#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_২৩
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি সুহাসিনী
——–
তিমিরাচ্ছন্ন পৃথিবী। নিস্তব্ধতায় ঘেরা চারপাশ। বন জঙ্গল থেকে পেঁচা ও শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। আজকাল শেয়াল রাতের সাথে দিনের আলোয়ও লোকালয়ে ঘুরাফেরা করে। চোখের সামনে গল্পের বইয়ে পড়া কাল্পনিক শেয়ালকে দেখে অনেকেই চমকায়, আবার অনেকে ভয়ে উলটে দৌড় লাগায়। নয়নার এই মুহূর্তে কঠিন একটি কাজ করতে ইচ্ছে করছে। ঘন জঙ্গলে এই রাতে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। একাকী সে কীই বা আর করবে! বারান্দায় বসে গুনগুন করে গান গাইছে। সময়ের হিসাব তার জানা নেই। রাত্রির ঠিক কয়টা বাজে খবর নেই। সন্ধ্যায় তূর্যের কাছে একটা ইমারজেন্সী কল আসায় দ্রুত হাসপাতালে যেতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পর মাহবুব শিকদারও চলে যান! সেই থেকেই সে তূর্য ছাড়া একা সময় কাটাচ্ছে। বারান্দার ফ্লোরে মুঠোফোন পড়ে আছে, নয়নার নজর সেদিকেই গেলো। পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর ফোনে আলো জ্বলে উঠছে, নয়না স্মিত হেসে রিসিভ করে কানে ধরলো।অপরপাশ থেকে তাড়াহুড়োর স্বর শোনা গেলো,” এখনে বারান্দায় বসে আছো?”
” হু!”
তূর্য অপরপাশ থেকে ধমকের সুরে বলল,” তুমি কী চাইছো, রোগী রেখে তোমার কাছে চলে আসি! বুঝতে চেষ্টা করো না কেনো লক্ষীটি, আমি শান্তিতে রোগীদের সেবা করতে পারব তখনই যখন তুমি ঠিক থাকবে।”
নয়না মুচকি হাসলো। বারান্দা থেকে ঘরে এসে থাই গ্লাস লাগিয়ে দিলো। বিছানায় আরাম করে শুয়ে বলল,” আমি তো ঠিকই আছি।”
” কোথায় ঠিক থাকলে? একা একা ঠিক থাকা যায়? ডর ভয় নাই নাকি? এই নয়ন, শোনো?”
” হুম, বলো!”
” আমি কী চলে আসবো?”
তূর্যের কথা শুনে নয়না ফিক করে হেসে ফেলল। তূর্য এমনভাবে কথা বলছে যেন নয়না তার বিয়ে করা বউ! নয়না নিজের ভাবনায় থতমত খেয়ে গেলো, লজ্জায় মুখখানা লাল টকটকে হয়ে গেলো। বালিশে মুখ গুঁজে মিনমিন করে বলল,” আমার ঘুম পাচ্ছে, তূর্য!”
তূর্য নিশ্চুপ হয়ে গেলো। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তার মাতাল স্বর ভেসে আসলো,” ঘুমাও,প্রিয়া! তোমার ঘুমের শব্দ শুনে আমি রাত পাড় করি!”
নয়না চোখ খুলে ফেললো। উঁচু আওয়াজ করে বলল,” আশ্চর্য! আমি কী ঘুমের মধ্যে নাক ডাকি নাকি?”
” আশ্চর্যের কিছু নেই, নয়না! স্লিপিং বিউটিকেও খুব সুন্দর লাগছিল তিনি দীর্ঘ শুয়েছিলেন, কখনও বৃদ্ধ হননি এবং তার প্রিন্স চার্মিং পাওয়ার জন্য তাকে নাক ডাকা ছাড়া আর কিছুই করতে হয়নি।”
নয়না উচ্চ স্বরে হাসলো। তূর্যের কথার প্রেক্ষিতে উত্তর দিলো,” তাহলে তো আমারও প্রিন্স চার্মিং এর জন্য নাক ডাকা শুরু করতে হবে!”
” তোমার প্রিন্স তোমাকে এমনিতেই ভালোবাসে। তার জন্য নিজেকে পরিবর্তন নয়, নিজেকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করো। তোমাকে পাওয়ার আকুলতা বিশাল পর্বতের চেয়েও উঁচু।”
রাত যতো গভীর হচ্ছে, প্রেমিকযুগলের খোশ আলাপন ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে প্রেমিক পুরুষ তূর্যের মতে হলে নয়নার মতে মেয়ের দুঃখের অবসান হতো।
——————————
প্রভাতের আলো ফুটতেই আকলিমা নড়েচড়ে বসে। সূর্যের আলো ঠিক তার চোখের উপর পড়ছে। চোখ খুলতেই বোরহান উদ্দিনের অবয়ব ভাসমান হলো আকলিমার চোখের সামনে। বোরহান উদ্দিন ব্যাগ প্যাক করে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আকলিমা উঠে স্বামীর পাশে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছো?”
” রিহানকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছি।”
আকলিমা বোরহানের হত ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,” রিহানকে নিয়ে যাচ্ছো মানে? আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যেতে দিব না।”
বোরহান হাসলো। আকলিমার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল,” খবরদার ঐ খারাপ মুখে রিহানের নাম উচ্চারণ করবে না। এতোই যদি ছেলে ছেলে করো তবে কেনো ছেলেটাকে অসুস্থ অবস্থায় হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলে। কেনো নিজের সন্তানকে দূরে রাখলে?”
আকলিমার কাছে এর উত্তর নেই। সে তো বাশারের বুদ্ধিতে এই কাজ করেছিল। সে মিনমিন করে বলল,” বাশার বলেছিল,,,,
” বাশার, বাশার, বাশার তুই থাক তোর পাপের ফল নিয়ে। রিহান চলো,বাবা।”
ছোট্ট রিহান, বুঝ ক্ষমতা ভালো। ভালো,খারাপ বুঝেও।আকলিমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,” আমি মানুষের মতো মানুষ হয়ে ফিরব, মা! বাবাকে ভুল বুঝো না, বাবার সাথে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা আমার।”
আকলিমা বাকরূদ্ধ। মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। এই শোক সে কীভাবে কাটাবে? বোরহানের হাতে পায়ে ধরলো সে, অনুরোধের স্বরে বলল, ” এমন শাস্তি দিও না। রিহান কে রেখে যাও।”
বোরহান শুনলে তো! আকলিমার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।
দরজার আড়াল থেকে মাসুদা সবটাই দেখলো। তার চোখে মুখে ক্রুর হাসি। ফিসফিস করে বলল, ” বদলা তো মাত্র শুরু! এখনো কতো কিছু বাকী আছে! আস্তে আস্তে বুঝবে, মেয়েদের সম্মানে হাত দেওয়ার নির্মম পরিণতি কেমন হয়, বাশার!”
———————
লোকে বলে, প্রেমিকা পটানোর আগ পর্যন্ত অথবা বিয়ে করার আগ পর্যন্ত নাকি প্রেমিকের বা স্বামীর হাতে ঢের সময় থাকে কিন্তু পটে গেলে বা বিয়ের পর তাদের সময় কোথায় চলে যায় কে জানে! বিগত এক সপ্তাহ ধরে নয়নার তূর্যের প্রতি সেই কী অভিমান! নয়নাকে কাছে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলো, তূর্যের সময়ও ছিলো অনেক। নয়নাকে একা রাখেনি কখনো, অথচ নয়নাকে কাছে আনার পর থেকে সাহেব একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে। সারারাত হাসপাতালে কাটায় আর সারাদিন ঘুমে। নয়নার সাথে সময়ের হিসাব করে সাক্ষাৎ হয় তার, কথাও হয় অল্প স্বল্প। ভাবখানা এমন যেন এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নয়না সাক্ষাৎ করতে এসেছে, সীমিত সময় কথা বলেই ডাক্তার সাহেব চলে যাচ্ছে।
গতকালই তূর্যের রাতের ডিউটি শেষ হলো। আজ তার ছুটি আগামীকাল থেকে দিনের ডিউটি শুরু হবে সাথে তূর্যের ব্যস্ততাও। সাধারণত তূর্য ছুটির দিনটাও হাসপাতালে কাটাতো কিন্তু নয়না তার জীবনে আসার পর থেকে ছুটির দিনটার জন্যই অপেক্ষা করতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়ে তূর্য নয়নাকে খুঁজতে শুরু করলো। তিনতলায় নয়নাকে না পেয়ে নিচে আসলো। এক দুইবার নয়নার নাম ধরে হাঁক ছাড়লো কিন্তু আশানুরূপ কোনো সাড়া পেলো না। তূর্যের মনে ভয় ঢুকলো ভেবে, নয়নার কিছু হয়ে যায়নি তো! তাড়াহুড়ায় সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামতে গিয়ে হোটচ খেতে খেতে বেঁচে গেলো। রান্নাঘর থেকে টুংটাং পাতিলের শব্দ ভেসে আসছে, তূর্য সেদিকে আগালো। পোলাওয়ের ঘ্রাণ তূর্যের নাকে বাড়ি খেলে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে হাসলো। নয়না তখন পেঁয়াজ বেরেস্তা পোলাওয়ের উপর ছিটিয়ে দিচ্ছিল। তূর্যের আগমনে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। তূর্যকে ইগনোর করে সে তার কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহত দৃষ্টিতে তূর্য প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকটা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে কিন্তু কেউ শুনলে তো! অবশেষে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তূর্য বলতে শুরু করলো,” কী করছো আমার না হওয়া বউ?”
আগুনের উপর ঘি ঢেলে দিয়ে তূর্য দুষ্ট হাসলো, নয়না গোস্ত নাড়াচাড়া করছিল; খুন্তিটা তূর্যের দিকে এগিয়ে এনে বলল,” একদম উলটা পালটা সম্বোধন করবে না, তূর্য।”
তূর্য বুক হাত রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল,” হায়! তোমার সুরে আমার নামটা কী কিউট শোনায়!”
তূর্যে লজ্জায় লাল হওয়া ভাব দেখে নয়নার রাগ নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো কিন্তু সে বাহিরে তা প্রকাশ করলো না৷ মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,” হাসপাতালে যাবে না! যাও যাও, জলদি তৈরী হয়ে নাও। নয়তো তোমার ইয়াং ইয়াং মেয়েরা যারা রোগী সেজে বসে আছে,তারা তোমার দেখা না পেলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে।”
নয়নার কথায় তূর্যের ভীষণ হাসি পেলো। মেয়েটার মনে এসব চলে! দুষ্টু সুরে বলল,” আর ইউ জেলাস,নয়ন!”
নয়না থতমত খেলো। মনকে প্রশ্ন করলো, সত্যিই কী সে জেলাস! তূর্যের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য চেহারা আড়াল করে উত্তর দিলো,” বয়েই গেছে।”
তূর্য বলল,” মেয়ে তুমি হিংসার অজুহাত না খুঁজে,ভালোবাসার অজুহাত খুঁজো!”
নয়না মুখ বাঁকিয়ে বলল, ” নিজের মানুষটাকে অন্য কেউ দেখবে তা পৃথিবীর কোনো নারীই সহ্য করবে না। ”
” আমি সত্যিই কী তোমার পুরুষ, নয়ন!”
” এতেদিনেও বুঝলে না?”
” মুখে না স্বীকার করলে কীভাবে বুঝি!”
” সব কথা মুখে বলতে নেই, অপরপাশের মানুষটার জন্য মনের কোণে আলাদা স্থান আছে, তা বুঝে নিতে হয়।”
তূর্য গভীর নয়নে নয়নাকে দেখছে। নয়নার কাজ শেষ, সে রান্না ঘর থেকে বের হতে নিলে তূর্যের চোখের গভীরতা দেখে লজ্জা পেলো। তূর্যের চোখের উপর এক হাত রেখে বলল, ” এভবে তাকাবে না, আমার অস্বস্তি হয়।”
তূর্য হেসে নয়নার হাতে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। সহসা প্রেমিকের প্রেমময় প্রথম স্পর্শে নয়নার শরীরের শিরা উপশিরা টনটন করে উঠলো। হাত সরিয়ে তূর্যকে ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে গেলো।
তূর্য তা দেখে বিড়বিড় করে বলল,” আর অপেক্ষা নয়!তোমাকে বৈধতায় আবদ্ধ করার সময় হয়ে গেছে, নয়ন!”
(চলবে)…
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
[ কী হয়েছে! পিঠা বানিয়েছি। ইদ সামনে তো! তাই গতকাল গল্প দিতে পারিনি। আপনারা ইদে পিঠা বানান না?]