#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৪।
মায়ের মন এখন আগের থেকে হালকা হয়েছে কিছুটা। রাগও পড়ে গিয়েছে হয়তো। একসাথেই রাতের খাবারটা খেয়েছে সবাই। অনেকগুলো দিন পর আবার পুরো পরিবার একসাথে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসার ঘরে গল্প জুড়েছে। প্রিয়তা মা বাবাকে তার পাকিস্তান ভ্রমণের করুন গল্পগুলো শোনাচ্ছে। ওয়াদি তাকে ধোঁকা দিয়েছে সেটা বললেও, ধোঁকাটা ঠিক কীরকম সেটা বলেনি তাঁদের। সেটা কেবল নীহাল’ই জানে। তার ভ্রমণ গল্পের মুখ্য চরিত্রগুলো হলো, দিলরুবা বেগম, মৌমি আর ফারজাদ। এই তিনজন মানুষের বিবরণ দিতে দিতে এক পর্যায়ে প্রিয়তার চোখ ভিজে উঠে। তাদের কথা মনে পড়ছে খুব। লুৎফা বেগম অবাক হয়ে বলেন,
‘এখনো এত ভালো মানুষ আছেন?’
প্রিয়তা মলিন হেসে বলে,
‘হ্যাঁ মা, উনাদের দেখেই বিশ্বাস করেছি, পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ টিকে আছে।’
‘দিলরুবা আপার সাথে আমাকে একটু কথা বলিয়ে দিস তো। মানুষটাকে একটু কৃতজ্ঞতা জানাব।’
‘এখন কল করব একটা?’
‘যদি ঘুমিয়ে পড়ে?’
‘না, এত তাড়াতাড়ি উনারা ঘুমান না।’
‘তাহলে কর।’
প্রিয়তা মৌমির আইডি তে ভিডিয়ো কল দিল। সাথে সাথেই রিসিভ হলো সেটা। ফোনের স্ক্রিনে প্রিয়তার মুখটা দেখে মৌমির চোখ ছলছল করে উঠে। সে অভিমানের সুরে বলে,
‘দেশে গিয়েই আমাকে ভুলে গিয়েছ, তাই না?’
প্রিয়তা হেসে বলে,
‘কী যে বলো না, তোমাকে ভোলা কি সম্ভব?’
‘তাহলে আমাকে একটাও মেসেজ বা কল দাওনি কেন?’
‘এসেই আমার মা জননীর রাগ ভাঙানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই আর সময় করে উঠতে পারিনি।’
‘আন্টির রাগ ভেঙেছে?’
প্রিয়তা মায়ের দিকে তাকায়। তার মা মেকি রাগ দেখানোর ভান করে বসে আছে। সে হেসে বলে,
‘মনে হচ্ছে কিছুটা।’
‘চিন্তা করো না, পুরোটাও কমে যাবে।’
‘আচ্ছা। আন্টি কী করছেন?’
‘আম্মি বসার ঘরে। দাঁড়াও, আমি দিচ্ছি।’
মৌমি বসার ঘরে যায়। দিলরুবা বেগমকে গিয়ে বলে,
‘আম্মি, প্রিয়তা আপু কথা বলবে তোমার সাথে।’
তিনি খুশি হলেন। বললেন,
‘দে দে।’
প্রিয়তা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ভালো আছেন, আন্টি?’
‘তুমি যাওয়ার পর ভালো নেই, মা। তোমার কথা খুব মনে পড়ছে।’
প্রিয়তা মন খারাপ করে বলল,
‘আমারও। আপনাদের সবাইকে অনেক মিস করছি।’
‘তাহলে আবার চলে আসো।’
পাশ থেকে মৌমি বলল। নীহাল জবাব দিল,
‘এটা তো আমাদের হোটেল আর উনাদের বাসা, বললেই চলে আসা যাবে।’
মৌমি ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘তোমার ঝগড়ুটে ভাইটা দেখছি দেশে গিয়েও আমার সাথে ঝগড়া করছে। উনাকে তুমি কিছু বলো তো।’
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘আহা থাম না, তোর জন্য আমি একটু শান্তিতে কথা বলতে পারছি না।’
‘আমি কী করেছি, আম্মি? উনিই তো যেচে পড়ে আমার সাথে ঝগড়া করছেন।’
‘মা, তুমি চিন্তা করো না, আমি ওর কান মলে দিব।’
এই কথা শোনে ভীষণ খুশি হলো মৌমি। জিজ্ঞেস করল,
‘এটা কে বলল, প্রিয়তা আপু?’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘আমার মা।’
মৌমি লাফিয়ে উঠে বলল,
‘তাই নাকি? আন্টি শুনুন, কান মলাটা জোরে দিবেন, আমার আর আপনার দুজনেরটা মিলিয়ে।’
নীহাল ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘মা, তুমি উনার হয়ে কথা বলছো কেন?’
‘আমার মাও তো আপনার হয়েই কথা বলে। তাই আপনার মা আমার হয়ে কথা বলছে, সমান সমান।’
মৌমির কথা শোনে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠে। নীহাল নাক ফুলিয়ে বলল,
‘দেখেছ, কেমন ফাজিল মেয়ে!’
‘প্রিয়তা আপু, তোমার ভাই আমাকে ফাজিল বলল কেন?’
প্রিয়তা জবাব দেওয়ার আগেই নীহাল বলল,
‘ফাজিলকে ফাজিল’ই বলতে হয়।’
মৌমি নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘প্রিয়তা আপু, তুমি কিছু বলছো না কেন?’
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘তোদের জ্বালায় মেয়েটা কিছু বলতে পারলে তো। এবার একটু থাম, মা।’
মৌমি গাল ফুলিয়ে মুখ গোমড়া করে বসল। প্রিয়তা হাসল তা দেখে। বলল,
‘আন্টি, আমার মা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাইছেন।’
‘তাই! দাও না। আমিও তো ভাবছিলাম কথা বলব।’
প্রিয়তা মায়ের দিকে ফোনটা এগিয়ে দেয়। লুৎফা বেগম মুখে চওড়া হাসি টেনে হাতে নেন সেটা। মুখ বরাবর ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকান। এক মিনিট একই ভাবে তাকিয়ে আচমকা মুখের হাসিটা কেন যেন মিলিয়ে গেল। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন,
‘রুবা!’
ওপাশের মানুষটাও তাঁর মতো সমান বিস্ময়ে চেয়ে আছেন। বোঝার চেষ্টা করছেন, স্ক্রিনে ভাসা মুখটা আদৌ সত্যি কি-না। যখন বুঝলেন, না এটাই সত্যি, এই প্রতিবিম্বে কোনো মিথ্যে নেই, তখন কম্পিত সুরে তিনি বললেন,
‘লুফু!’
দুই পাশের বাকি মানুষগুলো অবাক। প্রিয়তা মায়ের চাহনি দেখে চিন্তায় আছে, এই চাহনি বলে দিচ্ছে তাঁরা পূর্ব পরিচিত। মৌমিও তাই।
দিলরুবা বেগম বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বললেন,
‘তুই প্রিয়তার মা?’
লুৎফা বেগম মাথা নাড়ালেন। বললেন,
‘এত বছর পরেও আমার চেহারাটা মনে আছে তোর?’
দিলরুবা বেগমের চোখ ছলছল করছে। তিনি বললেন,
‘এই চেহারাটা কি ভোলা সম্ভব?’
‘না ভুললে এত বছর যোগাযোগ করিসনি কেন?’
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
‘নিজের উপর রাগ, ক্ষোভ আর অভিমানে আমি কারোর সাথে যোগাযোগ করিনি আর।’
‘আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, অনেক ভাবে চেয়েছি তোর একটা খোঁজ নিতে, কিন্তু পারিনি। তারপর আর দেশে আসিসনি কেন?’
‘কোন মুখে ফিরতাম? কী বলতাম মা বাবাকে গিয়ে?’
‘খালু খালাম্মা অনেকদিন পর্যন্ত তোর ফিরে আসার অপেক্ষাতে ছিলেন। অনেক খোঁজ নিয়েও শেষে কোনো উপায় বের করতে না পেরে আশা ছেড়ে দেন তাঁরা।’
দিলরুবা বেগম বড়ো করে শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
‘উনারা কি আর বেঁচে নেই?’
‘না। তোর চলে যাওয়ার খবরে খালাম্মা ঐদিনই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসা করেও উনাকে আর সুস্থ করা যায়নি। এক বছর পরেই ইন্তেকাল করেন। আর খালু মারা যান আজ থেকে আরো ছয় বছর আগে। বাড়িতে বোধ হয় এখন তোর ভাই ভাবি আর তাঁদের বাচ্চারা আছে। আমারও আর যোগাযোগ নেই কারোর সাথে।’
পুরোনো ঘা থেকে আজ আবার রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে বেশ। এই ব্যথা দিলরুবা বেগম টের পাচ্ছেন। তবে এখন আর কিছুই করার নেই। এখন হাজার মলম লাগালেও এই ঘা আর শুকাবে না। তিনি ক্ষীণ সুরে বলেন,
‘মা বাবাকে কষ্ট দেওয়ার ফল আমি প্রতিটা মুহুর্তে ভোগ করেছি। জানিস, এখানে আমি একটুও ভালো ছিলাম না।’
লুৎফা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
‘কেন? ভাই তোকে…’
‘থাক, এসব কথা। ভাগ্যের কী খেলা দেখ, আমাদের আবার এভাবে কথা হবে কখনো ভেবেছিলাম?’
‘সেটাই তো। কী অদ্ভুত! আমার মেয়েকে পাকিস্তানে গিয়ে তোর বাড়িতেই উঠতে হলো? ঐ যে কথায় আছে না, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আর এতসব দুঃখের পরেও একটা সুন্দর ভালো হলো, আমি তোকে ফিরে পেয়েছি আবার।’
দিলরুবা বেগম ঠোঁট চেপে নিজের কান্না আটকালেন। হাসলেন তিনি। বললেন,
‘হ্যাঁ। কী চমৎকার ব্যাপার, এভাবেও যে কাছের মানুষ ফিরে পাওয়া যায়, আমি কল্পনাও করিনি।
লুৎফা বেগম হেসে বললেন,
‘খারাপের পরেই ভালো থাকে। এবার দেশে ফির। কত শত কথা বাকি, সব বলতে হবে তো।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক কিছু বাকি আমাদের। এবার আর বিলম্ব করব না এক মুহুর্তও। আর কেউ না হোক, আমি তোর কাছে ফিরব।’
‘আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকব।’
‘আচ্ছা, এবার সত্যিই ফিরব তবে।’
লুৎফা বেগম ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে দিয়ে হেসে বললেন,
‘ওদের মুখগুলো দেখ, কেমন হা করে চেয়ে আছে আমার দিকে।’
দিলরুবা বেগমও হাসলেন। বললেন,
‘হ্যাঁ, এইদিকে আমার মেয়েরও এই অবস্থা।’
‘আচ্ছা, রাখ তবে, আমি ওদের বলি সব। নয়তো পরে চিন্তায় চিন্তায় স্ট্রোক করে বসবে।’
দিলরুবা বেগম হেসে বললেন,
‘আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।’
‘আল্লাহ হাফেজ।’
ফোন কাটলেন লুৎফা বেগম। প্রিয়তা চোখ পিটপিট করে বলল,
‘মা, কী এসব? আমার তো মাথা ঘুরাচ্ছে। তোমরা পূর্বপরিচিত?’
চলবে…..
#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৪।
মায়ের মন এখন আগের থেকে হালকা হয়েছে কিছুটা। রাগও পড়ে গিয়েছে হয়তো। একসাথেই রাতের খাবারটা খেয়েছে সবাই। অনেকগুলো দিন পর আবার পুরো পরিবার একসাথে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসার ঘরে গল্প জুড়েছে। প্রিয়তা মা বাবাকে তার পাকিস্তান ভ্রমণের করুন গল্পগুলো শোনাচ্ছে। ওয়াদি তাকে ধোঁকা দিয়েছে সেটা বললেও, ধোঁকাটা ঠিক কীরকম সেটা বলেনি তাঁদের। সেটা কেবল নীহাল’ই জানে। তার ভ্রমণ গল্পের মুখ্য চরিত্রগুলো হলো, দিলরুবা বেগম, মৌমি আর ফারজাদ। এই তিনজন মানুষের বিবরণ দিতে দিতে এক পর্যায়ে প্রিয়তার চোখ ভিজে উঠে। তাদের কথা মনে পড়ছে খুব। লুৎফা বেগম অবাক হয়ে বলেন,
‘এখনো এত ভালো মানুষ আছেন?’
প্রিয়তা মলিন হেসে বলে,
‘হ্যাঁ মা, উনাদের দেখেই বিশ্বাস করেছি, পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ টিকে আছে।’
‘দিলরুবা আপার সাথে আমাকে একটু কথা বলিয়ে দিস তো। মানুষটাকে একটু কৃতজ্ঞতা জানাব।’
‘এখন কল করব একটা?’
‘যদি ঘুমিয়ে পড়ে?’
‘না, এত তাড়াতাড়ি উনারা ঘুমান না।’
‘তাহলে কর।’
প্রিয়তা মৌমির আইডি তে ভিডিয়ো কল দিল। সাথে সাথেই রিসিভ হলো সেটা। ফোনের স্ক্রিনে প্রিয়তার মুখটা দেখে মৌমির চোখ ছলছল করে উঠে। সে অভিমানের সুরে বলে,
‘দেশে গিয়েই আমাকে ভুলে গিয়েছ, তাই না?’
প্রিয়তা হেসে বলে,
‘কী যে বলো না, তোমাকে ভোলা কি সম্ভব?’
‘তাহলে আমাকে একটাও মেসেজ বা কল দাওনি কেন?’
‘এসেই আমার মা জননীর রাগ ভাঙানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই আর সময় করে উঠতে পারিনি।’
‘আন্টির রাগ ভেঙেছে?’
প্রিয়তা মায়ের দিকে তাকায়। তার মা মেকি রাগ দেখানোর ভান করে বসে আছে। সে হেসে বলে,
‘মনে হচ্ছে কিছুটা।’
‘চিন্তা করো না, পুরোটাও কমে যাবে।’
‘আচ্ছা। আন্টি কী করছেন?’
‘আম্মি বসার ঘরে। দাঁড়াও, আমি দিচ্ছি।’
মৌমি বসার ঘরে যায়। দিলরুবা বেগমকে গিয়ে বলে,
‘আম্মি, প্রিয়তা আপু কথা বলবে তোমার সাথে।’
তিনি খুশি হলেন। বললেন,
‘দে দে।’
প্রিয়তা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ভালো আছেন, আন্টি?’
‘তুমি যাওয়ার পর ভালো নেই, মা। তোমার কথা খুব মনে পড়ছে।’
প্রিয়তা মন খারাপ করে বলল,
‘আমারও। আপনাদের সবাইকে অনেক মিস করছি।’
‘তাহলে আবার চলে আসো।’
পাশ থেকে মৌমি বলল। নীহাল জবাব দিল,
‘এটা তো আমাদের হোটেল আর উনাদের বাসা, বললেই চলে আসা যাবে।’
মৌমি ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘তোমার ঝগড়ুটে ভাইটা দেখছি দেশে গিয়েও আমার সাথে ঝগড়া করছে। উনাকে তুমি কিছু বলো তো।’
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘আহা থাম না, তোর জন্য আমি একটু শান্তিতে কথা বলতে পারছি না।’
‘আমি কী করেছি, আম্মি? উনিই তো যেচে পড়ে আমার সাথে ঝগড়া করছেন।’
‘মা, তুমি চিন্তা করো না, আমি ওর কান মলে দিব।’
এই কথা শোনে ভীষণ খুশি হলো মৌমি। জিজ্ঞেস করল,
‘এটা কে বলল, প্রিয়তা আপু?’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘আমার মা।’
মৌমি লাফিয়ে উঠে বলল,
‘তাই নাকি? আন্টি শুনুন, কান মলাটা জোরে দিবেন, আমার আর আপনার দুজনেরটা মিলিয়ে।’
নীহাল ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘মা, তুমি উনার হয়ে কথা বলছো কেন?’
‘আমার মাও তো আপনার হয়েই কথা বলে। তাই আপনার মা আমার হয়ে কথা বলছে, সমান সমান।’
মৌমির কথা শোনে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠে। নীহাল নাক ফুলিয়ে বলল,
‘দেখেছ, কেমন ফাজিল মেয়ে!’
‘প্রিয়তা আপু, তোমার ভাই আমাকে ফাজিল বলল কেন?’
প্রিয়তা জবাব দেওয়ার আগেই নীহাল বলল,
‘ফাজিলকে ফাজিল’ই বলতে হয়।’
মৌমি নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘প্রিয়তা আপু, তুমি কিছু বলছো না কেন?’
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘তোদের জ্বালায় মেয়েটা কিছু বলতে পারলে তো। এবার একটু থাম, মা।’
মৌমি গাল ফুলিয়ে মুখ গোমড়া করে বসল। প্রিয়তা হাসল তা দেখে। বলল,
‘আন্টি, আমার মা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাইছেন।’
‘তাই! দাও না। আমিও তো ভাবছিলাম কথা বলব।’
প্রিয়তা মায়ের দিকে ফোনটা এগিয়ে দেয়। লুৎফা বেগম মুখে চওড়া হাসি টেনে হাতে নেন সেটা। মুখ বরাবর ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকান। এক মিনিট একই ভাবে তাকিয়ে আচমকা মুখের হাসিটা কেন যেন মিলিয়ে গেল। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন,
‘রুবা!’
ওপাশের মানুষটাও তাঁর মতো সমান বিস্ময়ে চেয়ে আছেন। বোঝার চেষ্টা করছেন, স্ক্রিনে ভাসা মুখটা আদৌ সত্যি কি-না। যখন বুঝলেন, না এটাই সত্যি, এই প্রতিবিম্বে কোনো মিথ্যে নেই, তখন কম্পিত সুরে তিনি বললেন,
‘লুফু!’
দুই পাশের বাকি মানুষগুলো অবাক। প্রিয়তা মায়ের চাহনি দেখে চিন্তায় আছে, এই চাহনি বলে দিচ্ছে তাঁরা পূর্ব পরিচিত। মৌমিও তাই।
দিলরুবা বেগম বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বললেন,
‘তুই প্রিয়তার মা?’
লুৎফা বেগম মাথা নাড়ালেন। বললেন,
‘এত বছর পরেও আমার চেহারাটা মনে আছে তোর?’
দিলরুবা বেগমের চোখ ছলছল করছে। তিনি বললেন,
‘এই চেহারাটা কি ভোলা সম্ভব?’
‘না ভুললে এত বছর যোগাযোগ করিসনি কেন?’
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
‘নিজের উপর রাগ, ক্ষোভ আর অভিমানে আমি কারোর সাথে যোগাযোগ করিনি আর।’
‘আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, অনেক ভাবে চেয়েছি তোর একটা খোঁজ নিতে, কিন্তু পারিনি। তারপর আর দেশে আসিসনি কেন?’
‘কোন মুখে ফিরতাম? কী বলতাম মা বাবাকে গিয়ে?’
‘খালু খালাম্মা অনেকদিন পর্যন্ত তোর ফিরে আসার অপেক্ষাতে ছিলেন। অনেক খোঁজ নিয়েও শেষে কোনো উপায় বের করতে না পেরে আশা ছেড়ে দেন তাঁরা।’
দিলরুবা বেগম বড়ো করে শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
‘উনারা কি আর বেঁচে নেই?’
‘না। তোর চলে যাওয়ার খবরে খালাম্মা ঐদিনই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসা করেও উনাকে আর সুস্থ করা যায়নি। এক বছর পরেই ইন্তেকাল করেন। আর খালু মারা যান আজ থেকে আরো ছয় বছর আগে। বাড়িতে বোধ হয় এখন তোর ভাই ভাবি আর তাঁদের বাচ্চারা আছে। আমারও আর যোগাযোগ নেই কারোর সাথে।’
পুরোনো ঘা থেকে আজ আবার রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে বেশ। এই ব্যথা দিলরুবা বেগম টের পাচ্ছেন। তবে এখন আর কিছুই করার নেই। এখন হাজার মলম লাগালেও এই ঘা আর শুকাবে না। তিনি ক্ষীণ সুরে বলেন,
‘মা বাবাকে কষ্ট দেওয়ার ফল আমি প্রতিটা মুহুর্তে ভোগ করেছি। জানিস, এখানে আমি একটুও ভালো ছিলাম না।’
লুৎফা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
‘কেন? ভাই তোকে…’
‘থাক, এসব কথা। ভাগ্যের কী খেলা দেখ, আমাদের আবার এভাবে কথা হবে কখনো ভেবেছিলাম?’
‘সেটাই তো। কী অদ্ভুত! আমার মেয়েকে পাকিস্তানে গিয়ে তোর বাড়িতেই উঠতে হলো? ঐ যে কথায় আছে না, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আর এতসব দুঃখের পরেও একটা সুন্দর ভালো হলো, আমি তোকে ফিরে পেয়েছি আবার।’
দিলরুবা বেগম ঠোঁট চেপে নিজের কান্না আটকালেন। হাসলেন তিনি। বললেন,
‘হ্যাঁ। কী চমৎকার ব্যাপার, এভাবেও যে কাছের মানুষ ফিরে পাওয়া যায়, আমি কল্পনাও করিনি।
লুৎফা বেগম হেসে বললেন,
‘খারাপের পরেই ভালো থাকে। এবার দেশে ফির। কত শত কথা বাকি, সব বলতে হবে তো।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক কিছু বাকি আমাদের। এবার আর বিলম্ব করব না এক মুহুর্তও। আর কেউ না হোক, আমি তোর কাছে ফিরব।’
‘আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকব।’
‘আচ্ছা, এবার সত্যিই ফিরব তবে।’
লুৎফা বেগম ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে দিয়ে হেসে বললেন,
‘ওদের মুখগুলো দেখ, কেমন হা করে চেয়ে আছে আমার দিকে।’
দিলরুবা বেগমও হাসলেন। বললেন,
‘হ্যাঁ, এইদিকে আমার মেয়েরও এই অবস্থা।’
‘আচ্ছা, রাখ তবে, আমি ওদের বলি সব। নয়তো পরে চিন্তায় চিন্তায় স্ট্রোক করে বসবে।’
দিলরুবা বেগম হেসে বললেন,
‘আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।’
‘আল্লাহ হাফেজ।’
ফোন কাটলেন লুৎফা বেগম। প্রিয়তা চোখ পিটপিট করে বলল,
‘মা, কী এসব? আমার তো মাথা ঘুরাচ্ছে। তোমরা পূর্বপরিচিত?’
চলবে…..
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/