#দমকা_প্রেমের_গল্প
#Ayrah_Rahman
#পর্ব_০৪
__________________
অরিত্রা হাত ঘড়িতে সময় দেখে বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, বৃষ্টির জোর কমে আসছে মনে হচ্ছে। হুটহাট এমন বৃষ্টি ভালো লাগে না তার। যাতায়াতের বড্ড সমস্যা হয়। ত্রস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালো টেবিল ছেড়ে, রিমঝিমদের বাসায় এসেছে প্রায় ঘন্টা দুই হতে চলল, ক্লাস ফাইভের ছাত্রী, বেশ লক্ষী আর বুদ্ধি মতী মেয়ে। অরিত্রার ওকে বেশ লাগে।
মেয়েটাকে বাড়ির কাজ দিয়ে ভাবলো বেরিয়ে যাবে পরক্ষণেই ব্যাগটা হাতরে মোটে ত্রিশ টাকা খুচরা পয়সা ছাড়া বাড়তি একটা টাকাও নেই। ভেতর থেকে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো, মাসের এই শেষ সময় টা বেশ টানা পোড়নে পড়ে যায় সে। মনে মনে হিসাব কষে দেখলে আজ মোটে আটাশ তারিখ, ফেব্রুয়ারির শেষ উনত্রিশে। একদিন আগে মাইনে চাইলে কি বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? মন কে বারংবার প্রশ্ন করতেই মনে মনে বলল, ভিক্ষা তো আর চাইছে না! নিজের হকের টাকাই তো!
” রিমঝিম ”
পড়াই মনোযোগী মেয়েটা তৎক্ষনাৎ ম্যামের দিকে তাকালো,
” জি ম্যাম? ”
অরিত্রা ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
” তোমার আম্মুকে একটু ডেকে দেবে?”
মেয়েটা মাথা ঝাকিয়ে দৌড়ে গেলো মায়ের কাছে। তার মিনিট দুয়েক পরই রুমে প্রবেশ করলেন রিমা আহমেদ। রিমঝিমের মা। পেশায় তিনি একজন গৃহিণী।
” কিছু বলবা অরিত্রা?”
অরিত্রা ঠোঁট ভেজায়, ইতস্তত করে বলল,
” আসলে আপু, এই মাস তো প্রায় শেষ হতে চলল! যদি এই মাসের টাকা টা দিয়ে দিতেন তাহলে উপকার হতো!”
অরিত্রা থামে। কথাটা কানে যেতেই মহিলার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
” মাস তো এখনো শেষ হয় নি! এখনি টাকা চেয়ে বসে আছো! এমন টাকা টাকা করলে আমি বাপু তোমার কাছে মেয়ে পড়াতে পারবো না। এমনি তেও তো কাজের কাজ কিচ্ছু ই করো না। সময়ের পরে আসো আর আগেই চলে যাও। ভালো করে এক ঘন্টা পড়াও কি না তাও সন্দেহ। থাক আমি বাপু এতো কাঠখোট্টা না তুমি দাঁড়াও আমি টাকা নিয়ে আসছি ”
অপমানে অরিত্রা চোখ নামিয়ে রাখলো, চোখ দুটো টলটল করছে পানিতে কিন্তু তা গড়িয়ে পড়ার আগেই সংগোপনে মুছে ফেলল না। কোন প্রকার দূর্বলতা প্রকাশে অনিচ্ছুক সে। ভেতর থেকে হাহাকার করে উঠলো, হায়রে টাকা! তোর জন্য কত অপমানই না সহ্য করলাম!
________________
” কাল থেকে রেগুলার অফিসে বসবে তুমি মুনতাসিম! ”
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতার মাঝে ব্যঘাত ঘটিয়ে কথাটা বলে উঠলো মেহেরাব মজুমদার। মুনতাসিমের কোন প্রকার হেলদোল না দেখতে পেয়ে দাঁতে দাঁত চাপলো মেহেরাব । ছেলেটার এমন গা ছাড়া ভাব মোটেও পছন্দ না তার।
দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো মুনতাসিম? ”
মুনতাসিম খাবারের দিকে তাকিয়ে চামচ দিয়ে প্লেটে টুংটাং আওয়াজ করতে করতে বলল,
” খাবার সময় বেশি কথা বলা ভালো না মজুমদার সাহেব! ”
মুনতাসিমের কথাটা কর্নোগোচর হওয়ার সাথে সাথে ই মাথায় অদৃশ্য চাপড় দিলো মুনতাসিমের বাবা মাহমুদ মজুমদার। ছেলেটার এতো বড় বুকের পাটা যেখানে নিজেই ভাইয়ের ভয়ে বিড়ালের বাচ্চা হয়ে থাকে সেখানে নিজের ছেলের এতো অধপতন!
” আহ মুনতাসিম এসব কি কথা! ”
মাহফুজ মজুমদারের কথা শুনে চোখ তুলে তাকালো মুনতাসিম। খাবার নাড়তে নাড়তে বলল,
” খারাপ কিছু বলেছি? ”
মেহেরাব মজুমদার শক্ত কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই তৃষা বেগম বলে উঠলো,
” খাবার খেতে বসে এতো কথা বলেন কেন? চুপচাপ খাওয়া যায় না! দেখছেন বাচ্চাটা খাচ্ছে তবুও এটা সেটা বলে মেজাজ খারাপ করছেন! নিজেও খান আমার বাচ্চাটাকেও খেতে দেন ”
বলেই মুনতাসিমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” খা বাবা, তুই খা ”
মেহেরাব মজুমদার চোখ মুখ শক্ত করে খেতে লাগলো। ছেলেটাকে মুখের কথা বলা যায় না, বাড়ির নারী সমাজ এক প্রকার ঝাপিয়ে পড়ে তার উপর আর তাদের লিডার নিজের ই বিয়ে করা বউ।
” এই বড় বউ মাছের তরকারি টা আনো নি? ”
তৃষা বেগমের কথায় টেবিলে চোখ বুলালো অরুনা বেগম মুনতাসিমের মা। দাঁত দিয়ে জীভ কেটে মাথার কাপড় টা টেনে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো রান্না ঘরের দিকে। তখন ই রান্না ঘর থেকে ত্রস্ত পায়ে এক বাটি রুই মাছের তরকারি হাতে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলো মুনারা আক্তার মাহফুজ মজুমদারের বউ।
” আর যেতে হবে না ভাবি আমি নিয়ে এসেছি ”
বলেই মাথার কাপড় টা আরেকটু টেনে টেবিলের কাছে এসে দাড়ালো।
” বড় ভাবি আমাকে একটু তরকারি দেন তো ”
মাহমুদ মজুমদারের কথায় তৃষা বেগম মুনারার হাত থেকে তরকারির বাটিটা নিয়ে মুনতাসিমের পাতে এক টুকরো মাছ দিয়ে বাতিটা মুনরার হাতে দিয়ে বলল,
” ভাইজান কে একটু দিয়ে দে তো ছোট। আমি মাছের কাটা টা বেছে দেই ওকে ”
মুনতাসিম তৎক্ষনাৎ নাকচ করে বলল,
” না না বড় মা মাছ বাছতে হবে না আমি পারবো তুমি বরং খাবার খেতে বসে পরো, দিনে দিনে শুকিয়ে কি হচ্ছো সে খবর কি কেউ রাখে নাকি! ”
কথাটা কানে যেতেই তৃষা বেগম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
” কি আর বলব বাবা! পুরাতন হয়ে গেছি তো তাই এখন আর আমাকে ভালো লাগে না তার। খোঁজ খবর নেয় না উল্টো ভালো করে কথাও বলে না ”
” থাক বড় মা তুমি মন খারাপ করো না। আমি আছি না! তোমার ছেলে থাকতে কিচ্ছু হবে না। আর কারো কোন খোঁজ খবর নিতে হবে না ”
” হ্যা বাবা তুই আছিস বলেই তো কেউ তো একটু খোঁজ নেয়, আর কেউ তো চোখেই দেখে না আমাকে ”
কথাটা মেহেরাব মজুমদারের দিকেই বললেন তৃষা বেগম। বাকিরা ঠোঁট চেপে হাসছে।
এতোক্ষণ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে সায়র আর ইফতেখার।
মেহেরাব মজুমদার এতোক্ষণ সব কিছু অবলোকন করে নিচের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
” শুরু হয়েছে মেলোড্রামা! বজ্জাত ছেলে আর তো কোন হাতিয়ার পায় না শেষ মেষ আমার বউটাকেই হাতিয়ার বানায়! ”
” মিনু আর মেধা কোথায় আসে নি? ”
কথাটা বলেই মুনারা আশেপাশে তাকালো, অরুনা বেগম শাড়ির আচলে হাত মুছতে মুছতে বলল,
” মেধা তো এখনোও আসে নি হল থেকে, আজ তো ছুটি দেওয়ার কথা ছিলো। আর মিনু খাবে না বলে দরজায় খিল লাগিয়ে বসে আছে ”
মুনারা কথা বাড়ায় নি। একে একে সকলের খাবার শেষ করে রুমে চলে গেলো। মুনতাসিম রুমে গিয়ে দেখে সায়র তার রুমেই বসে আছে।
” এই তুই আমার রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছিস কেন? তোর রুম নেই ফাজিল ছেলে? ”
মুনতাসিমের রুড় কথাটা কানে যেতেই নড়েচড়ে বসলো সায়র। মনে হলো কথা টা কানের পাশ দিয়ে উড়ে চলে গেছে। মুনতাসিম ভ্রু কুঁচকালো এই ছেলে কি শুনতে পাচ্ছে না!
মুনতাসিম এগিয়ে গেলো ডিভানের দিকে যেখানে সায়র একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পড়ছে। সরি পড়ছে বললে ভুল হবে পড়ার ভান ধরছে।
মুনতাসিম সামনে আসা চুল গুলো পিছনে ঠেলে ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে চোয়াল শক্ত করে শান্ত কন্ঠে বলল,
” কথা কি কানে যায় না! নাকি কানে গরম শিক ঢুকাতে হবে? ”
সায়র ম্যাগাজিনে চোখ রেখেই মিনমিন করে বলল,
” ভাইয়া ম্যাগাজিন পড়ছি তো! আর তোমার রুম টা আমার বরাবর ই ভালো লাগে তাই তো এখানেই বসলাম ”
মুনতাসিম ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো,
” ম্যাগাজিন বুঝি উল্টো করে পড়তে হয়? জানতাম না তো ”
সায়র চমকে ম্যাগাজিনের দিকে তাকালো, দাঁত দিয়ে জিভ কেটে তৎক্ষনাৎ সোজা করে ধরলো ম্যাগাজিন। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে ই দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসলো, কোলের উপর বালিশ রেখে তার উপর ল্যাপটপ রেখে আড়চোখে এক পলক সায়রের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলো, ছেলেটা যে এখানে শুধু শুধু এসে বসে নেই সেটা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কবেই জানিয়ে দিয়েছে।
” কি বলবি বল! নয়তো এখান থেকে যা ”
সায়র এতোক্ষণ এটারই অপেক্ষায় ছিলো, ভাইয়ের অভয় বানী শুনতে পেয়ে তড়িৎ গতিতে ম্যাগাজিন টেবিলের উপর রেখে সোজা হয়ে বসলো,
” ভাইয়া একটা কথা বলবো? ”
মিনতাসিম কিছু ই বলল না, সায়র আর উত্তরের অপেক্ষা করলো না সে জানে মুনতাসিম উত্তর দেবে না। এমন ঘাড় ত্যাড়া মানুষ!
” আজকে সকালের মেয়েটার দিকে খেয়াল করেছো ভাইয়া? ওই মেয়েটাকেই তো সকালে দেখেছিলাম! ”
মুনতাসিমের দৃষ্টি তখনো ল্যাপটপে নিবদ্ধ। সায়র দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। ঠোঁট ভিজিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো,
” ভাইয়া মেয়েটার চেহারার সাথে কারো মিল পাচ্ছো তুমি? আমার কাছে ছোট চাচ্চুর মতো লাগছে! মেয়েটার কথা বলার ধরন, ভ্রু গোছানো সব কোথাও না কোথাও গিয়ে আমার পরিচিত মনে হচ্ছে, তোমার হচ্ছে না? ”
মুনতাসিম নিজের চোখ ল্যাপটপের স্ক্রিনে রেখেই চোয়াল শক্ত করে বলল,
” পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে একই চেহারার। তাই এটা নিয়ে এতো লাফানোর কিছু হয় নি। ছোট চাচ্চু আসার হলে অনেক আগেই আসতে পারতো কিন্তু সে আসে নি তাই এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের পড়া পড়। এমনি তেই এক বছর গ্যাপ গিয়েছে, কভার কর। ”
সায়র ঠোঁট উল্টালো, ” আজ পর্যন্ত আমার কোনো কথায় পাত্তা দিলা না তুমি! দেখবা একদিন পস্তাতে হবে আমার কথায় পাত্তা না দেওয়ার কারনে! গরীবের কথা বাশি হলেও ফলে ”
মুনতাসিম এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
” তুই গরীব? ”
সায়র আমতাআমতা করে বলল,
” এটা কথার কথা। ”
মুনতাসিমের চোয়াল শক্ত। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” তুই কি এখান থেকে যাবি নাকি একটা লাত্থি দিয়ে ফ্যানের মধ্যে বানরের মতো ঝুলিয়ে রাখবো বল ”
সায়র ঠোঁট বেঁকিয়ে উঠতে উঠতে বলল,
” যাচ্ছি তো! এতো অপমান করার কি আছে!আমার ও তো একটা মান সম্মান আছে! ”
“এই সায়র শোন ”
সায়র মুখ গোমড়া করে ফিরে তাকালো,
” বলো ”
” ইফতেখার কোথায়? ”
” আর কোথায়, পাবলিক রুম মানে আমার রুমে ”
মুনতাসিম ল্যাপটপের দিকেই নজর রেখে বলল,
” ঠিক আছে, ঘুমিয়ে যাস তাড়াতাড়ি। দুই বাদরে আবার একসাথে বাদরামী করিস না ”
সায়র চোখ মুখ কুঁচকালো,
” তুমি কি ইনডিরেক্টলি আমাকে বাদর বললে? ”
” ডিরেক্টলিই বলেছি ”
মুনতাসিমের স্বাভাবিক কন্ঠ। সায়র যেতে যেতে বলল,
” অপমানসস ”
বলেই জিনিস পত্র বগলদাবা করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। মুনতাসিম আড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করে কারো নাম্বারে কল করলো,
” একটা এড্রেস পাঠাচ্ছি, সেখান কার প্রতিটি সদস্যের ইনফরমেশন আমার চাই, এট এনি কস্ট এন্ড যত দ্রুত সম্ভব। ”
অপর পাশ থেকে উত্তর আসার আগেই ফোন টা কেটে দিলো সে। পুনরায় মনো নিবেশ করলো নিজের কাজে। পেন্ডিং প্রচুর কাজ তার উপর সামনে নির্বাচন, নিজ দলের লোক নির্বাচন করলে এই এক সমস্যা, দলের সভাপতি হয়েও গাধারখাটুনি খাটতে হয়। গত এক বছর যাবত সকল কাজ একা হাতে সামাল দিচ্ছে জাহিদ। মুনতাসিম ছিলো না বিধায় চাপ টা জাহিদের উপর একটু বেশিই হয়েছিলো কিন্তু নির্বাচন যত কাছিয়ে আসছে ততই যেন চাপ বাড়ছে আর বেচারা জাহিদ সব কিছু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তাই আজিজুল খন্দকার ইমিডিয়েটলি শহরে ফিরতে তাগিদ দিয়েছে মুনতাসিম কে। আজিজুল খন্দকার দলের সবচেয়ে পুরাতন সদস্য সেই খাতিরেই তাকেই এবারের মেম্বার পদে দাড় করানো হয়েছে যদিও দলের সকলের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চলবে,….
[ কেমন লাগলো জানাবেন কিন্তু ]