরি করছিল, তখন কেমন লেগেছিল আব্বুর! আর্তনাদ কোরে থামতে বলেছিল ওদের? অন্তূর মাথাটা ঘুরে আসে, বুকে মনে হলো গবগবিয়ে রক্ত বয়ে যাচ্ছে, গভীর ক্ষত, গভীর! অনবরত তীব্র যন্ত্রণারা সরু সুঁচের ন্যায় খোঁচাচ্ছে।
জয় পিস্তলের ব্যারেল টেনে বুলেট লোড কোরে নিলো। পলাশের চোখ মৃদু আলোতে জ্বলজ্বল কোরে উঠল। মুখে সেই প্যাচপ্যাচে হাসি। যা দেখতে ভীষণ ভয়ংকর লাগে। যেন সূর্যগ্রহণের রাত, তার ওপর পলাশের মৃদু আওয়াজের অমানুষিক হাসি রাতটাকে কলুষিত নাম দিচ্ছিল। পলাশ বলল, “জয়! আমি কিন্তু পলাশ জোয়ার্দার! আমার মাথা সব সময় ঠান্ডা, বাপ! একদম বরফের মতোন ঠান্ডা। আমার ইশারায় মানুষও ঠিক ওইভাবেই রক্ত জমাট বেঁধে মরে, হাহ হা হা!ʼʼ
জয় হেসে ফেলল, পিস্তলের মুজেল দিয়ে গলা চুলকে বলল, “পরশুদিনের ভোটকেন্দ্রে আপনার মতো পলাশ আর মাজহারের মতো খা-ন-কির ছাওয়াল যদি দুই-হাজারও উপস্থিত থাকে। আমি জয়, আমি জয় আমির এক এক হাজারের জন্য একেকশো কোরে লাশ বিছাবো। তাই দেখবেন বাকি নয়শোরা ওদের জানাজায় উপস্থিত হবে, গন্ডোগোল করাদ কেউ থাকবে না কেউ অন্তত নির্বাচন চলাকালীন সময়ে। সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ভোটে হামজা পাটোয়ারী পরশুদিন মেয়র নির্বাচিত হবে।ʼʼ
জয় পিছিয়ে এসে অন্তূর কাছে ঝুঁকলো, “আরমিণ! দ্রুত ওঠাও তোমার বাপকে। আমরা বের হবো জলদি। দ্রুত..ʼʼ
কথা শেষ হলো না। এক খাবলি থুতু এসে মুখে পড়ল জয়ের। অন্তূ বলে উঠল, “তোর মতো জানোয়ারের বাচ্চার সাহায্য লাগবে শেষ পর্যন্ত আমার? তুই তো জারজ রে! তোর কারও বাপকে বা মেয়েকে বাঁচাতে হবেনা।ʼʼ
পলাশের সরু হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। সাথে লোকগুলোও হাসছে। জয় আরও চমৎকার কোরে হাসল, মুখের ওপর থেকে থুতুটা মুছতে অন্তূর ঝুলে থাকা ওড়নার প্রান্ত তুলে নিলো। তা দিয়ে সযত্নে থুতুটুকু মুছে আরও সুন্দর কোরে হাসল, “তুমি আমায় থুতু দিলে, তোমাকেও থুতু দেবে লোকে, সত্যি বলছি। তবে সেসব ঋণ মিটমাট পরে হবে।ʼʼ এবার একটু আওয়াজ নিচু করল জয়, “কিন্তু এখন ওঠো জলদি। হাজার হোক, আমি একা। পিস্তলেও যদ্দূর সম্ভব বড়জোর দুটো বুলেট আছে। আমি ফাইটিং পারিনা অত ভালো। ওঠো, দ্রুত ওঠো। আমি সাহায্য করবো বাপকে ওঠাতে?ʼʼ
চলবে…
[রিচেইক করিনি, ভুলত্রুটি ক্ষ্যামা করবেন।
আর একটা কথা, আমার লেখাতে আসলে মনস্তাত্বিকতা এসেই যায় কেমন কোরে যেন। সেক্ষেত্রে আপনাদের পূর্ণ মনোযোগ এবং দেখার বাইরেও আরও অনেককিছু দেখার চোখ এবং ভাবনা থাকতে হবে। প্রতিটা শব্দ মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। দেখবেন কোথাও না কোথাও সবগুলো শব্দ মিলে যাবে একটার সাথে আরেকটা। হতে পারে বহু আগের একটা শব্দের যোগসূত্র এখনকার একটার সাথে মিলে যাচ্ছে। আবার একেকজনের মনোভাবে বহুত সাইকোলোক্যাল ফ্যাক্ট থাকবে। যেগুলো প্রাপ্ত মনষ্কতা দিয়ে বুঝে নেবার বিষয়। আবার অনেকের কাজকর্ম উদ্ভট লাগবে, তাতে উদ্ভট মনে করাথ কিছ নেই। আসলে চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্যই ওমন। তাদের প্রতিক্ষণের কাযকর্মই ওমন। মানে আমার লেখায় আসলে দেখতে পাওয়া বিষয়ের চেয়ে, না-দেখতে পাওয়া বিস্তর ভাবনার অস্তিত্ব বেশি। যা বুঝতে আপনাকেও উদ্ভট হতে হবে, নয়ত রাগ হবে আপনার। কারণ, আমি উদ্ভট, আমি তারকাটা পাগল, সাইকোপ্যাথের রোগী।🙂]