#অসম্ভবেও আমার তুমি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–১৯
উদ্বেগ হীন কদম ফেলে কেবিনের ভেতরে ঢুকলো আবরার।সামনেই সোজাসুজি বেডে টানটান হয়ে শুয়ে আছে তনয়া।মাথার পুরোটা সাদা রংয়ের কাপড়ে মোড়ানো।এক কথায় ব্যান্ডেজ করা।
আবরার এগিয়ে গিয়ে তনয়ার বেডের এক পাশে দাড়ালো।
তনয়া চোখ মেলেনি,,তবে চোখের পাতা গুলো এক করে থাকা অবস্থাতেই ভীষণ কাঁপছে,,,ঠোঁট গুলো নড়ছে। অস্পষ্ট শব্দে আবরারের নাম বেরিয়ে আসছে।
তনয়াকে উদ্দেশ্য করে এবার নার্স মেয়েটি গলা বাড়িয়ে বলল,,
— ম্যাম,আপনি যাকে খুঁজছিলেন,,,মানে যার নাম বলছিলেন তিনি এসছেন।
এটুকু শুনতেই পিটপিট করে চোখ খুললো তনয়া। ঘাড় কাত করে একবার নার্স মেয়েটির দিকে তাকালো। তনয়াকে চোখ খুলতে দেখা শেষে মেয়েটি ব্যাস্ত হয়ে পরলো নিজের কাজে।
পরক্ষনে অন্য পাশে ঘাড় বাকালো তনয়া।ঝাপ্সা দৃষ্টিতে আবরার কে দেখে কোনও রকম মৃদূ ঠোঁটে হাসি ফুটলো। একটু বাদেই স্পষ্ট হয়ে এলো আবরারের মুখমণ্ডল। ক্যানেল লাগানো হাত উঁচিয়ে তনয়া কাপা স্বর তুলে বলে উঠলো,
— আআপনি এ..সে.. ছেন ??
উত্তর দিলোনা আবরার,,,সৌজন্যতায় তনয়ার হাত ধরে ঝুঁকে এসে ওর পেটের ওপর ভাজ করে রেখে ,,শীতল কন্ঠে বলল
— আসতেতো হতোই,,,
তনয়া যথাসম্ভব চেষ্টা চালালো উঠে বসার,,,কিন্তু সামান্য নড়লেই মাথার চিনচিনে ব্যাথাটা নাড়া দিয়ে উঠলো।
বিকৃত মুখ করে ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো একেবারে,,,আবরার ব্যাস্ত গলায় বলল,,
— এত উত্তেজিত হবেন না।আমি আছি এখানে,
কথাটা শুনলেও মানলোনা তনয়া। উঠে বসতে চাইলেও আবারো ব্যার্থ হলো। এবার আগের থেকেও বেশি উদগ্রীব হয়ে বলল,
— আবরার আমার পাশে একটু বসুন না।প্লিজ।
একটা ছোট দম ফেলে চেয়ার টেনে বসলো আবরার। তনয়া ভাঙা গলায় বলল,
— আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, আপনার কিছু হয়নি।
আবরার শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
— আপনি কেন নিজেকে বিপদের মুখে ফেললেন তনয়া?
তনয়া মুচকি হাসলো,,বলল,
— আপনার জন্যে আমি সব পারবো।এটুকু তো কিছুই নয়,,
আবরার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
— এসবে কোনও লাভ নেই তনয়া।বুঝতে চাইছেন না আপনি,,
কথাটা বলেই থেমে গেলো আবরার,,,মনে হলো এসব বলার সঠিক সময় এটা নয়।মাত্রই মেয়েটার এত বড় অপারেশন শেষ হলো,উত্তেজনা একদম ঠিক হবেনা।
— আমি কি বুঝতে চাইছিনা আবরার? বলুন না..
তনয়ার কুঞ্চিত ভ্রু দেখে, আবরার প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে উঠলো,
— এখন কেমন লাগছে আপনার?
আবারো মৃদূ হাসলো তনয়া,বলল,
— ভালো। আপনি অনেক চিন্তা করছিলেন আমার জন্যে তাইনা?
আবরার উৎসুক নজরে চেয়ে বলল,
—- এরকম কেন মনে হলো?
— আপনার মুখ চোখ বড্ড শুকনো লাগছে।
আবরার নিচু আওয়াজে উত্তর দেয়,
— ওহ!
যেটা ভেবে শান্তি পাবেন সেটাই।
তনয়া আবরারের হাতের ওপর হাত রাখে,,,চট করে তাকায় আবরার,,,তনয়া ছেলেমানুষী আওয়াজে বলে,
— আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন না আবরার।
আবরার ইতস্তত করে বলল,
— আমি?
তনয়া ওপর নিচে ক্ষীন মাথা নাড়লো,আদুরে কন্ঠে বলল,
— ঘুম পাড়িয়ে দিন আমায়।
না চাইতেও হাত এগিয়ে তনয়ার মাথায় আস্তে করে বুলিয়ে দিতে শুরু করলো আবরার। তনয়া এক ভাবে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছে,,,
“”এই মানুষ টাকে সে অনেক বেশি ভালোবাসে। কিছুতেই সে তার না হয়ে অন্যের হতে পারেনাহ।এতোটা ভালোবাসা কোনও মতেই বিফলে যেতে পারেনা তার। অন্তত সে যেতে দেবেনা।
আবরারের হাত টা নিজের হাত দিয়ে ধরে থামালো তনয়া,আবরার জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে বলল,
— কি হলো ঘুমোবেন না?
তনয়া উত্তর না দিয়ে আবরারের হাত টা মাথা থেকে সরিয়ে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এলো,,কপালে ভাঁজ পরলো আবরারের।
কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবরারের হাতের উল্টো পৃষ্ঠে আস্তে করে ঠোঁট ছুইয়ে চুমু খেলো তনয়া।
ঘটনাক্রমে ভড়কে গেলো আবরার।অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। হাত সরাতে চেয়েও তনয়ার অবস্থার কথা ভেবে পারলোনা।
এ পর্যায়ে আবরারের ঠান্ডা হাত তনয়া নিজের গালে ছুইয়ে আবেশে চোখ বন্ধ করে নিয়ে বলল,
— আপনি সব সময় আমার পাশে থাকবেন আবরার। এইভাবে।আমি আপনাকে কাছ ছাড়া হতেই দেবোনা।
নিজেকে অপ্রীতিকর ঘটনার স্বীকারগ্রস্ত মনে হলো আবরারের, ,বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে হাতে মৃদূ টান দিয়ে বলল,
— হাত টা ছাড়ুন তনয়া।আপনার ঘুমানো প্রয়োজন।
বিশ্রাম দরকার,
তনয়া আবরারের দিকে তাকিয়ে ঘোর লাগা গলায় বলল,
— আপনিই আমার বিশ্রাম আবরার, আপনিই আমার শান্তি।
উত্তর দিলোনা আবরার। সবটা দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়ার চেষ্টা চালালো।
তনয়া আবরারের মুখের দিক তাকিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হাসে। পরক্ষনে চোখ সরিয়ে আচমকা দরজার দিকে তাকাতেই মুখের খুশির ভঙিমা পাল্টে আসে তার।
দরজার একপাশ আগলে দাড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা। মুখে হাসির রেশ টুকু নেই।মলিন মুখস্রী একেবারে।স্নিগ্ধাকে দেখতেই গায়ে আগুন ধরে আসার মত অনুভব হলো তনয়ার,,,ক্রোধে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
— ও এখানে কি করছে??
কথাটায় তনয়ার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকালো আবরার।তনয়ার চোখ অনুসরন করে দরজার দিকে পিছু ঘুরলো,,,,স্নিগ্ধাকে দেখে নিজেও অবাক হলো।
তনয়া উত্তেজিত হয়ে স্নিগ্ধার দিকে আঙুল ইশারা করে বলতে লাগলো,
— আবরার,ও কেন এসছে এখানে? ও আপনাকে আমার থেকে কেড়ে নিতে এসেছে? ওকি আপনাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে? আমাকে আবারো একা করে দেবে?
কথাটা বলতে বলতে আবরারের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো তনয়া,,
— আমি আপনাকে শক্ত করে ধরে রাখবো আবরার।ওই মেয়েটা কিছুতেই আপনাকে নিয়ে যেতে পারবেনা আমার থেকে
তনয়ার আওয়াজে নার্স মেয়েটি হাতের স্যালাইনের বোতল টেবিলে রেখে বেডের কাছে এগিয়ে এলো। উদ্বেগ নিয়ে বলল,
— ম্যাম আপনি শান্ত হন।আপনার উত্তেজিত হওয়া নিষেধ আছে।
তনয়া থামলোনা।বিড়বিড় করে একি কথা আওড়াতে লাগলো।আবরার একবার স্নিগ্ধার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার তনয়ার আগলে রাখা নিজের হাতের দিকে। স্নিগ্ধার মলিন মুখটা কেমন অসহায় লাগছে আবরারের কাছে। ক্ষুন্ন দৃষ্টি মনে হচ্ছে অশ্রুতে ভিজতে চাইছে। হয়তো কোনও কারনে পারছেনা।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তনয়ার হাত ছাড়িয়ে স্নিগ্ধার কাছে যেতে অব্দি অপারগ আবরার। উত্তেজিত হলে ভালো মন্দ কিছু হতে পারে তনয়ার।
কেবিনে ঢোকার আগেই তো নার্স মেয়েটি তাকে বলেছিলো,,,সামান্য ব্যাগ্রতা তনয়ার মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে! আর মাথার মত এমন সেন্সিটিভ জায়গায় বারবার আঘাত পেলে পেশেন্ট কোমাতে অব্দি যেতে পারে।
“” নাহ! তার জন্যে কারো প্রাননাশ হবে এটা কখনোই মেনে নেয়া যায়না,,,তনয়া -তনয়ার বাবা যাই করুক,সেতো পশু নয়।সে মানুষ।
তনয়ার উত্তেজনার মাত্রা বাড়তে দেখে নার্স মেয়েটি আবরার কে উদ্দেশ্য করে গলা বাড়িয়ে বলল
— স্যার প্লিজ ম্যাম কে শান্ত করুন,একরকম করলে ওনার শরীর আরো খারাপ হবে।
ধ্যান ভাঙে আবরারের।
স্নিগ্ধার থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। ধীর গলায় তনয়াকে বলে ওঠে
— তনয়া প্লিজ শান্ত হন।
শুনলোনা তনয়া,, আকুলতা নিয়ে বলল,
— ও আপনাকে নিয়ে যাবে আবরার,,ও আপনাকে কেড়ে নিতে এসছে,,
স্নিগ্ধা চুপ করে তাকিয়ে রইলো আবরার আর তনয়ার দিকে,,, পরক্ষনে মাথা নামিয়ে শুকনো ঢোক গিললো।
আবরার নিজের বাহুতে ধরে রাখা তনয়ার হাত মুঠো করে ধরলো,আস্বস্ত গলায় বলল,
— আমি কোথাও যাচ্ছিনা তনয়া,,কেউ আমাকে নিতে আসেনি,আপনি শান্ত হন।আমি আছি আপনার সাথে।
আবরারের কথার প্রেক্ষিতে অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকালো স্নিগ্ধা। নিস্ক্রিয়তায় মোড় নিলো দৃষ্টি।
কথাটা কানে পৌঁছানোর মাত্রই প্রায় সাথে সাথে থেমে গেলো তনয়া।শান্ত হয়ে এলো। ঠোঁট এলিয়ে আবরারের হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। ব্যাকুল হয়ে বলল,
— আপনি সত্যি বলছেন?
মৃদূমন্দ মাথা নাড়লো আবরার।ঠোঁট টেনে হেসে বলল,
— হ্যা।
তনয়া আবারো চোখ ঘোরালো স্নিগ্ধার ক্লান্ত মুখের দিকে,,,,উদ্বেগ নিয়ে বলল,
— তবে ওকে চলে যেতে বলুন।এক্ষুনি বলুন।
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো আবরার। তনয়ার থেকে হাত ছাড়াতে গেলেও তনয়া আবারো শক্ত ভাবে পেচিয়ে ধরে বলল,
— আমি আপনার হাত ছাড়বোনা।ছেড়ে দিলেই আপনি পালিয়ে যাবেন।
তীব্র বিরক্তি লাগলো আবরারের।মুখে ফুটে উঠলো তার স্পষ্ট ছাপ,,,গুমোট গলায় বলল,
— হাত না ছাড়লে ওকে এখান থেকে পাঠাবো কি করে?
তনয়া কিছু একটা ভেবে হাত সরিয়ে নেয় নিজের।মুহুর্তে আবারো ধরে ফেলে,,ভীত হয়ে তাড়াহুড়ো করে বলে,
— আপনি আবার আমাকে ফেলে যাবেন না তো?
আবরার বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে আসা মুখ নিয়ে বলল,
— বললাম তো যাবোনা।
আস্বস্ত হলো তনয়া,মৃদূ ঠোঁট বাকা করে হেসে আবরার কে ছাড়ল।
উল্টো ঘুরে ধীরে পা ফেলে দরজার কাছে এলো আবরার,স্নিগ্ধার মুখোমুখি দাড়ালো,,,শান্ত ভাবে বলল,
— পরি তুমি…
এটুকু বলতেই স্নিগ্ধা মাঝ পথে ক্ষীন আওয়াজে বলে উঠলো,
— চলে যাবো,তাইতো?
আবরার কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
— হুম!তনয়া চাইছেনা তুমি এখানে থাকো।
স্নিগ্ধা চোখ তুলে তাকালো আবরারের মুখের দিকে,,,ঢোক গিলে বলল,
— আর তাই আপনিও চাইছেন না।
বুঝতে পেরেছি।
আবরার ব্যাস্ত হয়ে বলে,
— এরকম নয়,আমিতো…..
আবরার পুরো কথা শেষ করার আগেই ভেতর থেকে ধৈর্য হীন হয়ে ডেকে উঠলো তনয়া,
— আবরার,,আসুন,এত কি বলছেন ওর সাথে? ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিন না…!
রাগে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো আবরার।দাঁত চেপে বলল,
— পরি প্লিজ এখান থেকে যাও।
স্নিগ্ধার খুব কান্না পেলো।কিন্তু কাঁদলোনা।কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলার মধ্যে ঘুরতে থাকলো।
কেন জানিনা মনে হলো আবরার বুঝি তার থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষ টা!
চলবে,
গল্প নিয়মিত চাইলে পর্ব ছোট হবে।আর আমি যেহেতু দুটো গল্প কন্টিনিউ করি তাই মাঝে মাধ্যে দিতে দেরি হয়ে যায়।এ নিয়ে কেউ রাগ করবেন না😑আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করিতো আগের মত নিয়মিত দেয়ার।